ইউজার লগইন

টিটিকাকা হ্রদে ভ্রমণের গল্প : সহজ জীবনের খতিয়ান

১.
জীবনে সুযোগ পেলে একবার আমাজন মহাবনে ঘুরতে যাবো- এমনটা যখন আমি প্রথমবার ভেবেছিলাম তখন বোধহয় আমার বয়স ছিল ১৩। ১৯৯৮ সালের শেষ দিকর কথা। সেবা প্রকাশনী কিশোর থ্রিলার সিরিজ "তিন গোয়েন্দা"-র কোনো একটা সদ্যপ্রকাশিত বইতে সেবার কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড আর মুসা আমান মিলে আমাজনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল চোরা-কারবারিদের পাকড়াও করা। বইয়ের পাতায় পাতায় মহাবন অমাজনের যে জীবন্ত বর্ণনা ছিল তাতে যেন সবকিছু ভেসে বেড়াচ্ছিল আমার চোখের সামনেই। এক দমবন্ধ উত্তেজনায় ঠাসা দুপুরে এক বসায় বইটা শেষ করে আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম, একদিন আমাজনে আমায় যেতেই হবে।

তারপর তো আমাদের পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়াল। মনে আছে সেই ১৩ বছরের কিশোর আমি ৩৩ বছরের তরুণে রূপান্তরিত হবার বেলায় কোন এক পড়ন্ত বিকেলে জার্মান দেশের ইলমিনাউ শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময়, কথাচ্ছলে সেই অধরা স্বপ্নটার কথা উচ্চারণ করেছিলাম একবার। তারপর ভুলে গিয়েছিলাম আবার।

'ইলমিনাউ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়'টি জার্মানীর হাতেগোণা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি, যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা সিংহভাগ। ক্যাম্পাসের মূল ভাষাও তাই ইংরেজি। জার্মানরাও ইংরেজিতে কথা বলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সাথে। এমনটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না বলে জার্মানিতে পড়তে আসার আগে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্থানীয় ভাষাটা শিখে আসতে পরামর্শ দেয়া হয়।

যাহোক সেই পড়ন্ত বিকেলে যখন বন্ধুদের বলছিলাম আমার ছোট্টবেলার স্বপ্নটার কথা তখন প্রায় পাঁচ-ছয় জন দক্ষিণ আমেরিকার শিক্ষার্থী একসাথে কথাটা শুনেছিল। শুনে যে তারা কোনোকিছু করার আগ্রহ দেখিয়েছিল তা না। আমিও যখন বলেছিলাম তখন এমনিই বলেছিলাম, বিশেষ কোনো কারণে না। জার্মানী থেকে দক্ষিণ আমেরিকা যাওয়াও আসলে খুব সহজ না। যাই হোক, ঘটনাপ্রবাহ সেবার গড়িয়ে গড়িয়ে কিভাবে আমার ছোট্টবেলার সেই প্রিয় স্বপ্নটা পূরণ হয়ে গিয়েছিল, কেনই বা হয়েছিল- সেসব নিয়ে এই গল্প।

কোনো মানুষের নাম যে আমেরিকা হতে পারে, তা আমেরিকাকে না দেখলে কখনো জানতে পারতাম না। পেরুর সহজ-সরল, সাধারণ দেখতে একজন মানুষ। কথা বলে খুব নিচু স্বরে। বন্ধুমহলে তেমন সরব প্রকৃতির মানুষ না, শুধু দলের সাথে বসে চুক চুক করে বিয়ার পান করে, যেন কোনায় বসে হামি দিতে থাকা বেড়ালটা!

তবে মানুষ হিসেবে খুব সহানুভূতিশীল। কারো সাথে দেখা হলে কখনো "কেমন আছ?" জিজ্ঞেস করতে ভোলে না। জিজ্ঞাসায় একটা চাহনি থাকে যা দেখলে এক ধরনের নিশ্চিন্তি আসে। মনে হয়, এই আজকালকার হাই-টেক ফাইভ-জি'র দুনিয়াতেও পরের জন্য ভাবে এমন একটা-দুইটা মানুষ আসলেই আছে। এই যে সামনেই যেমন একটা দাঁড়িয়ে আছে।

এই অনুভূতিটা কিন্তু সবার "কেমন আছ?" প্রশ্নে আসে না।

তো আমাদের একটা ভাল বন্ধুত্ব দাঁড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগলো না। আমেরিকার মাধ্যমে পরিচয় গাঢ় হয়ে গেল কার্লোস, হুয়ান, মারিয়া, রাউল এবং আরো বেশ কিছু দক্ষিণ আমেরিকান শিক্ষার্থীর সাথে। বিদেশ-বিভুইঁয়ের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডর্মিটরিতে এরকম বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়ে গেলে, সেটার সদস্যদের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালবাসা জোয়ারের স্রোতের গতিতে বাড়তে থাকে। স্বদেশ আর আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দূরদুরান্তে এসে একা একা থাকা, পড়াশোনা, পার্টটাইম কাজ- ইত্যাদি করতে হয় বলেই হয়তো, আশপাশে যারা থাকে তাদের জন্য দ্রুতই এক গভীর মমতা জন্ম নেয়। সে মমতা দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হয়।

২.
দক্ষিণ আমেরিকানরাও মেলামেশার ক্ষেত্রে ভীষণ অকপট। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। অল্প দিনে গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়াতো বটেই, আরও থাকে কার সাথে কার সাথে বন্ধুত্ব কতটুকু সেটিকেও খুব যত্নসহ সম্মান দেয়ার দর্শনীয় প্রচেষ্টা।

আমার সাথে যেমন আমেরিকার মাধ্যমে সবার সাথে পরিচয় হওয়ার দরুণ ওরা আমাকে ধরেই নিয়েছিল যে, আমি মূলত আমেরিকার বন্ধু এবং সেই সুবাদে দলের একজন। যে কারণে দেখা যেত অনেক সময়ই বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব আমাদের দুইজনের কাঁধে একসাথে পড়তো, যেমন একবার পড়ল- বার্বিকিউয়ের কয়লা কিনতে যাওয়ার কাজ।

