অভিমানী মা আমার
ছোটবেলায় যখন বুঝে-না বুঝে বাজে কোনো অন্যায় করে ফেলতাম, মা এসে দুমদুম করে দুই-চার ঘা লাগিয়ে দিতেন। ব্যস ফুরিয়ে যেত। কিন্তু ভেতরটা ফালাফালা হয়ে যেত যখন মা কোনো কিছু না বলে গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াতেন, দূরে দূরে থাকতেন, কাছে ঘেঁষতে চাইলেও পাত্তা দিতেন না। বুঝতে পারতাম যে এবারের অপরাধটা মায়ের সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেছে, মাকে হয়তো খুব আঘাত দিয়ে ফেলেছি। মা কষ্ট পাচ্ছেন আমার জন্য এ কথা মনে এলেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেত। আঁচল ধরে মায়ের পেছনে পেছনে ঘুরতাম, ঘ্যান ঘ্যান করে মাফ চাইতাম...মা ও মা আর করবো না, মাফ করে দাও, সত্যি বলছি আর ভুল হবে না কোনোদিন। অভিমান অল্প হলে মা মাফ করে দিতেন, কোলে তুলে নিতেন, আমি আবার নিশ্চিন্ত হয়ে উড়ে যেতাম খেলার সাথীদের মাঝে। অভিমান খুব কড়া হলে, মা তখনও মুখ ফিরিয়ে থাকতেন, দু’একবার ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতেন। আমিও নাছোড়বান্দার মতো মায়ের পিছুপিছু যেতাম রান্নাঘরে, কলতলায়, মা যেদিকে যেতেন সেদিকেই। মনে পড়ে একদিন ছোট ভাইটাকে রাগের মাথায় মেরে পেয়ারা গাছের নিচে ফেলে দিয়েছি, মা এসে চিলের মতো ছোঁ মেরে গ্যাদাভাইটাকে কোলে তুলে নিয়ে প্রচণ্ড এক চড় বসালেন আমার গালে। ভেবেছিলাম শাস্তি হয়ে গেছে, আবার চলে যাই দুষ্টুমি করতে। কিন্তু ফিরে এসে দেখি মায়ের মুখ তখনও থমথমে, ছোট ভাইটা থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। আমি খিদে পেয়েছে বলে মায়ের কাছে যেত চেষ্টা করি, মা মুখ ঝাঁমটা দিয়ে চলে গেলেন। বুঝতে পারলাম এবারের অপরাধ আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পরের ঘন্টাখানেক ঘ্যান ঘ্যান করে মায়ের মাথা ধরিয়ে ফেললাম, কিন্তু মাফ পেলাম না। এক পর্যায়ে অসহ্য হয়ে মা বলে ওঠেন, ‘ কাকে মা ডাকিস তুই? তোর কোনো মা নেই। তোর মা মরে গেছে। আর কোনোদিন আমাকে মা ডাকবি না।’ আমার মা নাই, আমার মা মরে গেছে—সেই কথাটা আমার কচি বুকে একটা প্রলয় ঘটিয়ে দিল।
মনে পড়ে পেয়ারা গাছের নিচে হাত-পা ছড়িয়ে, গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদে ছিলাম সেই দিন। কান্নার আওয়াজে পাড়া-প্রতিবেশীরা চলে আসেন, কিন্তু মায়ের অভিমান ভাঙতে ভাঙতে সেই সন্ধ্যা।
আজ এত বছর পরে আবার সেইভাবে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
মা তো সেই কবেই চলে গেছেন। কিন্তু একটা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের কাঁধে, মাকে কথা দিয়েছিলাম—মা, ঘুমাও তুমি শান্তিতে, আমরা জেগে আছি লাখো ছেলে। তোমার শুরু করা কাজটি শেষ না করে আমরা ঘরে ফিরবো না। কথাই সার, আজ পর্যন্ত পারলাম না মাকে দেয়া কথাটির মর্যাদা রক্ষা করতে। মা কি আর সব জানেন না? আমার মা সব জানেন। ঠিকই দৃষ্টি রাখছেন এই অভাগা সন্তানগুলোর উপরে, দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে আমরা সরে এলাম মায়ের দেখানো পথ থেকে। সেই অভিমানেই কি মা প্রতিনিয়ত আরও দূরে যাচ্ছেন আমাদের কাছ থেকে? আমাদের স্বপ্ন থেকে, চিন্তা-চেতনা থেকে। চাইলেও কেন আজকাল আর মায়ের মুখটা মনে করে পারি না আগের মতো?
