এক যে ছিল ছোট্ট রাজকুমার..
আমি যখন ছোট ছিলাম, অনেক ছোটই বলা যায়। আমি বই পড়তে খুব ভালোবাসতাম, গল্পের বই।
এখনও ভালবাসি, কিন্তু তখনকার মত অতটা না। ওই মনটাই আসলে আর নেই, অথবা কেমন ছিল তা মনে নেই।
যা মনে রাখার কথা সেটাই বরং ভুলে বসে থাকি। এজন্যই হয়তো মাঝে মাঝে নিজেকে বড় বড় মনে হয়!
যাই হোক, আগের কথায় আসি। সেই ছোটবেলায় আমার নিজের তো আর বই কেনার উপায় ছিল না। কেউ উপহার দিলে পড়তাম, সেই সময়ে আমার নানার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি বেশি।
মাঝে মাঝেই পেতাম নতুন একেকটা বই, নতুন কোন কাহিনী পড়তে কি যে ভালো লাগতো তা বলে বোঝানোর নয় আসলে। যে জানে, সে জানে। তখনই একবার একটা বই পেয়েছিলাম, আতোয়াঁ দ্যু সাঁ-জ্যুপেরীর লেখা 'ছোট্ট রাজপুত্র'।
অন্যরকম এক রাজপুত্রের গল্প ছিল তা, অনেক কিছু বুঝি নি তখন পড়ার সময় তাই অত বেশি ভালোও লাগে নি। তবে বইটার পাতায় পাতায় আঁকা ছবিগুলোর জন্যই হয়তো তাকে ভুলে যাই নি।
প্রথম পড়ার বেশ কয়েক বছর পর যখন আমি আরেকটু কম ছোট তখন পড়ে অনেক ভালো লেগেছিল, তারপর যতবার পড়েছি ভালোলাগাটা বেড়েই চলেছে কোন এক ভাবে, ব্যাপারটা অবাক করা।
আমি একটু ভেঙেই বলি, আর নয়তো তুমি নাও বুঝতে পারো পুরো ঘটনাটা।
ছোট্ট রাজপুত্রের নামই জানা নেই আমার, তাই এরকম 'নাম', 'বয়স', 'বাবা-মা কি করে?'র মত বোকাবোকা প্রশ্ন করো না যেনো। আমি যা জানি আর মনে আছে তাই বলি, বসে শোনো। সে থাকতো বড়জোড় একটা ঘরের সমান হবে, এতটাই ছোট একটা গ্রহে।
গ্রহ, বা গ্রহাণু, আবার এস্ট্রয়েডও হতে পারে - বি৬১২ - যেখানে ও থাকতো। তার একটাই ভয় ছিল, বাওবাব গাছ। তিনটা বাওবাব গাছ যদি কোনভাবে বড় হয়ে যেতে পারে, তাহলে একটা ঘরের সমান গ্রহের কি অবস্থা হতে পারে চিন্তা করা যায়।
গ্রহটাই দেখা যাবে নাই হয়ে গেছে, একবার নাকি এমনটা হয়েও ছিল। বোঝো, ভয় পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক! তিনটা আগ্নেয়গিরিও অবশ্য ছিল, তবে তার দুটো ছিল মোটে জ্যান্ত। রাজপুত্রের চুল ছিল কোঁকড়ানো আর ঝিকিমিকি সোনালি। ওর জামা ছিল সবুজ অথবা সাদা-নীল,
হাতে ছিল একটা তলোয়ার।ওর একটা কোদালও ছিল যা দিয়ে সে নতুন কোন বাওবাবের চারা গজাতে দেখলেই উপড়ে ফেলতো, কেন তা তো আগেই বললাম। ফুলগাছও হতো ওখানে, তবে কিছুটা একঘেয়ে লাগতো এক লাইনের পাপড়ির যত ফুল। রাজপুত্রের সূর্যাস্ত খুব পছন্দ ছিল,
মন খারাপ থাকলে নাকি সূর্যাস্ত দেখতে ভালো লাগে। একবার তো একদিনেই সে ৪৪বার সূর্যাস্ত দেখেছিল, ছোট্ট সেই গ্রহের জন্য তা ছিল কেবলই বসার চেয়ারটা একটু এদিক সেদিক করে নেয়ার ব্যাপার।
