পাঠ প্রতিক্রিয়া- সেদিন অনন্ত মধ্যরাতে।
মোস্তাক শরীফের সেদিন অনন্ত মধ্যরাতে পড়া শেষ করলাম, কিছু কিছু গল্প এক ঘন্টার নাটক হওয়ার সম্ভবনা রাখে- এ উপন্যাসটিও সে ধাঁচেরই। হালকা দু:খ, হালকা বিষাদ, হালকা প্রেম, হালকা জীবনবোধ, হালকা চটুলতা আর হালকা দার্শণিকতা, সব মিলিয়ে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠবার সব গুণই এই উপন্যাসের আছে।
হুমায়ুন আহমেদ নবীন সাহিত্যিকদের জন্য এক ধরণের ভাষা তৈরি করে দিয়েছেন, ছোটো ছোটো জটিলতাবিহীন বাক্য, খুব ভাবগম্ভীর ভাবনা প্রকাশের উপযুক্ত না হয়েও যা আটপৌরে জীবনযাপনের গল্প বলার খুব উপযোগী ভাষা। এ উপন্যাস সে ভাষারই ধারাবাহিকতা, উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণ, চরিত্রের বিকাশ ও চরিত্রের পরিপার্শ্বে তেমন আলাদা কিছু নেই যা দেখে মনে হবে এ উপন্যাসটা হুমায়ুন আহমেদ লিখেন নি, যদি মোড়কে ধ্রুব এষের ছবি ছাপিয়ে লেখকের নাম বদলে অন্য প্রকাশ বইটা প্রকাশ করে তাহলে হুমায়ুন আহমেদের পাঠকেরাও আলাদা করে ভাববেন না বইটা সম্পর্কে। হুমায়ুন আহমেদের অনুসরণ করতে পারাটাও এক ধরণের দক্ষতা- এভাবে ধীরে ধীরে নিজের লেখার ভাষাটা তৈরি করতে পারবেন মোস্তাক শরীফ।
উপন্যাসটি খুব গুছিয়ে লেখা- স্বতস্ফুর্ত কিছু না, বরং সব কিছুই ফর্মায় ভাগ করে, অনেকবার অনুশীলন করে নেওয়া এমনটাই মনে হয়। উপন্যাসের অর্ধেক থেকেই আশংকা তৈরি হয় শেষ পর্যন্ত অদিতির সাথে মারুফ রহমানের প্রেম হবে- কি প্রকারে লেখক এ প্রেম উপস্থাপন করবেন সেটা খুঁজতে গিয়েই উপন্যাসের শেষ পাতায় চলে আসলাম। অবশেষে অদিতিকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে মারুফ এমন একটা অবস্থানে ঘোর বৃষ্টির ভেতরে উপন্যাসটা শেষ হয়।
চরিত্র তেমন বেশী নেই, মারুফের পরিবারের তিনজন সদস্য এবং একজন স্মৃতিভ্রষ্ট বাবা- একজন হারুন কাকা , একজন অদিতি এবং একজন হাসিবকে বাদ দিলে উপন্যাসের চরিত্র বলতে মারুফের সহকর্মী দুইজন। এদের প্রত্যেকেরই প্রয়োজন ছিলো, তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু প্রয়োজন পুরণ করেছে।
হাসিব চরিত্রটা প্রয়োজন ছিলো মারুফের অন্তর্মুখিতা আর আত্মসম্মান কিংবা আত্মসচেতনতা কিংবা দারিদ্রক্লিষ্ট অহংকার প্রকাশের জন্য- সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সাথেও জীবনের এইসব ঘটনা আলোচনা না করা অন্তর্মুখিতার প্রয়োজন শেষ হলে মারুফের সাথে হাসিবের সম্পর্কটা আচানক সহজ হয়ে যায় । মারুফের চাকরিটা যদি উপন্যাসের শেষ ফর্মায় হতো তাহলে হয়তো উপন্যাসিক এই সহজ সম্পর্কটা নির্মাণ করতে ভীষণ জটিলতায় পরে যেতেন। হাসিবের অন্য একটা প্রয়োজনও ছিলো, অদিতির সাথে মাফুরের পরিচয়ের সূত্র এবং পরিণয়ের অনুঘটক হিসেবেও এ চরিত্রটা প্রয়োজনীয় ছিলো, এর বাইরে প্রায় ১০ বছরের বড় একজন মেয়েকে বিয়ে করা ব্যতীত হাসিব সম্পূর্ণ উপন্যাসেই বেকার।
উপন্যাসে আনিস ভাই প্রয়োজনীয় কারণ মারুফের আত্মসম্মান বজায় রেখে একটা চাকুরির প্রয়োজন ছিলো, সে চাকুরির সুবাদে চলে আসে এনজিও, জীবনদর্শণ, আদতে কেমন ধাঁচের জীবনযাপন করা বাঞ্ছনীয় এইসব মধ্যবিত্ত প্রশ্নগুলো। মারুফের গ্রামের জীবনযাপনের গল্প কিংবা গ্রাম্য রাজনীতি সেসব কারণেই গুরুত্বপুর্ণ কিন্তু এই সব চরিত্রের আনাগোনা উপন্যাসে মাফুরকে ফুটিয়ে তোলার বাইরে অন্য কোনো কাজ করে না। উপন্যাসিক অবশ্য সবার চাহিদাই পুরণ করেন ধারাবাহিক ভাবে, হাসিবের মা-বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, মুহিবের অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পরা, মুনিয়ার বোনের স্নহ উৎকণ্ঠা, আনিসের বিষয়ের কৌতুহল পুরণ হয় উপন্যাসের পাতায় পাতায়- সবারই এক ধরণের আপাত পরিণতি থাকে। মারুফের পরিণতি কোন দিকে যাবে সেটা উপন্যাসের শেষ পাতায় এসেও বোধগম্য হয় না।
