ইউজার লগইন

যে ঝড়ো মেঘ একদিন আমাদের আকাশেও ডেকে আনবে বিপুল অন্ধকার

এই গল্পগুলো খুব চেনা আর সাধারণ। ওরা প্রত্যেকে কাছাকাছি সময়ে আলাদা পরিবারে মানুষ হচ্ছিল। বয়েস ৪-৬ বছর। ২০১১ সালে যে গল্পগুলো ছিল এরকম-

১. অমি প্রতি শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকে। বাবা বাসায় থাকে সারাদিন। বিকেলে ওকে নিয়ে বের হয়। হয় শিশুপার্ক, নয়তো চন্দ্রিমা, নয়তো চায়নীজ। ফিরে আসার সময় মুঠোভর্তি চকোলেট আর বেলুন। প্রতি শুক্রবার ওর জন্মদিনের আনন্দ।

২. নীহা প্রতি রাতে ঘুমোবার আগে এক ঘন্টা বাবার গলা জড়িয়ে গল্প শুনে। সেই তিন বছর বয়স থেকে গল্প শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে বাবার প্রতিটা গল্প, তবু বাবার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করে ওর। প্রতিবার শুনলে মনে হয় এই প্রথম শুনছি, বাবা এমন মজা করে গল্প করে।

৩. শায়ানের খুব শখ ঘোড়ায় চড়া। বাবাকে কতো করে বলেছে একটা ঘোড়া কিনে দাও। বাবাটা কথা শোনে না। তাই শাস্তিস্বরূপ প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে বিছানাময় ঘুরে বেড়ায়। বাবা অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে এসে সানন্দে ওকে পিঠে নিয়ে পংখীরাজ হয়ে যায়।

২০১২ সালে এসে গল্পগুলো হয়ে যায় এরকম-

১. অমি এখন শুক্রবারের প্রতীক্ষা করে না।

২. নীহা আর প্রতি রাতে গল্প শোনার বায়না করে না।

৩. শায়ান আর প্রতি সন্ধ্যায় পংখীরাজের পিঠে চড়ে না।

স্থান ভিন্ন। কাল ভিন্ন। পাত্র ভিন্ন। তবু একটা জায়গায় মিলে যায় তিনজনের সমীকরণ।
সাদা কাপড়ে ঢাকা চারপায়ের একটা বিছানায় করে বাবাকে ওরা নিয়ে যাবার পর থেকে আর কিছুই আগের মতো হচ্ছে না।

==========================================================

উপরের গল্পগুলো ছিল অন্য পাড়ার। নীচের গল্পটা আমার ঘরের পাশেই-

ভদ্রলোকের নামও জানতাম না। আমি থাকি ৭ তলায়, উনি ১০ তলায়। দেখা হতো লিফটে, আসা যাওয়ার পথে। কেমন আছেন, এটুকুই যোগাযোগ। সিগারেট হাতে থাকতো প্রায়ই। ওনার সিগারেট খাবার দৃশ্যটা দেখতে কেন জানি ভালো লাগতো। কিছু একটা ছিল তাতে। রাতে ফেরার সময় হাতের মুঠোভর্তি থাকতো বিস্কুট চিপস জুস কিংবা বাজার। এই ফ্ল্যাট বসতির ৬০ টি পরিবারের মধ্যে ওনাকেই আমার সবচেয়ে স্মার্ট তারুণ্যে দীপ্ত মনে হতো। মনে মনে পছন্দ করতাম খুব, ভাবতাম একদিন বসে চা সিগ্রেট খাবো।

কিন্তু কখনো বসা হয়নি। ফ্ল্যাটবাড়িগুলিতে প্রত্যেকটা পরিবার আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা যেন। সে কারণেই হয়নি। গত শুক্রবার নামাজের জন্য বেরুচ্ছি এমন সময় সাইরেন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে গেট দিয়ে। ভাবলাম কেউ অসুস্থ হয়তো, হাসপাতালে নেবে। বেরুবার সময় সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, হক স্যারকে আনছে। মারা গেছেন। মনটা একটু খারাপ হলো, হক সাহেব মানে উপর তলার চশমা পড়া মাঝবয়েসী স্মার্ট ভদ্রলোক, নাকি প্যারালাইসড বুড়ো ভদ্রলোক যিনি ড্রাইভারের কাঁধে ভর দিয়ে প্রায়ই বিকেলে বেরোতেন। যেই হোক, দুঃখজনক ব্যাপারটা। মসজিদে চলে গেলাম আমি।

ফিরে আসার পর দেখি অ্যাম্বুলেন্সটা তখনো দাড়ানো। অনেক লোকজন আসছে। সবার চেহারা শোকার্ত। আমি লিফটে না গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে গেলাম। ভাবলাম হক সাহেবকে দেখে যাই। কে তিনি চিনে যাই। অ্যাম্বুলেন্সের ছোট্ট খুপরি আয়না দিয়ে তাকাতেই বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠলো। এ তো সেই ভদ্রলোক, যাকে চেহারায় এত চিনি, কখনো নাম জানা হয়নি, সেই দিব্যি তরুণ, আমাদের বয়সী, এভাবে চলে গেলেন?? সকালে কাজের উদ্দেশে বেরিয়েছেন সুস্থ মানুষ। দুঘন্টা পরেই ফিরে এলেন লাশ হয়ে। কী নিদারুণ অনিশ্চিত মানুষের জীবন।

