আলোকবর্তিকা...
অনেকদিন ব্লগে লেখা হয়নি, মূলত ব্যস্ততার কারণেই - যদিও মাঝে মাঝে লেখার কথা ভেবেছি। ভেবেছি, আনন্দময় কোনো অভিজ্ঞতার কথা লিখবো, পড়ে সবার মন-ও আনন্দে ভরে উঠবে! আমাদের নাগরিক জীবন থেকে আনন্দ তো হারিয়েই গেছে, যদি একটা লেখা অনেকের মনে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে - পারে মন্দ কি? আবার, এমন কিছু লেখার কথাও ভেবেছি কখনো কখনো যা পড়ে মনটা কোমল বিষণ্নতায় ভরে উঠবে । না, মন খারাপ করিয়ে দেয়ার মতো লেখার কথা বলছি না, বলছি কোমল অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হবার মতো লেখার কথা। আমাদের যাপিত জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলো এতটাই রূঢ়, এতটাই কঠোর যে মনটা দুমড়ে-মুচড়ে থাকে সারাক্ষণ। আনন্দিত হবার মতো বা কোমল আচ্ছন্নতায় ভরে উঠবার মতো ঘটনা প্রায় ঘটেই না! ভেবেছি বটে, লেখা হয়নি আর। তবু ভাবনাটা আজ সকাল পর্যন্তও একইরকম ছিলো। দারুণ ব্যস্ততার পর অবসরও মিলেছিল খানিকটা। কিন্তু তেমন কিছু লেখার আগেই মনটা ভেঙে যাবার মতো দুঃসংবাদ এলো - তারেক মাসুদ আর নেই!
২
বলার মতো তেমন কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমার ছিলো না তাঁর সঙ্গে। ‘মাটির ময়না’ মুক্তি পাওয়ার পর একটা রিভিউ লেখার কথা ছিলো, কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। আমি চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটি বুঝি না, চলচ্চিত্র সমালোচনার দুঃসাহস তাই হয়নি। তবে একথা সত্যি যে, এই ছবিটি আমাকে তাঁর সম্বন্ধে আগ্রহী করে তুলেছিল। ‘মাটির ময়না’র আগে দেখা ‘মুক্তির গান’ আমাকে মুগ্ধ করেছে বটে, কিন্তু তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি মনে। মনে হয়নি যে, এই লোকটির পথচলা কেবলি চলার জন্য নয়, এই পথচলার একটা বিশেষ ধরন আছে। ধরনটি হলো - তিনি তাঁর গন্তব্য জানেন, কিন্তু ওটাই যে তাঁর গন্তব্য সেটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য পথচলার সময়েই পথে পড়ে থাকা, এমনকি আশেপাশে পড়ে থাকা নানা উপাদান সংগ্রহ করেন তিনি এবং সেগুলোকে আরো অনেকের সামনে হাজির করেন। ‘মুক্তির গান’ দেখে মনে হয়নি বটে, ‘মাটির ময়না’ দেখে এই কথাগুলোই মনে হয়েছিল আমার। কেন ‘মুক্তির গান’ দেখেই মনে হয়নি কথাটা, এ প্রশ্ন নিজেকে করেছি। এবং মনে হয়েছে, ওই ডকুমেন্টারিতে তাঁর কমিটমন্টের ব্যাপারটা বোঝা গেছে বটে, কিন্তু তাঁর মানসগঠন বোঝা যায়নি। হয়তো ‘মাটির ময়না’ ফিচার ফিল্ম বলেই সেটা খানিকটা আঁচ করা যায়! কিন্তু একজন শিল্পীর একটিমাত্র কাজ দেখে তাঁর সম্বন্ধে ভালোমন্দ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আমার স্বভাববিরুদ্ধ, আমি তাই তাঁকে বোঝার জন্য আরো কিছু কাজ দেখবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
৩
ব্যক্তিগত জীবনে একটা সংগ্রাম ছিলো তাঁর। ছোটবেলায় তাঁকে পড়াশোনা করতে হয়েছে মাদ্রাসায়, বাবার ইচ্ছায়। তাঁর বাবা সম্ভবত খানিকটা গোঁড়া ছিলেন, যদিও পরিবারের অন্যান্যরা তা ছিলেন না হয়তো। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘বাবা আমাকে মাদ্রাসায় রেখে তবলিগে চলে যেতেন, আর চাচা এসে আমাকে উদ্ধার করতেন!’ কিন্তু সেই ‘উদ্ধার’ বেশিদিনে জন্য নয়, তাঁকে মাদ্রাসায় ফিরে যেতেই হতো আর সেজন্যই মাধ্যমিক পর্যন্ত তাঁকে মাদ্রাসাতেই পড়তে হয়েছে! কলেজ পর্যায়ে এসে তিনি যুক্ত হন সাধারণ শিক্ষা ধারায়। কলেজে সবাই যখন একে অপরকে জিজ্ঞস করতো - কে কোন স্কুল থেকে এসেছে, তিনি বলতে লজ্জা পেতেন। কিন্তু ব্যাপারটা তো আর চেপে রাখা যায় না, ফলে একসময় যখন বন্ধুরা জেনে গেল তখন সবাই তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতো! আর তাঁর মনে হতো - ‘আমি বুঝে গেলাম, আমার শৈশব আর সবার মতো ঠিক স্বাভাবিক নয়!’ এটা বুঝে যাওয়া এমন কোনো কঠিন বিষয় নয়। যেটি কঠিন, সেটি হলো - কলেজ জীবন থেকেই তিনি যুক্ত হলেন চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে, আর গুরু হিসেবে পেলেন মোহাম্মদ খসরুকে!
