টাঙ্গুয়ার হাওরে একদিন
এক.
সিদ্ধান্তটা হুট করেই। জুন ক্লোজিং এর কাজের চাপ ছিল। তবু ভাবলাম ঘুরে আসি। এমন সুযোগ আবার কবে আসবে কে জানে। সাইদ ভাইর সাথে যোগাযোগ করে আমাদের জন্য ৫ জনের বুকিং দিলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত সাতজন গেলাম ট্যুরে । সাথে দুই পিচ্চি। মোট ৯ জন।
বাসের জন্য অপেক্ষা এবং বাস ভ্রমণ:
'আগে আসলে আগে পাবেন' এর ভিত্তিতে সিট দেয়া হবে-এমন একটা প্রচারণা চলছিল। আমরা পৌঁছেও যাই সময়মত। ঢাকার জ্যাম গলে বাস আসতে দেরী করে ফেলে ১ ঘন্টা। বোধহয় স্বজনপ্রিতী হবে, মেসবাহ ভাই আমাদের জন্য সিট বরাদ্দ দিলেন বাসের মাঝ বরাবর। ঢাকা থেকে বের হতে হতে রাত একটার কিছুটা বেশি।
আধো ঘুম আধো জাগরনে চলছিল বাস ভ্রমণ। রাতে একজায়গায় থেমে ফ্রেশ হবার বন্দোবস্ত এবং হালকা নাস্তার ব্যবস্থা। ওখানে আমাদের গ্রুপের আরেকজনের সাথে দেখা। সে যাচ্ছে সিলেট ট্যুরে। ওরা ১০/১২জন। তারপর আবার বাসের এসি পরিবেশ।
একটা সময় চারদিক থেকে আঁধার কেটে যেতে থাকে। ভোরের আধো আলোয় দুপাশের পানি আর গাছের সারি চোখে পড়ছিল। ভাবছিলাম টাঙ্গুয়া যাবার আগেই প্রকৃতির এমন চেহারা, ওখানে না জানি কী অপেক্ষা করছে। হঠাৎ সামনে ভেসে ওঠে এক অপরূপ সূর্য। বউকে জানালাম একটা ভাল মানের ক্যামেরা ছাড়া এইসব ট্যুর অর্থহীন। তখনই হঠাৎ দুলে ওঠে বাস। একটা এক্সিডেন্টের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাই সবাই। জানা গেল কিছু একটা ভেঙ্গেছে। মেসবাহ ভাই ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করে ফেলেন। আমরা টেম্পো সদৃশ যানে চড়ে পৌঁছে যাই সুনামগঞ্জ।
টেম্পো ভ্রমণ:
টেম্পোতে উঠে চতুর্মুখী বৃষ্টির কবলে পড়লাম। পলিথিন থাকা স্বত্বেও ভিজে গেলাম প্রায় সবাই। এদিন ছিল তানবীরা আপুর জন্মদিন। কেকটা তানবীরা আপুর সাথে আমাদের টেম্পোতেই জায়গা করে নিল। তানবীরা আপু জানালেন কাল রাতে একতারার টুংটুং শুনে ভেবেছিলেন গান হবে, না হওয়ায় উনি কিঞ্চিত হতাশ। ব্যস, শুরু হয়ে যায় গান। সাইফুল, মাসুদের সাথে অন্যরা গলা মেলানোয় বেশ জমে উঠল ভ্রমণ। 'সর্বনাশের পাহাড় ডানে সাহারা তার বামে'-একটা গানে এরকম একটা লাইন থাকায় কয়েকজন তীর্যক মন্তব্য করতে ছাড়লেন না। এর মধ্যে আবার একজন গান ধরল 'মধু কই কই বিষ খাওয়াইলা' মাসুদ ধরলো 'বকুল ফুল বকুল ফুল' যদিও আমি ওকে পরামর্শ দিয়েছিলাম 'বকুল' শব্দটারে 'বিয়ে' শব্দ দিয়ে পরিবর্তন করে নিতে।
টেম্পো সুনামগঞ্জ গিয়ে একটু থামায় আমাদের দুজন নেমে চা খেতে চলে যায় কিছু না জানিয়ে। বাকি দুটো টেম্পো ছেড়ে দেবার পর ওদের খোঁজ পড়ে। ওরা আসতে আসতে চলে যায় বাকি দুটো টেম্পো। আমরা নানা জনের সাথে কথা বলে, মেসবাহ ভাইকে বার বার ফোন দিয়ে বিরক্ত এবং উৎকণ্ঠিত করে এক সময় পৌঁছে যাই সদর হাসপাতালের কাছের সেই বাড়িতে।
একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু:
