'অপরাজেয় বাংলা'- একটি ছোটখাটো অসামান্য তথ্যচিত্র
'অপরাজেয় বাংলা' তিনজন মুক্তিযোদ্ধার এই ভাস্কর্যটি সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত ভাস্কর্য। ফার্স্টএইড বাক্স হাতে সেবিকা, সময়ের প্রয়োজনে রাইফেল কাঁধে তুলে নেয়া গ্রীবা উঁচু করে ঋজু ভঙ্গিমায় গ্রামের টগবগে তরুন এবং দু'হাতে রাইফেল ধরা আরেক শহুরে মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধের রূপক এই ভাস্কর্যটি চিনলেও এর ইতিহাস কতজন জানে? কত অজানা তথ্য আছে এই মুর্তি তিনটি ঘিরে সেটা আজ প্রথম জানলাম আমাদের পরিচিত ব্লগ বন্ধু সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল ভাইয়ের তৈরী তথ্যচিত্র 'অপরাজেয় বাংলা' দেখে। হেলাল ভাই ব্লগ লিখেন 'লাল দরজা' নামে। দেশের বাইরে থাকেন, মাঝেমাঝে দেশে আসেন তার চিত্র নির্মানের কাজে। এর আগেও উনার তৈরী দুইটা তথ্যচিত্র দেখেছি 'আনিকার বাড়ি' এবং 'সিনেম্যানিয়া', তবে 'অপরাজেয় বাংলা' একেবারেই অনবদ্য, এটি খুবই তথ্যবহুল একটি প্রামান্যচিত্র।
১৯৭৩ এ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭৯ সালে, এর মাঝে যে কত ঝড়ঝাপটা গিয়েছে এই ভাস্কর্যটি ঘিরে সেটা কখনও কারো কাছে শুনিও নাই, কোথাও পড়িও নাই (আমার এই লেখাটা তৈরি করার সময় উইকিপিডিয়ায় সার্চ দিয়ে দেখলাম সেখানে ভাস্কর্যটির ছবি ছাড়া আর কিছুই নাই)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে যেখানে 'অপরাজেয় বাংলা' দাড়িয়ে আছে ঠিক সেইখানে আরেকটি ভাস্কর্য ছিলো যেটা যে কোন কারনেই হোক ভেঙে ফেলতে হয়েছিল, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ সেখানে আরেকটি ভাস্কর্য তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভাস্কর্য নির্মাতা সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ কাজটি পান, ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক তখন ম. হামিদ। তিনজন মডেল নির্বাচন করে প্রথমে একটি তিনফুট উচ্চতার কাদামটি দিয়ে অপরাজেয় বাংলার প্রতিরূপ তৈরি করা হয়। সেই প্রতিরূপ তৈরিতে যারা মডেল হয়েছিলেন তাদের মুখ থেকে তখনকার ঘটনা শুনে বোঝা যায় কতটা কষ্টসাধ্য ছিলো সেই কাজ। এরমধ্যে একজন মডেল মূল অপরাজেয় বাংলা তৈরির সময় সহকারী হিসেবেও ছিলেন।
কলাভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলা তৈরির কাজ যখন শুরু হয় তার কিছুদিন পরেরই ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ড হয় এবং সাথে সাথে পুরো দেশের পরিস্থিতি একেবারেই উল্টে যায়। তখন এটির কাজও থেমে যায়। এখানে এসে বেশ চমকপ্রদ একটি তথ্য জানতে পারলাম সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্মির কিছু ট্যাংক সহ অবস্থান নেয় এবং একটি ট্যাংক কলাভবনের সামনে আংশিক নির্মিত 'অপরাজেয় বাংলা'র দিকে নল তাক করে অবস্থান নেয়। সেই সময় এটির সহকারী ভাস্কর এবং এটির মডেল বদরুল আলম বেনু সাধারন জনতা হিসেবে সেখানে যায় এবং শুনতে পায় সেখানে অবস্থান নেয়া আর্মিরা এটি ভেঙে ফেলবে কিনা সেই বিষয় নিয়ে আলাপ করছে এবং সেই আর্মি অফিসাররা উর্দুতে কথা বলছিলো (জ্বী, সেটা ১৯৭৫ সালের কথা বলছি), জনাব বেনু ধারনা করেন এরা পাকিস্তান ফেরত বাঙালী আর্মি অফিসার ছিলো (আমার এখানে খুবই আগ্রহ হচ্ছিলো এই অফিসাররা কারা ছিলো যদি জানা যেত!)।
