অবসরে কি করতে ভাল লাগে?
১.
ছোটবেলায় স্কুলে এই প্রশ্নটা শুনতে হতো অনেক। আমি প্রায়ই একটা গতবাঁধা উত্তর দিতাম প্রশ্নটার, অবসর সময়ে আমার ঘুরতে ভাল লাগে।
আদৌই কি সেই প্রাইমারি স্কুলের বেলায় 'অবসর' কি তা বোঝার অবসর ছিল? মনে হয় না। তাই প্রশ্নটার উত্তর আগ-পাশ না ভেবে দিয়ে দেয়ার মধ্যেও কোনো দ্বিধা ছিল না।
এখন যদি আমায় কেউ জিজ্ঞেস করে, অবসর সময়ে কি করতে ভাল লাগে- তাহলে ভাবনায় পড়ে যাই। কারণ এখন আমি কোনটা অবসর আর আর কোনটা না, কোন অবসরটা কেমন, বড় না ছোট, ডিলাক্স না চিপ- সবই বুঝি। ছোটবেলার সেই কিছু-বোঝার-প্রয়োজন-না-থাকা সময়টা পেরিয়ে গেছে।
তাই প্রশ্নটার উত্তর দেয়া এখন আর আগের মতো সহজ না। অবসরের নানান রকম আছে। এই যেমন নিত্যদিনের কাজের অবসর হচ্ছে একরকম, আবার বছরের এক মাস অফিস ছুটি হচ্ছে আরেক রকম।
ইদানীং কোভিড-১৯ টাইপের সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ পৃথিবীব্যপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার দরুণ অন্য আরেক রকমের অবসর সৃষ্টি হয়েছে। যাকে বলে অখণ্ড অবসর। এই অবসরের মধ্যে ঘরে বসে অফিসের কলিগদের সাথে মিটিং করা, অফিসের কাজ করা, ঘরের প্রতিটি কোণ একবার ঝাট দেয়া, দুইবেলার রান্না করে ফেলা, কয়েকটা টিউটোরিয়াল দেখে ফেলা, এবং আরও অনেক রকমের কাজ করে ফেলা যায়। অবসরের কোনো কমতি হয় না। চলতেই থাকে। হাতের সব কাজ শেষ করার পরও অবসর ফুরায় না। কমেও না একরত্তি! এমন অবসরে কিছুই করতে ভাল লাগে না অনেক সময়। তাহলে বলুন, ‘অবসরে কি করতে ভাল লাগে প্রশ্নটা’ এখন সেই ছোটবেলার চেয়ে অনেক অন্যরকম একটা অর্থ পেয়েছে কিনা?
২.
যাহোক অখন্ড অবসর হাতে, তাই এত বিস্তৃতভাবে লিখছি। স্বাভাবিক সময়ে, যখন সোম থেকে শুক্রবার, নয়টা থেকে পাঁচটার চক্রে জীবনের কাঁটা ঘোরে তখন আমার অবসর মূলত দুই রকমের। প্রতিদিনের কাজ শেষের অবসর আর বছরে একবার প্রায় এক মাসের অবসর।
প্রতিদিনের কাজ শেষের অবসরটা গত বেশ কয়েকটি বছর ধরে প্রায় একই রকম রয়েছে। কয়েকটা কাজ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করা হয়। আমি যেটা সবচেয়ে বেশি করতে চাই কিন্তু করা হয় কমই, সেটা হচ্ছে 'জগিং' করতে বের হওয়া। জার্মানিতে আমার ছয় বছরের পুরোটা সময়ই কেটেছে বিভিন্ন পাহাড় ও বন-অধ্যূষিত অঞ্চলে। প্রথম চার বছর ছিলাম মধ্য থুরিঙ্গিয়া প্রদেশে। অনেকে বলেন থুরিনজিয়া। স্থানীয়রা 'ঠুরিং'-ও বলেন কেউ কেউ। সব উচ্চারণই ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ। এলাকাভেদে শুধু ভিন্ন। আমাদের যেমন উত্তরবঙ্গের উচ্চারণ একরকম, দক্ষিণবঙ্গের আরেক- তেমন আরকি। পাহাড় আর বনভূমির আধিক্যের কারণে থুরিঙ্গিয়াকে বলা হয় "গ্রীন হার্ট অফ জার্মানি"।
পরের দুই বছর ধরে আছি ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলে। এখানেও জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধু পাহাড় আর বনভূমি। এই বন আর পাহাড়ে ঘেরা ভূমিখন্ডের ওপর শহরের কোলাহল পেছন দিকে রেখে কিছুক্ষণ জগিং করলেই হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেয় নির্মল প্রকৃতি। বড় বড় ওক আর পাইনের বনের ভেতর দিয়ে জগিং করার ট্রেইলের অভাব নেই। প্রায় প্রতিটি পথই গিয়ে শেষ হয়েছে কোনো না কোনো পাহাড়ের কিনারায়। যেখানে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে বিছানো প্রাকৃতিক নয়নসুধা পান করা যায় অনায়াসে। মানুষ সবসময়ই প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হওয়ার জন্য প্রোগ্রামকৃত। খুব কমই রয়েছেন এর ব্যতিক্রম। হয়তো তাই মানুষের বেশিরভাগ পথই গিয়ে শেষ হয় সৌন্দর্য্যের সামনে।
৩.
