আমার রবীন্দ্রনাথ : প্রেমে ও প্রার্থনায় - 'বড়ো বেদনার মতো বেজেছো'
অনেকদিন ধরে লেখালেখি থেকে দূরে সরে আছি। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে - লিখতে পারছি না। এর ঘোরতর দুর্যোগ যেন নেমে এসেছে জীবনে। তবু, আজকে মনে হলো - রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দু-চার কথা বলার চেষ্টা করি। তাঁকে নিয়ে সবসময়ই কথা বলা যায়, কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। আজ তাঁর জন্মজয়ন্তী। এই উপলক্ষেই না হয় কিছু বলা যাক।
২.
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল ছোটবেলাতেই, আমার ফুপার কল্যাণে। তিনি ছিলেন ঘোরতর রবীন্দ্রপ্রেমী, এরকম বিস্ময়কর রবীন্দ্রপ্রেম আমি আর কারো ভেতরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কত গান আর কবিতা যে তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল এখন ভাবলেও অবাক লাগে। কন্ঠও ছিল উদাত্ত, ফলে তাঁর পাঠ বা আবৃত্তি খুবই আকর্ষণ করতো আমাকে। আমাদের পরিবারটি ছিল পুরনো কালের যৌথ পরিবার। বাড়িতে বাবা-চাচা-ফুপু, তাদের ছেলেমেয়ে, আত্নীয়স্বজন মিলে অনেক মানুষ - প্রায় ৫০/৬০ জন। তাদের ভেতর থেকে আমি বিশেষভাবে ফুপার ভক্ত হয়ে গেলাম; মনে হলো, তিনি যেন সবার থেকে আলাদা। সাধুসন্তের মতো জীবন-যাপন ছিল তাঁর। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সমস্ত বৈষয়িকতাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তিনি। এই ফুপার কাছ থেকেই আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথকে চেনা। তিনি শুধু পড়তেন না, ব্যাখ্যাও করতেন অসাধারণভাবে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি বলতেন - 'প্রফেট অব পোয়েট্রি’। এগুলো ছোটবেলার কথা। বড়ো হয়ে, তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ততোদিনে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছি, লেখালেখির জগতে ঢুকেছি তারও আগে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি বহু-বহুবার ভেবেছি - কেন তিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এত বিভোর ছিলেন! কেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন? সেদিন এই কথাটি জিজ্ঞেস করতেই গিয়েছিলাম। এর আগেও তাঁর সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে অনেক কথা হতো। পারিবারিক কোনো আলাপ নয় - প্রধানত সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে আলাপ, আমাদের গল্পের ধরণই ছিল অন্যরকম। কিন্তু কোনোদিন তাঁর রবীন্দ্রপ্রেমের কারণটি জানতে চাওয়া হয়নি। এবার জিজ্ঞেস করার আগে তাঁর প্রিয় একটি কবিতা পাঠ করে শোনালাম, গীতাঞ্জলি থেকে -
“যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু,
এবার এ জীবনে
তবে তোমায় আমি পাই নি যেন
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।
এ সংসারের হাটে
আমার যতই দিবস কাটে,
আমার যতই দু'হাত ভরে উঠে ধনে,
তবু কিছুই আমি পাইনি যেন
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।’’...
যার কৈশোরকে তিনি ভরিয়ে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে তার কণ্ঠেই প্রিয় কবির প্রিয় কবিতা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন, চোখ ভরে উঠলো জলে, নীরব হয়ে রইলেন দীর্ঘক্ষণ। একসময় আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম - 'আপনি যে সারাজীবন রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করে গেলেন - কী পেলেন তাঁর কাছ থেকে?' উত্তরে তিনি একটিমাত্র বাক্য বললেন। আমার ধারণা - সারা পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথকে এ পর্যন্ত যত মানুষ ও লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, তাদের কেউই এরকম কথা কখনো বলেননি। তিনি বললেন - 'রবীন্দ্রনাথ মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের এ্যাকোমোডেশন দেখিয়েছেন!'
৩.
তাঁর এই কথাটিকে ব্যাখা করার মতো ভাষা আমি আজও শিখে উঠতে পারিনি। কি অর্থ ওই 'অ্যাকোমোডেশন' শব্দটির? তা-ও 'মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের এ্যাকোমোডেশন!' ঈশ্বরের ভেতরে মানুষের অ্যাকোমোডেশন নয় কিন্তু! ধরুন, এই ছোট্ট ঘরে আপনি এক হাজার লোকের থাকার ব্যবস্থা করতে চান। পারবেন? না, পারবেন না। কেন পারবেন না? 'অ্যাকোমোডেশন' হবে না! এত ছোট্ট ঘরে এত লোকের 'অ্যাকোমোডেশন' সম্ভব নয়! অর্থাৎ ক্ষুদ্র কোনোকিছুর ভেতরে বৃহৎ কোনোকিছুর 'অ্যাকোমোডেশন' হয় না! অথচ রবীন্দ্রনাথ সেটিই করেছেন! 'ক্ষুদ্র ও সসীম' মানুষের ভেতরে 'বৃহৎ ও অসীম' ঈশ্বরের 'অ্যাকোমোডেশন' দেখিয়েছেন! এটিই কি ফুপার কথাটির ব্যাখ্যা? আমি জানি না। ব্যাখ্যা করতে পারি না।
এই হচ্ছে আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথ দর্শন।
৪.