একদিন কোথা থেকে যেন উড়ে এলো অন্য কোন গাছের বীজ , রাজপুত্রের অনেক দিনের অপেক্ষার পর চারাগাছ বড় হয়ে সূর্যোদয়ের সাথে জন্ম নিয়েছিল গোলাপ। চারটা মাত্র কাঁটাই ছিল তার আত্মরক্ষার সম্বল। দিনে দিনে গোলাপের যত্ন নিতে নিতে ভালোবেসে ফেলেছিল রাজপুত্র,
যদিও তখনও সে জানতো না বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা কি। গোলাপও হয়তো তাকে ভালবেসেছিল, সময়ে বুঝতে না পারার অসময়ে। রাজপুত্রের কাছে গোলাপ ছিল সবচাইতে অন্যরকম, ওর বিশ্বাস ছিল তার গোলাপের মত গোলাপ আর হতেই পারে না। কারন আমাদের ভালোবাসাই
কাউকে আর সবার চাইতে বিশেষ আর অন্যরকম করে তোলে। তবুও একদিন রাজপুত্র তার গ্রহ ছেড়ে চলে এসেছিল বিশ্বভ্রমণের জন্য, খুব সম্ভবত এক ঝাঁক বাউন্ডুলে পাখির সাহায্যে। সে একেবারেই চলে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু গোলাপ কে বিদায় বলার পরও সে থাকতে বলে নি,
চলেই যাবার হলে - চলেই যেতে বলেছে। অভিমান বড় কঠিন জিনিস, মনেই থাকতে দেয় না - কাছের কারও চলে যাওয়াটাও আবারও কোনদিন ফিরে আসার পথে প্রথম ধাপ। আসলে ছোট্ট রাজপুত্রই গোলাপের ভালোবাসা বোঝার জন্য বা তাকে ভালবাসার জন্য অনেক ছোট ছিল,
তাই বোধহয় একটু কম ছোট হতেই গোলাপের কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাই ফিরে এসেছে বারবার।
গ্রহ ছেড়ে চলে আসার পর সে তার আসেপাশের গ্রহগুলো ঘুরে দেখতে থাকলো। যার এক গ্রহে ছিল এক রাজা, যার কাছে সবাই তার প্রজা আর কোন কিছুই তার হুকুম ছাড়া হয় না। আরেক গ্রহে থাকতো এক অহংকারী লোক, যে সবার কাছে কেবলই নিজের প্রশংসা শুনতে চাইতো।
আরেক গ্রহে ছিল এক মাতাল, যে মদ খাওয়ার লজ্জা ভুলতে মদ খায়। আরেক গ্রহে ছিল এক ব্যবসায়ী যার কাছে বেচা কেনার হিসাব করে করে আরও ধনী হওয়াই সবকিছু। আরেক গ্রহে ছিল এক বাতিওয়ালা, যার কাজ হোল সন্ধ্যা হলে গ্রহের একমাত্র ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া
আর সকাল হলেই নিভিয়ে দেওয়া। পরের গ্রহে ছিল এক ভূগোলবিদ, যে তার নিজের গ্রহ সম্পর্কেই প্রায় কিছুই জানে না। তার কাছে ক্ষণস্থায়ী কোন কিছুরই কোন মুল্য নেই! বড়রা আসলেই খুব অদ্ভুত। বড় বড় মানুষেরা সকলেই একদিন ছোট ছিল, কিন্তু তাদের মাঝে খুব কমই আছে যাদের তা মনে আছে।
এভাবে ছয়টা গ্রহ বা গ্রাহাণু ঘুরে দেখার পর ছোট রাজপুত্র আসে পৃথিবীতে। আফ্রিকার এক ম্রুভুমিতে এসে রাজপুত্রের সাথে পরিচয় হয় এক বিষাক্ত কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সাপের, তারপর আরও দেখা হয় তিন পাপড়ির এক একাকী ফুল আর সুবিশাল কিছু পাহাড়। তারপর বরফের দেশ পার করে
