ইউজার লগইন

কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হোক

K.preview.JPG

পরানানে ডাগের তরে
হুদু তুই গেলে...
রেদত জাগি ছউগত ভাজে ...
ডাগানান কানথ এলে...
ও ও ও কল্পণা,
তুই আইনা,
হুদু তুই গেলে...।
(কল্পনা চাকমা স্মরণে চাকমা গান)

১৯৯৬ সালের ১১ জুন দিবাগত রাত ১টা, সময়ের হিসেবে তা ১২ জুন। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্লাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে একদল মুখোশধারী সন্ত্রাসী অপহরণ করে কল্পনা চাকমাকে। যিনি ছিলেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন-এর তখনকার সাধারণ সম্পাদক। ষোল বছর বয়সী কল্পনা চাকমা পাহাড়ি নারীদের অধিকার আদায়ে সরব ছিলেন। সবসময় সরব ছিলেন পার্বত্য অঞ্চলে জুম্ম জনগনের উপরে সেনাবাহিনী ও বাঙালির নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে।

পরদিন ছিলো জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে কল্পনা চাকমা কাজ করছিলেন। কিন্তু নির্বাচন দেখে যেতে পারেননি। কয়েক ঘন্টা আগেই তাকে অপহরণ করা হয়।

কল্পনা চাকমা অপহরণের পর আজ ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। কল্পনার কোনো খোঁজ মেলেনি আজো!

কল্পনা চাকমার পরিবার প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে কোজোইছড়ি আর্মিক্যাম্পের ল্যাফটেনেন্ট ফেরদৌসই কল্পনা চাকমার অপহরণকারী। ১১ জন সেনাসদস্যকে নিয়ে সাধারণ পোশাকে তারা অপহরণ করেন কল্পনাকে। চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। ভাই ক্ষুদিরাম পিছু পিছু গিয়েছিলেন অনেকদূর। ব্রাশ ফায়ার করলে ক্ষুদিরাম কাচালং নদীতে ঝাঁপিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। সেই থেকে কল্পনা চাকমার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

সকালেই ক্ষুদিরাম ও পরিবারের সদস্যরা নিকটবর্তী সেনা ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে গেলে তাদের শান্তিবাহিনীর চর বলে মেরে ফেলার হুমকি দেয় সেনাবাহিনী। থানাও মামলা নিতে অস্বীকার করে। ল্যাফটেনেন্ট ফেরদৌস এবং সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে সেনাবাহিনী।

কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের দাবিতে ২৭ জুন পিসিপি তিন পার্বত্য জেলায় হরতালের ডাক দেয়। হরতাল চলার সময় বাঘাইছড়িতে পিসিপির মিছিলে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে নিহত হন পিসিপির রূপম, সুকেশ, মনতোষসহ চারজন ছাত্রকর্মী।

ইতোমধ্যে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার হতে শুরু করলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঢাকাতেও প্রতিবাদে নামেন সাধারণ মানুষ। আইন ও শালিস কেন্দ্রের পক্ষে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বাঘাইছড়ি থানায় কল্পনা চাকমা অপহরণের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও নাক গলাতে শুরু করে।

সরকারের টনক এবার একটু হলেও নড়তে বাধ্য হয়। বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে একটি সরকারি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সে পর্যন্তই। বিগত ১৪ বছরে সেই তদন্ত কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। থানায় যে মামলা হয়েছিলো, সেটাও সেখানেই ঝুলে আছে। কোনো অগ্রগতি হয়নি। কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা এখন কেবল একটি বাৎসরিক স্মরণসভা!

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিসন হেলিকপ্টারে করে সমস্ত পাহাড়ে লিফলেট ছড়ায় যে কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে। ১৪ বছরে এই পুরষ্কার কারো কপালেই জোটেনি। কিন্তু পুরষ্কার পেয়েছে কথিত অপহরণকারী ফেরদৌস। ল্যাফটেনেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন হয়েছে। [বর্তমানে হয়তো আরো উচ্চপদে থাকতে পারে, সর্বশেষ খবর জানা নেই]


চাকমা রাজধানীকে ডুবিয়ে দিয়ে, সহস্র পাহাড়ি অধিবাসীকে উদ্বাস্তু করে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পাহাড়ে যে নির্যাতনের শুরু অদ্যাবধি তার শেষ নেই। এইতো কিছুদিন আগেই আবারো বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনী আর বাঙালিদের যৌথ হত্যাযজ্ঞ চললো। লোগাং, নান্যাচর, লংগদু, বরকল, কাউখালি, পানছড়ি, দিঘিনালা, বাঘাইছড়ি- রক্তে রঞ্জিত এসব জনপদ জানে পাহাড়িদের কান্না। দুর্গম অঞ্চল বিধায় গোটা রাষ্ট্র থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ফলে পাহাড়ের অশান্তি, নিপীড়ন- এসব খবরের কিয়দংশই কেবল মূল ভুখণ্ড পর্যন্ত আসে, এবং গণমাধ্যমে প্রচার পায়।

আমরা নিজেরা উপনিবেশ ছিলাম, কিন্তু তবু আমরা বুঝতে পারিনি উপনিবেশের দুঃখ শোক। আমরা নিজেরা উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোকে!