সম্ভাবনার শুরু ট্যুরের আগের রাতে। যখন গভীর পেটের পীড়ায় ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। পরদিন দুপুর পর্যন্ত তিনটা এমোডিস খেলাম। যদিও দুপুরে বাধ্য হয়ে বিরিয়ানী খেতে হয়েছিল। বাসায় আসার পর আবার ফালুদা। নাহ্ এবার সম্ভাবনা পুরোপুরি তৈরি হল।
আগেরবার কক্সবাজার যাবার সময় বাস থামিয়ে কাজ সারতে হয়েছিল। এবারও একই ধরনের কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হবার পরও সেরকম কিছু ঘটলনা। সকাল বেলা যখন সুনামগঞ্জ পৌঁছলাম। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম।
লঞ্চ ভ্রমণ
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই লঞ্চে উঠলাম। নাস্তা সারলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। তারপর শুরু গানের আসর। সাইফুল, মাসুদ, নওরোজ, জুঁই, স্বর্ণালীদের চমৎকার কণ্ঠে পরিবেশিত হতে থাকল একের পর এক গান। সাথে অন্যরাও কম বেশী সুর মিলাচ্ছিলেন।
আমাদের সাথে একজন বাউল ছিলেন। ওনাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল মূলত গানের জন্যই। উনি একটা সময় খেয়াল করলেন এখানে বেশ জমে উঠেছে গানের আসর। তারপর ওনার টিম এবং আমাদের এমেচার টিম মিলে শুরু হয় যৌথ প্রযোজনার সংগীত আসর।
আমি খেয়াল করলাম আমাদের পুরো টিমটি কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যার যার কাজ করে যাচ্ছে। একটা টিম, এরা মূলত সিলেটের, ঢাকার তারেক ভাই, টুটুল ভাই আর মেসবাহ ভাইকেও এই টিমের সাথে দেখেছি, এরা ছিল মূলত ট্যুরের যাবতীয় কাজ সমাধা করার জন্য নিবেদিত প্রাণ। খাবার পরিবেশন সহ পুরো ম্যানেজমেন্টের বিরক্তিকর কাজটা এরা করেছে।
একটা টিম ছিল ফটোগ্রাফারদের। এরা আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল চলে যায় ছাদে। আরেকদল লঞ্চের নীচতলায়। উভয় গ্রুপই নিবিষ্ট মনে প্রকৃতির ছবি তুলেছে বলেই মনে হয়েছে।
একটা টিম ছিল যারা মূলত গানা বাজনায় ব্যস্ত ছিল। এরা সবাই গায়ক সবাই শ্রোতা। এরা দখল করে দোতলার মূল যায়গাটি। ঢোল, হারমোনিয়াম, গিটার, একতারা, মৃদঙ্গ, বাঁশি এসব ছিল গায়কদলের সরঞ্জাম। টিমের দুই সিনিয়র সদস্যও এই টিমের সাথে ছিলেন বলেই মনে হয়েছে আমার। তানবীরা আপুর গ্রুপের সবাইও এই টিমে ছিল। ছিল নওরোজ সহ তার গ্রপের কয়েকজন। আর অন্যরাও কম বেশী এখানে সময় দিয়েছেন।
আরেকটা টিম দখল করেছিল লঞ্চের পেছনের ডেক। নিজেদের মত করে আড্ডায় মেতে উঠেছিল তারা। সাথে পেশাদার ক্যামেরাও ছিল তাদের।
একজনকে মনে হল নিসঙ্গ অভিযাত্রী। একা একা ছবি তুলেছে শুধু বিভিন্ন জনের। মাঝে মাঝে হাওড়ের বুকেও তাক করতে দেখেছি ক্যামেরা। আশংকা ছিল ওর ছবি কি কেউ তুলবে ! রেজোয়ান ভাই'র একটা ছবি দেখে সে আশংকা অমূলক প্রতিয়মান হয়েছে।
দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম তাহিরপুর। জানাগেল, বারিক্কার টিলায় যাওয়া যাচ্ছেনা সময় স্বল্পতার কারণে। সুনামগঞ্জ থেকে লঞ্চ ছাড়তে ১১টা বেজে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ৮ টার মধ্যে লঞ্চ ছাড়তে পারলে ওখানে যাওয়া যেত।
