আজও হেঁটে যাই সবুজের পথ ধরে, লাল সূর্য্যের দিকে।
পূর্বাচলে আজ উদিত যে-সূর্য, প্রতিদিনের হয়েও সে প্রতিদিনের নয়; তার রক্তিমতায় ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আমাদের মনে পড়বে; আকাশ যে-কোমলতায় আজ উদ্ভাসিত, একাত্তরের সম্ভ্রমহারা ১০ লাখ মা-বোন-জায়ার ক্রন্দন ধোয়া সে-উদ্ভাস; ভোরের যে-রাঙা আলোটি আজ স্পর্শ করেছে ভূমি, স্বদেশের সেই পবিত্র ভূমি ভিজে আছে বঙ্গবন্ধুর রক্তে, আর সেই রক্তস্রোতে মিশে আছে জাতীয় ৪ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলীর উষ্ণ শোণিত। দেন দরবার নয়, কারও দয়ার দানে নয়, সাগর-সমান রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্ত-সাগর পেরিয়ে বাঙালি জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে।
একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের বুকে যে অস্ত্রের গর্জন ছিলো, তাতে ছিল আনন্দের রঙ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিলো পুরো বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরতে শুরু করেছিলো ঘরে। আনন্দ-বেদনার যে মহাকাব্য রচিত হয়েছিলো সেদিন, তাকে স্বাগত জানিয়েছিলো পৃথিবী। একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম-সময়ের বেদনা ও জন্মের আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিলো সবাই। যারা টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য চিত্রগুলো দেখেছেন, অদ্ভুত এক ভালোবাসায় সিক্ত হয় তাদের মন। নতুন প্রজন্মের মানুষও নিজেকে রাঙিয়ে নেয় মুক্তিযুদ্ধের রঙে। মুক্তিযুদ্ধের রেশ শরীরে নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি আমরা। ডিসেম্বর মাসজুড়ে ঢাকার রাজপথ গুলো বর্ণিল হয়ে যায় লাল-সবুজ পতাকায়। ঢাকার যান্ত্রিক মানুষগুলোও এক টুকরো জায়গা পেলে মনপ্রাণ দিয়ে এঁটে দেয় বাংলাদেশের পতাকা। কোথায় নেই লাল-সবুজ পতাকা বাসার ছাদে, অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে, দোকানে, গাড়িতে এমনকি ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতেও। মাসজুড়ে প্রাণের মধ্যে আমরা অনুভব করি স্বাধীন দেশের মুক্তির উজ্জীবিত আস্বাদ। এটাই কি শ্বাশত মুক্তির স্বাদ? অনেকে বলে, মুক্তির স্বাদ যে কী, তা শতভাগ অনুভূত হয়েছিলো একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরে। ৪০ বছর কেটে গেছে। তবুও বলি, সেই স্বাদ আজও ফিকে হয়ে যায়নি, বরং দ্বীপ্তিময় প্রভায় জেগে ওঠে বারবার। জেগে উঠি আমরাও। যে দেশাত্মবোধের জয়গান আমাদের মধ্যে বইছে, তা একাত্তরের অল্প কিছু পর থমকে দাঁড়িয়েছিলো। এ প্রজন্মের তরুণেরা বিষণ্ণতা আর হতাশার বেড়াজালে হারিয়ে যায়নি। বরং সেই বিষণ্ণতার গহ্বর থেকে তরুণেরা কণ্ঠ জোরালো করে আহ্বানকরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। আজ ষোলোই ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবসে আমাদের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হোক সবখানে।
সাড়ে সাত কোটি মানুষের অজস্র গল্প নিয়ে আমাদের একটি একাত্তর।৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি একাত্তর। তাই একাত্তর আমাদের কাছে অনেক বেশি মূল্যবান। ছোট্ট ছেলে মতিউরের আত্মত্যাগ, অজানা মুক্তিযোদ্ধা নাদেরের প্রতিরোধ,একজন নারী হয়ে শিরিন বানু মিথিলার যুদ্ধজয়, পাকিস্তানের ঘাঁটি থেকে বিমান নিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের আত্মত্যাগ, বীরশ্রেষ্ঠদের অকুতোভয় বলিদানসহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের বিনিময়ে একাত্তর আমাদের কাছে অতুলনীয়। একাত্তরের কোনো একটি গল্পের সাথে অন্যটির তুলনা হয় না। আমরা যারা এ প্রজন্মের তরুন, তারা কি ভুলে গেছি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্র,জল্লাদের দরবার, রক্তস্বাক্ষর, অগ্নিশিখা, দর্পণ, বজ্রকণ্ঠ, জাগরণী, ঐকতান নামের অনুষ্ঠানগুলোর কথা? ভুলে গেছি ইতালির নাগরিক মাদার মারিও ভেরেনজির কথা? সবকিছু মিলিয়ে একাত্তরের শিখা আজও আমাদের রক্তে বইছে। যা শুনেছি বা যা পড়েছি ভুলে যায়নি একটিও। বাঙালি জাতি বীরের জাতি। অল্পসংখ্যক ভীরু কাপুরুষ রাজাকারের মিথ্যা আস্ফালন আগেও টেকেনি, আজও জায়গা পাবে না।
দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ১৯ নভেম্বর ২০০৯বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছিন সুপ্রিম কোর্ট। এ রায় আমাদের আরও আশাবাদী করে ১৯৭১ সালের বর্বরতম গণহত্যাসহ যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্রোয়েশিয়া, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও রোমানিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, আজও তা চলছে। আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, উগান্ডা, ইরাক, বসনিয়া, কসোভো, সুদানসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সোচ্চার হয়ে উঠেছি আমরাও। আর কতো দিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের? বিচার চেয়ে নিভৃতে, অভিমানে হারিয়ে গেছেন অনেকেই। তাদের অভিমানগুলো নিয়েই আমাদের এ কঠিন পথ চলতে হবে। ৩০ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে জানাতে চাই, ঘুমের দেশে আমরা ঘুমিয়ে যাইনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এ দেশে করতেই হবে। এদের বিচার না হলে যে আমরা দায়মুক্ত হতে পারবোনা। প্রতিবারের মতো বিজয় দিবসে এ-ই আমাদের চাওয়া। নত শিরে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সব শহীদকে, শহীদদের সব স্বজনকে, সব বীরাঙ্গনাকে, সব যুদ্ধশিশুকে, একাত্তরের স্মৃতিতে উজ্জীবিত সবাইকে।
অনেক দিনের পর এলেন!
ভাল আছেন তো?
ভাল লাগলো।
শ্রদ্ধা জানাচ্ছি
মন্তব্য করুন