যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনের খসড়া ও একটি প্রস্তাব
'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন'-এর প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সহায়তায় বাংলাদেশ আইন কমিশন এই খসড়া তৈরি করেছে। আইন কমিশনের পক্ষ থেকে খসড়া চূড়ান্ত করে সরকারকে দেওয়া হবে। এরপর আইন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।
কী আছে এই খসড়া আইনে?
১। প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে অভিযুক্ত বা প্রতিনিধি অনধিক ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ জানাবেন লিখিত আকারে। তবে যুক্তিযুক্ত কারণ থাকলে পরবর্তীকালেও অভিযোগ জানানো যাবে।
২। অভিযোগ পেলে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। শুধু তাই না, যদি অভিযোগ মিথ্যা হয়, তাহলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।
৩। কমিটি হবে কমপক্ষে পাঁচ সদস্যের, যার মধ্যে একজন চেয়ারম্যান হবেন। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কমিটির প্রধান ও বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী। কমপক্ষে দুইজন সদস্য হবেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরের।
৪। সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।
৫। কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আদালতে আপিল করতে পারবে।
৬। এই আইন কেবল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভিক্টিম আলাদা করে আদালতেও মামলা করতে পারবেন।
৭। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখা হবে।
৮। গুরু ও লঘু, দুই ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে দুই ধরনের শাস্তির সুপারিশ আছে। তিরস্কার থেকে চাকরী বা ছাত্রত্ব বাতিল পর্যন্তই শাস্তির দৌড়।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত একজ শিক্ষিকা 'অ'সম্মানিত একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। তিনি প্রথমবার কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ জানাতে গেলে কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেনি, পরবর্তীতে আরো অনেক শিক্ষিকাকে সঙ্গে নিয়ে অভিযোগ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে উপাচার্যকে।
এরকম অসংখ্য ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা ধারণা করতে পারি নতুন যে আইনটি হচ্ছে তা কাগুজে আইনই হবে। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। একজন শিক্ষিকাকেই যখন অভিযোগ জানাতে এতো বেগ পেতে হয়, তাহলে ছাত্রী বা অধিনস্থ কর্মচারী কর্মকর্তার কী হবে?
আর যদি কর্তৃপক্ষীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিটিই হন অভিযুক্ত? তবে লিখিত অভিযোগ কার কাছে দেওয়া হবে? নাকি শেয়ালের কাছেই মুরগী বন্ধক রাখতে হবে?
অবস্থান অনুযায়ী সবল বা ক্ষমতাবানরাই সাধারণত নিপীড়ন চালায়, ফলে কর্তৃপক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বলের বাণী কানে তোলেন না। অতীতে এরকম ঘটনার অনেক উদাহরণ থেকেই এই মন্তব্য করতে হচ্ছে। গণ আন্দোলন করেও কর্তৃপক্ষকে অভিযোগকারিণীর পক্ষে আনা যায়নি, তারা বরাবরই অভিযুক্তর পক্ষেই থেকে গেছেন।
কর্তৃপক্ষের কাছে বিচার চাইতে গেলে আগে কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ববান হতে হবে। কিন্তু আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়িত্ববোধের ঘাটতি দেখেছি। তাই নতুন এই আইন কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
আইন অনুযায়ী কমিটি গঠন করা হলেও তা কতটুকু নির্ভরযোগ্য হবে? এই কমিটির নিরপেক্ষতা কে যাচাই করবে?
কমিটি যে সুপারিশ করবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এই জরিমানা কে আদায় করবে?
এই আইনের খসড়া তৈরি করার আগে দেশে ইতোপূর্বে সংঘটিত যৌন হয়রানিগুলোর কেইস স্টাডি করা হয়েছে কী না আমার জানা নেই। জানা নেই যৌন হয়রানির শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের মতামত এখানে প্রতিফলিত হয়েছে কি না? কেবল জানি বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সহায়তায় এই আইনের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে।
এই আইন হয়তো পাস হবে, কিন্তু তাতে বর্তমান চিত্র কতটুকু বদলাবে? কেউ নিপীড়নের শিকার হলে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগের রাস্তা কখনোই বন্ধ ছিলো না। অভিযোগের ভিত্তিতে এর আগেও বহু তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তদন্তও হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফলাফল শূণ্য। এই আইন কি বিদ্যমান অবস্থায় সুফল বয়ে আনতে পারবে? রোধ করতে পারবে যৌন হয়রানি?
বিকল্প প্রস্তাব
তারচেয়ে একটা কেন্দ্রীয় যৌন নিরাপত্তা সেল গঠন করা যায় কী? স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় যারা কাজ করবে?
সেলফোন কোম্পানিগুলোর মতো সার্ভিস সেন্টার থাকবে একটা। যেখানে যে কোন সময় যে কেউ ফোন করে বা ইমেইলে অভিযোগ জানাতে পারবে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সেল থেকেই একটি দল পাঠানো হবে সেই প্রতিষ্ঠানে। যারা সংশ্লিষ্ঠ সকলের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন দিবে, এবং সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।
সম্ভব?