গরমের দিনে বার্বিকিউ করা আসলে যতোটা না প্রাচুয্য তারচেয়ে বেশি ব্যাবহারিক। সারাদিন ক্লাস, লাইব্রেরি, টো টো ইত্যাদি করে, বিকেলের দিকে ক্যাম্পাসের মাঠে দৌড়ঝাপ, টেবিল টেনিস, ফুটবল বা বাস্কেটবল খেলতে খেলতেই বার্বিকিউয়ের পরিকল্পনা হয়ে যেত। বিকেল গড়িয়ে যাবার বেলায় দেখতাম পশ্চিম আকাশে লাল, কমলা, সোনালীসহ নানারকম আলো ধরে যাওয়ার পাশাপাশি মাঠে বার্বিকিউয়ের সরঞ্জামাদি আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন দিক থেকে।

মাঠে যারা খেলাধুলা কর‍ছিল তারাই সব দলবেঁধে গোল হয়ে আগুনকে ঘিরে বসে হই-হুল্লোড় শুরু করবে এখন। চলবে মিউজিক। হাহাহিহি, গ্লাসের টুংটাং আর বাতাসে ভাসবে পোড়া মাংসের গন্ধ। এ হচ্ছে এপ্রিল-মে মাস থেকে অগাস্ট, কোন কোন বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনের গল্প। তারপর আবার বার্বিকিউয়ের সব সরঞ্জাম ঢুকে যাবে মাটির নিচের স্টোররুমে। পরের গ্রীষ্মের প্রতীক্ষায় দিনগোণা শুরু হবে আবার একবার।

সেবার যখন আমেরিকার সাথে দোকান থেকে কয়লা কিনে মাঠের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরেছি, তখন সে নিজেই বলেছিল, আমাজনের কাঠকয়লার নাকি কোনো বিকল্প হয় না। পৃথিবীর সেরা কাঠকয়লা।

আমাজন শুনেই আমার বুক ঢিপ ঢিপ শুরু হয়েছিল। ওই দক্ষিণীগুলোদের তো সবসময় দেখি বছরান্তের একসাথে বাড়ি যেতে, আবার একসাথেই ফিরতে। আমায় একবার নিয়ে গেলেই তো পারে। মাঝে মাঝে যে কথাটা আমার মনে হয় নি- তা না।

ভাবছি যখন, তখনই আমেরিকার কন্ঠ কানে এলো, তোমায় একদিন পেরুতে নিয়ে যাবো। আমাদের বাড়ির নিচের থেকে শুরু যে পাহাড়ি ঢাল, ওই দিয়ে নামতে থাকলেই বনের শুরু। প্রথমে একটা বিশাল লেক, তার নাম টিটিকাকা। আমার সবকিছু হাতের তালুর মতো চেনা।

আমার তখন উত্তেজনায় চোখ তার কোটর ফেটে বের হয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম সেদিন। তারপর গিয়ে বার্বিকিউয়ের চুলায় কয়লা ঢেলে আস্তে আস্তে আগুন ধরানো শুরু করলাম।

৩.
সেই সন্ধ্যায় অনেক হৈ-হুল্লোড় হয়েছিল। কার্লোস হদ্দ মাতাল হয়ে আমেরিকার হাত এনে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, আমার বোনকে তোর হাতে তুলে দিলাম- নিয়ে যা।

বোম্বেটে ছেলেটা ওরকমই ছিল। কার সাথে কি করতো বা বলতো কখনো খেয়াল করতো না। এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকে। অনেক দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কথা-বার্তা চালাচালি হয় নি যদিও। তারপরও খোঁজখবর পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে ওর তোলা ছবি দেখি। বেশিরভাগ শর্টস্ পরে সৈকতে দৌড়াদৌড়ির ছবি।

সেদিনের পর অবশ্য আমেরিকার সাথে আমার সম্পর্কটা আরো খানিকটা গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। তারপর গরম কমে আস্তে আস্তে শীত পড়তে শুরু করে দিল। আমরা দু'জন তখন প্রায়ই একসাথে গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে গ্রেট থুরিনজিয়ান বনভূমিতে হাঁটতে যেতাম।

শিশিরঢাকা ঘাসের গালিচায় জুতা পড়ে হাঁটতেও অস্বাভাবিক আনন্দ হয়। আমরা হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম আমাদের গোপন সেইসব স্থানগুলোতে, যেখানে খুব সহজে সবসময় পৌঁছানো যায় না। হয়তো অনেক সময় সঠিক মানুষটা পাশে না থাকার জন্য হয় না, আবার অনেক সময় সঠিক মানুষটা পাশে থাকলেও সময়টা সঠিক না হওয়ার জন্য হয় না।

সে রকম ঘুরতে ঘুরতে এক ভর দুপুরে আমি সত্যিই নিজেকে টিটিকাকা হ্রদে ভাসমান এক সরু ক্যানুর ওপরে আবিস্কার করেছিলাম। ক্যানুগুলোতে সাধারণত দুইজনের বসার জায়গা থাকে। আমি ঘোর ভেঙ্গে সবকিছু বুঝতে বুঝতে দেখি কি কার্লোস আর মারিয়া পাশের আরেকটা ক্যানু থেকে ভাঙ্গা গলায় উচ্চস্বরে "ডেসপাসিতো" গানটি গাইছে। ছেলেটা বিপজ্জনক মাত্রায় মদ্যপান তো করেছেই, তার ওপর টিটিকাকা লেকে ভুলভাল ক্যানু চালাচ্ছে। স্থানীয়রা ক্যানুগুলো নিয়ে নামার সময় আমায় দেখেই কিনা, আমেরিকা আর মারিয়াকে পই পই করে বলে দিয়েছিল কুমির আর অজগর থেকে সাবধানে থাকতে। আহা, তারা যদি জানতো আমার চেয়ে অনেক বেশি অসাবধান থাকে দলের অন্য ছেলেটা!

