সভ্যতা Vs বর্বরতা
মেয়েটার নাম পরী। দেখতে সুন্দর বলে তার মা খুব শখ করে এই নাম রেখেছিলেন। কিন্তু গরীব ঘরে জন্মানো মেয়েদের রূপ থাকতে নেই। এই রূপই তার কাল হয়ে দাড়াঁলো। দিনের পর দিন অভাবের তাড়ণায় ভুগতে থাকা হতভাগ্য এই পরিবারটি সিদ্ধান্ত নিল মেয়েকে ঢাকায় কাজে পাঠাবে। তার বাবা গ্রামের এক প্রতিবেশী মহিলার সাথে কথা বললেন পরীকে ঢাকায় কাজ খুঁজে দেয়ার ব্যপারে। এই মহিলা নাকি এর আগে আরো অনেক মেয়েকে ঢাকায় কাজ দিয়েছে। সেই মেয়েদের পাঠানো টাকাতে গ্রামে তাদের পরিবার এখন ভালভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারছে। পরী ঢাকায় যাবে শুনে মহিলা খুব খুশী হয়ে বললো, ও যে মেয়ে তাতে ও আরো অনেক বেশী টাকা পাঠাতে পারবে। পরীর বাবা এই কথা শুনে খুশী হয়ে বাড়ি ফিরলো।
খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরীর কাজে যাওয়ার সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। তার বয়স তখন মাত্র ১৫। পরী কাজে গেল ঠিকই। কিন্তু কাজের জায়গা ঢাকা নয়, টাঙ্গাইল যৌনপল্লী। মহিলাটি তাকে মাত্র দুই হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে বাড়ি ফিরে গেল।
পতিতাবৃত্তিকে সমাজ স্বীকৃতি দেয়না। আইনেও রয়েছে এই পেশা সম্পর্কে নানা ধরণের জটিলতা। যেসব মেয়ে এই পেশায় রয়েছে তাদের আমরা বলি “নষ্টা”। আমাদের সমাজের “সো কলড” ভাল মেয়েদের থেকে তাদের অনেক পার্থক্য। কেননা “সো কলড” ভাল মেয়েরা যা করে তা গোপনে করে যেটা বাইরের কেউ জানতে পারেনা আর এই “নষ্টা” মেয়েগুলো যা করে তা সবার সামনে করে, সেখানে কোন রাখঢাক থাকে না। আর সমাজ? সে তো গোপনীয়তা পছন্দ করে। তাই এই “নষ্টা” মেয়েদের সাথে যা খুশী তাই করা যায়। যা খুশী তাই।
এই সমাজ নেশাখোর, সন্ত্রাসী, খুনী, ঘুষখোর, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদেরকে ঘৃণার চোখে দেখেনা। এমনকি ঘুষখোর বা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদেরা সমাজে অনেক সম্মানীত ব্যক্তি। কিন্তু যে মেয়েগুলো তাদের সম্মান, শরীর, রক্ত, মাংসের বিনিময়ে টাকা উপার্জন করে তাদের বলে “নষ্টা”। কেন? তারা মেয়ে, তাই? মেয়েরা “সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট” উপাধিতে ভূষিত হয়েছে আরো অনেক আগেই। তার উপর এরা তো অনেক বেশি “মার্জিনালাইজড”। অথচ যারা এই “নষ্টা” দের কাছে যাচ্ছে তারা কিন্তু কখনো “নষ্ট” হচ্ছেনা। বরং তারা সমাজের সিংহ পুরুষ।
এই সিংহ পুরুষদের হঠাৎ করে মনে হয় শহরে কোন যৌনপল্লী থাকলে ঘরের ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী এমনকি নিজেরও নৈতিক অবক্ষয় ঘটতে পারে। সেজন্য সমাজকে বাচাঁনোর মহান উদ্দেশ্য থেকে তারা যৌনপল্লী উচ্ছেদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এরই ধারাবাহিকতায় অযাচিতভাবে চলে “যৌনপল্লী উচ্ছেদ”। ঠিক একই ভাবে কিছুদিন আগে বহুকাল পুরনো “টাঙ্গাইল যৌনপল্লী” উচ্ছেদ অভিযান চললো। “টাঙ্গাইল অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানারে একটি দল যৌনপল্লীতে গিয়ে সবাইকে তিন ঘন্টা সময় দিয়ে ঘর ফাঁকা করতে বলে। কিন্তু এতে কোন কাজ না হলে, তারা আবার সেখানে যায় এবং বাড়ির মালিকদের বলে, যদি তিন ঘন্টার মধ্যে তাদের ঘরগুলো ফাঁকা করে না দেওয়া হয়, তাহলে সবাইকে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা হবে। উচ্ছেদের আগেই সেখানকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এর পরপরই প্রাণভয়ে রাতের অন্ধকারে একে একে ঘর ছাড়তে থাকেন এই পল্লীর যৌনকর্মীরা। এদের মধ্যে অনেকেই ছোট শিশু নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এখন প্রশ্ন হল, এই উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে কি সম্ভব বাংলাদেশের পতিতাবৃত্তি নির্মূল করা? এই শিশুগুলো কোন অপরাধের কারনে রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে রাস্তায় পড়ে আছে?