আরেক রকমের অবসরের দেখা প্রতিদিন মেলে না। মেলে ঈদে-চান্দে এক-আধবার। সেসব অবসরে কখন কি করা হবে, তার কোনো ধরবাঁধা নিয়ম নেই।
কখনও মনে হয় একদম একা কোথাও চলে যাই। ওয়ারশ বা প্রাগের মতো পূর্ব ইউরোপের কোনো ঘিঞ্জি ট্যূরিস্ট-স্পটে। মানুষের ভিড়ের ভেতর ঢুকে চুপচাপ স্রোতের সাথে পা মেলাই আর মোবাইলের ক্যামেরায় অনবরত সবকিছু রিলবন্দী করতে থাকি। কোনো একদিন এইসব কাঁচামাল দিয়ে কোনো একটা কন্টেন্ট তৈরি করবো এমন সূদর পরাহত দুরাশায়। মোবাইলের সেই সব ছবি কখনই আর পিসি-তে নেয়া হয় না। হলেও মাঝে-মধ্যে ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করার জন্য হয়তো বা। শতকরা আশি ভাগের কপালে শুধু সেই ঘটমান মুহুর্তেই একবার ছবি হয়ে চক্ষুমেঘের ভার বাড়ানোর সুযোগ জোটে।
আবার কখনও মনে হয়, এবার ঘুরতে যাবো ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামটাকে মবিল দেয়ার জন্য। সমানে ছবি তুলবো, আপলোড করবো, ঘন্টায় ঘন্টায় 'স্টোরি'-তে নতুন ছবি বা ভিডিও দেবো- এসবের উদ্দেশ্যে। সেসব সময় আশপাশে যদি পৃথিবীর সেরা বিনোদনকেন্দ্রও থাকে, দেখা যায় আমি সেসবের ছবি না তুলে নিজের ভেটকি'র ছবি তুলে তুলে আপলোড দিচ্ছি। এই করে অবসর কাটছে।
তবে কখনো-সখনো সত্যিকার অর্থেই অবসর সময়টাতে ভাল লাগার মতো কিছু করে কাটানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। বুদা শহরের লিবার্টি পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে, পেস্ট শহরের যতোটা দু'চোখের লেন্সে আঁটে- পুরোটার শুধু একটা চিরসবুজ স্মৃতি মস্তিষ্কের কোন এক দীর্ঘস্থায়ী নিউরণে প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে আসতে মন চায়।
বুদা আর পেস্ট দু'টো আলাদা শহর, ওরা একত্র হয়ে গঠন করেছে বুদাপেস্ট জেলা। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে দানিয়ুব নদী। পূর্ণিমার রাতে পাহাড়চূড়ার লেডি লিবার্টির বেদীর সামনে তিল-ঠাঁই ধারণের জায়গা থাকে না, যদি সময়টা গ্রীষ্মকাল হয়। আমার মাঝে মাঝে সেই পাহাড়ের চূড়ায় তাঁবু খাঁটিয়ে ক্যাম্পিং করতে ইচ্ছে হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা দানিয়ুবের বাতাস শরীরে লাগাতে লাগাতে আর বুদাপেস্টের বর্ণিল সড়কবাতির খেলা দেখতে দেখতে অজান্তেই সেই থেরাপিগুলো হয়ে যেতো, যেগুলোর আশায় কাউন্সেলিং-এ গিয়ে গন্ডায় গন্ডায় ডলার গোণে ব্যস্ত নগরবাসী।
আবার কোনো কোনো অবসরে মাথার ভেতর প্রবল স্পীডে বাজতে থাকে হালআমলের হিপ-হপ। তারই টানে উত্তেজনার একটা গ্রেনেড হয়ে ঘুরে বেড়াই পুরোটা সময়। ওরকম তিন-চার দিনের হার্ডকোর ট্রিপগুলো স্মৃতির বস্তা হয়ে ওঠে প্রায় সময়ই। পৃথিবীটাকে অনেক রঙিন- স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই রঙিন দেখায় সে সময়। তবে অমন সময়কেও আমি ভালবাসি। জানি বাঁধন ছিঁড়ে হারিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, তাই মাঝে মাঝে লাগামছাড়া স্ফূর্তিতে নিজেকে ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠা হয় না আমার কখনো। প্রত্যেকবার নিজেকে আগের চেয়েও অনেক বেশি গুছিয়ে নিয়ে আসতে পারি- সেটাও হয়তো একটা কারণ। সেবার আমস্টারডামে জুটেছিল অমন অবসর।
৪.