লঞ্চ থামতেই আমরা কজন নেমে পড়লাম নদীতে গোসল করার জন্য। এক আধটু সাতারের দু:সাহস দেখালাম। লঞ্চ থেকে কয়েকজনকে চোরাগোপ্তা ক্যামেরা ব্যবহার করতে দেখলাম। আমাদেরকে ব্লাকমেইলিং এর উদ্দেশ্য হয়তো ছিলনা তাদের...
তারপর দুপুরের খাবার গ্রহণ। হাওরের মাছের স্বাদ নিলাম। আহ সেই স্বাদ.... যারা পায়নি তাদের কষ্ট বাড়ানোর চেষ্টা করা বোধহয় ঠিক হবেনা...তাই চেপে গেলাম স্বাদ বর্ণনা।
বারবিকিউ এবং গানের আসর:
সন্ধ্যার পরপরই টর্চের আলোয় আমরা রেস্ট হাউজ থেকে বারবিকিউর স্পটে চলে গেলাম।স্পটের পাশেই শনির হাওর। বেশ মনোরম পরিবেশ। অবশ্য যারা বিকেলে এখানে আসেনি তাদের বোঝার কথা নয় জায়গাটা কত সুন্দর!
পেশাদার শিল্পীদের আগমনের আগেই আমাদের এ্যামেচার টিম গান ধরল। এবার দেখা গেল আরো কয়েকজন আছেন যারা বেশ সুন্দর গান করেন।গানে গানে এগিয়ে চলল সময়। পাশাপাশি চলছিল মাংস ঝলসানোর কাজ।
রাত ৯ টার পর বিদ্যুত দেখা করে আমাদের সাথে। সাইফুলের একরাতের জন্য ২ হাজার টাকা দিয়ে জেনারেটর নেবার পরিকল্পনা এতে ভেস্তে যায়।
বিদ্যুতের চেনা আলোয় শুরু হয় খাবার পর্ব। খাবার শেষ হতেই বৃষ্টি এসে আরেকবার আমাদের সাথে দেখা করেন। বৃষ্টিতে অল্প স্বল্প ভিজতে ভিজতে পৌঁছে যাই রেস্ট হাউজে।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় রিপোটিং। আমার ঘুম ভাংলো পৌনে পাঁচটায়। আমরা ফ্রেশ হয়ে লঞ্চে পৌঁছে যাই ছটার আগেই।
এবার শুরু হবে ট্যুরের মূল পর্ব-টাঙ্গুয়া ভ্রমণ। আগের দিন পুরো সময়টা ছিলাম নদীতে। আজ থাকব হাওরে....
দুই.
তাহির পুর থেকে ট্যাকেরঘাট পর্যন্ত টাঙ্গুয়ার বিস্তির্ণ জলরাশি। মাঝে মাঝে জনবসতি। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বুকে জীবনের স্পন্দন। বাড়ির সাথে বেঁধে রাখা নৌকা-বর্ষাকালে এখানকার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম।অবশ্য মোবাইলের কারণে হাওয়াই যোগাযোগের সুবিধাও পাচ্ছে এখানকার মানুষ।
কিছুক্ষণ নদী পথে চলে একটা সময় হাওরে প্রবেশ করে আমাদের টাইটানিক। আমরা দূর থেকে দেখি পাহাড়ের সারি। মেঘের আড়ালে ঢেকে থাকা পাহাড় হাতছানি দিতে থাকে। পাহাড়ের আরো কাছে চলে আসে লঞ্চ। পাহাড়ের কোলে মেঘেদের আনাগোনা। আছে ছোটখাটো মানব বসতির চিহ্ন।
হাওরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে শত শত নৌকা। কোনটায় মাছ ধরছে জেলেরা। কোনটায় মালামাল বহন করছে সওদাগরেরা। কোনটা যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আমরা যখনই কোন লোকালয় পার হচ্ছিলাম। মানুষজন দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল। কোন কোন জায়গায় হাত নাড়িয়ে জানাচ্ছিল অভিবাদন। আমরাও প্রত্যুত্তর করছিলাম।