তো যাই হোক, কার্লোসকে দেখে বিচলিত হচ্ছিলাম তাই আমেরিকা আমায় বললো, "ও কিছু না। কার্লোসকে মনে হয় কুমিরেও খাবে না। কুমিরের টেস্ট এত খারাপ হওয়ার কথা না।" আমি যেন ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না করি।

আমার চিন্তা তবুও যাচ্ছিল না। থেকে থেকে ছেলেটার হেঁড়ে গলার গান ভেসে আসছিল। আমাদের আশপাশে আরও অনেক রকমের নৌকা ভাসছিল। টিটিকাকা লেকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর নৌকাগুলো। এত বর্ণিল, নানাবিধ আকৃতির নৌকা চারপাশে, যে পুরো পরিবেশটাকে খুব উৎসবমুখর মনে হচ্ছিল। স্থানীয়রা প্রায় সবাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, পেরুর পুনো অঞ্চলের বাসিন্দা। আমেরিকাও তাদেরই একজন। মেয়েটিকে জার্মানিতে যতোই সাদাসিধে লাগুক, ওখানে গিয়ে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো সহজ হচ্ছিল না। ইনকা সাম্রাজ্যের কোনো এক রাজার উত্তরপুরুষের বংশধর সে। পুনো অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় তাদের বাড়ি। এককালের রাজপ্রাসাদ আজ পুরোনো জৌলুস হারিয়েছে কিন্তু ঐতিহ্য হারায় নি। বাড়ির সকলকে এখনও স্থানীয় পোশাক পড়তে হয়। শুধুমাত্র আমেরিকা "বিদেশে" পড়াশোনা করে তাই তার জন্য নাকি এই একটা জিনিস ছাড় দেয়া হয়েছে।

৪.
সেবারের ভ্রমণে আমাদের মূল মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে সেই প্রাচীন রাজপ্রাসাদটিকেই ঠিক করা হয়েছিল। তবে সেখানে থাকা হয়েছিল খুব সামান্য সময়ই। বাকিটা সময় কেটেছিল বনে-বাদাড়ে, নদী আর খালে। গভীর সবুজ আমাজনের ভেতরকার শ্বাপদসংকুল পরিবেশ কিন্তু ভয়ের চেয়ে রোমাঞ্চ বেশি জাগায়। ভয় তো খুব বেশি কিছুর নয়, মৃত্যুর বড়জোর। চোখের সামনে যে অসামান্য সৌন্দর্য্যের পসরা, তার সামনে মৃত্যুকে তখন আসলেই ভীষণ তুচ্ছ মনে হয়। তারচেয়ে পরিবারকে হারানোর ভয় অনেক বড় হয়ে ধরা দেয়। মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের সাথে চিরবিচ্ছেদের ভয় বেশি করে বাজে বুকে।

সেবারের ট্রিপটা দৈর্ঘ্যে সংক্ষিপ্ত ছিল বলেই আমরা ঠিক করেছিলাম ক্যানুতে করে যাবো প্রথমে টিটিকাকা লেকের ইনকা পয়েন্ট পর্যন্ত। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন আমরা যাবো পুনো অঞ্চলের বিখ্যাত চূড়া টাকিলা'য়। চূড়াটি অবস্থিত যে দ্বীপে তার নামও এই চূড়ার নামেই রাখা, অর্থাৎ টাকিলা। এই চূড়ার নাম নিয়ে রয়েছে অজস্র কৌতুক। টাকিলায় একরাত কাটিয়ে আবার ক্যানুতে করে ফিরবো টিটিকাকায়। তারপর যাবো আরেকটু দূরের একটা দ্বীপ উরোস্-এ। সেখানে আবার কাটাবো একটা পুরো দিন ও রাত। তাতে করে যথেষ্ট বিশ্রাম হলে আমরা একই পথ ধরে একই ক্যানুতে করে ফিরবো আবার। সাথে নিয়ে নিয়েছি দুইদিনের যথেষ্ট শুকনো খাবার, তামাক, দেশলাই, মোমবাতি, ওডোমস, দড়ি, সুইস চাকুর মতো জরুরি জিনিসগুলো। আমেরিকা যেন কি মনে করে বুমেরাং আকৃতির একটা বিঘত সাইজ লম্বা দু'মুখো চাকু অবলীলায় ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছিল।

প্রথম যাত্রাবিরতির জন্য ইনকা পয়েন্টে পৌঁছুতে আমাদের স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় চার ঘন্টা সময় বেশি লেগেছিল। মূল কারণটি ছিলাম আমিই। ক্যানু চালানোয় আমার পূর্বাভিজ্ঞতা বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। একবার কিছুদিন বান্দরবানে মাছ ধরার নৌকায় কাজ করেছিলাম। তার সুবাদে লব্ধ বৈঠা বাওয়ার জ্ঞান সেই টিটিকাকা লেকের সরু ক্যানুতে কোনো উপকারে আসছিল না।

আর একবার জার্মানিতে শিক্ষাসফরে গিয়ে কমলা আর হলুদ রংয়ের লাইফজ্যাকেট পড়ে ক্যানু চালানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেখানে এক প্রাতিষ্ঠানিক ক্যানুচালক আমায় কিছু বিষয় দেখিয়েও দিয়েছিল। সেসবেও কেন যেন কাজ হচ্ছিল না। বার বার ঘুরে যাওয়া ক্যানুর মুখ ঠিক করতে করতেই প্রথমদিন বেলা গড়িয়ে গেল। আমার কাণ্ড দেখে কার্লোস আর মারিয়া তো হেসেই কুটিকুটি। আমেরিকাও প্রথম হাসি চাপার চেষ্টা করে তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছিল। তারওপর যখন আসলেই আমার জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছিল এবং লেকের ওপরেই সন্ধ্যা নেমে আসার চোখরাঙানি ভেসে উঠেছিল, তখন আমেরিকা আমার বলেছিল, তুমি বৈঠা উঠিয়ে রাখো।

একটি মেয়ে প্রায় সারাদিন বৈঠা বেয়ে সন্ধ্যার মুখে কিভাবে সঙ্গীকে বলে তোমার আর বাইতে হবে না, বাকিটা আমি দেখছি- তা আমার জানা ছিল না। আমি ওকে বললাম তোমার হাত ব্যাথা করছে না? বললো করছে। কিন্তু ব্যাপার না। এসবে নাকি ওর ছোটবেলা থেকে অভ্যাস আছে।