সাধারণ জনগনের উপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিলে কী হয়, তাও আমরা জানি। কিন্তু তবু আমরা পাহাড়িদের সঙ্গে সেই আচরণটাই করে চলছি, পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে যা যা করেছিলো।

সরকার সেনাবাহিনীকে লাঠিয়াল বাহিনী করে পাঠিয়েছে পাহাড় দখল করতে। সরকার এবং সেনাবাহিনীর এই অপকর্মের দায় জনগন হিসেবে আমাদের ওপরও বর্তায়। নিজেকেই ধিক্কার জানাই।


কল্পনা চাকমা ফিরে আসবে, সে আশা করি না। কিন্তু এখনো প্রত্যাশা করি সরকার এর সুষ্ঠু তদন্ত করবে। অপহরণকাজে জড়িতদের খুঁজে বের করবে, এবং কঠোর শাস্তি দেবে।
কিন্তু সে আশার গুড়ে বালিই কেবল ঝরে পড়ে, যখন দেখি কল্পনা চাকমা অপহরণ স্মরণে আজকের আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার তদন্ত বিচার কিছুই করবে না আমরা বুঝে নেই। কিন্তু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি প্রতিবাদের পথটুকুও বন্ধ করে দেওয়ার খবরে!

তবু জোর কণ্ঠেই প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে চাই, জোর কণ্ঠেই বলতে চাই- ‘কল্পনা চাকমার অপহরণকারীর ফাঁসী চাই’

কার্টুন: শিশির ভট্টাচার্য (ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)

পোস্টটি ৩১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

নাহীদ Hossain's picture


অবশ্যই যথাযত তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিৎ ............

নজরুল ইসলাম's picture


এই ঘটনা কেবল একটি সরকারের অসারতাই প্রমাণ করে।
একটি অপহরণ ঘটনার কোনো কুল কিনারা করতে পারছে না রাষ্ট ১৪ বছর ধরে!
লজ্জা

নজরুল ইসলাম's picture


আপনার পোস্ট থেকে মাল মশলা নিয়ে একটা ব্যানার বানায়ে পাঠায়ে দিছি মডুদের কাছে। দেখা যাক তারা ঝুলান কী না

রন্টি চৌধুরী's picture


পাহাড়ে আর্মি যে নিপীরণ করছে তার দায় আমাদের সবাই।
পাকিরা আমাদের সাথে যা করেছে আমরা ঠিক তাই করছি পাহাড়ীদের সাথে। জাতিগত ভাবে আমাদের গর্ব করার কিছু আমি খুজে পাই না। আমারা যদি আন্তর্জাতিক ভাবে ক্ষমতাশালী হতাম তাহলে অনেক খারাপ হত। আমরা যদি আমেরিকার জায়গায় হতাম তাহলে বিশ্বের অবস্থা কি হত আল্লাহমালুম।

শওকত মাসুম's picture


রাষ্ট্র চায় না বলেই হচ্ছে না। আমি বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র চাইলেই পারে।

হাসান রায়হান's picture


পোস্টের দাবীর সাথে শতভাগ একমত।

সাঈদ's picture


পোষ্টের দাবীর সাথে একাত্মতা পোষন করছি।

সালাহ উদ্দিন শুভ্র's picture


হুদু তুই গেলে...

মাহবুব সুমন's picture


রাস্ট্র যদি না চায় তবে কিভাবে হবে !

১০

মীর's picture


এইটা আমাদের জন্য একটা দুঃখের ব্যপার। এতদিন হয়ে গেলো অথচ মেয়েটার কোন খোঁজ বের করা গেল না। ভাবতেই খারাপ লাগে।

১১

তানবীরা's picture


একটা কবিতা বোধহয় লিখেছিল ফারুক ওয়াসিফ

হারিয়ে গেছে পাহাড়ী বোন কল্পনা
একথাটা আর গল্প না,

এমন কিছু লাইন গুলো

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

সাম্প্রতিক মন্তব্য