ইউজার লগইন

তার ছিড়া গল্প

১.
দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। জানালা দিয়ে অনেক দূরের কিছু পাহাড় সারির ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশাটা বৃষ্টির পর্দা। পাহাড়গুলো নদীর ওপারে। মাঝে মাঝে দেহবহির্ভূত হয়ে মনটা ওই পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেয়। একদিন নদীটা পার হয়ে সোজা ওই পাহাড়গুলোর দিকে চলে যাবো। অফিসে আসার পথে প্রতিদিন নদী পারাপারের খেয়াঘাট পেরিয়ে আসি। কখনো সখনো দেখি সারিবদ্ধ মানুষ নৌকা থেকে নেমে শহরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে ঘাট, সেখানেই বাসস্টপ। সন্ধ্যের আগে কাজ সেরে সবাই ফিরে যাবে ওই পাড়ে।

নদীর এই ঘাটলাটা বড় সুন্দর। আধুনিক খেয়াঘাট। কাঠের সুন্দর পাটাতন মহাসড়ক থেকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে নৌকার কাছে। শহরের মধ্যখানে এমন সুন্দর একটা ঘাট আছে ভাবতে ভালো লাগে। ঘাট থেকে মূল নদী কয়েকশো গজ দূরে। নদী ছেড়ে একটা সরু খাল শহরের পেট চিরে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে, সেই খালের মধ্যেই এই ঘাট। এই দূরত্বটাই এই ঘাটের সৌন্দর্য। খালটি নদীতে প্রবেশের আগে কয়েকশো গজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পেরিয়ে আসে। ঘাটের ছাউনি বরাবর বিশাল একটা অশ্বথ গাছ ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। গ্রামের হাটবাজারে কিংবা নদীর ঘাটেও এই গাছগুলিই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মহানগরের এই দালানকোঠার ভিড়ে কেউ খেয়াল করে ওকে? এরকম গাছগুলো কেউ লাগায় কিনা জানি না, মনে হয় এরা পাখির ঠোঁট থেকে পতিত বীজ থেকে জন্মায়, তারপর অযত্নে বেড়ে ওঠে একসময় মহীরূহ হয়ে যায়। এই গাছের ছায়ায় বসে মানুষ যাত্রার ক্লান্তি দূর করে, আয়েশ আড্ডাবাজি করে, আর বৃষ্টির সময় এই গাছগুলো হয়ে ওঠে নিদারুন আশ্রয়। আহ্ আমারো তেমন একটা আশ্রয় বৃক্ষ ছিল গ্রামের বাঁশবনটায়।

ঘাটের জায়গাটা ঘিরে অদ্ভুত সৌন্দর্য বিস্তার করেছে গাছটা। তবে এই গাছটা একেবারে নিঃসঙ্গ না, তার আরেকটা কনিষ্ঠ সঙ্গী খালের ওই পাশেও। ওদিকে ঘাট নেই, জাহাজ মেরামত কারখানা। এপাশের গাছের নীচে জিরোবার জন্য নগরকর্তারা চৌচালা টিনের ছাউনি বানিয়ে দিয়েছে। তার নীচে চারপাশ ঘিরে সিমেন্টের বাধানো বিশ্রামাসন। ওখানে বসে নদীর হাওয়া খেতে অপূর্ব লাগবে। আমি প্রায়ই কল্পনা করি ওখানে বসে প্রাণ জুড়ানো হাওয়া খাচ্ছি একা একা। সত্যিই একদিন সময় করে বসবো ওখানে। যেদিন খেয়া নৌকায় নদী পার হবো সেদিন।

