এইসব বাজার-সদাই
বিষয়টা এমন না যে আমি জীবনেও বাজার করি নাই।
আমার বাজার-সদাইয়ের দৌড় কালে ভাদ্রে চিনি-লবন-সাবান পর্যন্ত, তাও আবার নির্দিষ্ট পরিচিত দোকান থেকে যেখানে দামাদামির কোন বিষয় নাই ঠকার কোন চান্স নাই।
তবে তরি-তরকারী মাছ-মাংস কেনার অভিজ্ঞতা আমার নাই বললেই চলে। সেগুলো সর্বদা আব্বার ডিপার্টমেন্ট। আব্বা আমাদের উপর ভরসা করতে পারে না এইগুলোর ব্যাপারে অথবা হয়তো নিজে যাচাই বাছাই করে কিনতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন আব্বা সব সময়। কারন বাজার এনে সব সময়ই আম্মা বা ইদানিং বউমাদের বেশ আগ্রহ নিয়ে গল্প করেন ঢেরসটা কিভাবে চিনতে হয়, ডাটাটা কিভাবে বুঝতে হয়, আজ পর্যন্ত কেউ বুড়ো শশা গছিয়ে দিতে পার নাই কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
মাসের শুরুতে আব্বা-আম্মা গেছে হজ্ব করতে। সংসারের দায়ভার আমার আর ভাইয়ার দূর্বল কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে। ভাইয়ার ভাগে বাড়ি ভাড়া আদান-প্রদান ইত্যাদি আর আমার অতি দূর্বল কাঁধে সংসারের খরচ। যদিও আব্বা দু'মাস চলার মত পর্যাপ্ত বাজার এবং টাকা দিয়ে গেছে উপরন্তু আমি যে দু'চারশ টাকা বেতন পাই তা তো আছেই।
সমস্যা শুরু হলো এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই। মনযোগ দিয়ে অফিস করছি এমন সময় বাসা থেকে ফোন, আমাদের বাসার সাহায্যকারী মেয়েটা অপরপ্রান্তে, - "ছুডো ভাইয়া, ধইন্না গুড়া শ্যাষ"
আমি গভীর চিন্তায় পড়লাম, 'ধইন্না গুড়া' এখন আমি কই পাই!!
দুই সপ্তাহ শেষে এক সন্ধ্যায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম অফিস ফেরত আমি হাতে এক ডজন সাগর কলা একটা মাঝারি সাইজের লাউ আর দুই হালি কাগজি লেবু পাতলা পলিথিনে ঝুলিয়ে বাসায় ফিরছি। সংসারের দাবি অস্বীকার করার উপায় নেই। (পরে বাসার লোকজন আবিষ্কার করেছে আমার কেনা লাউটা বেশ প্রাচীন ছিলো এবং বউ শিখিয়ে দিলো কিভাবে নখ চেপে লাউ চিনতে হয়, জীবনে কত কিছু জানার বাকি!!)
বাসায় মাছ-মাংস যা ছিলো দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় শেষ, যদিও হালি খানেক ইলিশ তখনও প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে ছিলো, কিন্তু বাসার লোকজন মিছিল মিটিং করে জানালো ইলিশ তারা গত কয়েকদিন ধরেই খাচ্ছে তাই অন্য কিছু খেতে চায়। অগত্যা এক ছুটির দিন সকালে থ্রিকোয়ার্টার-গেঞ্জি গায়ে রেডি হলাম, গন্তব্য কাওরান বাজার।
বাজারের ফর্দ পকেটে একে একে আলু-শিম-কচুরলতী-শশা-লাউশাক-মিষ্টিকুমড়া-ধনেপাতা-মেন্দিপাতা ইত্যাদি কেনা শেষ করলাম। পরিচিত মুরগির দোকানে গিয়ে দেড় হালি মুরগি কেটেকুটে রেডি রাখার ঘোষনা দিয়ে রওনা দিলাম মাছের বাজারে।
মাছের বাজার!!
জীবনে মাছের বাজারে হাতে গোনা কয়েকবার ঢুকেছি আমি এবং প্রতেকবার আব্বা পাশে ছিলো এবং শেষবার যখন আব্বা আমাকে নিয়ে মাছের বাজারে এসেছিলো সেটা গত মিলেনিয়ামে।
একটা গভীর দম নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে ঢুকলাম মাছের বাজারে। দুর থেকে অবলোকন করে করে মোটামুটি পুরোটা বাজার একটা চক্কর দিয়ে নিলাম। বাজারে কোন সাইজের মাছ কোথায় আছে জানা শেষ, পকেটের ফর্দতে লেখা চিংড়ি এবং ছোট মাছ। কি করবো কি করবো ভাবছি হঠাৎ আর্কিমেডিস এর মত ঝটাং করে একটা বুদ্ধি আসলো মাথায়, আরেকটু হলেই 'ইউরেকা!!!!' বলে চিৎকার দিতে গিয়েও দিলাম না।
সরু চোখে অনেক্ষন সময় নিয়ে একজন অভিজ্ঞ মুরুব্বি টাইপ ক্রেতা বাছাই করলাম। মুরুব্বির পিছে পিছে এমন ভাবে লেপ্টে থাকলাম যেন মাছওয়ালারা মনে করে আমরা চাচা-ভাতিজা। মুরুব্বি চিংড়ি টিপে টিপে দেখলো অনেকক্ষন তারপর গম্ভীর গলায় হাক ছাড়লো - 'কত কইরা মিয়া?'