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, ব্যর্থ এক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আজ আপনার কাছে ক্ষমা চাইতেও আমার সাহস হচ্ছে না। তেলাপোকার মতো বেঁচে আছি মা, রাজাকারগুলো এখনও কিলবিল করছে রাষ্ট্রযন্ত্রের সবখানে। মা, আজকের দিনে আপনিও হয়তো মেঘের দেশ থেকে বলছেন, কাকে মা ডাকিস তুই? তোর কোনো মা নেই, তোর মা মরে গেছে। অন্ধ-বধির আর অথর্ব হবার কারণে আপনার সেই কথাটিও হয়তো আমি শুনতে পাচ্ছি না। যেভাবে শুনতে পাইনি আপনার শেষ কথাগুলোও।
মা, আজকাল আমি আকাশের দিকে তাকাবার সাহসও হারিয়ে ফেলেছি।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
যে স্বপ্ন তুমি বুনে দিয়ে গেছো
মা দেখে নিয়ো, একদিন তা সত্য করবোই
(মামুন ভাই পোস্টটা এতো টাচি হইলো কিভাবে, হ্যাঁ?)
কোন কোন লেখা খুব ভালো লাগলেও স্বস্তি দেয় না...
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
মামুন ভাই, পোষ্ট পড়ে স্তব্দ হয়ে গেলাম।
এই লজ্জা আমাদের সবার।এই লজ্জা নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি প্রতিদিন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ......
মামুন ভাই বলার ভাষা নেই .........
অসাধারণ মামুন ভাই।
জাহানারা ইমামের স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেটিকে দূর্ভাগ্যও বলা যায় কারণ চোখের সামনে তাজা তাজা ইতিহাস দাঁড়িয়ে থাকলে স্তব্ধ হয়ে যায় ভেতরটা। কি করতে পেরেছি আমরা এই পরিবারটির জন্য? শহীদ রুমীকে কী দিয়েছি? আর শহীদ জননীর সংগ্রামের মুখ থুবড়ে পড়ার ইতিহাসটাতো শুধু বেদনার নয় লজ্জ্বারও! এর দায় কেউ নিলোনা।
অসাধারণ মামুন ভাই...
মা .. তোমাকে শুধু স্মরণই করি
কিছু বলার নাই।

সহমত জানিয়ে গেলাম।
ধন্যবাদ মামুন ভাই ...মন ছুঁয়ে গেলো
আমি এবার কিছুটা হলেও আশাবাদী ... আমরা সবাই এভাবে মনেপ্রাণে একটা বিচার চাচ্ছি, সেটা হবেই!
মায়ের জন্য কিছু করতে পারবো কি না জানি না কিন্তু লেখাটা অসাধারণ।
মনে পড়ছে সেই উত্তাল দিনগুলো। রক্ত তখন টগবগ করে ফুটতো। উনার বাড়ির সামনে বসে থাকতাম আমরা। ভেতরে মিটিং। আমরা বাইরে ছটফট করি। একটু ইশারা পেলেই মিছিল। জঙ্গী মিছিল। শহীদ মিনারে জনসভা, রাজপথে গজারীর ডাল হাতে মিছিল। প্রেসক্লাবে গোলাম আযমের জনসভা মঞ্চে আগুন লাগানো...
আর সর্বশেষ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে লাশ নিয়ে যাওয়া...
সব ভেসে উঠলো চোখের সামনে...
...................................................
লেখাটা ভীষন মর্মস্পর্শী!
মা, আমাদের শুধু দেরী হয়ে যায়, কেবলি দেরী হয়ে যায়----
ঐ মিয়া, লিখেন না কেন?
হ, লেখেন না ক্যান?
অসাধারণ মামুন ভাই।
আমাদের দিয়ে কিছু হবে না। বিচার হবে এমন আশা আর করি না।
পাঠ এবং মন্তব্যের জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের জীবদ্দশাতেই মায়ের অসমাপ্ত কাজটির শেষ দেখে যেতে পারবো।
চমৎকার লেখা কিন্তু
.............................
........................................।
দেরি হইছে, কিন্তু এখনো সময় আছে ... শলার ঝাড়ু দিয়া তেলাপোকাগুলারে মারার সময় এখনো যায় নাই ...
মা এবং মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা নেই এমন লোক কমই খোজে পাওয়া যাবে। এই ভালবাসার অনুভূতিটা সহজে বুঝাতে পারি না। নানান কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও আমরা আমাদের মা - মাতৃভূমির কথা ভুলে যাই না। মা মাটির টানেই আমরা ছুটে যাই মাতৃভূমির কোলে। কিন্তু মাতৃভূমির কোল আজ নিরাপদ নয়। বিভিন্ন কারনে মাতৃভূমির বুক আজ ক্ষত বিক্ষত বেদনার হাহাকার। কোথাও কারো নিরাপত্তা নেই।
চমৎকার লেখা। মন ছুঁয়ে গেলো।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম'এর প্রতি অনেক শ্রদ্ধা
লেখাটি আবেগে আপ্লুত করেছে
মন্তব্য করুন