যেহেতু নিজেকে একজন “উন্নয়ন কর্মী” বলে দাবি করি, তাই গিয়েছিলাম টাঙ্গাইলপল্লীর মেয়েদের এখন কি অবস্থা সেটা সরেজমিনে দেখার জন্য। আমাদের অনেক কাজ ছিল এই মেয়েদেরকে নিয়ে। তাই এখানে আমি আগেও গিয়েছিলাম। ওখানে যেয়ে দেখলাম ভাঙ্গাচোড়া এক পল্লী। যেখানে দূর- দূরান্ত পর্যন্ত কোন মানুষ নাই। মানুষের জীবন কত কষ্টের হতে পারে সেদিন ঐ মেয়েগুলো আর ওদের ছোট বাচ্চাগুলাকে না দেখলে হয়তো বুঝতে পারতাম না। একটু পর পর পড়ে থাকা লুব্রিকেন্ট জেল আর ছেঁড়া কনডম থেকে ওদের হাহাকার ভেসে আসছিলো।
একদিন মিরপুর যাওয়ার পথে ফার্মগেটে অনেকক্ষণ জ্যামে পড়েছিলাম। দেখলাম, একটি ছোট্ট শিশু, বয়স বারো কি তেরো হবে। তার মা তাকে নিয়ে একজন বয়ষ্ক লোকের সাথে দর কষাকষি করছে। মেয়েটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাপঁছে আর ডুকরে কেঁদে চলছে। লোকটা কিছুতেই দুইশ টাকার বেশী দিতে রাজি হচ্ছে না আর মা’টা আরেকটু বেশী টাকা দাবি করছে কারণ মেয়েটা ছোট। সেদিন ঐ শিশুটির সাথে সাথে আমিও কি কেঁদেছিলাম?
আমার বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে পারছিনা, পারছিনা ট্রাফিকিং বন্ধ করতে, আমরা পারিনা আমাদের মেয়েগুলোকে ভোগের পণ্য হিসেবে না দেখে সম্মান দিতে, আমরা পারিনা রাস্তায় বেড়ে উঠা মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, পারিনা ছিন্নমূল এই শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা দিতে। অথচ “সো কলড ভদ্র” পরিবারের ছেলে মেয়েরা বিত্তের বৈভবে থেকে বাংলা ভাষাকে ঠিকমতো উচ্চারণ করাটাকে মনে করে আনস্মার্টনেস। এই দায় কার?
টাঙ্গাইলের মেয়েগুলোর কথা বলছি কারণ কাজের সুবাদে ওদের অনেককেই আমি চিনি। ওরা যদি বাইরে কোথাও কখনো আমাকে দেখতো এমন ভাব করতো যে আমাকে চেনেনা, কখনো দেখেনাই। এটা ওরা নাকি আমার সামাজিক স্ট্যাটাসের(!) কথা চিন্তা করেই করতো। আর আমি যখন ওদের ওখানে যেতাম, তখন আমি ওদের “প্রিয় আপা”। জানিনা, ওরা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে।
মেয়েগুলো আবেগের বশবর্তী হয়ে আবার তাদের পুরনো জায়গায় ফিরে আসতে চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওরা এখানে আসলে বেত্রাঘাত করা হবে। ওরা যে “নষ্টা”! ওরা গোটা সমাজকে কলুষিত করছে। একটা স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এটাই ওদের প্রাপ্য! ওদেরকে সাহায্য করার জন্য মিডিয়ার যেরকম সমর্থন আমরা চেয়েছিলাম তা পাইনি। কেননা, বেশীরভাগ মিডিয়াই এখন সরকারের বিরুদ্ধে এই বিষয়ে কোন স্টেপ নিতে চায়না। জনৈক সাংবাদিকের কাছে আরো হাস্যকর যে কথাটা শুনলাম তা হল, মিডিয়া কি প্রেশার গ্রুপ নাকি?
মেয়েরা আবার তাদের পুরানো আবাসস্থলে ফিরে আসতে চাইলে তিনশ’ জন হুজুর রেডি হয়ে গেছে জুমআর নামাজের পর ওদের মারার জন্য। আমরা যখন এই খবর পাই তখন সত্যি নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। একজন মানুষ হিসেবে, একজন নারী হিসেবে আমি লজ্জিত। কারন আমি জানি, ওদের জন্য আমরা কিছুই করতে পারবোনা। এই মেয়েগুলো যখন বিপদে পড়ে বার বার ফোন দেয়, তখন ওদেরকে সাহস এবং সান্ত্বনা দেই ঠিকই কিন্তু মনে মনে বলি, “ক্ষমা করে দিও পরী, আমি তোমার জন্য সুন্দর একটি পরীর সাম্রাজ্য এনে দিতে পারলাম না। এই ব্যর্থতার দায় শুধুই আমার”।
এইসব ব্যর্থতা সব আমাদেরই
এই পুরুষেরাই তো কুকুর, কুকুরে মুখ দিলে পাত্র যদি ভেলে দিতে হয় সে দায় কি পাত্রের নাকি কুকুরের। এই কুকুরগুলিকে আগে শুয়োর হতে হবে ,তারপর হবে অন্যান্য ঘৃণ্য প্রানী এরপর বিবর্তনের সূত্র ধরে যদি মানুষ কখনও হতে পারে।
কি আর বলবো আপু?
আপনার লেখাটা হৃদয়ের খুব গভীরে কোথায় যেন আঘাত করল
মন্তব্য করুন