এই যে ধর্ম-কেন্দ্রিক শিক্ষার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কলেজে এসে চলচ্চিত্রের মতো একটা ‘ধর্মবিরোধী’ বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, পুরোপুরি বিপরীতধর্মী একটা মাধ্যমকে নিজের ভালোবাসার ক্ষেত্র হসেবে বেছে নেয়া - আমি এটাকেই বলছি সংগ্রাম। নিজের সঙ্গে নিজের, পরিবারের সঙ্গে নিজের! তাঁর এই সংগ্রামটি আমাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে এসেছে বরাবর।
যে-কোনো বড়োমাপের মানুষকেই তাঁর পরিবারের বেঁধে দেয়া গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে পা ফেলতে হয়, নইলে তার জীবন হয় -‘জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর/ একটি নামের মধ্যে নিজেরই বিস্তার ধরে রাখা!’ তারেক মাসুদ গণ্ডিটি পেরিয়েছিলেন অল্প বয়সেই - তাঁর সংগ্রামের বিশেষত্বটা এখানেই।
৪
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে তিনি পেয়েছিলেন মোহাম্মদ খসরুকে, আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই পরিচিত হয়েছিলেন আহমদ ছফার সঙ্গে। ক্রমশ সেই পরিচয় ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছিল আর তাঁর সুবাদেই পরিচিত হয়েছিলেন শিল্পী সুলতানের সঙ্গেও। শুধু পরিচয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি, সুলতানের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাটিয়েছেন সাতটি বছর!
তরুণ বয়সে এই ধরনের মানুষদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা যে-কোনো শিল্পীর মনেই গভীর প্রভাব ফেলে! সুলতানকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার সুযোগ হয়নি আমার, কিন্তু আহমদ ছফাকে যতোটুকু কাছ থেকে দেখেছি, মনে হয়েছে - তাঁর কথাগুলো ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতো যে কোনো মানুষকেই। তাঁকে আপনি স্বীকার করতে পারেন, অস্বীকারও করতে পারেন - কিন্তু তার সম্বন্ধে উদাসীন থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়, তাকে উপেক্ষা করা তো আরও অসম্ভব! ঘোর বিরোধী হলেও তাঁর কথাগুলো আপনাকে ভাবাবেই।
ছফা এবং সুলতান দুজনই ছিলেন শেকড়সন্ধানী শিল্পী! তাঁদের সন্ধান-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে কারো মনে কোনো প্রশ্ন থাকলেও এ কথা কেউ অস্বীকার করেন না যে, তাঁদের চিন্তাপদ্ধতি ছিলো মৌলিক, ভিন্নতর এবং প্রচলিত ধারণা-বিরুদ্ধ।
এই দুজনের কোনো প্রভাব কি পড়েছিল তারেক মাসুদের ওপর?
৫
ব্যক্তিমানুষকে দিয়ে সবসময় তাঁর শিল্পের বিচার করা চলে না। অনেক সময়ই একজন মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বা আর শিল্পীসত্ত্বা ভিন্ন হয়ে থাকে। তবু কথাগুলো বললাম, কারণ কখনো কখনো শিল্পীমানস বোঝার জন্য ব্যক্তির জীবনযাপন সহায়তাও করে।
আমার কাছে তারেক মাসুদকেও মনে হয়েছে শেকড়সন্ধানী মানুষ। তাঁর চিন্তা হয়তো ছফা বা সুলতানের চিন্তার সমার্থক নয় ( না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, প্রত্যেক শিল্পীকেই মৌলিক চিন্তার পরিচয় দিতে হয় - নইলে তিনি শিল্পীই নন), কিন্তু তাঁর সন্ধানটি বোঝা যায় কাজগুলো দেখলেই!
আর এ সন্ধানের জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধকে বেছে নিয়েছিলেন বাতিঘর হিসেবে - যা তাঁকে দুবোর্ধ্য অন্ধকারেও পথ দেখাবে!
