জয়ী হোলো কৌশলি অনুপ্রেরণাদায়ক ফুটবল, হেরে গেছে মিডিয়া ফ্যান্টাসী।
এবারের বিশ্বকাপে অঘটনের ঘটনা এতোবেশি ঘটছে যে প্রেডিকশান নির্ভর কোন লেখা লিখতে সাহস করতে পারিনি গেলো কয়েকটা দিন। তবু বিশ্বকাপের আমেজে না লিখে বসে থাকাটা বেশ কষ্টকর লাগছিলো। বিশেষ করে গতকালের দুটো খেলা দেখার পর মনে হলো এমন অসাধারণ দুটো খেলা নিয়ে কিছু একটা না বললেই নয়। গতোদিনের দুটো খেলা নিয়েই সমর্থকদের তর্ক বিতর্ক নিশ্চিত চলবে আরো চারটা বছর, বাছাই পর্ব পেরিয়ে পরবর্তী বিশ্বকাপে যদি এ দলগুলো খেলতে আসে তবে মিডিয়া নিশ্চিত তাদের প্রতিশোধ পরায়নতার বিশাল গল্প সমগ্র ফেদে বসবেন। দুটি খেলার রেফারীরাই এবারের বিশ্কাপে তো বটেই পরবর্তী আর কোন বিশ্বকাপেই খেলা পরিচালনার ভার আর পাবেন কীনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার।
যাই হোক প্রথম খেলা নিয়ে কিছু বলি। ইউরোপিয়ান লীগগুলো'র জন্য ইউয়েফা কিছু মানদন্ড দিয়ে দিয়েছেন। আর সেই মানে ইংলিশ লীগ প্রথম সারিতেই আছে। কেবল ইউরোপেই নয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ নিয়ে সারা পৃথিবীময় তুলকালাম কান্ড হয়ে যায়। প্রিমেরা লীগের রিয়াল মাদ্রিদের পর ইংলিশ লীগের দুটো প্রতিদ্বন্দ্বী দলই সবচে' ব্যবসা সফল দল হিসেবে বিবেচিত হয়। যখন চীনের কোন এক ফুটবল পাগল তার মাসের পুরো আয় দিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের রুনির জার্সি কিনে কান্নায় ভেঙে পড়ে তখন আসলেই উন্মাদনাটা টের পাওয়া যায়। সেই রুনিদের দল ইংল্যান্ড আর তাদের চীরকালীন প্রতিপক্ষ জার্মানী'র তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ খেলা হয়ে গেলো কাল। ক্রিকেটে যেমন ইংল্যান্ড যে মানের দলই হোক না কেনো, অস্ট্রেলিয়ার সাথে যেকোন সিরিজ পত্রিকার পাতায় একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে, তেমনি ফুটবলের অ্যাশেজ বলে খ্যাতি পায় ইংল্যান্ড আর জার্মানীর খেলা। জার্মান লীগকেও ইউয়েফা গুরুত্ব দিলেও তার সাথে নাকি ইংলিশ লীগের যোজন যোজন ফারাক।
গ্রুপ লীগে ইংল্যান্ড যাচ্ছেতাই ফুটবল খেলেছে। ভাগ্যের জোরে কোনমতে অনেক অংক মিলিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার সুযোগ পায়। অন্যদিকে জার্মানীরা শুরুটা বিশ্বজয়ীদের মতো করতে পারলেও পরের খেলাতেই পঁচা শামুকে পা কেটে ফেলে। সার্বীয়দের কাছে বাজে খেলে ১ - ০ গোলে পরাজয়ের পর তাদের নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমে যায় অনেক্ষানি। শেষ ম্যাচে তারাও ট্যাকটিকাল গেইমের মধ্য দিয়ে নিজেদের ম্যাচটা জিতে অন্য ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ভরসায় তাকিয়েছিলো। যাই হোক ইংল্যান্ড শেষ খেলায় দূর্বল দল স্লোভেনিয়ার সাথে জিতেই আবার হাক ডাক শুরু করলেও জার্মানরা এবার যেনো পন করে এসেছে তারা লো প্রোফাইল রেখেই এবার বহুদূর যাবে।
দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলাটি শুরু হওয়ার পরপরই ইংল্যান্ড তাদের বড় শরীরের খেলোয়াড় আর লাল জার্সির বদলা নিয়ে মাঠ প্রায় দখল করে ফেলেছে মনে হচ্ছিলো। সেসময়েই য়ূর্গেন ক্লিন্সমানের সুযোগ্য শিষ্য ইয়াকিম লো সাইডলাইনের বাইরে ডাগআউটে বসে খেলছিলেন কৌশলের খেলা। ইতালীয় কোচ ফ্যাভিও ক্যাপেলোর খ্যাতি ক্লাব পর্যায়ের ফুটবলে বিশাল। ইতালীর যূবদলের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। কিন্তু কৌশলী ফুটবলে যে জার্মান জাতি চীরকাল এগিয়ে সেটা তার মনে ছিলো না একেবারেই। এবারের ইংল্যান্ড দল নিয়ে আমি এর আগেই এক লেখায় বলেছিলাম যে তাদের বোঝাপড়াতে বেশ ঝামেলা আছে। কাল খেলা দেখার পর আমার নিজের বিশ্বাসটাই আরো দৃঢ় হয়েছে। এতো নামকরা কোচ, বিশেষজ্ঞদের ভারে নুয়ে পড়া ফেডারেশনের দল বাছাই প্রক্রিয়াটা যে কতোটা খেলো ছিলো ইংলিশ ফুটবলাররাই সেটা প্রমাণ করে দিলেন। পেশাদার একটা দলের মাঝমাঠে দুজন ফুটবলার কেবল নামের ওজনে একের পর এক ম্যাচ খেলেছেন এটা শুনলেও বিশ্বাস হতো না যদি খেলা দেখার অভ্যেসটা কম থাকতো আমার। ইংল্যান্ডের মধ্যমাঠে দুজন বা পেয়ে খেলোয়াড় ল্যাম্পার্ড এবং জেরার্ড একই সাথে ম্যাচ শুরু করেছে সবগুলো ম্যাচেই। বার্ক্লে লীগে দুজন খেলোয়াড়ই পছন্দ করেন লেফ্ট উইং ধরে দৌড়তে। তারপর বা পায়ের ক্রস কিংবা সরাসরি গোলে শট নিয়ে চমকে দেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্সকে। আর বিশ্বকাপের কোন ম্যাচেই দেখলাম না তাদের বাম প্রান্ত ধরে ছুটতে। যেনো দুজনই অন্যজনের জন্য জায়গাটা ছেড়ে দিচ্ছেন। ইংলিশ লীগে সাধারণত লিনেকার জমানার পর ক্লাসিক স্ট্রাইকার ধারণাটার খুব একটা কদর নেই। থাকলেও সেটা দখল করে আছে ভিনদেশী ফুটবলাররাই। আর তাই এমিল হেস্কির বিরক্তিকর ফুটবলের পর ডিফো'র এক গোলেই কোচ বেশি আহ্লাদিত হয়ে পড়েছিলেন। ক্রাউচের মতোন কার্যকরী স্ট্রাইকারকে বসিয়ে রেখে, বা বদলী হিসেবে ডান প্রান্তে নামিয়ে কি ফল আশা করেছিলেন জানি না। তার জন্য যে অবসনের হেড অথবা ল্যাম্পার্ডের কিকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, কখন ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হ'ন সে আশায় সেটা বোধকরি ক্যাপেলো বুঝেছেন এবার। কিন্তু ২০১০ সালের ফুটবলতো আরো ট্যাকটিকাল হয়ে গেছে, ভাগ্যদেবী এখন আর ফুটবলে মনোযোগী নন, তিনি মনে হয় ধনীলোকের গল্ফেই মনোনিবেশ করেছেন কেবল।
