`ঝরা পাতার গান ' শেষ পর্ব
সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে আর কাঁদতে কাঁদতে উত্তরের বালুপথ আর নদীর তীর ধরে পদ্মা নদীর তীরে এসে বসলাম। গোদারা ঘাটের মাঝিরা আমার বাবাকে, আমাকে চেনে। তিন পুরুষের যাতায়াত এ নদী দিয়ে। পদ্মা বিধৌত উর্বর মাটির সন্তান আমি এবং আমার পূর্ব পুরুষ। এ নদীকে কেন্দ্র করে এর কাছাকাছি শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও বিক্রমপুর-এ হাজার বছর ধরে আমাদের পিতৃগণ ও মাতৃগণের বসবাস। আমার জন্মস্থান বিক্রমপুরের লৌহজং-এ। নদী পার হয়ে দিঘলী বাজারে এসে কিছু চিড়া-মুড়ি খেয়ে কদম বাবার মেলায় চলে এলাম। কদম বাবার মেলা শীত প্রকৃতির আরেক অকৃত্রিম রূপ। নানা জাতের মাঘের পাগল এখানে এসে মাস খানিক ভীড় করে গান করে। ব্যবসায়ীরা আর ভক্তরা খুশী থাকলে এ মেলা সাত থেকে দশ দিন পর্যন্ত চলে। নানা রকমের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা। নানা স্বাদের মুড়ী, চিড়া, খইয়ের মোয়া, সন্দেশ, নাড়ু, বাতাসা, কদমা, মিষ্টি খই, চিনি মাখানো ছোট ছোট গোল মিষ্টি, নিমকী, গজা কত না স্বাদের, গন্ধের খাবার। মাঘ মাসের শীতের মেলায় মানুষের ভীড়ে একটুও শীত লাগে না। ছোট্ট বেলায় তাই আগুন না জ্বালিয়ে উষ্ণতার জন্য মেলায় চলে যেতাম।
বিপদ-আপদ-মঙ্গল-রোগ মুক্তি-পরকাল কামনায় শরৎ-হেমন্তের গ্রাম্য বাংলার শাশ্বত সাংস্কৃতিক রূপের সাথে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে শুরু হয় নানান পাগলের মেলা, পীর-মুর্শীদের ওরস, ওয়াজ মাহফিল। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-পথ-আঙ্গিনা-ঘর-গোলা। মুসলমানরা প্রথম ফসল দিয়ে মাজার, দরগায় শিন্নি দেয়; কেউবা কোন কিছু পাবার আশায়, কারো রোগ মুক্তি কিংবা মঙ্গল কামনায় পীর-মুর্শীদ বা পাগল বাবার জন্য প্রথম ফসল মানত করে রাখে। গাঁয়ের কোন কোন বাড়িতে ‘ক্ষেতের বত্ত’ পূজা শুরু হয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ভাগ্যলক্ষ্মী কার্তিক-অগ্রহায়ণের কাঁধে চড়ে পৌষ-মাঘে ঘুরে বেড়ায়, মাঠ-ঘাট শস্য শ্যামলায় ভরে দেয়। আর তাইতো, সনাতন জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য ধর্ম জাতির মধ্যে অসীম রহস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নিজেদের তৈরী বিশ্বাসের মিথগুলোকে গড়ে তোলে নিজেদের মতো করে।
কোন কোন স্কুলে শুরু হয় বার্ষিক-ক্রীড়া অনুষ্ঠান। বড় রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়ে মাইক বাজিয়ে কোন স্কুলের শিক্ষা সফর অথবা কোন ক্লাব, সংঘের সদস্যরা বনভোজনে ছুটে চলে--নাচে, গানে, আনন্দে আত্নহারা হয়ে। ঘন কুয়াশায় দিনের বেলায়ও হেড লাইটের আলোয় গাড়ী চলে শহরে। সচ্ছল মানুষেরা দেহের উপর আরামের বোঝা চাপিয়ে অথবা নানা রংয়ের টুপি, জ্যাকেট, হাত মোজা, পা-মোজা, কোট-টাই পরিধান করে শীতকে হাসি দিয়ে মুখে বরন করে। অসচ্ছল, দরিদ্রদের হয় একটি চাদর, নয়তো একটি জামা, কারো মাফলার থাকে, কারো টুপি, কেউবা একটি লুঙ্গী গায়ে দিয়ে আরেকটি ছিঁড়া লুঙ্গী গায়ে জড়ায়ে রাখে--এরা সর্বদা আগুনের কাছে থাকতে চেষ্টা করে অথবা হাড় কাঁপানো শীতে ফুটপাতে কুড়ানো কাগজ পুড়ায়ে উষ্ণতা অনুভব করে। তাই মনে হয়-এ শীত যেন মানুষের হাতে গড়া এ বুর্জোয়া সমাজে বিত্তবানদের জন্য পোশাক প্রদর্শনী আর নিঃস্বদের জন্য সহিষ্ণুতার অগ্নিপরীক্ষা। শহরে কাজে আসলে কবি জসিম উদ্দিনের কবিতা মনে পড়ে, ‘‘তুমি যাবে ভাই--যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়ে...।’’
শীতের বনতল; শীতের সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা; শীতের জোৎস্না রাত্রির চাঁদ, দিনের সূর্য; শীতের নির্জনতা আর স্থান কাল-পাত্র ভেদে সৌন্দর্যেয় বৈচিত্রতা; নির্জন আকাশতলে দিগন্তব্যাপী কত রুপে, কত সাজে যে শীত কন্যা সাজে, এ বাংলার প্রকৃতিতে। সৌন্দর্য পিয়াসীর চোখ অথবা কবির মন হারিয়ে যায় বারে বারে প্রকৃতির নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওর-মাঠে-ঘাটে অথবা অন্য কোথাও, কোন কুয়াশার বাঁকে। মনে প্রশ্ন জাগে, হে শীতকন্যা, অনার্য যুগে অথবা যখন আর্যরা এদেশে এসেছিল তখন কি তুমি এ রকম ছিলে; চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে, গ্রীক সম্রাট সেলুকাসের দূত মেগাস্থেনিস ভারতে থাকা কালে; অতীশ দীপংকরের সময়ে, লক্ষন সেন, মোঘল আমলে অথবা নিকট অতীতে?
আমি বিস্মিত ! কে তুমি সৃষ্টি করেছ এ প্রকৃতিকে? সাজায়েছ এ ঋতু নানা বৈচিত্রে? করেছ আমায় স্ত্রীহারা, ছন্নছাড়া বাউল--আমি সৌন্দর্যের শাশ্বত ধারায় অবগাহন করি অবলীলায়। কেন সারাটা দিন তোমার পিছু ছুটে চলি--আমি জানিনা, হে প্রকৃতি। কেন এত পাগল করে মন তোমার জন্য, হে শীত কন্যা--আমি জানি না।
আপনাকে ধন্যবাদ,
চমৎকার একটা সিরিজ গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
ভাল থাকুন।
সেইরম একটা সিরিজ শেষ হইলো
ধন্যবাদ
আপনাকে ধন্যবাদ,
চমৎকার একটা সিরিজ গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
ভাল থাকুন।
মন্তব্য করুন