এসে এক গোলাপ বাগানের কাছে দেখা হল এক শিয়ালের সাথে। তার সাথে কথা বলতে বলতে বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার পর অনেক কিছুই শেখা হয় সেই শিয়ালের কাছ থেকে। যেমন 'বন্ধন তৈরি করার নামই বন্ধুত্ব। তোমার বন্ধু তোমার কাছে হবে আর সবার চাইতেই আলাদা, আর তোমার
বন্ধুর কাছেও তুমি হবে আর সবার চাইতে আলাদা। খুব স্পেশাল, ইওনিক কেউ একজন। অচেনা কাউকে নিজের করে নেয়ার যে দায়িত্ববোধ জন্ম নেয় সেটা মেনে চলাটাই বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসা। যা যা আছে সত্যিকার অর্থেই দরকারি, খালি চোখে তার কিছুই দেখা যায় না।
কেবল মাত্র হৃদয় দিয়েই তা দেখা যায়। এই সহজ সত্যটাই মানুষ ভুলে গেছে, তুমি যেন এই ভুল করো না।' তারপর বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে মন খারাপ করে ফের ফিরে চলে রাস্তায়, ছোট্ট রাজপুত্র।
পথে দেখা মিলে এক রেলওয়ে কর্মচারীর সাথে। তার সাথে কথা বলে মনে হয়, বড় বড় যত মানুষেরা সবাই কেবল ছুটছে। যেন, নিজের জায়গায় কেউই কখনো সুখী হতে পারে না। আসলে, ছোটদেরই ভাগ্যটা বেশ ভালো। তাদেরই কেবল জানা আছে, তারা কি খুঁজছে? কি চায়?
যা চায়, তা পেলে তা নিয়েই তারা খুশি আছে আর না পেলে কেঁদে বুক ভাসায়। তারাই কেবল জানে জানলার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে বাইরেটাও দেখা যায়। তারাই বেশ সুখে আছে। তারপর আরও পথ চলতে চলতে এসে আরেক সুবিশাল মরুভূমিতে দেখা মিলে যায় এক উড়োজাহাজের পাইলটের
সাথে, উড়োজাহাজ নষ্ট হয়ে পড়ায় নিজেই তা মেরামত করছে। এই উড়োজাহাজের চালকই হল আমাদের এই গল্পের লেখক, উড়োজাহাজ ভেঙ্গে পড়ার পর একদিন সকালে এখানেই দেখা হয় তার সাথে রাজপুত্রের। আর কথায় কথায় বন্ধুত্ব তো হয়েই যায়, রাজপুত্রের গ্রহের বাওবাব গাছ
খেতে পারবে এমন ভেড়ার ছবি এঁকে দিতে পেরেছে বলেই আবশ্য এত কিছু, কাঁটাসহ গোলাপ গাছ যেন না খেয়ে নেয় ভেড়া সেই ব্যাবস্তাও করে দিতে হয়েছে।
এভাবে আটদিন মরুভূমিতে পানি ছাড়া থাকার পর এক সকালে খুঁজতে খুঁজতে মিলে যায় এক কুয়া, মিষ্টি সুপেয় পানিতে ভরপুর। আর তখনই রাজপুত্রের মনে হয়, মরুভূমির সৌন্দর্যই হল যত লুকিয়ে থাকা কুয়োতে। তার পরের দিন অবশেষে ঠিক হয়ে এলো উড়োজাহাজ।
আর ওইদিনই এক বছর হলো রাজপুত্রের এই পৃথিবী ভ্রমনের, বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসে আর লেখকেরও মন খারাপ হতে থাকে অজানা আশংকায়। কাউকে কাছে টানলে, জলে চোখ ভেজানোর ঝুঁকিটা রয়েই যায়। রাজপুত্রেরও মন খারাপ, ফেরার পথ অনেক দূর। তবুও সান্ত্বনা দেয়
হয়তো এমনিতেই, 'যা কিছু আছে সত্যিকারের সুন্দর আর গুরুত্বপূর্ণ, তার কিছুই খালি চোখে দেখা যায় না। আমার গোলাপ ফুটে আছে কোন এক তারায়, তাই আমার কাছে মনে হয় সব তারাতেই গোলাপ ফুটে আছে। আমি যখন দূর আকাশে চলে যাবো, কোন একটা তারায় থাকবো আমি।