২.
এই দেখো ভাবতে ভাবতে চা জুড়িয়ে জল। শেষ দুই চুমুকে চা শেষ করে আবারো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ওমা, ওদিকে তো সব ঝাপসা। পাহাড়টা কখন দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেছে। ধুম বৃষ্টি পড়ছে মাইলখানেক দূরের নদীতে। এদিকে এখনো ঝিরিঝিরি। আমি অনেকদিন বৃষ্টিতে ভিজি না। একদমই যে ভিজিনি তা নয়। অফিস থেকে ফেরার পথে, বাজার করে আসার পথে টুকিটাকি বৃষ্টির ছাঁট লেগেছে। কিন্তু সেরকম আয়োজন করে ঝুপ ঝুপ করে ভেজা হয়নি অনেক দিন। আমাদের পুরোনো বাড়িটা ছেড়ে আসার পর বৃষ্টিতে ভেজার দুর্ভাগ্য কমে গেছে। ওই বাড়িতে অনেক ভিজেছি ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। এখন সেই স্মৃতিগুলোই সম্বল। আজকাল ভিজতে চাইলেও পারি না। পকেট সম্পদ মোবাইল মানিব্যাগের চিন্তায় ভেজা হয়ে ওঠে না।

৩.
তোমার সাথে মেঘের যেমন মিল, বৃষ্টিরও। যখন অঝোর বৃষ্টিতে পৃথিবী ভেসে যায়, তখনো আমি তোমাকে খুঁজে পাই বৃষ্টির ছন্দে। তোমার মায়াগুলো বৃষ্টির ঘ্রান হয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেয়। বৃষ্টি আমার অনেক অনিষ্ট করেছে তবু তোমার জন্যই বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়।

৪.
-চলো একটা বিকেল দুজনে একসাথে কাটাই
-কিভাবে?
-বাইরে কোথাও বসবো
-যদি কেউ দেখে ফেলে?
-সেই রেস্তোঁরায় বসবো, ওদিকে কেউ যায় না তেমন।
-তবু ভয় করে
-ভয় আমারো, তবু একদিনও বসবো না আমরা, এ কেমন কথা?
-এখন বসে কি হবে?
-কিছুই হবে না। তবু মুখোমুখি নিরিবিলি কিছুটা সময় পাওয়া...
-যখন সময় ছিল তখন তো ডাকেননি
-তখন ডাকার সুযোগ ছিল না
-কেন?
-বলবো?
-বলেন
-পকেট ছিল গড়ের মাঠ, তোমাকে নিয়ে কোথায় বসতাম বলো?
-আমার পকেটে তো ছিল, আপনার সাহসটা থাকলেই হতো
-সাহস থাকে পকেট ভর্তি থাকলে
-আপনি কাপুরুষ ছিলেন
-এখন বসতে রাজী আছো কিনা বলো
-মাকে কি বলবো?
-সে তুমিই জানো
-আপনি একটা বুদ্ধি দেন
-তোমার বুদ্ধি আমার চেয়ে বেশী
-কচু
-সত্যি, মনে আছে অনেক বছর আগে তুমি আমাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলে মায়ের কাছ থেকে?
-হ্যাঁ খুব মনে আছে, সেই চিঠির উত্তরটা দেবার জন্য..
-যে উত্তরটা বহুবছর খুব কষ্ট দিয়েছিল
-যে উত্তরের অর্থ ভুল করেছিলেন বলে
-কেন অমন জটিল করে লিখেছিলে, আরেকটু সহজ ভাষায় বলা যেতো না?
-আমার রাগ হয়েছিল আপনার প্রশ্ন শুনে... তাই ওরকম লিখেছিলাম
-রাগ কেন?
-অত বছর পর কেউ অমন কথা জিজ্ঞেস করে?
-কত বছর?
-জানি না, তবে আমি জানতাম আমরা দুজনেই একই কাপে চা খাচ্ছি, তবু আপনার মনে সেরকম অবান্তর একটা প্রশ্ন
-ওটা স্বাভাবিক প্রশ্ন
-না, মোটেও না, আপনি আমাকে অন্ততঃ ওই প্রশ্ন করতে পারেন না
-কেন?
-আপনি ভালো করেই জানতেন কেন আমি আপনার কাছে আসি, আপনার সঙ্গ কেন পছন্দ করি। আপনি জেনেও না জানার ভাণ করতেন
-সত্যি জানতাম না
-বিশ্বাস করি না, আমি সবাইকে সরিয়ে শুধু আপনার কাছে থাকতে চাইতাম...আর আপনি তা জানেন না সেটা কি করে বিশ্বাস করি?
-এখন বিশ্বাস করি, আগে করতাম না
-আপনি একটা ভীতুর ডিম

