ইউজার লগইন

আমাদের ক্যালকুলাস

নানুর বাসা বলতে বেশীর ভাগ মানুষের হয়তো গ্রামের বাড়ি, মেঠো পথ, চারদিকে সবুজে ঘেরা সুন্দর কোন প্রকৃতির কথা মনে পড়ে। কিন্তু আমার কাছে নানুর বাসার কথা মনে হলে কোন সুন্দর প্রকৃতি, চাঁদের নরম আলো গায়ে মাখা কিংবা মজার কোন খাবারের কথা মনে পড়েনা। আমার কেবলই মনে পড়ে একটি মুখ। খুউব সুন্দর দেখতে একটি মুখ। যে মুখটি এই ইট, পাথর, সিমেন্টে ঘেরা জরাজীর্ণ ঢাকা শহরের একাকীত্ব গায়ে মেখে সারাক্ষণ শুধু আমাদের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতো। মাফ করে দিও নানু আমাকে। যে তুমি আমাকে এতো বড় করেছো সেই তোমার বৃদ্ধ বয়সে তোমার জন্য আমার হাতে কোন সময় ছিলোনা।

আমি আর অবন্তী, দুই বোন। তমা আমাদের মামাতো বোন। আমাদের মায়েরা তিনজনকে নানুর কাছে রেখে চাকরিতে যেতো। তখন আমার ছোট মামাও বেশ ছোট। আমরা চারজন দুষ্ট বাচ্চা সারাদিন কী যে যন্ত্রণা নানুকে করতাম! অথচ সে হাসিমুখে আমাদেরকে বড় করার কাজটি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে করে গেছে। কোনদিন একটা ধমক কাউকে দিয়েছে বলে কখনো মনে পড়েনা। ছোটবেলায় আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো, “তোমরা কয় ভাই বোন?” আমি খুব আত্নবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিতাম, “তিন বোন এক ভাই। আমি, তমা, অবন্তী আর মামা”। কেউ যদি বলতো, “তোমার মা কই?” আমি নানুকে দেখিয়ে বলে দিতাম, “ঐ যে ঐখানে”।

সারাদিন আমরা ছাদের উপর খেলতাম আর গায়ে ময়লা লাগতো। নানু গোসলের সময় আমাদের একেকজনকে একেকবার জোর করে টেনে নিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকিয়ে কোন কথা নাই বার্তা নাই ধুন্দলের ছোবার উল্টা পাশে সাবান লাগিয়ে কোন পানি ছাড়াই গায়ে ঘষা শুরু করতো। আমাদের তখনকার সেই গগনবিদারী চিতকার শুনে নানু বলতো, “গা ভর্তি সাতা আর সাতা। এইভাবে না ঘষলে কি সাতা যায়? ফর্সা শরীরগুলো সাতার ঠ্যালায় কালো দেখা যাচ্ছে”। এখানে, সাতা প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি। সাতা শব্দের অর্থ হচ্ছে “ময়লা”। এটা নানুর নিজস্ব ব্যবহৃত শব্দ। নানুর একটা অভ্যাস ছিল, সে বিভিন্ন রকম শব্দ তৈরী করে একেকটা কথা বলতো। যে শব্দগুলোর আক্ষরিক কোন অর্থ ছিলোনা। কিন্তু তিনি সিচুয়েশন অনুযায়ী শব্দ তৈরী করে সেটা বলতেন আর আমরা সেটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করতাম। পরবর্তীতে তার এই অভ্যাসটা আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। আমি নিত্যনতুন একেকটা অর্থহীন শব্দ বানাই যেটা শুনে মানুষ খুব মজা পায়। এখন আবার গোসলের প্রসঙ্গে আসি। যদিও আমরা কেউই অতো ফর্সা ছিলামনা যেরকম ফর্সা নানু আমাদেরকে মনে করতো। বরং গোসলটা ছিলো আমাদের চারজনের জন্যই ভয়ংকর একটা ঘটনা। সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়লে এখনো আমি একা একা হাসি। নানু, তোমাকে যেদিন শেষবারের মতো গোসল করানো হলো আমি তোমাকে দেখছিলাম আর আমাদের সেই গোসলের কথা মনে পড়ছিলো।

