Reply to comment
বাংলাদেশ ডায়েরি ০৩
দুরপাল্লার বাসে প্রচন্ড আতংকে চেপে ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সীটে বসে থাকার মতো পেরেশানী দ্বিতীয়টি নেই। পরীক্ষায় প্রথম না হওয়া যত ক্ষিপ্ত- ক্ষুব্ধ মানুষেরা দুরপাল্লার বাসের ড্রাইভার হয়। তাদের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য সবাইকে কাটিয়ে প্রথম হওয়া। যে বাসগুলো গাজীপুর থেকে ঢাকা আসছে, গতির মত্ততায় সেগুলোকে কাটিয়ে রাজশাহী- দিনাজপুরের বাস ঢাকায় ঢুকতে পারবে না কিন্তু গতির মরিয়া লড়াইয়ে রঙ সাইডে আটকে পরা বাসের যাত্রীরা যমুনা ব্রীজের আগে ক্রমাগত ড্রাইভারকে উপদেশ দিচ্ছে।
ঐ মিয়া বাসটা ঐ লাইনে লাগাইলে তো এতক্ষণে ব্রীজের কাছে যাইতাম গা। কি চালাও কিচ্ছু বুঝি না। তোমারে এইখান থামাইতে কইলো কে? অন্য পাশ থেকে দ্রুত বাস ট্রাক আসছে। সেসব বাস-ট্রাকের ড্রাইভারের আসনে বসে আছে আরও সব কখনও প্রথম হতে না পারা ক্ষুব্ধ প্রাক্তন ছাত্রেরা।
ক্রুদ্ধ ড্রাইভার হেঁকে বললো মিয়া এত কথা না কইয়া আপনি আইসা চালান আমি গিয়া আপনের সীটে বসি। যাত্রী আরও ক্ষেপে বললো মিয়া ড্রাইভার কি আমি না আপনে, ঠিকমতো চালাইতে পারেন না। আমাগোর কি কাম কাজ নাই কোনো?
কথায় কথা বাড়ে।এলঝেইমার আক্রান্ত দেশের মানুষেরা সব সময় যা বলে সেই পরিচিত সংলাপ ভেসে আসলো পেছন থেকে। আমারে চিনস ব্যাটা। আগে গাবতলীতে পৌঁছা তারপর তোরে দেখাবো। প্রতিক্রিয়ায় ড্রাইভার যাত্রীর বিভিন্ন স্বজনের সাথে নানান কায়দায় কয়েকবার বিছানাভ্রমন শেষ করার পর একজন গান্ধীবাদী যাত্রী উঠে দাঁড়ালেন। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসলো।
গভীর রাতে কিংবা মধ্য দুপুরে শহর নিজের মতো জ্যান্ত। দুই কোটি মানুষের শহরে সব সময়ই দশ লক্ষ মানুষ রাস্তায় থাকে। কারো মর্নিং শিফটে ডিউটি থাকে, কারো লেট নাইট শিফটে। কারা কোথায় ডিউটিতে আছে সে অনুযায়ী যানজটের সীমারেখা নির্ধারিত। বাসায় পৌঁছানোর পর মনে হলো চোখের ভেতরে এক ছটাক বালি জমে আছে।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্কুলের অভিভাবক সমিতির নির্বাচনে অংশগ্রহন করছে মানুষ। বেইলী রোডের দুই পাশে গাছের ডালে আর দেওয়ালে নির্বাচনী পোস্টার। যেতে যেতে এইসব অভিভাবক প্রতিনিধিদের নির্বাচনী শ্লোগান পড়ি। পড়তে গিয়ে বুঝলাম নানা পদের অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে। স্কুলের অভিভাবক সমিতির মর্ণিং শিফট, ডে শিফট, কলেজ শাখা, স্কুল শাখা আছে। স্কুল পরিচালনায় এইসব নির্বাচিত অভিভাবক প্রতিনিধি আসলে কি ধরণের ভুমিকা পালন করেন? স্কুলের বোর্ড প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্ত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে দুর্নীতির জনরব আছে। সিদ্ধ্বেশরী এলাকার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত মানুষেরা কি ডোনেশন বাণিজ্যের ভাগ চাইছেন আয়োজন করে?
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রায় নিয়মিত সিদ্ধেশ্বরীতে আসতাম। মনোয়ারা হাসপাতাল আর কিডস হ্যাভেন স্কুলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা গোটা কয়েক ৪ তলা বিল্ডিং, এর বাইরে সম্পূর্ণ এলাকাতেই বাগানবাড়ী সমেত শুধুমাত্র দোতালা ভবন ছিলো। বন্ধুর বাসার উল্টোপাশের বাগানবাড়ীতে যখন এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের কাজ শুরু হলো, বন্ধুরা তারপরপরই এলাকা ছেড়ে দেওয়ায় কয়েক বছর ওখানে যাওয়া হয় নি।
কয়েক বছর পর যখন সিদ্ধেশ্বরীতে থাকা থাকতে শুরু করলাম কালী মন্দিরের হলদে দেয়াল আর লালচে গ্রীলের দরজা পেরিয়ে অনেক দিন শান্তিনগর মোড়ে গিয়েছি চা খেতে। তখন এলাকার মানচিত্র বদলে গেছে। উঁচু উঁচু অট্টালিকার সারির ভেতরে পোকা খাওয়া দাঁতের মতো একটা দুটো দুই তলা বাড়ী।
এবার গিয়ে দেখলাম কালী মন্দীরের জৌলুস বেড়েছে। লালচে গ্রীলের দরজার বদলে চকচকে মোটা স্টিলের দরজা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মানুসারীদের আস্থা- অনুরাগের জায়গা। নাগরিক নিস্পেষণের সাথে তাল মিলিয়ে এইসব উপাসনালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন আসে। যখন উপাসনালয়গুলো দুর্গের মতো শক্ত-পোক্ত কাঠামোতে বদলে যেতে থাকে, ধরেই নেওয়া যায় সে সমাজে ঐ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষেরা কোণঠাসা হয়ে গেছে। স্টিলের মোটা কলামের আড়ালে পূজার মন্ডপ। আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা বেষ্ঠনীতে বন্দী দেবী । দেবতার পায়ের কাছে বসে উপাসনার সুযোগ পাচ্ছে না ভক্ত কিন্তু অন্তত অন্তরে সে জানে এই কোণঠাসা সময়ে মানসমুর্তিকে ভাঙচুড়ের হাত থেকে রক্ষা করাটাই এখন ধর্মীয় কর্তব্য।