হলেও হবে হয়তো বা। আমি যেহেতু বৈঠা বেয়ে তাকে আর সাহায্য করতে পারছিলাম না, ভাবলাম একটু তামাক সাজাই। কোন না কোনভাবে নিজের কুঞ্চিত অস্তিত্বটা কাজে লাগাই। আর আমি পানি থেকে বৈঠা তোলার সাথে সাথেই যেন আমাদের ক্যানুতে আলগা একটা গতি চলে আসলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

৫.
ব্রাজিলের ওদিকে পিতু নামের একপ্রকারের রাম খুব জনপ্রিয়। ব্রাজিলিয়ানরা রামটির রেসিপি চুরি করেছে নাকি পেরু, বলিভিয়া আর ইকুয়েডরের কাছ থেকে। আগে বহু আগে সেই ষোড়শ শতকের শুরুতে স্প্যানিশরা যখন ইনকা সভ্যতা দখলের ব্যার্থ চেষ্টায় কোনো ফল পাচ্ছিল না, তখন ব্রাজিলিয়ানদের এই পিতুর রেসিপি উদ্ধার করে দেবে শর্তে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছিল তারা। জনশ্রুতিতে রয়েছে।

সেই রাম এখনও ইনকা সভ্যতার বংশধরেরা আখ গাঁজিয়ে নিজেদের বাড়িতে প্রস্তুত করে। আমরা ইনকা পয়েন্টে পৌছুঁনোর পর সেই রাম দিয়ে স্থানীয় কটেজের দেখাশোনায় নিয়োজিত টিটু রিমাচি আমাদের আপ্যায়ন করে। সাথে ছিল আমাজনের আচাই কুল। একদম বান্দরবানের পাহাড়ি পাড়াগুলোর মতো লাগছিল তখন আমার কাছে। আমার পৌঁছেছিলাম সেখানে ভর সন্ধ্যাতে।

নক্ষত্রে খোদাই করা এক অভিজ্ঞতা হয়ে আছে সেদিনের সন্ধ্যেটা।

আমাদের সারাদিনের বৈঠা বাওয়ার ক্লান্তি আচাই কুলের অনন্য চনমনে গন্ধে মুহূর্তে উবে গিয়েছিল সেদিন। তারপর ধীরে ধীরে যখন বনের আকাশে একটা একটা করে তারা ফুটে উঠছিল, তখন আমরা চারজন আর টিটু রিমাচির পরিবার কিছু শুকনো কাঠ জোগাড় করে আগুন ধরিয়ে গোল হয়ে বসেছিলাম। টিটু রিমাচির দুই বৌ, আর তিন মেয়ে। আমাদের আসার খবর পেয়ে ওরা আগে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। স্থানীয় লাল মরিচের গুড়ায় মেখে রেখেছিল বুনো খরগোশের চামড়া ছাড়ানো শরীর। আগুন ধরানো হয়ে গেলে, তার ওপরে শিক দিয়ে জুড়ে দেয়া হলো গোটা চারেক পেল্লায় আকারের খরগোশ। তাদের পেটের ভেতর প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ-রসুন-আদা ঠেসে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর খরগোশের শিক চারটি থেকে একটু ওপরে একটা লোহার তৈরি বৃত্তাকারেরর জালও, ওই শিকগুলোকে যেমন মাটিতে উল্লম্বভাবে পুতে রাখা শক্ত ডাল দিয়ে বাঁধা হয়েছিল, তেমনি তিনটি ডালের ওপর বেঁধে বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই লোহার জালটির ওপর ছিল বড় বড় চামড়াশুদ্ধ আলু। টিটু রিমাচির ছোট মেয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আমাদের চোখ বড় বড় করে বলছিল, ওর বাবা কিভাবে খরগোশগুলোকে শেকড়ের নির্যাস মেশানো তীর দিয়ে বধ করেছে। ওই নির্যাস শরীরের প্রবেশ করলেই খরগোশ ঢলে পড়ে চিরশান্তির ঘুমে।

পোড়া মাংসের গন্ধে যখন চারদিক ম ম করে উঠল, সে সময় আমাদের পেয়ালার টুংটাং শব্দ কানে সমধুর আনন্দের সুর বাজিয়ে প্রবেশ করছিল। খোলা আকাশের নিচে আমাজন মহাবনে বসে বসে কখনো বার্বিকিউ করবো- এতদূর তো স্বপ্নেও ভাবি নি, তাহলে?

মাংস হয়ে যাওয়ার পর আমাদের খাবার বন্দোবস্ত হলো সবার একসাথে। পেল্লায় আকারের এক স্টিলের গামলাতে। সেখানে মাঝখানে সাজানো হলো থ্যাতলানো আলু। আর তার চারপাশে খরগোশের মাংস। খরগোশের পেটে সেদ্ধ হওয়া পেয়াজ-রসুন-আদাগুলো ছড়িয়ে দেয়া হল পুরো গামলাজুড়ে।

খাবারের পুরোটা সময় হাসি-ঠাট্টায় পার হয়ে যাবার পর যখন পেটের কোনো কোনাতে এক মিলিমিটার জায়গা ফাঁকা নেই, তখন আমরা চারজন আগুনের চারপাশেই মাটির ওপর শরীর এলিয়ে দিয়েছিলাম। টিটু রিমাচি তার স্থানীয় বাঁশি নিয়ে এসে বসেছিল আমাদের পাশে। দূরে মায়েদের শরীরে এলিয়ে শুয়ে ছিল ওর মেয়েরা। একদল প্রকৃতির সন্তান প্রকৃতির বুকে মাথা রেখে গভীর আনন্দে হারিয়ে গিয়েছিল অচেনা সুরের রাজ্যে।

৬.
পরদিন ভরসকালে ঘুম ভাঙে কার্লোসের চিৎকার-চেচাঁমেচিতে। আর কোনো কারণে নয়, আগের রাতে আমরা সব পিতু শেষ করে ফেলেছি বলে। সে বেলা বাঁচিয়ে দিয়েছিল টিটু রিমাচির বড় বৌ'টা। কোত্থেকে যেন এক লিটারের প্লাস্টিকের বোতল খাদি কাগজে মুড়ে এনে রাখলো কটেজের দাওয়ার সামনে। বলে গেল কাগজে মুড়েই রাখতে। সূর্যের তাপে নাহলে নাকি মদটা নষ্ট হয়ে যাবে। কার্লোসের খুশি দেখে কে!