লঞ্চের সামনের ডেকে তখন চলছিল জমজমাট বাউল গানের আসর। আমি লঞ্চের ছাদে বসে দেখতে থাকি আকাশ, পানি, পাহাড়, মেঘ আর বিস্তির্ণ প্রকৃতি। আমার মনের কোণে উঁকি দেয় একটি কবিতা লেখার বাসনা। চিল্কার সৌন্দর্য নিয়ে যেমন লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু! এই সৌন্দর্য আমার দেখা আগের সব সৌন্দর্যকে যেন ম্লান করে দেয়। আমি হারিয়ে যেতে থাকি শাশ্বত বাংলা মায়ের আঁচলে।
একটি দু:সাহস এবং অত:পর
হঠাৎ ঘটে যায় তেলেসমাতি কাণ্ড। দু'জন দু:সাহসী অভিযাত্রী লঞ্চের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পানিতে নামে। তাদেরকে মূলত উসকিয়ে দেয়া হয়েছিল ছবি তোলার খাতিরে। তারাও লুফে নেয় সুযোগটা। পরে লঞ্চ থামিয়ে বয়া ফেলে তাদেরকে লঞ্চে তোলা হয়। পরে বুঝেছিলাম সাহসী দুজন হাওড়ের বুকে কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছিলেন।
ট্যাকের ঘাটে অবতরণ:
ধীরে ধীরে আমরা ট্যাকের ঘাটের কাছে পোঁছে যাই। ট্যাকের ঘাটের যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলাম পাহাড়ের সৌন্দর্য ততই বাড়ছিল। আকাশের রং একেকবার একেক রকম হচ্ছিল। কখনো বৃষ্টি নেমে আসার ভয় দেখাচ্ছিল। তবু আমরা বৃষ্টিহীন প্রহরেই নামলাম ট্যাকের ঘাট। আমাদের গাইড বিএসএফের গুলির ভয় দেখিয়ে বললেন উনি যেখানে যাবেন তার চেয়ে বেশী দূর গেলেই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা বিএসএফএর তরফ থেকে ছুটে আসবে গুলি।
আমরা সার বেঁধে চলে যাই একটি লেকের কাছে। এখান থেকে একসময় চুনা পাথর তোলা হত। সেই পাথরে চলত ছাতকের চুনাপাথরের কারখানা। বৃটিশরা যাবার সময় এমন কায়দা করে দেশ ভাগ করে যে আমরা পাহাড়ের চুনাপাথরের অধিকার হারাই। বেকার হয়ে যায় পাথর তোলা এবং পরিবহনের শত শত যন্ত্রপাতি। এখনো পড়ে আছে কিছু যন্ত্রপাতি অব্যবহার আর অযত্নে জীর্ণ।
এখানে চলে কিছুক্ষণ ফটোসেশন। এক ফাঁকে ট্যুরের মূল নায়ক হাসান মোর্শেদ ভাই আমাদের গাইডকে নিয়ে চলে যান (সম্ভবত দুপুরের খাবারের জন্য মাছ কিনতে)।লেকের স্বচ্ছ পানিতে গোসল করার লোভ জাগে। নওরোজের গামছাটা ধার চেয়ে বসি। কিন্তু আমার গ্রুপের অন্যদের বিরোধীতার মুখে সেটা সম্ভব হয়না। পরে লঞ্চে গিয়ে লুংগি গামছা এনে আমরা তিনজন গোসল করতে নেমে যাই লেকে। সাইদ ভাইরা দেখলাম ওখানে গোসল করেছে।
সুনামগঞ্জ ফিরে আসা :
এরপর দ্রুত লঞ্চে ফিরে আসি। লঞ্চ থেকে ওঠা নামার জন্য একটা কাঠের সিড়ি ফেলা হয়। সাধারণত এই ধরনের লঞ্চে এই সিড়িই ব্যবহার করা হয়। আমাদের কয়েকজনকে লঞ্চে থেকে যেতে দেখলাম। তারা যে একটা অসাধারণ স্পট মিস করেছে সেটা স্পষ্ট। তবে তারা কেন নামেনাই তা স্পষ্ট নয় আমার কাছে। হয়তো বিএসএফের গুলির ভয়, অথবা বাচ্চাদের নিয়ে নামতে ঝামেলা হতে পারে সেই অস্পষ্ট কারণ।
এখানে বলে রাখা দরকার, লঞ্চের নীচ তলা থেকে টাঙ্গুয়ার সৌন্দর্য এক রকম। দো্তলা থেকে আরেক রকম। আর ছাদ থেকে আরেক রকম। তবে আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়েছে নিচ তলা থেকে। মনে হচ্ছিল পানির সমান্তরালে ছুটে যাচ্ছি আমি। ঢেউ গুলো যেন খুব কাছ থেকে ছুয়ে যাচ্ছে আমাকে। ট্যাকের ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছতে ছাদে চলে যাওয়ায় মনে হয়েছে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য ছাদই বেস্ট। দোতলা বা নীচ তলা থেকে এই সৌন্দর্য পুরোপুরি অবলোকন সম্ভব নয়।