জন টেরীর নিশ্চিত ক্যাপ্টেন্সী ফিরিয়ে নিয়েছিলো ইংলিশ ফেডারেশন। তার দোষ তিনি অন্য আরেক খেলোয়াড়ের প্রেমিকার সাথে প্রতারণামূলক অভিসারে গিয়েছেন। চেলসী'র টেরী তাই ইংলিশ আদর্শের নৈতিকতায় ফেসে দলের সাধারণ একজন ব্রাত্য খেলোয়াড়ের মতোই খেললেন এবারের বিশ্বকাপ। গতোকাল জার্মান টেকনিকে তিনি ধরা খেলেন নাকি ধরা খাওয়ালেন সে বিষয়ে গবেষণাটাও হয়তো ব্রিটিশ মিডিয়ায় শুরু হবে ক'দিন পর। জার্মানরা ম্যাথুশ্যাকারের নেতৃত্বে গড়ে তুললো জমাট রক্ষণভাগ। যে ফ্রিদিরিক তার ৩৩ বছরের জীবনে আন্তর্জাতিক কোন খেলাতে কখনো কার্ডের মুখ দেখেনি কৌশলের মূল্য দিলেন তিনি কার্ড দেখে। রুনি তার হাতেই বোতলবন্দী থাকলো অধিকাংশ সময়। বোয়েটাং নাকি জার্মান দলের নিয়মিত কেউ নয় কিন্তু বাম প্রান্ত সামলে তিনি বেশ ক'বারই ওভারল্যাপ করলেন। যার একটাতে গোলের প্রথম স্পর্শটাও আছে। ছোটখাটো গড়নের ফিলিপ লামকে গ্রুপ ম্যাচগুলোতে বারবার উপরে উঠে যেতে দেখা গেলেও গতোকাল একবারো সে উপরে উঠার নাম করেনি। যাওবা দুয়েকবার উঠতে হয়েছে অ্যাটাকিং ফার্স্টের ভূমিকা শেষ করেই আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেছেন। এর আগে শোয়েইনস্টেগারকে বালাকের বিকল্প ভাবতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার কিন্তু কালকের পর মনে হলো, না লো সঠিক বিবেচনা থেকেই তাকে বালাকমানের ফুটবলার ভাবেন। মেসুৎ ওজিল গতোকালও কোরআন তেলাওয়াতের পর মাঠে নেমেছেন কীনা জানি না। তবে ২১ বছর বয়সী এ ফুটবলারের ফুটবল সেন্স আমার কাছে মেসির চাইতে কম মনে হয়নি। কেবল ড্রিবল দক্ষতায় যেটুকু পিছিয়ে থাকা। আর কাউন্টার অ্যাটাকে দুটি গোল করা ম্যূয়েলারকে আমার টিপিক্যাল জার্মান দলের উত্তরসূরী মনে হয়েছে, আর সেটাও যেনো ইয়াকিম লো'র পরিকল্পণা। ইংলিশদের কৌশল দিয়েই ইংলিশদের হারিয়ে দেয়া সাথে একটি অপরিচিত উপাদান ম্যূয়েলার।
লাইন্সম্যান ইংল্যান্ডকে একটি গোলবঞ্চিত করেছেন তাই বলে ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই রেফারী জার্মানদের পক্ষে ছিলো। তারা এলোমেলো খেলা পরিচালনা করেছে। একই ধরনের ট্যাকলে দুরকমের রায় দিয়েছেন হরহামেশাই। তার কোনটা গেছে রুনির পক্ষে কোনটা ফ্রিদিরিকের। এবারের রেফারিং খুবই উত্থানপতন পারফর্মেন্স মেনে চলেছে। এসব নিয়েই জার্মান বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচ নিয়ে শেষ কথা বলে দেয়া যায়, গতকাল জয় হয়েছে কৌশলি অনুপ্রেরণাদায়ক ফুটবলের, হেরে গেছে মিডিয়া ফ্যান্টাসী।
এটা তো আসলে ব্রিটিশ মিডিয়া টিম। আর টেরির খেলা দেখে কাল ব্যাপক অবাক হয়ছি।
বিশ্লেষণ নিয়মিত চাই।
বিশ্লেষককে ফিরে পেয়ে ভালো লাগলো। নিয়মিত চাই বিশ্লেষণ
আপনাকে এ কদিন মিস করেছি।
যথারীতি চমৎকার বিশ্লেষণ।
ইতালীর ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন শুনতে আগ্রহী।
আর ক্যাপেলো রুনিকে উঠিয়ে ডিফোকে সামনে রেখে তার ঠিক পেছনে জেরার্ডকে রেখে খেলালে কি সফলতা পেতেন?