সেই পঁচাত্তর পরবর্তি সময়েই পাকিপন্থী ছাত্ররা ইসলামের দোহাই দিয়ে নির্মিত অপরাজেয় বাংলা ভেঙে ফেলার দাবী তোলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি ভেঙে ফেলার সমর্থনে সাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে, সেই সময় এই সব সারমেয় ছানাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধরে ডলা দেয় এবং কান ধরে ওঠবোস করায়। সেই সময় বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে ইসলামি জনতা (অনুমান করা যায় এরা কারা ছিলো) কোন এক বাদ জুম্মা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অপরাজেয় বাংলা গুড়িয়ে দেয়ার ঘোষনা দেয় এবং সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও তখন এইট প্রতিহত করার জন্য তৈরি হয়। সে সময় প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি গিয়ে অনুরোধ করেন কিছু একটা ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য এবং পুলিশ গিয়ে সেদিন ইসলামিক জনতাকে বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে যেতে দেয় নি নইলে হয়তো বিরাট এক সহিংসতা ঘটে যেত সেদিন।
এর অনেকদিন পর ১৯৭৮ সালে আবার ভাস্কর্যটির কাজ শুরু হয়, তখন আমরা দেখতে পাই সদ্য প্রয়াত মিশুক মুনির কে, তিনি তখন একেবারেই টগবগে তরুন ক্যামেরা নিয়ে টুকটাক ছবি তোলা শুরু করেছেন, শিখছেন, নির্মিত অপরাজেয় বাংলাকে তিনি তার ফটোগ্রাফির বিষয় হিসেবে নেন এবং নিয়মিত বিভিন্ন সময় এটির ছবি তুলেন পরবর্তিতে যে ছবিগুলো তথ্যভান্ডার আরো সমৃদ্ধ করে।
এই 'অপরাজেয় বাংলা' ১৯৭৫ সালে যারা ভাঙতে চেয়েছিলো কিন্তু ভাঙতে পারে নি, তারাই কিন্তু ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে নির্মিত লালন এর ভাস্কর্য দড়ি বেঁধে টেনে হিচড়ে ঠিকই গুড়িয়ে দিয়েছে ২০০৮ সালে। মতিঝিলে বলাকা ভবনের সামনে ভাস্কর্য 'বলাকা'র গলায়ও দড়ি বেঁধে টেনে নামাতে না পাড়লেও পাখিগুলোর পা ভেঙে দিয়েছিলো এবং সেই সময় অপরাজেয় বাংলা গুড়িয়ে দেবার সেই পুরনো হুমকি আবারো দেয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য সেই হুমকি-ধামকির সময় কিছু ব্লগার ঢাকা এয়ারপোর্টের সামনে লালনের গুড়িয়ে দেয়া ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান কর্মসূচি করেছিলো। আরো একটা কাজ করেছিলো চারুকলার গুটি কয়েক তরুন ছাত্র, তারা অপরাজেয় বাংলা আবার নতুন করে তৈরি করেছিলো এবং সেটি নিয়ে বিজয় দিবসে রাস্তায় নেমেছিলো প্রতিবাদ স্বরূপ।
এমনি অনেক অজানা তথ্যে বোঝাই করেছেন হেলাল ভাই তার এই 'অপরাজেয় বাংলা'।
তবে আমার একটা ছোট সমালোচনা ছিলো, তথ্যচিত্রটিতে যখন এর পাত্র-পাত্রিরা কথা বলছিলো তখন তাদের নাম নিচে দেয়া হয়েছে কিন্তু পূর্ন পরিচয় দেয়া হয়নি, প্রদর্শনীর শেষে চা খেতে খেতে হেলাল ভাইকে কথাটা বললাম, তিনি জবাব দিলেন - এদেরকে আপনাদের সামনে নিয়ে আসলাম এবার আপনাদের দ্বায়ীত্ব এদের প্রত্যেকের পরিচয় খোঁজ করা। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, আমরা কি কখনো এই বিষয়গুলো নিয়ে কখনো ভেবেছি? কখনো ভাবা উচিত এইটা চিন্তা করেছি?
হেলাল ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে চাই এই কষ্টসাধ্য তথ্যচিত্রটি নির্মান করার জন্য। আমাকে ভীষন রকম নাড়া দিয়েছে "অপরাজেয় বাংলা" তথ্যচিত্রটি। স্যালুট হেলাল ভাই
১৬ তারিখ রাতে মনে হয় এইটা ছবির হাটে দেখানো হইতেসিলো। এক ঝলকে যা মনে হইলো, খুবই ভালো ক্যামেরার কাজ আছে। ৩৫ মিলিমিটার নাকি কে জানে! ডকুটি খেয়ে ফেলার ইচ্ছা আছে।
পরবর্তী প্রদর্শনী হবে ২০ ডিসেম্বর, সকাল ১০টায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মিস করতেছি!