আর একই রিপোর্ট অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও আইন প্রয়োগ করবে। আদালতে মামলা হবে, বিচার হবে।
তাহলে ভুক্তভোগীকে আর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না সুবিচারের আশায়। শিকার হতে হবে না হেনস্থার।
অসুবিধা
১। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই হয়রানীর শিকার হচ্ছে নারীরা। এরকম সেল গঠিত হলে এতো বিপুল সংখ্যক অভিযোগ আসবে, যাতে হিমশিম খেতে হবে। লোকবল বাড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব কিছু না। সরকার আন্তরিক হলে অবশ্যই সম্ভব। আর কঠোরতার নমুনা প্রদর্শন করা গেলে অপরাধ কমে যাবে আশা করছি।
২। অযাচিত অভিযোগ আসবে প্রচুর।
সুবিধা
১। ভুক্তভোগীকে একবার কর্তৃপক্ষের কাছে, আরেকবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ করার নামে হেনস্থার শিকার হতে হবে না।
২। অন্তত কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থার চেয়ে এই ক্ষেত্রে সুবিচারের আশা বেশি।
৩। প্রতিষ্ঠানের হোমড়া চোমড়া ব্যক্তির নামে অভিযোগ দাখিল করার মতো সাহস অনেকেরই হয় না। তাই অনেকেই মুখ বুজে সহ্য করে নেন। তার জন্য এই ব্যবস্থা সুখকর হবে হয়তো।
নতুন যে আইনের খসড়া হচ্ছে, তা পুরনো ধারণাগুলোরই লিখিত রূপ, যে ধারণাগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে ইতোমধ্যে। তাই এই নতুন প্রস্তাব। পাঠকের নিকট থেকে সমালোচনা কিংবা নতুন ধারণা বা প্রস্তাব আশা করছি।
প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ জীবনে যৌনতা উপভোগ করুক। যৌনতা যেন নিপীড়নের হাতিয়ার না হয়।
বাংলাদেশে আইনের অভাব নাই। অভাব নিরেপক্ষ ও সঠিক প্রয়োগের।
নীতিমালারও অভাব নাই, অভাব নিজের ক্ষেত্রে সেটা মানা ও প্রয়োগের।
প্রয়োগকারী সংস্থা বা ব্যক্তির মাঝে সমস্যা দূর না করলে কি ভাবে প্রয়োগ হবে সেটা আগে ভাবা দরকার।
সব চাইতে দরকার নিজের মননে পরিবর্তন, এখানেই মূল সমস্যা।
আমি খুব আশাবাদী না।
বাংলাদেশে আইন করে কতদূর আর কী হবে?
আইন বানানের চাইতে আইনকে ভয় পাওয়ানোর ব্যবস্থা করা দরকার। মূল সমস্যা হলো আইনকে ভয় পায় না এদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। যেমন ইচ্ছে তেমন করার গনতান্ত্রিক স্বাধীনতার মানসিকতাই সকল অপরাধের মূল উৎস। অপরাধীকে ফাকফোকড় দিয়ে বের করে নিয়ে যাবার জন্য রয়ে প্রচুর সাহায্যকারী উপাদান। কো্র্টে একবেলা হেটে আসলেই দেখা যায়।
লোকেনদা, গতরাতেই পোষ্ট পড়লাম এবং বুঝতে পারলাম প্রস্তাবিত সব কয়টা প্রস্তাবনাই আজাইড়া। এর মাধ্যমে কতোটুকু যৌন হয়রানী বন্ধ হবে সেটা প্রস্তাবকদেরও বোঢগম্য হয়েছে কিনা সেই ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।
যাই হোক প্রস্তাবনার পূর্বে যেটা উচিত তা হলো ঠিক কি কি কাজ করলে বা কি ধরণের অপরাধকে যৌন হয়রানী বলে বিবেচনা করা হবে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে আইন করে কি হবে বা কাকে কোন অপরাধে ধরা হবে সেটা ভাবতেই প্রস্তাবনাগুলো বালখিল্য লাগছে।
দেশে আইনের তো অভাব নাই , কিছু হইলেই একটা আইন বানায় কিন্তু তার প্রয়োগ নাই।
আইন গুলা প্রয়োগ করার জন্য আরেকটা আইন করা দরকার , না হলে এই হাস্যকর আইন কাগুজে আইন হয়েই থাকবে অথবা ফখ্রুদ্দিন সরকারের মত দেখা যাবে এই আইনের প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতাদের কে আটকায় রাখছে।
যত্ন করে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আইনের এই নতুন প্রস্তাব কোনো কাজে আইবো বইলা মনে হইতেছে না। যেই লাউ হেই কদু...
প্রয়োজনীয় পোস্ট।
সরকারী উদ্যোগে ভরসা না থাকনে ক্যানো সচেতনতার জন্য কোন দাবী করা যাইবো না, সেইটা বুঝলাম না...
সবাইকে ধন্যবাদ
একটাই প্রত্যাশা, নীপিড়ন বন্ধ হবে।
সুস্থ হবে পরিবেশ
যত্ন করে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আইনের এই নতুন প্রস্তাব কোনো কাজে আইবো বইলা মনে হইতেছে না। যেই লাউ হেই কদু..
প্রিয়তে নিয়ে নিলাম
মন্তব্য করুন