লঞ্চে উঠে মুড়ি চানাচুরের স্বাদ নিলাম। বাসা থেকে নিয়ে আসা তুহিন আপার ভাজা বাদামের স্বাদও নিলাম একটু। মনে হয়েছিল আরেকবার চেয়ে নিই কিছু বাদাম। ফিরতি পথে লঞ্চের ছাদে উঠে কিছুক্ষণ তাস খেলা চলে। তারপর ছেলের পীড়াপীড়িতে সাইফুল দোতলায় নেমে গেলে ছাদেই বসে গানের আসর। আমিও নেমে আসি একসময়। এদিকে গান পাগল মানুষগুলো গানের জন্য বিশেষ অনুরোধ পাঠায় ছাদে থাকা মাসুদকে। মাসুদ নেমে এলে আবার শুরু হয় গানের আসর।
এই আসরে লোকজ, রবীন্দ্র, নজরুল সবই ছিল। নওরোজের গানের গলা বেশ সুন্দর। তালিমও নেয়া আছে। একটু যত্ন করলেই ভাল একজন শিল্পী হবার সম্ভাবনা তার আছে। সাইফুল, মাসুদও বেশ সুন্দর গান করে। জুঁই এবং স্বর্ণালীর গলাও চমৎকার। এবার বাউলকে ছাড়াই শুরু হয় গান। অবশ্য তাদের ঢোলক/ঢুলী যোগ দেয় এদের সাথে। গান শুনে, প্রকৃতি দেখে পার হয়ে যায় সময়।
দুপুরে খাবার একটু দেরীতেই আসে। (অবশ্য মুড়ি চানাচুররর থাকায় কেউ ক্ষুধায় কষ্ট পেয়েছে বলে মনে হয়না আমার।) হাওড়ের টাটকা মাছের স্বাদ পেতে এতটুকু সবাই হাসিমুখে মেনে নেয়। শুটকি ভর্তা, দুই/তিন ধরনের মাছ আর ডাল আহ কী স্বাদ !
খাবার পর আবার গানের আসর। এর মধ্যে শুরু হয় দুর্দান্ত বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে ভেজা যারা মিস করেছে তাদের ভরা বর্ষায় টাঙ্গুয়ায় ঘুরতে যাবার মজা কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে। দু:খজনক হলেও আমি নিজেও মিস করেছি বৃষ্টিতে ভেজা। যারা ভিজেছে তাদের প্রতি হিংসা রইল।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর লঞ্চ এসে ভিড়ে সুনাম গঞ্জে।তারপর ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। রাত সাড়ে দশটায় বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মধ্যরাতের সিলেটে একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাই। মেনুতে ছিল শিদল (শুটকি ভর্তা),সব্জি আর মুরগী ভুনা। শিদলের স্বাদ ছিল অসাধারণ। পেটের কথা মাথায় থাকায় বেশী খাবার রিস্ক নেই নাই। একটা কথা না বললেই নয়, শুনেছিলাম সিলেটের খাবার বাইরে থেকে যাওয়া লোকদের তেমন ভাল লাগেনা। কিন্তু ট্যুরের প্রতিটি খাবার ছিল দারুণ স্বাদের।
পথে বাসটা একটু ঝামেলা করছিল। পরদিন দুপুর বারোটায় ঢাকা পৌঁছি। অবশ্য যাত্রাবাড়ির জ্যামে ছিলাম তিনঘন্টা। তবে এসি বাস হওয়ায় ভ্রমনের কোন ক্লান্তি স্পর্শ করেনি আমাদের। সিডিউলে না থাকলেও সকালের নাস্তায় আমরা মেসবাহ ভাই'র আতিথেয়তা গ্রহণ করি। সবচেয়ে মজার ছিল বাসের দুলুনি। নৌকায় চড়লে সাধারণত এমন দুলুনি পাওয়া যায়। আমরা বলছিলাম এটা হল ডিজিটাল নৌকা। অবশেষে অনেক মজার পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে যাই যে যার বাসায়।