তারপর শুরু হলো মহাবন আমাজনের একদম মধ্যিখানটি দিয়ে আমাদের যাত্রা।

ইনকা পয়েন্ট থেকে টেকিলা দ্বীপে পৌঁছুতে প্রথমে ঘন্টা চারেক গভীর বনভূমির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হয়। টিটু রিমাচিও আমাদের গাইড হিসেবে সঙ্গী হয়ে গেল। প্রথমে সেই গহীন বনের ভেতর দিয়ে চার ঘন্টা হাঁটাপথ পাড়ি দিয়ে আমাদের পৌছুঁতে হবে স্থানীয় মাছের বাজারে। সেখান থেকে মাছ ধরার ট্রলারে করে ঘন্টাখানেক ছুটতে হবে টিটিকাকা লেকের বুক চিড়ে। তারপরও অনেক জার্নি আছে।

সেদিন যেন কোনোকিছুতে বেগড়বাই না করি, তাই আমি আগে থেকে অনেক বেশি সাবধান ছিলাম। যাবতীয় নায়কোচিত ভাবসাব বাদ দিয়ে একদম ভাল মানুষ হয়ে গেলাম।

বনের ভেতর দিয়ে যে নিয়মিত মানুষে যাতায়াত হয়, তা বোঝা গেল বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পায়ে চলার পথ দেখে। তবে চিকন ওই পথটুকুই শুধু। প্রস্থে বড়জোর দুই মিটার। তার দুই পাশে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। নাম না জানা গাছের সংখ্যা এত বেশি যে, সেগুলোর নাম জানার চেষ্টা করা পণ্ডশ্রম। আমাদের গাইড জানালো আমাজনে সবচেয়ে বেশি হয় আচাই কুলের গাছ যা মূলত এক ধরনের পাম-ট্রি। সব আচাই কুল আবার মানুষের জন্য সহনীয় না। আর "সুমাওমাইরা" গাছগুলোকে বলা হয় প্রহরী গাছ কারণ তারা সবচেয়ে উঁচু হয়।

চলার পথে প্রায়ই চোখে পড়ছিল বড় বড় পাখির কলোনি। পুরো গাছ জুড়ে পাখির বাসা। এক একটা গাছে বসে আছে সহস্র পাখি। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়লো হার্পি ঈগলের কলোনি। গাইডও জানালো এই ঈগলই নাকি আমাজনে চোখে পড়ে সবচেয়ে বেশি। সাদা আর কালো রংয়ের পালকে ছাওয়া পাখিটির আকৃতি আমাদের দেশের দাঁড়কাকের সমান। সামনে বাঁকানো ঠোঁট যেন সদম্ভের নিজের ক্ষমতার জানান দিচ্ছে। পাখি হলেও কোনো চঞ্চলতা নেই তাদের মধ্যে। এমনকি তাদের গাছগুলোর নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়েও আমি টানা এক ধরনের চাপা গুঞ্জন ছাড়া বেশি কিছু শুনি নি। যেটা পুরোই অন্যরকম ছিল নীলকণ্ঠ পাখির কলোনিগুলোর আশেপাশে। তাদের তীক্ষ্ণ চিৎকারে কানই প্রায় ঝালাপালা হওয়ার জোগাড় হয়ে উঠছিল। কার্লোস একবার রসিকতা করে বললো, গোটা কতেক ধরে পুড়িয়ে পেটপুজো করে নিলেই হয়। ঝামেলা শেষ!

তার কথায় আমরা কেউ সায় দিলাম না। ব্যাকপ্যাকে থাকা শুকনো খাবার ছিল আমাদের চলার পথের ভরসা। পিতুর বোতলটি শেষ হয়ে গিয়েছিল ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই। হাঁটা পথে কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটে নি শুধু একবার পেল্লায় আকারের এক অজগরকে আমাদের চলার পথের একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে যেতে দেখা ছাড়া।

অজগরটি প্রথম দেখতে পেয়েছিল মারিয়া। আমাদের দলের মধ্যে মানসিক কোমলতা বোধহয় আমি ছাড়া আর যার মধ্যে সামান্য ছিল সে মারিয়া। সে আমাদের চেয়ে দু'কদম এগিয়ে হাঁটছিল অনেকটা আনমনেই। হঠাৎ একপাশের ঝোপ ফুঁড়ে একটি সাপের মাথা বের হতে দেখে আতঙ্কে প্রায় জমেই গিয়েছিল। আমি ছিলাম তার পরে। দ্বিতীয় জন হিসেবে সাপটি দেখলাম আমি। দেখেই আমার ভেতরে লালিত দীর্ঘ সংস্কারের অবধারিত প্রকাশ ঘটলো উচ্চস্বরে "লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" বলে চিৎকার কর ওঠার মধ্য দিয়ে!

সাথে সাথে আমাদের গাইড এসে মুখে হাত চেপে ধরলো। অজগরটি যদি ক্ষুধার্ত হয় তাহলে নাকি বিপদ হয়ে যেতে পারে। কানে কানে বললো তার দক্ষিণ আমেরিকান অ্যাকসেন্ট-এ। ততক্ষণে আমেরিকা, কার্লোসরাও পাশে এসে গেছে। সবাই দুই মিনিট ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অজগরের চামড়ার স্নায়ু পোড়ানো সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। তখন গাছের ডালে ঝুলে থাকা কিছু বানরের কিচ কিচ শব্দ আর দূরে স্তিমিত হয়ে যাওয়া নীলকণ্ঠের তারচিৎকার ছাড়া, চরাচরে আর কোনো শব্দ ছিল না।

৭.
সেদিন টিটিকাকার বুকে মাছ ধরার ট্রলারে বসে আমি ভাবছিলাম যদি অজগরটি ক্ষুধার্ত থাকতো, তাহলে কি হতে পারতো?