ভদ্রলোকের নাম মাহমুদুল হক। চিটাগাং গ্রামার স্কুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা তাদের বাবাকে হারালো। কখনো দেখেছি বাচ্চাদুটোকে? হয়তো দেখেছি। কিছুক্ষণ পর ওনার স্ত্রীকে লাশের মুখটা দেখাতে নিয়ে এলো কয়েকজন ধরাধরি করে। সেই দৃশ্যটা বর্ননা করার ভাষা নেই আমার। কেবল বলতে পারি উপস্থিত সবাই সম্মিলিতভাবে চোখের জল ফেলছে। গতকাল আর আজকের মধ্যে কত যোজন যোজন পার্থক্য করে দিয়ে যায় একেকটি মৃত্যু। কতোগুলো স্বপ্নের কবর রচনা করে দিয়ে গেল এই মৃত্যুটা।

মৃত্যু অনিবার্য একটা ঘটনা, তবু এরকম মৃত্যুগুলো কিছুতেই মানতে পারি না। অচেনা মানুষের জন্যও শোকে ভেসে যাই। মাহমুদুল হকের চেহারাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। যেন আজকেও বাড়ি ফেরার পথে লিফটে দেখা হবে, হাসিমুখে জিজ্ঞেস করবেন -কেমন আছেন?

পোস্টটি ১৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মীর's picture


মৃত্যু অনিবার্য একটা ঘটনা, তবু এরকম মৃত্যুগুলো কিছুতেই মানতে পারি না। অচেনা মানুষের জন্যও শোকে ভেসে যাই। মাহমুদুল হকের চেহারাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। যেন আজকেও বাড়ি ফেরার পথে লিফটে দেখা হবে, হাসিমুখে জিজ্ঞেস করবেন -কেমন আছেন?

ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন।

মেসবাহ য়াযাদ's picture


মৃত্যু অনিবার্য একটা ঘটনা, তবু এরকম মৃত্যুগুলো কিছুতেই মানতে পারি না। অচেনা মানুষের জন্যও শোকে ভেসে যাই। মাহমুদুল হকের চেহারাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। যেন আজকেও বাড়ি ফেরার পথে লিফটে দেখা হবে, হাসিমুখে জিজ্ঞেস করবেন -কেমন আছেন?

এটাই জীবন। এটাই সত্য। এর চেয়ে বড় সত্য জীবনে আর কী আছে ?
তাঁর আত্মার শান্তি হোক।

উচ্ছল's picture


গতকাল আর আজকের মধ্যে কত যোজন যোজন পার্থক্য করে দিয়ে যায় একেকটি মৃত্যু। কতোগুলো স্বপ্নের কবর রচনা করে দিয়ে গেল এই মৃত্যুটা।

ঠিক আছে ,সবই সত্য.... তবুও মানতে চায় না এ মন কিন্তু অনিবার্য এ পরিস্থিতি কখনই কাম্য নয়। যদিও জানি যে কেউ হতে পারে এ পরিস্থিতির শিকার।

উচ্ছল's picture


যে ঝড়ো মেঘ একদিন আমাদের আকাশেও ডেকে আনবে বিপুল অন্ধকার

ইদানিং বড় ভয় হয়। Sad

হাসান রায়হান's picture


কয়দিন ধরে মৃত্যুভাবনা মাথায় ঘুরছে। দিলেন আবার ঢোলের বারি।

শওকত মাসুম's picture


সেইম রায়হান ভাই

তানবীরা's picture


যাদের ওপর দিয়ে অনিবার্য ঝড় যায়, শুধু তারাই জানে

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


মন খুব খুব বেশি খারাপ হয়ে গেল।

তাঁর আত্মার শান্তি হোক।

আহমাদ মোস্তফা কামাল's picture


এরকম মৃত্যু আমার পরিবারেও ঘটেছে... বুঝতে পারি...

১০

প্রিয়'s picture


উনার আত্মার শান্তি হোক।

১১

এ টি এম কাদের's picture


সব আত্মার উপর শান্তি বর্ষিত হোক !

১২

লিজা's picture


Shock
এভাবে কত চেনা অচেনা মুখ হারিয়ে যায় আমাদের চারপাশ থেকে প্রতিদিন । ওনার আত্মার শান্তি কামনা করছি ।

১৩

লীনা দিলরুবা's picture


নীড়দার লেখার হাত ব্যাপক লাগে। আজ এই মৃত্যু চিহ্নিত লেখাও ছুঁয়ে গেলো, লেখনীর গুণে এবং বিমর্ষতায়।

১৪

সাঈদ's picture


মৃত্যু - স্বাভাবিক ঘটনা অথচ মেনে নেয়া সবচেয়ে কষ্টকর।

১৫

আরাফাত শান্ত's picture


খুব বিষন্ন লাগে সাথে গলা শুকিয়ে যায় এরকম লেখা পড়ার পরে!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নীড় সন্ধানী's picture

নিজের সম্পর্কে

ভুল ভূগোলে জন্ম নেয়া একজন অতৃপ্ত কিন্তু স্বঘোষিত সুখী মানুষ!