৫.
জোসেফিন অনেকদিন পর এই শহরে। ওকে নিয়ে আমি কখনো কোথাও বসিনি। সেদিন ওর কালো পোষাকে অপুর্ব লাগছিল। আমি জানি সে আমার জন্য সেজে বসেছিল। সাজলে ওকে অপূর্ব লাগে। ও সাজতে জানে। ওর এত কষ্ট বুকে, তা বোঝার উপায় নাই ওর সাজ দেখে। আমাকে দেখে কি যে উৎফুল্ল হয়েছিল সেদিন, সেটা কেবল আমিই বুঝেছি। সে পারছিল না আমাকে ধরে বসে থাকতে। যদি আর কেউ না থাকতো, তাহলে হয়তো আমাকে আসতেই দিত না।

-না যেতে দিব না, হোক দেরী
-বৃষ্টি আসবে তো
-আসুক বৃষ্টি
-এমন করে বসে থাকলে চলবে?
-আমি কিছু বুঝি না, আপনি বসে থাকবেন, আমি আপনাকে খাওয়াবো, তারপর যাবেন
-অনেক খেলাম তো, এত এত নাস্তা পানি
-না, আরো খেতে হবে, চুপ করে বসেন তো

আমার হাত ধরে বসিয়ে দিল। তারপর সেও বসলো। কাছাকাছি। চোখে চোখ রেখে। কাজল কালো চোখ। মায়াভরা দৃষ্টি। আকুল হয়ে দেখছে। আমি ওর হাত ধরলাম। সে আমার হাত দুটো চেপে ধরলো। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। মনে মনে বললো, এত দেরী করে এলেন কেন? আমি চোখ দুটো ওর চোখে রাখলাম। সে চোখ নামিয়ে আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আমি ওর মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরলাম। এই প্রথম। এই প্রথম জোসেফিনকে আমি বুকে নিলাম। কতো বছর ধরে অপেক্ষা ছিল!!!! টের পেলাম বুকের কাছটা ভিজে যাচ্ছে। জোসেফিন কাঁদছে। অক্ষম কান্না।

আমি জোসেফিনের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললো, আই লাভ ইউ জোসেফিন!
জোসেফিন একটু কেঁপে উঠে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে বলছে, আপনাকে আমি যেতে দেবো না, কিছুতেই দেবো না।

কিন্তু আমি জানি আমাকে উঠতে হবে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে ব্যাঙ ডাকছে তারস্বরে। জোসেফিনদের বাড়িটা নির্জন জায়গায়। আশেপাশে এখনো খোলা মাঠ, ফসলের ক্ষেত, পাহাড় আর বন। আমি এই বন পেরিয়ে হেঁটে রাস্তায় উঠবো। যদি কোন গাড়ি আসে উঠে পড়বো। আমাকে যেতে হবে বহুদুর।

কিন্তু জোসেফিন শক্ত করে ধরে রেখেছে আমাকে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এত বছর পর ওকে পেলাম, এই পাওয়া স্বপ্নের মতো। এখুনি শেষ হয়ে যাবে স্বপ্নটা।