বাংলাদেশের ছোট একটা জেলা বগুড়ার ততোধিক ছোট উপজেলা কাহালুর ক্ষুদ্র গ্রাম জোকার পাড়ার একটা ছেলে জীবনের পরিক্রমায় যদি ঢাকা, চিটাগং, পেরু ইত্যাদি ঘুরে একটি অজগরের পেটে শেষ ঠাঁই নেয় আমাজন মহাবনে- তাহলে কি পৃথিবীর কোথাও কোনো স্বাভাবিক পথপরিক্রমায় এক ন্যানোডিগ্রী সমপরিমাণের বিচ্যুতি ঘটবে?

পৃথিবী গ্রহটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই বোধহয় এটা। এখানে প্রতিটি মুহূর্তকে অনুভব করে বাঁচতে হয়। চলে যাওয়া একটি সেকেন্ডও একবারের জন্য পেছনে ফিরে তাকায় নি এর জন্মের সাড়ে তের মিলিয়ন বছরের ইতিহাসে। পুরো বিশ্বব্রক্ষ্হাণ্ডই এমন। যে ক্ষণটি একবার চলে যায়, তাকে আর কোনকিছুর বিনিময়ে ফিরে পাওয়া যায় না। কখনোই।

এমন ভাবনার ডালপালায় ঘুরতে ঘুরতে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম অন্যদের কাছ থেকে। ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ আবহসুর হয়ে বাজছিল কানে। কিছুক্ষণ পর কার্লোস এসে কানে কানে বললো, আমাদের গাইডটি আমায় গাঁজা-ভাঙ কিছু দিয়েছে কিনা। আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম ওর কথা।

আমরা যখন পৌঁছেছি তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বেলা বাজছিল আড়াইটা। পেটে ক্ষুধার নাচন। পোড়া মাংস আর নয়, এবার চাই একটু স্বাভাবিক খাদ্য। ফোটানো চাল, সবজি, ঝোল যাই হোক কিছু একটা। তবে জানতাম আমাজনের আশেপাশের এই দ্বীপগুলোতে একেবারে মনের মতো ভাত-ডিমভাজি পাবো না। আসলে দূর-দুরান্ত পর্যন্ত সবই বনভূমি। গাড়িতে করে যাতায়াতের তো কোনো ব্যবস্থাই নেই। স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা ট্রলারে করে সবজিও ফেরি করে। আমরা যেটিতে করে এসেছিলাম সেটিতে ছিল না যদিও। তাই খাওয়া-দাওয়া কি যে হবে, তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা হচ্ছিল বটে!

ওদিকে আবার স্থানীয় জনগণের সাথে আমাদের দলের গাইড জনাব রিমাচী সাহেবের বেজায় ভাব। কারও সাথে সামনাসামনি হলেই দাঁড়িয়ে দু'তিনটি কথা বলে নিচ্ছেন। আমরা নিয়ে নিচ্ছি চোরা বিশ্রাম। স্থানীয়দের সবার পরনে ঐতিহ্যবাহী ইনকা পোশাক পঞ্চ। আধুনিক মেক্সিকানদের পঞ্চ নয়। বনের উপজাতিদের বর্ণিল কিন্তু সংক্ষিপ্ত পঞ্চ। আবার সিনেমার মতো অতো সংক্ষিপ্তও না।

তারা আমেরিকাকেও চেনে দেখলাম। এক ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব যে মানুষের ভেতর, বিশেষ করে স্থানীয় যারা একদম, কাল-কালান্তর ধরে পৃথিবীর কেন্দ্রের মাটি খুড়ে বাঁচার সংগ্রাম চালিয়ে রেখেছে, তাদের ভেতর এখনও যে রাজপরিবারের আছে তা বোঝা যায়। তবে সেটা ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ না কি আমাজনের অন্য আরও অনেক কিছুর মতো আজো আমাদের জানাশোনার বাইরে রয়ে যাওয়া কোনো রক্তাক্ত ইতিহাস-এর হাতছানি, তা নিয়ে খানিক ভাবার চিন্তেটা ক্ষুধার কাছে বারে বারে মার খেয়ে যাচ্ছিল।

আসলে হয়েছে কি ওই দেশে এমন ব্যবস্থা নেই যে, কিছু মানুষ গিয়ে কোথাও বসে খাবার অর্ডার দিলে কেউ এসে সেটা নেবে কিংবা সে খাবারটি সার্ভ করবে। আমাদের পরিকল্পনা মোতাবেক এখন টিটু রিমাচীর ছোট স্ত্রীর ভাই রঙ্গন আটোকের বাসায় যাচ্ছি আমরা।

মানুষজন রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। বেশ ভাল। হাসিখুশি পরিবেশ। অবশ্য কোনো খোলামেলা জায়গা না। চারপাশে ঘন বন। সঙ্গে প্রচ্ছন্ন বিপদের শঙ্কায় পূর্ণ আমার মন। কারণ পরিবেশটা আমার আগের যতো অভিজ্ঞতা আছে তার কোনো কিছুর সাথে মিলছে না। বন্ধুবান্ধবদের সাথে উচুঁ গলায় হাসাহাসি এখানেও হচ্ছে, কিন্তু এমন না যে বনে কোনো গাছে কলা ধরে আছে, গিয়ে পেড়ে খাবো। আমরা হাঁটছি মোটামুটি সরু একটি পায়ে চলা পথ দিয়ে যার চারপাশে সমান্তরাল রেখায় গড়ে উঠেছে বনের বাসিন্দাদের পাড়া। কোন-কোনোটা লম্বায় আধমাইল। পাড়ার সব বাড়ি ভাসমান। আর নিচে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বুজে যাওয়া জলধারা। ভেতরে গাছপালা উঠে পানির স্তরকে অনেক নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে, অনেকটা যেন রাজধানী ঢাকা শহরের মুগদা-মান্ডার ওদিককার পুরোনো খাল জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে অনেকগুলো।

নানা রকম জলজ গাছে ছাওয়া জলধারাগুলো। সেসবের ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই সুঁচালো দাঁতের সারি নিয়ে ভয়াল চোখে তাকিয়ে আছে রং-বেরংয়ের কীটকল। কার্লোস একবার ঠাট্টা করে বললো, যাই করো বাপু ওই জলাশয়ে পড়ো না, গাছেদের খাদ্য হয়ে যেও না। তাহলে সর্বনাশ!