পরবর্তি প্রদর্শনী ২০ ডিসেম্বর, সকাল ১০টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হলে।
সিনেট হলে নাকি? ঐটা একটা ওয়ার্ল্ড ক্লাস কনফারেন্স হল। ব্যপক ব্যপার হবে তাইলে।
তাই নাকি! আমি যাই নাই কখনো, যামু নে আবার তাইলে
ভাস্কর্য ভাঙ্গার অংশটুকু পড়তে পড়তে ভাবছিলাম বিমানবন্দরের আর বলাকার কথা, পরে দেখি তাও উল্লেখ করছো তুমি। কত কিছু জানি না, দেখার শখ থাকলো ফিল্মটা।
একবার লাল'দা বলছিলেন যে, "নিজের মন মতন কাজ হইছে রে, আমি স্যাটিস্ফায়েড!" কতটা কষ্ট করে ৭বছর যাবত কাজ করার পর সব ঠিকঠাক মতোন হইলে উনার মতো কেউ এম্নে বলতে পারে।
ভাবার পর এই নিয়ে কাজ করার কথাও কি কেউ চিন্তা করবে এই ফিল্ম দেখে? আশায় রইলাম।
লালনের ভাস্কর্য আর বলাকার কথা 'অপরাজেয় বাংলা'তেই দেখানো হইছে। নূরানী হুজুরের হুমকি ধামকির ফুটেজ সহ।
তাইলেই হইছে। সুশীলরা ফিল্ম দেখবে তারপর ভুলে যাবে (
হ
ডাক্তার আপা যে দায়িত্ব লইলো, সেইটা বল্লানা? নুরানী টাইপের কোনো মুফতি তার ওটিতে আইলে যে কিডনী গায়েব কইরা দিবো?
আসলেই এই ডকুটা সবার অন্তঃত একবার হইলেও দেখা উচিত। ইতিহাসের একটা অংশ লালদা খুবই সুন্দরভাবে তুইলা আনছেন।
সেইটা শুনলে আবার ঘৃনাবাদ বিরোধীরা নতুন সন্দেহে এই তথ্যচিত্রের উদ্দেশ্য খুঁজতে শুরু করবে, এইজন্য বল্লাম না।
ঘৃণাবাদ বিরোধীদের ** **
আমি অন্তঃত এই ঘৃণা অন্তরে পোষণ করি...
এই ছবিটা বানানোর পেছনের কথা বছর কয়েক আগে সামুতে যখন লালদার পোস্টে পড়তাম ভাবতাম তখন কবে দেখব। কাল সেই আশা পূর্ন হল। চমৎকার কাজ, একটা কমপ্যাক্ট ডকুমেন্টারি।
যাইতে পারিনাই ।
পরে একদিন দেখে নিবো।
লালদা কে সালাম।
আবারো পাল্টি
সকালে হইলে যাইতাম , সবাইরে জিগাইলাম সকালে আছে নাকি , পরে দেখি সকালে প্রোগ্রাম নাই । বিকালে কাজ ছিল।
ডকুমেন্টারিটা অসাধারণ।'অপরাজেয় বাংলা'র এই ইতিহাস জানা ছিলো না। সবারই দেখা উচিত।
হু, চিন্তা করো নিয়মিত এর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করি কিন্তু কত তথ্য জানি না!
হেলাল ভাই আসলেই একটা দারুন কাজ করেছে।
কি হইছে??
দেখার ইচ্ছা ছিলো খুব। পরীক্ষা তাই আসতে পারলাম না।
কত কিছুই যে এখনো দেখা বাকি!
দেশে আসলে দেখে নিয়েন।
সামহয়ারইনে আপনার লেখা আর মন্তব্য অনেক পড়েছি। ২০০৯ এর পর আপনার আর কোন পোস্ট সেখানে দেখিনি। ভেবেছিলাম ব্লগিংয়ে মনে হয় আগ্রহ হারিয়েছেন। আজ হঠৎ করেই এখানে আপনাকে খুঁজে পেলাম। আপনার প্রফাইল পিকটা আমার খুব ভালো লাগে। তথ্যচিত্রটির খবর দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
আমার মনে আছে, সামুতে বাবুয়া ইস্যুতে বাবুয়ার পক্ষে বেশ তৎপর ছিলো এই নিক টি। এনিওয়ে, থ্যাংকু ।
এবারে একাউন্ট খুলেই মন্তব্য করছি-
মানে কি আপনি আর সামুর বিষাক্ত মানুষ একই নন? যদিও ব্লগে ঘুরাঘুরির বয়স আমার অনেক দিনই হল, কিন্তু আমি নিয়মিত কোন কিছু ফলো করিনি। বাবুয়ার বিষয়টাও মিস করেছি।
লেখায়
মন্তব্য করুন