নানুর যখন বয়স বাড়তে শুরু করলো তখন তিনি কানে কম শোনা শুরু করলেন। এইজন্য আমরা তিন বোন আর মামা, নানুকে টিনটিন সিরিজের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্যালকুলাসের নামে ডাকা আরম্ভ করলাম। ততোদিনে আমরা চারজনই বড় হয়ে গেছি আর টিনটিনও আমাদের খুব প্রিয়। নানুতো কখনো টিনটিন পড়েনি তাই ক্যালকুলাস নামে ডাকলে খুব রাগ করতো। ভাবতো, কথা শুনতে পাচ্ছে না বলে আমরা বোধ হয় রাগ করে তাকে বকা দিচ্ছি। আসলে ক্যালকুলাস যে আমাদের কি ভীষণ প্রিয় সেটা নানুকে বোঝানোর সাধ্যি কার!

নানুর মতো মানুষ আমি দেখিনি। উনার পড়ালেখা খুব বেশী ছিলোনা কিন্তু উনার চিন্তা ভাবনা, মন- মানসিকতা যেরকম ছিলো তা আমি পড়ালেখা জানা শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও দেখতে পাইনা। তিনি ছিলেন অসম্ভব রকমের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। যে কিনা এতো বড় পরিবারটা একা সামলাতেন। নাতী- নাতনীদের সাথে কখনোই তিনি অশ্লীল কোন শব্দ ব্যবহার করে ঠাট্টা- মশকরা করতেন না, যেটা আমার অন্যান্য নানু- দাদু পর্যায়ের লোকজন খুব অবলীলায় করে থাকেন। আমার ছোট খালা কিছুদিন আগে একজন আমেরিকানকে বিয়ে করেন। আমার আম্মু, খালামনি, মামা সবাই এটা প্রথম দিকে তার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলো। যদি তিনি বিষয়টা সহজভাবে মেনে নিতে না পারেন এই ভয়ে। পরে যখন তিনি জানতে পারলেন, আমি দেখলাম কী সুন্দরভাবে তিনি বিষয়টা গ্রহন করলেন আর বললেন, “আমার ছেলে- মেয়েরা যাকে নিয়ে যেভাবে খুশী আমিও তাকে নিয়ে সেভাবে খুশী”। কথাটা শুনে আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম আর ভাবলাম, কিভাবে পারো নানু তুমি এরকম কথা বলতে? কই, আমিতো এতো চেষ্টা করেও তোমার মতো হতে পারিনা! তোমার মতো করে ভাবতে পারিনা! তোমার কাছেই প্রথম শিখেছি, “যে তোমাকে সম্মান করেনা মনে করবা সে তোমাকে কখনো ভালোবাসে নাই”।

শেষবার যখন তুমি হসপিটালে ভর্তি হলে খুব শরীর খারাপ ছিল তোমার। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। এর মধ্যেই তুমি আমাকে দেখে, তোমার সেই সুন্দর হাসিটা হেসে নার্সকে বলছিলে, “এই যে দেখো আমার বড় নাতী চলে আসছে এখন আমার আর তোমাদের কাউকে দরকার নাই”। তোমার কথা শুনে নার্সসহ আমিও হেসে ফেললাম। আর আমার হাসি দেখে তুমি কী খুশী! সেই দৃশ্য আমি আজো যে ভুলতে পারিনা নানু। তোমার সেই হাসি তো আমি কোটি টাকার বিনিময়েও আর কিনতে পারবোনা। আমার জীবনের বিনিময়েও যদি আমি তোমার সেই হাসিটা আর একবার দেখতে পেতাম তাহলে আমি তাই করতাম, জানো? তোমার একটা ম্যাক্সি আমার কাছে আছে। যেখানে তোমার গায়ের গন্ধ এখনো লেগে আছে। আমি প্রতি রাতে ঘুমাবার আগে একবার সেই ম্যাক্সি থেকে তোমার গায়ের গন্ধ নিয়ে তারপর ঘুমাতে যাই। তখন না চাইতেও কেন আমার চোখে রোজ পানি চলে আসে? তুমি যখন সারাদিন একা থাকতে তখন তোমাকে দেখার জন্য আমার কক্ষনোই সময় হতোনা। আর এখন যে কোনদিন যে কোন সময় তোমার কথা মনে হলেই আমি কবরস্থান চলে যাই তোমাকে একটু দেখার জন্য। এখন আমার প্রচুর সময় কিন্তু আমি এখন আর তোমাকে দেখতে পাইনা।