আবার এমন অনেক সময় আছে যখন অবসর যে কি, সেটাই আমরা আলাদা করতে পারি না জীবন থেকে। সেই সময়গুলোতে রান্নাও আমার অবসরে-ভাল-লাগার একটা কাজ। যখন সারাদিনের কাজের চাপে নিজের দিকে একবার তাকানোর সুযোগ হয় না- তখন বাসায় ফিরে ঝাল ঝাল মুরগি ভুনা আর সবজি খিচুড়ি চুলায় চড়িয়ে, চট করে একটা গোসল দিয়ে, নেটফ্লিক্সে শতবার দেখা কোনো একটা সিরিয়াল ছেড়ে দিয়ে একা একা রাতের খাবার নিয়ে বসার মধ্যেও অবসর কাটানোর একটা ফিল কিন্তু পাওয়া যায়।
তবে অন্য সময়ে, যখন কাজের চাপ মাত্রাতিরিক্ত নয় বরং সহ্যসীমার ভেতরে থাকে তখন, রান্না করাটা অবসর কাটানোর মধ্যে নয়, বরং প্রয়োজনে কাটানো সময়ের মধ্যে পড়ে। আর যখন ব্যস্ততা সবকিছুকে তার প্রয়োজনের ঘরে টেনে নেয়, তখন এমন কিছু কাজকেই আলাদা করে নিতে হয়, যেটা আমাদের খানিকটা হলেও ওই খোলা জানালাটার পাশে গিয়ে একটু বসার সুযোগ করে দেয়। যে জানালাটা হ্যারি পটারের রুম অফ রিকোয়ারমেন্টস্-এর মতো। শুধু যার দরকার, তার সামনেই ধরা দেয়।
---
অবসরনামা সত্যিই ভালো লেগেছে। পড়েছিলাম সকালেই। কিন্তু আমার আবার অবসর নেই, নেই ক্লান্তিও। তাই কমেন্টে দেরি হয়ে গেলো।
খুব ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, নিরাপদে থাকবে, মীর দা বটি কুড়াল।
অনেক দিন পর ব্লগে কমেন্ট পড়তে দেখলাম। খুবই ভাল লাগলো। আগে একটা সময় ছিল যখন ব্লগের লেখা ও কমেন্ট- সবই পড়তে ভাল লাগতো।
ধন্যবাদ লাবণী দি গ্রেট আর্টিস্ট! ভাল থাকবেন আপনিও :
"ব্যস্ততা" অথবা "অবসর", আলাদা করার সুযোগ নেই এখন আর, সব এক হয়ে গেছে! তবে যেই সময়টায় "কাজ নিয়ে ব্যস্ত" থাকছি না তখন সিনেমা, সিরিয়াল অথবা ডকুমেন্টরি দেখছি। যেমন এখন এভেঞ্জার সিরিজ টা দেখছি আবারো, বোঝার চেস্টা করছি কেম্নে কি ঘটেছে
মহাবিশ্বে কি হচ্ছে, নতুন গ্রহ আবিস্কার বা ব্ল্যাকহোলের অজানা কি জানা গেলো, তা জানার চেস্টা করি। এখন যোগ হয়েছে কোভিড১৯ সহ অন্যান্য ভাইরাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ!
আমিও একই কাজ করেছি এই হোম আইসোলেশনে। হ্যারি পটার, লর্ড অব দি রিংস্ এবং মার্ভেল আর ডিসি ইউনিভার্সের পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো সব দেখেছি।
ভেবেছিলাম এতদিন পর কি আবার সেই ভাল লাগা কাজ করবে? বিশেষ করে হ্যারি পটারের ক্ষেত্রে... কিন্তু পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হতে হলো যখন দেখতে বসলাম। এখন দেখি ছোটবেলার চেয়েও বেশি আগ্রহ পাই, কি আশ্চর্য!
আমার বেড়ে ওঠা ছিল হ্যারি পটারের সাথে। প্রতি বছর নতুন বইয়ের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। সেই কত বছর আগের কথা! অথচ এখনো এদের আবেদন একরত্তি কমে নি। এখনকার পিচ্চিপাচ্চাদের মধ্যেও হ্যারি পটারের ক্রেইজ দেখি। ভালও লাগে দেখলে।
মন্তব্য করুন