এ ট্রিবিউট টু এডাম
গতসপ্তাহে কক্সবাজার গিয়েছিলাম অফিসের এক কনফারেন্সে। এই বছরে এই নিয়ে চারবার আসা হলো কক্সবাজার। ঢাকা থেকে ৪৫ মিনিটেই উড়োজাহাজে কক্সবাজার। এয়ারপোর্টের গেইটে গাড়ি দাড়িয়ে আছে ড্রাইভারের হাতে আমার নাম। গাড়ি নিয়ে এলো পাঁচতারা হোটেলে , যা চাচ্ছি তাই পাচ্ছি, শুধু সমুদ্রটা দেখার সময় পাচ্ছি না।
রাতে প্রেজেন্টেশনে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। হোটেলের বারান্দা থেকে দুরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের ডাক শোনা যাচ্ছে। মন মাতাল করা সে শব্দ। রাত বেশি হয়ে গেছে এখন সাগরে যাওয়াটা কি খুব বেশি ঝুঁকি হবে?
এই সন্ধ্যারাতে আমি ঝুঁকির কথা ভাবছি, এখনো রাত এগারোটাও বাজেনি। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি হয়তো !
কক্সবাজার যতবার আসি ততবার আমার প্রথম সমুদ্র দেখার স্মৃতিটা ঘুরেফিরে মাথায় আসে। সেই স্মৃতি অনেকগুলো বন্ধুর, সেই স্মৃতি 'এডাম' এর।
১৪/১৫ বছর আগে প্রথমবার কক্সবাজার আসি। জীবনে প্রথমবার সমুদ্র দর্শন।
এডাম আমার ফুপাত বন্ধু। রায়েরবাজার থাকতো। লাম্বাটে লিকলিকে ঋজু শরীর। যে আমাকে প্রথম সমুদ্র দেখিয়েছিলো।
আমার ফুপাত ভাই হিমেল আর আমি সমবয়সী ছিলাম। সেই সুবাদে হিমেলের সকল বন্ধু আমারও বন্ধু ছিলো। তারা ছিলো আমার ফুপাত বন্ধু। আর আমার সকল বন্ধু হিমেলের মামাতো বন্ধু ।
অনেকগুলো বছর নিয়মিত আমি আমার ফুপাত বন্ধুদের সাথে ধানমন্ডি লেকে আড্ডা দিয়েছি। সেই আড্ডায় আরো অনেকের সাথে নিয়মিত মুখ ছিলো এডাম।
সেই দিনগুলো একটা সিগারেট নিয়ে তিন/চারজন কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার দিন। লেকের পাড়ে ছিলো সুমনের চায়ের দোকান, আমরা হাঁক দিতাম – ‘সুমন ! তিনকাপ চা বানাইয়া পাঁচ কাপে দে। আর একটা বেনসন দে’
সিগারেটের অর্ডার দেয়া মাত্রই সেটার বুকিং চলতো; ফার্স্ট বুক, সেকেন্ড বুক। তিনটাকা দিয়ে একটা বেনসন! তিনটাকা মুখের কথা না।
আড্ডার বিষয়বস্তু থাকতো বারোয়ারী। সমসাময়িক রাজনীতি, হিন্দী সিনেমা, সুমন-নচিকেতা-অঞ্জন, বই, উপন্যাস, ঢাকা কলেজের সামনে গেঞ্জির বর্তমান মূল্য, ইত্যাদি।
আমরা রোজ সন্ধ্যায় কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড এর কাছে ধানমন্ডি লেকের ভেতর আড্ডায় মাততাম। যদিও আড্ডায় আগতদের বেশির ভাগের বাসা ধানমন্ডি ১৫ নাম্বার এর কাছে শুধু মাত্র হিমেল আর আমার কারনে আড্ডাস্থল লেকের পূর্বপারে ছিলো।