কোনদিন তুমি জানালা দিয়ে রাতের আকাশে তাকালে আকাশ ভরা তারাদের মাঝে আমাকে দেখতে পাবে, চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাবে আমার হাসি - ম্রুভুমির কুয়ার পানির মতই মিষ্টি। হাসি ভরা সেই তারা রয়ে যাবে কেবলই তোমার জন্য। '
তারপর ছোট্ট রাজপুত্র হেটে যেতে থাকে ম্রুভুমির ভেতর, দূরে হটাত তার পায়ের কাছে ঝলক দিয়ে উঠে সোনালি একটা কিছু। গল্পের মাঝামাঝি সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সাপের মতন। হয়তো এত লম্বা যাত্রার জন্য তার ছোট্ট শরীরও বড্ড বেশি ওজনদার, খোলস ফেলেই চলে যেতে হয়।
ফিরে তো তার যেতেই হবে, তার প্রিয় গোলাপ যে এখনও অপেক্ষায়। গল্প এখানেই শেষ, লেখকের মনের অপেক্ষায় - কি হলো তারপর? কারও জানা থাকলে জানিও যেন। যেখানেই আছে, ভালো থাকুক সোনালী চুলের ছোট্ট রাজপুত্র।
[শেষের পর - কয়েকদিন আগে, আমি যখন একটু কম ছোট থেকেও আরও আরেকটু কম ছোট; দেখা হয়ে গেল এক প্রচণ্ড ব্যস্ত মায়ের ছোট্ট মেয়ের সাথে। বড়মানুষদের ব্যাস্ত দুনিয়ার এক কোণে তাদের বাসার পাশেই দেখি সেইইইইই লেখক মশাই। তিনি এখন ইয়া লম্বা দাড়ির বুড়ো, সেই উড়োজাহাজটা
এখনো আছে।ছোট্ট মেয়েটাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ছোট্ট রাজপুত্রের দুনিয়ার সাথে। গল্পের যাদু মাখা যত পাতা জোড়া লেগে বই হতে হতেই লেখক অসুস্থ, কিছু ভালো লাগতে পারে যদি মিলে যায় উত্তর - কোথায় আছে কেমন আছে ছোট্ট রাজপুত্র। বুড়োর সাহায্যে এগিয়ে আসে আমাদের নতুন ছোট্ট বন্ধু।
খুঁজে বের করতেই হবে, বড় হয়ে যায় নি তো আবার ছোট্ট রাজপুত্র? সেই প্রিয় গোলাপেরই বা কি খবর? আর বি ৬১২? ছোট্ট রাজপুত্রের মতই সাহসী আর কৌতহলী পিচ্চি মেয়েটারই বা কি হবে? জানতে হলে আর কি, ঝাপিয়ে পড় এখনই। এডভেঞ্চারের শুরু এখানেই!
*** ছোট্ট রাজপুত্র সম্পর্কে আরো জানতে - www.thelittleprince.com আর
শেষের পরের কথা জানতে - https://en.wikipedia.org/wiki/The_Little_Prince_%282015_film%29 ]
অনেক অনেক ছোট বেলায় রাজপুত্রের গল্প পড়ি নি যে সেটা মনে আছে। রাক্ষস থাকবে এই ভয়ে। গল্পগুলো এমন হলে পড়তাম।
রাক্ষসকে ভয় পাওয়ার কি আছে, হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আঙুলের ফাঁক দিয়ে আলিফ লায়লার লাল, নীল, সবুজ রাক্ষস খোক্ষসের কান্ডকারখানা দেখতে তো দারুন লাগতো আমার।
দারুণ লিখেছো। তারা দিলাম, অসংখ্য তারা।
^_^
তুমি এখন মুভিটা নিয়া লেখো একটা কিছু।
অলরাইট, নেক্সট লেখায় সিনেমাটার কথা থাকবে।
মন্তব্য করুন