সংলাপের ক্ষেত্রে বলা যায় মারুফের গুলশান পার্কের মেলোড্রামা বাদ দিলে সংলাপগুলো মানানসই, বাবার অসুস্থতা এবং বাবার বন্ধুর পীর ফকির সব দিক দিয়ে চেষ্টা করা একেবারেই স্বাভাবিক একটা চিত্র- তেমন অস্বাভাবিক লাগে না। কিছুটা ক্ষ্যাপাটে হাসিবকে বাদ দিলে চরিত্রগুলো স্বাভাবিকই বলা যায়।
উপন্যাসের পরিবারটি মধ্যবিত্ত না হয়ে কেনো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হলো এ রহস্যের কূল-কিনারা পেলাম না অনেক ভেবেও- মধ্যবিত্ত নিজের বাসায় থাকা মারুফ হয়তো একটা টিউশনি কম করতো, হয়তো বাসা ভাড়া খুঁজতে মিরপুর যেতো না, কিন্তু তাতে উপন্যাসের কোনো পরিবর্তন ঘটতো না, মানে মারুফের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থাটা উপন্যাসের গতি-প্রক্বতি এবং পরিণতির কোনো পরিবর্তন আনতো না। হুমায়ুন আহমেদ এমন অভাবী মানুষের জীবন সংগ্রাম লিখে মধ্যবিত্ত পাঠককে আলোড়িত করেছেন, এইসব স্বপ্ন এবং কল্পনা তার পাঠকদের বিচলিত করে- এই উপলব্ধিটুকুর বাইরে নায়কের নিম্নমধ্যবিত্ত হওয়ার অন্য কোনো কারণ মনে আসলো না।
উপন্যাসটা পড়ে খারাপ লাগে নি, চমৎকার সময় কেটেছে, অনেক অনেক দিন পর একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। মোস্তাক শরীফ আরও একটু পরিশ্রম করে আনিসুল হকের ধারাবাহিক ফাজলামি থেকে আমাদের মুক্তি দিবেন এমন শুভকামনা রইলো লেখকের প্রতি।
উপন্যাসের শুরুটা খুব ভাল ছিল। তবে পুরো আদলটা কেথায় যেন শঙ্খনীল কারাগারের মতো লাগে। তবে এটা সত্যি যথেষ্ট সুখপাঠ্য। একটানে আমিও পড়ে শেষ করেছিলাম, যেখানে আজকাল আর উপন্যাস পড়া হয় না।
হুমায়ুন আহমেদের প্রথম দিকের উপন্যাসগুলোর সাথে সাদৃশ্যটুকু আরও প্রকট হতো যদি বাবা মেয়ের জন্য রং ফর্সা করা ক্রীম আর নারীঘটিত একটা কেলেংকারি থাকতো-
এখানে নারীঘটিত কেলেংকারি ঘটতে ঘটতে ঘটে নি, কারণ সম্ভবত আমাদের সাম্ভাব্য পাঠকের মানসিকতায় এক ধরণের পরিবর্তন আসছে। আর রং ফর্সা করার ক্রীমের বিষয়টা তেমন গুরুত্ব পায় নি কারণ চরিত্রগুলোর রং-রুপ বর্ণনা কিংবা আদল নির্মাণের তেমন আগ্রহ ছিলো না লেখকের।
অনেকদিন পর আমিও এই উপন্যাসটা একটানে পড়েছিলাম।
বাহ সবাই পড়েছে। ভালো।
উপন্যাসটা এক রাতেরবেলা পড়ে শেষ করলাম এবং মধ্যরাতেই লেখককে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে প্রতিক্রিয়া জানালাম। পরদিন দেখি ক্ষুদে বার্তাটি ফেরত এসেছে মানে লেখকের কাছে পৌঁছায়নি

রাসেলের বিস্তারিত পোস্টমর্টেমের সাথে প্রায়ই শতভাগ একমত।
লেখকের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।
সবার দেখি একই কাহিনী .... আমিও মোটামুটি একটানে শেষ করছি বইটা .. আর রাসেল ভাই প্রথম দুই প্যারায় একদম আমার মনের কথাটাই বলছেন। আরেকটা ব্যাপার হল এই বইতে অযথা কঠিন কঠিন কথাবার্তা নাই, যেটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগছে
হাতে আসেনাই এখনও, পেলে পড়ে দেখব।
মন্তব্য করুন