একটা সময় বনের গাছপালা কমে চারপাশে শুধু মাত্র বাঁশ আর ঘন সোনালি রংয়ের ছনের তৈরি লম্বা লম্বা সমান্তরাল পাড়া বেশি বেশি দেখা যেতে থাকলো। ওই মানুষখেকো জলাভূমির ভেতর বাঁশ পুঁতে ভাসমান কুড়েগুলো বানানো হয়েছে কিভাবে- তাই আমি যেতে যেতে ভাবছিলাম। সে সময় পেছন থেকে মারিয়া আর আমেরিকা দুজনেই জিজ্ঞেস করলো, এরকম বনভূমি আমি আগে কোথাও দেখেছি কিনা।

বললাম, দেখেছি।

আসলে চাপা যদিও। বান্দরবানের সেরকম গহীন কোনো জায়গায় আমার এখনো যাওয়া হয় নি। এছাড়া আসলে অন্য কোথাও আমাকে কখনো কেউ যেতে দেখেছে বলে বলতে পারবে না। তাই ওরকম বনভূমি, আমাজনের ভেতর, আমার কাছে দুর্দান্ত রকমের অচিন্ত্যনীয়। সেই সাথে যোগ হয়েছে ছেটোবেলার ফিকে হয়ে যাওয়া স্বপ্ন সত্যি হওয়ার তিরতিরে আনন্দ! বলে বোঝানো অসম্ভব।

স্বপ্নটার সাথেও যে এমন একটা যোগাযোগ আমার ভেতর ভেতর লুকিয়ে ছিল, সেটাই বা কে জানতো। গত বিশ বছরে ক'বারই বা কথাটা আমি ভেবেছি, প্রথমবারের মতো স্বপ্নটির সাথে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে? প্রথমবার স্বপ্নটা অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। প্রায় ২০০৩ বা ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এরপর বগুড়া থেকে ঢাকায় চলে আসায় হয় আমার পুরো পরিবারসহ।

সেই রাস্তাটা মানুষজনের হৈ-হুল্লোড় আর কোলাহলে ভরা হলেও, ছিল কিন্তু অনেক লম্বা। আমাদেরকে নাকি আবার গিয়ে খেয়েই পাহাড়ে চড়তে শুরু করতে হবে। টেকিলার চূড়ার উদ্দেশ্যে তখন হবে আমাদের যাত্রা।

৮.
প্রায় ১৫ মাইল পথ দ্রুত হেটে পাড়ি দিয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছুলাম রঙ্গন আটোকের কুড়ের দুয়ারে। ক্ষুধা মিটেছিল সেদিন পাহাড়ি শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভুট্টার আটায় তৈরি রুটি খেয়ে। প্রতি আষাঢ়ে দুই বার পূর্ণিমার টানে পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসে এই মাছ টিটিকাকা হ্রদে। দেশি শিং মাছের কাছাকাছি স্বাদ তবে চামড়াটা বেশ মোটা। অনেকটা দেশের বাইন মাছের মতো। মূলত স্থানীয় যেকোন একটি ক্যাটফিশের প্রজাতি। তবে মাছটি খেতে যেমন ছিল নরম, তেমনি সুস্বাদু। আর রঙ্গন আটোকের বউ মাছের ঝোলে লঙ্কা দিয়েছিলেন বেড়ে। সাথে ছিল গুয়াকামোলে। আভোকাডো, লেবু আর ধনেপাতার সাথে আমাদের আসার পথের জলাশয়গুলোর মতোই একটা থেকে তোলা লাল মরিচ চটকে বানানো গুয়াকামোলে।

রঙ্গন আটোকের বাড়ির ভুট্টার রুটি দিয়ে শিং মাছের ঝোল আর ঝাল ঝাল গুয়াকামোলে ছিল আমাদের সে ভ্রমণের একটা টাচ-পয়েন্ট। সারাদিন কত মাইল হাঁটা হয়েছে তার ইয়ত্তা ছিল না। ৩৫ থেকে ৪০ মাইল তো হবেই। দক্ষিণ গোলার্ধের দিনের দৈর্ঘ্য অনেক বড় বলে সেই বিকেল বেলায়ও সূর্য শক্তিমান তাপ বিকিরণ করছিল। রঙ্গন আটোক জানাল সূর্য্যের আলো থাকবে আরও ৬-৭ ঘন্টা।

সেদিন সেই পরিবেশে মনের আনন্দে খেয়েছিলাম সবাই। কার্লোসটা তো খেয়ে সেরেই শুয়ে পড়লো। জাস্ট ওর জায়গাটাতেই। মারিয়া, আমেরিকা আর আমি স্থানীয়দের সাথে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো পাইপে তামাক সেবন শুরু করলাম। ফাঁকে ফাঁকে কথা হচ্ছিল, চূড়ায় যেতে যেতে যদি রাত হয়ে যায় তাহলে আজ চূড়াতেই থাকা হবে এমন কিছু টিটু রিমাচী ওদেরকে বলছিল।

টেকিলার চূড়ায় উঠতে গিয়ে আমার প্রাণবায়ু প্রায় বেরিয়েই যেতো, যদি না আমাদের গাইড শেষের খাঁড়া অংশটুকু আমায় প্রায় কাঁধে করে না উঠাতো। তবে ওঠার পর চোখের সামনে বিস্তীর্ণ টিটিকাকা হ্রদের জমকালো নীলের বাহার এক মুহূর্তে সব শক্তি কোত্থেকে যেন ফিরিয়ে এনেছিল আবার। একই ঘটনা আগের দিন সন্ধ্যায় ইনকা পয়েন্টের কটেজেও ঘটেছিল। তাই এবার আর অবাক হই নি। ধরে নিয়েছি মহাবন আমাজনের এনার্জিটাই এরকম। ঠিক একমাত্রিক নয়। বহু মাত্রার। আবার এক-এক সময় যেন কথা নেই, বার্তা নেই, কোনো প্রকার হুইসেল নেই- হুটহাট এসে ভর করে।