তুমি কি জানো নানু, তোমার অনেক কিছু খুব ধীরে ধীরে আমার মধ্যে চলে এসেছে। তুমি ডাল খেতে খুব ভালোবাসতে আমিও ডাল খেতে ভালোবাসি। তুমি মজা করে চা বানাতে আমিও খুব মজা করে এখন চা বানানো শিখেছি। তুমি খুউব ঝাল খেতে আমিও এখন অনেক ঝাল খেতে পারি। আমি একটু রাগ করলেই আম্মু বলে, আমি নাকি তোমার মতো জেদ পেয়েছি। আমার চুলে হাত দিয়ে আম্মু সারাক্ষন বলে, আমি নাকি তোমার মতো চুল পেয়েছি। কিন্তু আমি জানি, আম্মু সারাক্ষন তোমার সাথে আমাকে মিলিয়ে আমার মধ্য দিয়ে তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করে। তুমি যেভাবে সবার সাথে মিশে চলতে পারতে, সবাইকে নিয়ে চিন্তা হতো তোমার, সবাইকে ভীষণ ভালোবাসতে আমি সেগুলো একদম পারিনা নানু।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমরা যে প্রত্যেকটা মানুষ তোমাকে এতো বেশী মিস করছি সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো? সবাই আমাকে বোঝায়, বয়স হয়ে গেছে, এখনতো এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার যে মন মানেনা। আমার শুধু মনে হয়, আজকে যদি তুমি বেঁচে থাকতে আর আমি যদি তোমাকে জড়িয়ে ধরে খানিক্ষন কাঁদতে পারতাম তাহলে মনে হয় আমার সব কষ্ট চলে যেতো। ঠিক ছোট্টবেলার মতো যখন আম্মু বকা দিলে বা মারলে তোমার বুকে এসে লুকাতাম আর কাঁদতাম। আর তুমি কী সুন্দর করে গল্প বলে সব কষ্ট ম্যাজিকের মতো হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে। গোবিন্দর নাচ তুমি পছন্দ করতে বলে আগে আমরা কত হাসতাম তোমাকে নিয়ে! আর এখন আমি গোবিন্দর নাচ দেখতে পারিনা। দেখলে তোমার কথা মনে পড়ে আর কষ্ট হয়, তাই আমি চ্যানেল বদলে দেই।

আমি তোমাকে খুব খুব বেশী মিস করছি নানু। কী করা যায় বলতো?

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


মন খারাপ হয়ে গেলো!

প্রিয়'s picture


আমারতো কবে থেকেই মন খারাপ Sad

জাকির's picture


করার কিছুই নেই। সম্ভবের ভিতর আছে শুধু মন ভরে দোয়া করার সাধ্যটা।

প্রিয়'s picture


হুমম সেটাই।

ফাহিমা কানিজ লাভা's picture


সমবেদনা জানাচ্ছি। আমার দাদুকেও মিস করি, আপনার লেখা পড়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

প্রিয়'s picture


ছোটবেলার এই স্মৃতিগুলো কখনো ভোলার না। Smile

জ্যোতি's picture


ছোটবেলার কত কথা যে মনে পড়লো! চোখ ভিজে যাওয়া লেখা। আমাকে নানু বাড়িতে রেখে আমার মা স্কুলে যেতো। নানু-নানার কাছেই কেটেছে শৈশব। কত যে স্মৃতি। কত যে মধুর স্মৃতি! আজ এত আদর নিয়ে কেউ নেই, কখনো আর এমন কেউ থাকবে ও না। খুব মনে পড়ে মাঝে মাঝেই। তখন মনে হয় বয়স বাড়ছে বলেই বোধ হয় ছোটবেলার এই মানুষগুলোকে মনে পড়ে কান্না পায় এত।

নাজনীন খলিল's picture


টিপ সই

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

প্রিয়'s picture

নিজের সম্পর্কে

নিজে লিখার চেয়ে অন্য সবার লিখা পড়তেই বেশী ভাল লাগে।