সেই আড্ডাটার অংশিদার না হলে জীবনে অনেক কিছুই করা হতো না।
একঘন্টার নোটিশে পকেটে সব সম্বল খালি করে হুট করে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে যে ট্রেন সামনে আছে সেটাতেই উঠে পড়বো এই নিয়তে রাতের শেষ ট্রেনে আখাউড়া যাওয়া হতো না।
হুট করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোপুরে এক বন্ধুর ঘাড়ে গিয়ে হাজির হওয়া হতো না।
আমরা ধানমিন্ড লেকের পাড়ে সন্ধ্যায় হেড়ে গলায় গান গাইতাম, গাল ভরে ধোঁয়া ছাড়তাম, কড়া কনডেন্সমিল্ক দেয়া চায়ে চুমুক দিতাম আর দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতাম।
এরমধ্যে একদিন এডাম কোন এক ডকুমেন্টরিতে অভিনয়ের সুযোগ পায়। স্যুটিং হবে গ্রীসে। আমরা সবাই মহাখুশি। এডাম গ্রীসে চলে গেল কিছুদিনের জন্য, আমাদের আড্ডা আগের মতই চলতে থাকতো।
মাস দেড়েকের মধ্যেই এডাম ফিরে আবার আমাদের আড্ডায় যুক্ত হলো। কত গল্প কত গল্প! বন্ধুদের জন্য এডাম ‘বিশেষ’ এক উপহার এনেছিলো, সেটার খেতে মৌরীর মত দেখতে পানির মত তবে পানির সাথে মেশালে রং সাদা হয়ে যায়। সে এক আজব ব্যাপার! আমাদের সবার মন বেশ খুশি খুশি। এর মধ্যে ঘোষনা হলো এডাম যে পারিশ্রমিক পেয়েছে সেখান থেকে সে সকল বন্ধুদের কক্সবাজার ঘুরিয়ে আনবে। বলা বাহুল্য, এডাম উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলো না তবে এডামের মনটা ছিলো উচ্চবিত্ত।
এরপর এক রাতে আমরা ননএসি বাসে করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মোট ৮/১০ জনের একটা দল, আনন্দে সবাই ভরপুর। বাস সায়দাবাদ পার হবার সময়ই পাশের এক ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে ডান পাশের কয়েকটা জানালার কাঁচ চুরমার হলো, তারপরেও আমাদের আনন্দ কমে না। সেই বাসের একেবারে পেছনে টয়লেট ছিলো, সেই টয়লেট ব্যবহার করতে যেয়ে ঝাকিতে একেকজনের সারা শরীর মাখামাখি, আমাদের আনন্দ তরপরেও কমে না।
ভোরে কক্সবাজার পৌছলাম, কলাতলী রোডের আগে যে বাঁকটা আছে সেখানে রাস্তা থেকেই সমুদ্র দেখা যায় সেই বাঁকের আগে আমরা হুমরি খেয়ে বাসের ড্রাইভারের পাশে এসে দাড়ালাম বাস থেকেই সমুদ্র দেখবো বলে।
কক্সবাজার নেমে মোটামুটি মানের এক হোটেলে দুইটা রুম ভাড়া করা হলো, কোন রকম কাঁধের ব্যাগগুলো ফেলে নিচে নেমে এক ছাপড়া হোটেলে পরোটা-ভাজি খেয়ে সবাই দৌড় দিলাম সাগরে। কি আনন্দ কি আনন্দ !!