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়:
ট্যুরের শুরুতেই কিংবা লঞ্চে উঠার পর ভ্রমণকারীদের দ্বারা যাতে হাওরের পরিবেশ নষ্ট না হয় এ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার ছিল আয়োজকদের পক্ষ থেকে। আমি বাসে কোথাও খালি বোতল ফেলার বন্দোবস্ত না পেয়ে রাস্তার পাশে ফেলতে গেলে তুহীন আপা বিষয়টা মনে করিয়ে দেন যে, এতে পরিবেশের ক্ষতি হবে। আমি তখন টুটুল ভাইকে জিজ্ঞেস করি এগুলো ফেলার কোন বন্দোবস্ত বাসে আছে কিনা। তিনি জানালেন আছে। আমি তখন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আবার বাসে রাখা পলিথিনে সেগুলো ফেলি।
লঞ্চের ছাদে যখন ছিলাম একবার বোতল এবং চিপস এর প্যাকেট ফেলতে দেখেছি হাওরে। এটাও কিন্তু অসচেতনতার কারণে। আগেই ঘোষণা দিয়ে বিষয়টা জানিয়ে রাখলে কেউ এ কাজ করত বলে মনে হয়না।
একবার লঞ্চ থামিয়ে, সম্ভবত ইঞ্জিন পরিস্কার করা হয়, এটাও হাওরের জীব বৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর। ইঞ্জিন পরিস্কারের পর সেই ময়লা পানি হাওরেই ফেলা হয়। সুতরাং বেশি বেশি ট্যুর জীব বৈচিত্রের জন্য বেশি বেশি ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে এ ধরনের ট্যুর হলে ময়লা পানি ফেলার আলাদা ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটা ভাবা দরকার।
কিছু ছিন্ন কাহিনী
১.হাসান মুর্শেদ ভাই যাবার সময় একটু গুডবাইও বলেন নাই। এমনকি সবার সাথে পরিচিত ও হননি। এটা হয়তো নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা। তবে সবাই কিন্তু নেপথ্যের নায়ককে ঠিকই চিনে ফেলেছে।
২.অনেকের মধ্যে এত ভাল রিলেশন তৈরি হয়েছিল যে, তারা চাচ্ছিলেন ট্যুর টাঙ্গুয়ার মেম্বারদের নিয়ে একটা গেট টুগেদার।
৩.অনেকেই ফেসবুক নিক এবং মোবাইল নম্বর দেয়া নেয়া করছিল। দু:খের বিষয় হইল কেউই আমারটা নেয়নি, আমারেও দেয়নি কেউ। শুধু কুয়াশা একবার কি যেন জিগাইছিল।
৪.বাসের সরেজমিন হাকিকত আগে দেখা দরকার ছিল। অবশ্য এটা দেইখা বোঝা যাইতনা।
৫.সিলেটের বন্ধুদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
৬. মেসবাহ ভাই একজন জটিল মানুষ। সব ঝামেলা কেমন অবলীলায় ঠিকই সামলে নিয়েছেন।
৭.সাইদ ভাই মোটেও ভাল মানুষ না। আমাদের রাইখা উনি সিলেট ভ্রমণে চইলা গেলেন।
৮.তানবীরা আপুর নাম শুইনা মনে হইছিল মধ্য বয়সী কেউ। দেইখা মনে হইছে ২৪/২৫ বছরের কেউ।
৯.একুশ তপাদারের সাথে ব্লগে পরিচয় অনেক আগে। অথচ তারে চিনলাম ট্যুর থেকে ফিরা আসার পর।
১০. ট্যুরের দুই সিনিয়র সদস্য তুহীন আপা এবং পান্না আপার প্রাণ প্রাচুর্যের কাছে নিজেরে বুইড়া মনে হইছিল।
একলাই গেলেন, মজা করলেন; আমারে নিলেন্না ?
লেখা ভালো হৈছে... আরো বিশদ লেখেন...
সবাইরে অনেক থ্যাংকু
হ বস একলাই গেলাম। পরেরবার মিস কইরেন্না।
আমাদের বাসের চালক