ছোটবেলা তো একরকম, কিন্তু যৌবন থাকে উদ্দামতায় ভরা। ওই বয়সে রবীন্দ্রনাথ সার্বক্ষণিকভাবে সঙ্গে থাকেন না, আসলে। তখন তারুণ্যের জয়গান গাওয়া হয়, শুধু রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে চলে না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা বলি - তখন ব্যান্ড সংগীতের রমরমা সময়, বাজার প্রায় পুরোটাই তাদের দখলে। নব্বই দশকেও ব্যান্ড সংগীত, নাচানাচি, হৈচৈ ইত্যাদি চলতো। সে-সময় ব্যান্ড সংগীত যেমন শুনছি, হুল্লোড়-হৈচৈ করছি, তেমনই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দিচ্ছি - এইরকম। কিন্তু ঘরে ফিরে এসে, গভীর রাতে, যখন একা, তখন কবিতা বলতে জীবনানন্দ দাশ এবং গান বলতে রবীন্দ্র সংগীত। রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার ফিরতেই হতো। তাঁর কত গান যে আমার সংগ্রহে আছে, আর কত গান যে শুনেছি বলতে পারবো না! তাঁর প্রায় সমস্ত গল্প-উপন্যাস আমার পড়া; প্রবন্ধ আর কবিতা সবগুলো না হলেও বেশকিছুই পড়া। অবশ্য এখন তাঁকে পড়ার ব্যাপারটা অনিয়মিত, কিন্তু তাঁর গান না শুনলে আমার চলেই না। আজকে থেকে নয়, বহুদিন আগে থেকেই আমি তাঁর গানে বুঁদ হয়ে আছি। রবীন্দ্র সংগীত আমাকে একটা-না-একটা শুনতেই হবে, প্রতিদিনই। এটা কী জোর করে? না। মনের টানেই। আর তিনি এমনই এক শিল্পী যে, একেকসময় একেকভাবে আমাকে ধরা দেন। একটি গান এক বয়সে এক ধরনের অর্থ নিয়ে ধরা দেয়, পরে সেটিই আবার আলাদা অর্থ নিয়ে হাজির হয়।
একটা উদাহরণ দিই। 'বড় বেদনার মতো বেজেছ' নামে একটা গল্প লিখেছিলাম বছর দশেক আগে। ওই গল্পে একটা কথা আছে। গল্পের নায়কের মুখেই শুনুন - 'প্রেম আমার কাছে কী জানেন? রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না - বড় বেদনার মতো বেজেছ; ওই রকম। প্রেম যদি বেদনার মতো বেজে না ওঠে তাহলে সেটি প্রেম নয়। আমার জীবনে অনেক ভাল লাগা এসেছে। হয়তো প্রেমও এসেছে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। কেন? কারণ সেই প্রেম বেদনার মতো বেজে ওঠেনি।' ওই সময় গানটি আমার কাছে নারী-পুরুষের প্রেম অর্থেই ধরা দিয়েছিল। কিন্তু এর কয়েক বছর পর আমার কাছে গানটির অর্থই বদলে গেল কলিম শরাফীর কণ্ঠে শুনে। একটা প্রামাণ্যচিত্র হয়েছিল কলিম শরাফীকে নিয়ে। তিনি তো বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় এসেছিলেন; ওই প্রামাণ্যচিত্রে যখন এই প্রসঙ্গটি আসে, মানে তাঁর দেশত্যাগের প্রতীকী চিত্রটির কথা বলছি, তখন তিনি অসামান্য এক দরদভরা বেদনা দিয়ে গেয়ে ওঠেন - 'বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে...।' ঠিক সেই মুহূর্তে আমার কাছে গানটির অর্থ বদলে যায়, মনে হয় এই 'তুমি' মানে হারানো জন্মভূমি, যেখানে আর কোনোদিন ফেরা হবে না। তাঁর বেদনাটি আমি অনুভব করে উঠি। কারণ আমার নিজের জন্মভিটে, আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি, যেখানে আমার বাবা জন্মেছিলেন, মৃত্যুকেও বরণ করেছিলেন ওই বাড়িতে, যেখানে আমার মা নতুন বউ হয়ে এসেছিলেন, এমনকি আমার দাদিও - সেই শতবর্ষের পুরনো বাড়িটি পদ্মায় ভেঙে নিয়ে গেছে। সেখানে আর কোনোদিন আমার ফেরা হবে না। কলিম শরাফীর কণ্ঠে গানটি শুনে আমার চোখ ভিজে ওঠে। আর তারপর থেকে সমস্ত হারিয়ে যাওয়া 'তুমি'র কথা মনে হলেই গানটি মনে আসে। এমনকি মায়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও।
৫.