সাগরে নেমে দুইটা ডুব দিয়ে দেখি আমার চোখে চশমা নেই, হারিয়ে গেছে। পাশে বন্ধু তুষার তার পায়ের নিচ থেকে আমার চশমাটা তুলে দিলো। কতক্ষন আমরা সাগরে ছিলাম সেটা ভুলে গেছি তবে শরীর যতক্ষন সহ্য করেছে ততক্ষন আমরা সাগরের পানিতে নেচেছি এটুকু মনে আছে।
এরপরের গল্পটা অনেক ফাঁকা, জীবন অনেক ছোট হলেও আমাদের সমস্যাগুলো অনেক বড় । আমরা বড় সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ভুলে যাই জীবনটা যে খুব ছোট, একেকটা দিন যায় আর জীবন ছোট থেকে ছোট হতে থাকে।
হিমেল, আমার ফুপাতো ভাই দেশের বাইরে চলে গেল, আমি দেশের বাইরে চলে গেলাম। আমার ফুপাতো বন্ধুদের সাথে কোন রকম খোঁজ খবর রইলো না। কে কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানি না।
মাস কয়েক আগে হিমেলের সাথে কথা হলো, এখনো অস্ট্রেলিয়ায়। জীবন চালাচ্ছে।
একে একে বাকি সবার খোঁজ নিচ্ছি তখন হিমেল জানালো এডাম নেই। আমার ফুপাত বন্ধু এডাম নেই। কি অভিমানে একটা ছেলে নিজেকে শেষ করে দিলো! আমি খবরটা শুনে কিছুই বলতে পারি নাই।
মাঝরাতে ঢাকার কোন গলি দিয়ে একসাথে হাঁটার সময় এডাম হঠাৎ ‘নন্দিনী.....’ বলে চিৎকার দিতো।
এডাম বলেছিলো, সুনীলের ‘জীবন যেরকম’ পড়ে দেখ, বইটা ভাল।
‘জীবন যেরকম’ এখন আমার আলমারির কোনায় পড়ে আছে পড়া হয়নি। বইটা হয়তো আমার আর পড়া হবে না। বইটার দিকে তাকালে এডামের কথা মনে পড়বে।
আমার পাঁচতারা হোটেলে সকালের নাস্তাটা কম্লিমেন্টারী। বিশাল বুফে আয়োজন, এত এত খাবার যে, একজনের পক্ষে সব আইটেম খেয়ে দেখা সম্ভব না। আমার মধ্যবিত্ত মন সেই ১৫ বছর আগের বন্ধুদের সাথে ছাপড়া হোটেলে যে পরোটা ভাজি খেয়েছিলাম সেই স্বাদ খোঁজে। সেই বন্ধুদের খোঁজে। সেই সময় টা খোঁজে।
কম অভিমান/কষ্ট/চাপা ক্ষোভ (যেটাই বলো না কেন) না জমলে কেউ এইভাবে চলে যায়না! আমার তো লাগে, সাহসী বলেই পারে অনেকে।
ভাল একটা লেখা হয়েছে! প্রথমে পড়তে অন্যরকম লাগছিল, মাঝে লাগছিল সেই রোমান হলিডে দেখার মতো মজার কোন ঘটনা আসবে, কিন্তু শেষটা করলে অন্যকিছু দিয়ে!!
সাহসী? হবে হয়তো।
নিজেকে শেষ করাটা সাহসের কাজ তো বটেই।
কতদিন পরে বিমার লেখা ?
সকালবেলা মনটা বিষন্ন কিংবা অন্যরকম এক আচ্ছন্নতায় ছেয়ে গেলো।
এডাম ভালো থাকুক, তুমি, তোমরাও
মেসবাহ ভাই আপনারে সেইদিন দেখলাম হাওয়া উড়িয়ে যাচ্ছেন। ডাক দিছিলাম আপনার কান পর্যন্ত পৌছলো না
একসময় সবকিছুই স্মৃতি হয়ে যায়
যে দিনগুলি ফেলে এসেছি, যে প্রিয়মুখগুলি হারিয়ে যাচ্ছে সেসব ছাড়া সবকিছুই পানসে লাগে কখনো, একদিন সবকিছু্ই হয়তো শুধু স্মৃতি হয়ে যাবে।
একদিন সব স্মৃতি হয়ে যাবে।
বেঁচে থাকুক এডামরা স্মৃতিতে ভালোবাসা হয়ে
মন্তব্য করুন