অপেক্ষায় আড্ডা

ব্রেক...

বাসের সমস্যায়

বিকল্প ব্যাবস্থার সন্ধানে

বিকল্প ব্যাবস্থা...

লঞ্চে বাউল আসর

দিক নির্দেশনায়

উপরের সব গুলো ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা তারেক ভাইয়ের কাছে
রেজওয়ান ভাইয়ের তোলা ছবি

১.
২. এসো হৃদয়ের সব মালিন্য আমরা আগুনে সমর্পণ করি....

৩. চলাচল...

৪. প্রকৃতিকে দেখা.... কোন চোখে? ব্যক্তিক না নৈর্ব্যক্তিক?

৫. কি সন্ধানে যাই সেখানে আমি

মনের মানুষ যেখানে,
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবারাত্রি নাই সেখানে ...
ইভানের ছবি:

Ekush Tapader এর ছবি

আপ্নার আর সাইদ ভাইর ছবির জন্য অপেক্ষাইতাছি....
জয়িতা ফুপু যায় নাই। তাও বাসের টায়ার পাংচার??
তানবীরা আপু তো এইটা দেখলে খুশিতে অজ্ঞান হইয়া যাইব। আচ্ছা তানবীরা আপুর নাচে নাই?
হ উনি তো দারুণ নাচ জানেন। ফটুক তুলছিলাম নাচের। কিন্তু মোবাইলে তোলা সেই ছবির রেজুলেশন এত চমৎকার যে আপলোড করলে কেউ বুঝবোনা ছবিটা আসলে কিসের....
ভালু লাগলো ছবি লেখা দুটোই
, তয় ভ্রমন এর ব্যাপারে আগে জানতে পারলাম না এইটাই দুঃখ
।।
আমি কিছু জানিনা ভাই। আমারে দুইষেন না। আমি আরেকজনের কাছ থেকে হুইনা গেছি।
তানবীরার শুধু কী নাচ ! দুলাভাইয়ের গান, সুমির গান... সামিয়াতো দারুন গান করে...
হ্যা ওনারা তিন বোনই সুন্দর গান করেন। দুলাভাইও ভাল গান করেন। উনি তো মনে হয় ক্যারাওকে নিয়া আইছিলেন গান করার জন্য।
যেখানে বাস থেমে গেলে টেম্পোতে চড়ে রওয়ানা দেই সুনামগঞ্জ
হাওড়, পাহাড় আর মেঘের মিতালী
গানের আসরে শ্রোতাদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ
লেখাটা পড়ে আবার যেতে ইচ্ছে করছে ।