রবীন্দ্রনাথ এমন এক শিল্পী যিনি একটা গান কিংবা কবিতার ভেতরে হাজারটা অর্থ ধরে রেখেছেন, যা ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে আমার কাছে ধরা দেয়। আমার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এমনভাবে মিশে আছেন যে, তাঁকে ছাড়া আমার চলেই না। কোনকিছুতেই যখন স্বস্তি মেলে না, কোনো মুখ আমাকে শান্তি দেয় না, সব মিলিয়ে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা ভর করে, তখন রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতরে ঢুকে পড়ি। প্রেম বা প্রার্থনা, স্বস্তি, শান্তি, আনন্দ বা আশ্রয় সবই মেলে তাঁর কাছে। আর তিনি তো সেই অসামান্য শিল্পী যিনি প্রেম ও প্রার্থনাকে অবলীলায় একাকার করে ফেলেছেন; দুটো বিষয়কে তিনি আলাদা করে তো দেখেন-ই নি, বরং সমার্থক করে তুলেছেন। যা কিছু প্রেম তা-ই প্রার্থনার যোগ্য, যা কিছু প্রার্থনা তা-ই প্রেমের যোগ্য। এরকম উদাহরণ আপনি আর কোথায় পাবেন, বলুন? তাঁর এ ধরনের গান যখন শুনি, মনটা শান্ত হয়ে আসে; নমিত ও স্থির হয়ে আসে। আর তাই, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া দিনযাপন - এক অসম্ভব ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে।
রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিনিয়ত ফিরে আসাটাই প্রতিটি বাঙ্গালী স্বত্তার নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে।
অবশ্য হবে না ই বা কেন!
আর কে ই বা কবে আমাদের সাধারন অনুভূতিগুলি নিয়ে এতটা ভেবেছেন; লিখেছেন, এতটা অসাধারণ ভাবে তার রচনায় অমরতায় রেখে গেছেন!
সেটাই। আর কে-ই বা পেরেছেন এমন!
পড়াশোনার জীবনে তিনি বড়ই ত্যাকত করেছেন (
কবিতা মুখসথ সাথে কঠিন কঠিন শবদের মানে
খালি ত্যক্ত করেছেন? তাঁকে ছাড়া তো একত মুহূর্তও থাকতে পারেন না! বলতে লজ্জা লাগে?
দারুন।
রবীন্দ্রনাথ সব লেইখা শেষ কইরা ফেলছে
হ!
প্রফেট অফ পয়েট্রি, ভাল লাগছে এই কথাটা। তবে ভাগ্য ভালো যে এর বাংলা করেন নাই। তাহলে খবর ছিল।
অনেকদিন পর লিখলেন। নানা ধরণের ঘটনা লিখছে। এই সময় লেখকরাই তো লিখবেন। কেন লেখা বন্ধ করেন?
লেখা বন্ধ করার ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়, মাসুম ভাই। গত বছর অতিরিক্ত পরিশ্রম করেছি, কিছুটা অবসাদ এমনিতেই ছিল। ভেবেছিলাম, কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে, ঢাকার বাইরে গিয়ে কিছুদিন বেড়িয়ে এসে আবার শুরু করবো। কিন্তু এ বছরের শুরু থেকেই একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগলো, জাতীয় জীবনে এমন সব বিপর্যয় ঘনিয়ে এলো যে, কিছুতেই স্থির হয়ে দুদণ্ড ভাবতে পারছি না। অস্থিরতা, আশংকা, দুঃশ্চিন্তা মনের ওপর মারাত্নক চাপ ফেলেছে। লেখা বন্ধ হয়ে গেছে নিজের অজান্তেই। জানি না, কবে এই বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাবো।
অসাধারণ...
রবিকে ছাড়া একটি দিন.. কেন যেন হয়না।
দিনের যে কোন সময় নিজের অজান্তে হলেও গুন গুন করে মনের কোণে বেজে ওঠে রবির গান..
অসাধারণ। ।
অসাধারণ একটা লেখা ।
জন্মভূমির প্রতি, পৈত্রিক ভিটার প্রতি আপনার মমতা, আবেগ সত্যি মুগ্ধ করে বারবার ।
নিয়মিত লিখবেন ।
মন্তব্য করুন