আর আমি ভাবছি ফুটবলে ভিডিও টেকনলজি যুগের আগমন অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে ইংল্যান্ড-জার্মানি আর মেক্সিকো-আর্জেন্টিনা ম্যাচদুটো্।
ইতালির ব্যর্থতার বিশ্লেষণে আর সবার মতোই আমারো বয়স নিয়ে প্রশ্ন আছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার কারনে এবার বয়স্ক খেলোয়াড়েরা এমনিতেই সমস্যায় পড়ছে। খেয়াল করলেই দেখবেন এখন পর্যন্ত চোখে পড়ার মতোন সব খেলোয়াড়ের বয়স তিরিশের নীচে। অনেকের তো কেবল ২০ পেরিয়েছে কেবল। তবে ইতালি দলে এবার সুপারস্টার খেলোয়াড়ের অভাব ছিলো, শুরুতে মনে হচ্ছিলো কোচ নাভাস আর পিরলোকে না নামিয়ে ভুল করেছেন...কিন্তু পরে এই দুজনও খুব ভালো পারফরমেন্স দেখাতে পারেনি। এ জন্য দায়ী আসলে তাদের খরুচে লীগ। এবারের বিশ্বকাপে প্রায় সকল দলেই নজরকাড়া খেলোয়াড়েরা পাঁচটি লীগে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে, স্পেনের প্রিমেরা, ইঙল্যান্ডের বার্ক্লে প্রিমিয়ার, ইতালির লা লীগা, ডাচ লীগ, বুন্দেসলীগ বা পর্তুগীজ লীগ। যে কারনে দেখবেন শুধুমাত্র জার্মান দল বাদে এই দেশগুলোর দলে সব পজিশনেই ঘাটতি রয়েছে। ইতালি দলের ৩৬ বছর বয়সী ক্যানাভারো এখনো রক্ষণভাগের নির্ভরতা।ডি রসি'র উপর সুইপার পজিশনের দায়িত্ব রয়েছে, কিন্তু তার গেম রিডিং ক্ষমতা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর ইতালি দলে গোল করার মতোন খেলোয়াড়টা কে যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে কার নাম বলবেন?
রুনিকে প্রথমে খেলানো হয়েছে সেন্ট্রাল স্ট্রাইকার হিসেবে, আর তার পর গতো ম্যাচে তার দায়িত্ব নিয়ে আমি নিজে সন্দিহান। তাকে ঠিক কোন দায়িত্ব নিয়ে খেলানো হয়েছে সেটা স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে। রুনি দূরপাল্লার শট নিচ্ছিলেন, রুনি নিজে গোল করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তাতে আমি কোন পরিকল্পিত প্রচেষ্টা দেখি নাই। ডিফোকে আমার ঠিক বিশ্বমানের স্ট্রাইকার মনে হয়নি। আমি এখনো মধ্যমসারির দলে খেলা ক্রাউচকে ক্লাসিক স্ট্রাইকার হিসেবে দেখতে আগ্রহী। গতো বিশ্বকাপেই তার ইনক্লুশন হঠাৎ হলেও বিশেষভাবে নজর কেড়েছিলো।
আর অবশ্যই ভিডিও টেকনোলজির প্রয়োজনটাকে সামনে নিয়ে এসেছে রেফারীদের ব্যর্থতা।
হুম, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার কথা মাথায় ছিল না। ধন্যবাদ।
অত্যন্ত আফসোসের ব্যাপার ইতালির মত ফুটবল পাগল দেশ চার বছরে নামোল্লেখ করার মত একজন খেলোয়াড় তৈরি করতে পারেনি। পিরলো সম্ভবত ইনজুরড ছিল, এ কারনে গ্রুপের প্রথম দিকের ম্যাচ দুটোতে তাকে নামানো হয়নি।
ধনব্যাদ আবারও যৌক্তিক বিশ্লেষণের জন্য।
হল্যান্ড আর স্লোভাকিয়ার খেলার বিশ্লেষন চাই
আপনাকে মিস করছিলাম ... ফ্যান্টাসী লীগে যোগ দেবেননা?
মন্তব্য করুন