আমি বেশ অনেকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম চূড়ার একটা কিনারায় গিয়ে।
সামনে যেদিকে তাকাই শুধু সুমাওমাইরা গাছের চূড়া আর ভেতরে ভেতরে জলাভূমি। মাইলের পর মাইল বিস্তৃীর্ণ। দু'চোখে যা কিছু ধারণযোগ্য তার সবই তখন ওই একই দৃশ্য, ঘন সবুজ গাছের চূড়া আর নীল জল।

কার্লোস তখন পেছন থেকে এসে জানতে চাইলো ক্লান্ত কিনা। বললাম, না ক্লান্ত না একবারেই। কনটেমপ্লেটিং বন্ধু। আমি এই মুহূর্তে শুধুই পরিপূর্ণ। অবশ্য এক চুমুক পিতু আর আর একটা পেরুভিয়ান সিগার পেলে জমে যেত।

ছেলেটা বললো, সে আর সমস্যা কি? ওই টিটু রিমাচি তো সেজন্যই আয়োজন করছে দেখছো না? তারপর সে কাছে এসে বললো, আচ্ছা তুমি কি ঠিক আছো বলোতো? প্রায়ই আনমনা হয়ে যাচ্ছ, ব্যাপারটা কি?

বললাম, আসলে ব্যাপার কিছু না। ঠিক টিটু রিমাচির মতো একজনকে আমি চিনি। সেও ঠিক একইরকম পাহাড়ে, বনে, নদীতে আর খালে ঘুরে বেড়ায়। ওর পরিবার থাকে একটা ছোট্ট পাহাড়ি কটেজে। ছেলেটার কথা আজ বারবার মনে পড়ছে, কিন্তু তার জন্যও যে আনমনা হয়ে যাচ্ছি তা নয়। আনমনা হচ্ছি আসলেই এমনিই। এই যে দেখো না, এখানে দাঁড়িয়ে সামনের ঘন বন আর হ্রদের নীল জলের দিকে তাকালে কি মনে হয়? পৃথিবীর যে ইমোজিগুলো হোয়াটস্অ্যাপে আছে, সেগুলোর একটা না? মনে হচ্ছে যেন মহাশূন্যে দাঁড়িয়ে আমাদের নীল রংয়ের গ্রহটার দিকে তাকিয়ে আছি। ঠিক না?

সেদিন আমায় যেন কথা বলার ভুতে পেয়েছিল খুব সামান্য একটা মুহূর্তের জন্য। বলেই যাচ্ছিলাম, এখানকার বাতাসে নীল জলের যে গন্ধ তা আমায় ছেলেবেলার প্রত্যেকটা ঘটনা নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে, জানো। আমার ছেলেবেলাটা কেটেছ সাগরপাড়ের একটা শহরে। যাওয়া হতো না ওই সমুদ্র সৈকতে খুব বেশি যদিও। কিন্তু তাতে কি? ঝড়ের সময় আমি ওখানে সাগরের তীরে নোঙর ফেলে রাখা জাহাজের মাস্তুলদের তান্ডবনৃত্য তো দেখেছি। আমার মনে হচ্ছে আহা, জীবনের ভাল ভাল মুহূর্তগুলোকে যদি ধরে ধরে বোতলে বন্দি করে রেখে দিতে পারতাম!

কার্লোসের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল আমার কথা শুনতে শুনতে বেচারা কান দু'টোতে বিস্ফোরণ ঘটবে। বড় বড় চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম একবিন্দু বুঝতে পারছিল না কোনোকিছু। না পারারই কথা। বয়সের দিক থেকে কার্লোস দশ বছরেরও বেশি ছোট। কেবল বিশের ঘরে পা দিয়েছে। ওর দ্বারা বড় সহজে সম্ভব টিটিকাকার অমোঘ হাতছানি উপেক্ষা করে টেকিলার চূড়ায় এক বোতল পিতু নিয়ে বসে হেঁড়ে গলায় লুই ফনসির স্প্যানিশ গানে টান দেয়া।

কার্লোস, আমেরিকা, মারিয়াদের দূর থেকে দেখতে দেখতে একসময় আমার মনে হতে লাগলো, এই তো বেশ ভাল হয়েছে। একটা জীবন না হয়, যা চেয়েছি তা না পেয়েই কেটেছে।

কিন্তু যদি অন্যভাবে ভাবি যে, যা পেয়েছি এ জীবনে তার কতোটুকু চেয়েছি আসলে? কিংবা চাইতে পারতাম সুযোগ পেলে? মহাকাল যে জীবনটি আমায় উপহার দিয়েছে, তারচেয়ে সুন্দর জীবন কি আমি নিজে নিজের জন্য সাজাতে পারতাম? কিংবা সেটা কি কখনো সম্ভব ছিল?

আজ সাড়ে চার বিলিয়ন বছর ধরে চলছে তো আমাদের নক্ষত্রকণা হিসেবে এই বিশ্বব্রক্ষাণ্ড পরিভ্রমণ নাকি? এরকমই কাছাকাছি আরও একটা সময় আমরা পাড়ি দেবো সামনে। বিভিন্ন রুপে, বিভিন্ন ধর্মে। একজন যদি সেখানে কোনো পরিবর্তন আনতে চায়, আসলেই কি আনতে পারে? আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই কি এই ছোট্ট সত্যটা বুঝতে না পেরে একটা জীবন হেলায় হারিয়ে ফেলি না?

ছেলেবেলার সেই দমবন্ধ উত্তেজনায় ঠাসা দুপুরে তিন গোয়েন্দা পড়তে পড়তে যদি এই ধাঁধাঁটায় আটকে না পারতাম, তাহলে বিশ বছর পর সেদিন টেকিলার চূড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর ইমোজির দৃশ্যটা লাইভ দেখার সুযোগ হতো কিনা জানি না।

---

পোস্টটি ৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!