আসলে কিছু যায়গা আছে যেখানে বার বার যাওয়া যায়। টাঙ্গুয়াকে আমার কাছে তেমনই মনে হয়েছে।
নিজের পাস হারায়ে ফেলার কারনে নিজের নিকে লিখতে পারছিনা কিনটু জটিল হৈছে লেখাটা,
ইভান
সবাই দারুণ মজা করলেন।ছবি আর পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
বিরাট মিস করলাম।
বাউল গানের আয়োজন দেখে মনটা আবারো আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল
বর্ষায় আপনারা সম্ভবত হাওরে স্বচ্ছ পানি পাননি। দুবছর আগে শীতে গিয়েছিলাম,হাজার পাখির ঝাঁক আর স্বচ্ছ পানির স্মৃতি সারাজীবন মনে থাকবে।
হাওরের পানি নোংরা করার ব্যাপারে আপনার সচেতনতামূলক কিছু ছিন্ন কথা বেশ ভাল লাগলো।
এই লেখার ভিতরে যারা আছে সবাই কি এই ব্লগের?
৪/৫ জন বাদে আর কাউরেই তো চিনলাম না!
এবি ব্লগের যারা যারা ছিলেন:
টুটুল, তানবীরা, একজন মায়াবতী, সাঈদ, মুক্ত বয়ান, আজম, রেজোয়ান, একুশ তরফদার, ইভান, মৃম্ময় মিজান, কুয়াশা, আমিসহ আরো ৫/৬ জন। বাকীরা এদের ভাই-বন্ধু-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা...
টুটুল ভাই কয় হাজার ছবি তুলছে?!
তানবীরা আপু বাংলাদেশে?!
সামিয়া আপু নতুন লেখা দেয়না কেন?আপনে আর সাঈদ ভাই ও চুপ ক্যান?কাহিনী কি?
মিজান ভাইরে তো দেখতাছিই,
বাকি রা কি লেখালেখি থেকে রিটায়ার করছে?!
এত প্রশ্ন করলে হয়!!
প্রবাসে থাকায় দেশের অনেক কিছুই মিস করি, যেমন এই টাঙ্গুয়া।।
ভালই তো বেড়ালেন ! সুন্দর সুন্দর ছবি দেখলাম !
... একদিন আমরাও !
বাপ্রে! এতো এলাহী কাণ্ড। আফসুস কেউ খবরও দিলো না
সংশ্লিষ্টরা আরো ছবি-টবি দেন। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই।
মিস করছি ইচ্ছা করেই!
নিজের কবিতার কথা কিছু কইলেন না? আমি রেকর্ড করসিলাম কিন্তু কেমনে আপলোড করা যায় বললে আপলোড করে দেই
ওই জিনিস আপলোড না করাই ভাল। মাইনষে মাইর দিবে...ইভ টিজিং শিখানোর দায়ে.....
দূর.. এসব ভালো না... ধ্যাৎ খেলুম না..যান..
এইবার নাকি আপ্নারা মেলা মজা করছেন ?
আমরা দারুণ মজা করছি, ছবি আর পোস্টের জন্য
ধন্যবাদ। এবারের টুরে আপনাদের ত্রিরত্নরে মিস করছি খুব। গানের আসর আরেকটু বেশী জমত আপ্নারা থাকলে।
আমার লেখা পড়ে আমাকে পরিণত বয়স্ক মনে হয় জেনে যারপর নাই সম্মানিতবোধ করছি। মধ্যবয়স্ক মনে হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত, খুকি মনে হওয়ার থেকে
বাকি বাক্যে গোলাপী থেকে লাল আর শেষ পর্যন্ত বেগুনী হয়ে গেলুম
তাইলে আমার মন্তব্য যথার্থ হয়েছে ? জেনে ভাল লাগল...
মন্তব্য করুন