৬.
অনেক রাত। আমার ঘুম আসছে না। খানিক পরেই ভোর হয়ে যাবে। জোসেফিনের কাছ থেকে ফেরার পর থেকে আমার বুকের ভেতরটা সুখের আবেশে ভরে আছে। গত তিন ঘন্টা ধরে অবিরাম স্মৃতির সেলুলয়েড ঘুরিয়েছি। জোসেফিন আর আমার কত কত স্মৃতি। দীর্ঘকালের আনন্দ বেদনার স্মৃতিচারণ। সেও কি ঘুমাতে পারছে না? ফোন করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সাহস হয় না। যদি কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায়! এটা বললে জোসেফিন খুব রাগ করে। ওর কাছে আমার যে কোন সময় ফোন করার অধিকার আছে। যে কোন সময়। তবে কেবল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সুযোগ সীমিত। এটা বলে জোসেফেন হি হি হি করে হাসতে থাকে। জোসেফিনের হাসি আমার বুকে বাজতে বাজতে আমার দুচোখে ঘুম নামিয়ে দেয়। এখন আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবো।

পোস্টটি ৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মীর's picture


ফার্স্ট কমেন্ট Smile

কেমন আছেন নীড়দা'? বহুদিন পর আপনাকে দেখলাম।

এ টি এম কাদের's picture


প্রিয় মীর,
লিখেন না কেন ? লেখার জন্য অনুরোধ করছি,দাবি জানাচছি, কোন কারণে যদি রেগে থাকেন মাফ চাচ্ছি । আমি বয়স্ক মানুষ । অনেক সময় ঘুচিয়ে বা বুঝিয়ে লিখতে পারিনা । এ দিকটাতো কোনসিডার করতে পারেন !

ভাল থাকুন ।

নীড় সন্ধানী's picture


আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? লেখালেখি ছাড়ান দিছেন দেখি Big smile

আরাফাত শান্ত's picture


বহুদিন পর আপনার লেখা পড়ে সকালটা আনন্দময় কাটছে!

নীড় সন্ধানী's picture


অনেক অনেক ধন্যাপাতা শান্ত!
কেমন আছেন? Smile

রায়েহাত শুভ's picture


দারুণ লাগলো নীড়দা...

(দুইবার কপি পেস্ট হয়েছে লেখাটা)

নীড় সন্ধানী's picture


কালকে তো দেখছিলাম একবারই, আজ দেখি দুইবার Shock
অনেক ধন্যবাদ শুভ! Smile

শওকত মাসুম's picture


দারুণ, অনেকদিন পর নীড়দা।
(কপি দুইবার হইছে, যদিও দুইবারই পড়তে ভাল লাগছে Smile )

নীড় সন্ধানী's picture


দুইবার কেমনে গেল! দিলাম তো একবারই Shock
একমন ধন্যাপাতা নেন শুদ্ধিকরনের জন্য Laughing out loud

১০

টোকাই's picture


অনেক সুন্দর লেখা। বেশি ভাল লেগেছে।

১১

নীড় সন্ধানী's picture


মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ টোকাই। ভালো থাকুন Smile

১২

টুটুল's picture


সিরাম হইছে বস

ম্যালাদেন বাদে Smile

নীড়দা পাত্থর Smile
ক্যামন আছেন বস?

১৩

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


দারুণ একটা লেখা পড়লাম। আপনার কাছ থেকে আরও বেশি লেখা আশা করি। ভাল থাকবেন।

১৪

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


চমৎকার লেখা।

আরেকটু নিয়মিত লেখা যায় না? Sad

১৫

সাঈদ's picture


যথারীতি সিরাম লেখা। অনেক দিন পর দেখলাম ।

১৬

তানবীরা's picture


চার আর পাচ দুইবার পড়েছি Big smile

১৭

জ্যোতি's picture


আসলেই নীড়দা পাত্থর। আরেকটু বেশী কেন লিখেন না? খুবই অন্যায়
দারুণ একটা লেখা পড়লাম।

১৮

মীর's picture


মাথা খারাপ করে দেয়ার মতো দারুণ একটা লেখা!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নীড় সন্ধানী's picture

নিজের সম্পর্কে

ভুল ভূগোলে জন্ম নেয়া একজন অতৃপ্ত কিন্তু স্বঘোষিত সুখী মানুষ!