মাছওয়ালা থুতনির দাড়ি নাড়িয়ে জবাব দেয়-
- জ্বী, সাড়ে পাঁচশ, বাজারে এমন চিংড়ি আর নাই চাচা।
- হ, বুঝলাম। সাড়ে চাইর রাখো আর কথা কইয়ো না।
- না চাচা, পাঁচশ একদাম।
- কি কও ! আইচ্ছা দাও এক কেজি
মাছওয়ালা ওজন দিতে দিতে আমি পাশ থেকে সুযোগ বুঝে বললাম,
- আরো এক কেজি মাপেন।
এদিকে মুরুব্বি একহাজার টাকার নোট বের করে মাছওয়ালার হাতে দিলো
মাছওয়ালা মনে করেছে আমরা চাচা-ভাতিজা মিলে দুই কেজি মাছ নিয়েছি, সে পুরো টাকাটাই তার টাকার থলেতে ভরে আমার এক কেজি মাছ প্যাকেট করতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
মুরুব্বি আবার গম্ভীর গলায় হাক দেয় - 'টাকা ফেরত দিবানা মিয়া?'
মাছওয়ালা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলে - ও আইচ্চা আপনেরা একলগে না?
আমি বিজয়ী হাসি দিয়ে বলি - না আমরা আলাদা, আমার টাকা এই যে।
মুরুব্বিতো চিংড়ি কিনেই চলে গেলেন। আমার তখনো ছোট মাছ কেনা বাকি। কিন্তু আমার তখন আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, বাজারে তো আর অভিজ্ঞ ছোট মাছ ক্রেতার অভাব নাই
বাসার লোকজনের বক্তব্য জানতে আগ্রহী
বাসার লোকজন মোটামুটি আমার বাজার দেখে মুগ্ধ।
ধরেন , চাচা মিয়া টেকার গরমে ৩৫০/ কেজি চিংড়ি ৫০০ টাকায় কিনছে, কিন্তু ভাতিজাতো ধরা খাইল !
তাতো খাইলোই
তবে পঁচা মাছ কিনে ধরা খাবার চেয়ে সেইটাও ভাল, টাকা যাক খেলা সুন্দর হোক
স্বনামের আগে বেনামে একখানা কমেন্ট ছাড়িলাম
বাজার তরতাজা করতে না পারলেও পোষ্ট তরতাজা
চেঅট মাছ পারলা কিনতে নাকি পঁচাই কিনলা জাতি জানতে চায়।
আবার জিগায় !!! একই পদ্ধতিতে ছোট মাছও কিনিয়াছি
এই পোস্ট আরো আগে দিলে উপকৃত হইতাম
এই টেকনিক এখনও ইমপ্লিমেন্ট করা যাইতে পারে
বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে ফিরতেই দেখি কলমি শাক নিয়ে একলোক। মনে মনে চিংড়ি ভাবতে ভাবতে কলমি কিনলাম ২০টাকার। দেখি আর এক লোক কাঁচকি নিয়ে বসেছে। বেটাকে বললাম --২৫০গ্রাম কাচকি দাও। বাছবে কে এই ভয়ও মনে মনে। বেটা বলে হাফ কেজির কম বেচি না। নিলাম হাফ কেজী। ব্যাগে ১০০টাকা নাই। রিকসাওয়ালার কাছে ধার করলাম ২০টাকা। হেটে আসা পথ ১০টাকা ভাড়া দিয়ে মাছ নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। কত বছর কাঁচকি খাইনি। উত্তরবঙ্গে এই মাছ পাওয়া যায় না।
আপনি তো ভালই বাজার করেন। আপনারা ভাই অভিজ্ঞ লোক, কোন বাজার থিকা বাজার করেন জানাইয়েন পিছে পিছে আমার নিজের বাজারটাও করে নিতাম
আমি ১কেজি কাচকি কিনছিলাম ২৫০ টাকা দিয়া। বাসার লোকজন তো মাছ দেখে মুগ্ধ!
যারে মুরব্বী ভাবতাছো, তিনি হইলেন মাছবাজারে এজেন্ট, প্রতি কেজিতে তাঁর কমিশন ১০%, কারওয়ান বাজারে প্রথম গেলা তো তা জানো না এইটা। আমরা এইখানেই থাকি, তাই জানি।
কি বলেন !!!
আসলেই কি তাই !!!
তাইলে কি ধরা খাইয়া গেলাম
ঘটনা কি সত্যি মাসুম ভাই? নাকি চাপা মারলেন!!
গত সাড়ে চার বছরে বাজার করার অনেক সম্ভাবনা থাকার পরেও যাওয়া হইছে কম। বেশীর ভাগ সময়তেই যথাযথ পল্টি মেরে তা অফিসের সহকারী ছেলেটা কিংবা মামার উপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছি। আমি বাজারে গেলেও লস, সবাই বাজার থেকে টাকা কামায়, আমি বাজার ভালো করতে পারি না, দাম বেশী রাখে, নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় নিজের পকেট থেকে টাকা ভরি।
হাহাহা, এইটা ভাল আইডিয়া
আর সব বাজার থেকে কিনতে পারলেও মাছেরবাজারে যাওয়া হয়নি এখনো, পুরাই তাল্গোল পাকায়ে যায়
আর মুরগিতেও ভেজাল করি, তবে গরুর মাংস ভালই কিনি 
মাছের বাজার বিষয়টা বেশ কঠিন।
মুরগি আর গরুর মাংস নির্দিষ্ট দোকান থেকেই নেয়া হয়, একেবারে হোম ডেলিভারি, তাই এগুলো নিয়ে টেনশন নাই
পোষট পড়ে আমি মুগধ
আন্টি, আপনার মুগ্ধতায় আমি আনন্দিত
সাব্বাশ! ভালা বুদ্ধি!
আমি অবশ্য প্রায় এক যুগ ধরেই এইসব করে আসতেছি,
এখন এই লেখা পইড়া নিজেরে সিনিয়র সিনিয়র লাগতেছে!
মন্তব্য করুন