৬
কাজগুলো তিনি শেষ করে যেতে পারেননি, তবু এই সন্ধানী শিল্পী মানুষটিকে, ব্যক্তিজীবনে বিনয়ী ও সহজ এই মানুষটিকে, এই সুনির্দিষ্ট গন্তব্যমুখী মানুষটিকে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।
তারেক মাসুদ, কাজ শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে হয়েছে আপনাকে; তবু আপনি আলোকবর্তিকা হয়েই বেঁচে থাকবেন পরবর্তী প্রজন্মের শেকড়সন্ধানীদের কাছে!
দ্রষ্টব্য : সারাদিন বিধ্বস্ত ছিলাম, এখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি। খানিকটা হালকা হবার জন্য লিখতে বসেছিলাম। কিন্তু যা ভেবেছি তার কিছুই লেখা হলো না! এলোমেলো একটা লেখা... গুছিয়ে লেখার মতো মন নেই... দুঃখপ্রকাশ করছি সেজন্য।
ভয়াবহ মন খারাপ হচ্ছে মানুষটার জন্যে।
যারা দেশে ফিল্ম নিয়ে স্বপ্ন দেখে তাদের জন্যে তারেক মাসুদ একটা বিশাল আশার জায়গা। স্বপ্ন দেখাটাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এখন।
লিমনের ঘটনার শোক কাটতে না কাটতে রুমানা... মিরসরাই ... আমিন বাজার... তারেক মিশুক... এর পর কে? একটার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে...
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১ জুন নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন দক্ষতা পরীক্ষা ছাড়াই ২৪ হাজার ৩৮০টি লাইসেন্স দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর সঙ্গে আবেদনে প্রতিস্বাক্ষর করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
এর পর আবার আমরা দাবী করবো যে সড়ক দূর্ঘটনা হ্রাস করার বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই... হুহ্!
মনটা যে কি পরিমান খারাপ বোঝাতে পারবো না।
খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমাদের দেশের জন্য এক অপুরণীয় ক্ষতি। তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
তাঁর মুক্তির গান ছিনেমার পরেই তাঁকে নিয়ে আগ্রহ তৈরী হয়, মুলতঃ মুক্তিযুদ্ধের উপর এরকম তথ্য নির্ভর ফিল্ম বা ডকুমেন্টরি আগে দেখিনি, এর পরেও দেখিনি ।
এর পরে মাটির ময়না , অন্তর্যাত্রা মুভি দিয়ে মনের ভিতর একটা আসন গড়ে নিয়েছিলেন। যাকে নিয়ে গর্ব করতে পারতাম। যাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম , দূর থেকেই । প্রথমে বিশ্বাস হয় নাই তারেক মাসুদের মৃত্যুর খবর। পুরো খবর কয়েকটা চ্যানেলে দেখে বিশ্বাস হয়েছে, তাও কষ্ট হচ্ছিল এরকম ভাবে চলে যাওয়ার জন্য।
ভয় হয়, বোধ করি তারেক মাসুদের সাথে মারা গেল সুস্থ-চলচিত্রের ধারা আর মিশুক মুনীরের সাথে মারা গেল সুস্থ-সাংবাদিকতার ধারা ।
~
আমাদের এই দুর্ভাগা দেশটা তার সম্পদ গুলারে রাখতে পারেনা।
যথার্থ বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাতিঘর। তারেক মাসুদ আলোকবর্তিকা হিসেবে বেঁচে থাকবেন।
এরকম আলোকবর্তিকার এমনিতেই এতো অভাব দেশে। তিনিও চলে গেলেন। সঙ্গে মিশুক ভাই।
আলাদাভাবে সবার মন্তব্যের উত্তর দেয়ার মতো মন নেই।...
যাঁরা চলে গেছেন তাঁদের প্রতি আমাদের এই ভালোবাসা চিরঞ্জিব হয়ে উঠুক।
এ ধরনের লেখা কখনোই এর থেকে বেশি গুছিয়ে লেখা যায় না।
কিছু বলার ভাষা নেই
মন খারাপ হয়ে আছে।
মাশুক এবং তারেক -এ দুই গুণী ব্যক্তির অকাল প্রয়াণের সচিত্র সংবাদ টিভি স্ক্রিনে দেখে অন্যদের সাথে আমার ৬ বছরের শিশুপুত্র মারুফ আহমেদ বর্ণ এবং ওর মা যারপরনাই অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। এমন মৃত্যু যে কতো অপ্রত্যাশিত এ থেকেই বোঝা যায়। আল্লাহ তাদের স্বর্গবাসী করুন। এ অকাল প্রয়াণ আর আমরা চাই না।
মন্তব্য করুন