ইউজার লগইন

ক্ষ্যাপ ০২

ব্যাক টু দি প্যাভেলিয়ন বলা যায় এটাকে কিংবা এক ধরণের পরাজয়ও, দিনাজপুরে কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় কিছুটা অসস্তি ছিলো, মহল্লার খেলার মাঠ সংকুচিত হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে প্লাস্টিকের বলে ক্রিকেট খেলা সম্ভব, মোটামুটি সবাই নিজের নিজের ধান্দায় ব্যস্ত, এর ভেতরে একেবারে নতুন করে নতুন মানুষদের সাথে পরিচিত হওয়ার ধাক্কাটা তেমন লাগে নি, কলেজে পরিচিত মানুষ কম নেই কিন্তু তাদেরও নিজস্ব পরিচিত গন্ডী আছে আর আমার অন্তর্মুখীতা বন্ধুত্বউপযোগী তেমন কিছু না। কলেজের পেছনের বেঞ্চে বসি, ক্লাশ শেষ হয়, হেঁটে হেঁটে দুরের ক্যান্টিনে গিয়ে সিগারেট টানি কিংবা শহরের উপকণ্ঠে যেটুকু গ্রাম্য আবহাওয়া সেখানে সময় কাটাই। রাতে বাসায় থাকি না, গভীর রাতে দিনাজপুর শহরের রাস্তায় হাঁটতে যাই, স্টেশন, হাসপাতাল মোড়, স্টেশন, রেললাইন, বাসা এভাবে ফিরতে ফিরতে রাত ২টা ,৩টা।

বাসার মানুষজন খানিকটা চিন্তিত ছিলো বটে কিন্তু কেউই তেমন ঘাঁটানোর আগ্রহ দেখাতো না, ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বাইরে কোনো পরিকল্পনা নেই, ছেলে যখন কিছুই করছে না, পড়ছে না, একটা টিউশনিতে পাঠিয়ে দেই, এমন মানসিকতা থেকেই হয়তো ফিজিক্সের জহিরুল হক স্যারের কাছে পাঠানো হলো, আমিও অন্য একজনের সাথে দুরুদুরু বক্ষে গিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় ব্যাচে ভর্তি হয়ে আসলাম।

কলেজে ভর্তি হওয়া উপলক্ষে একটা সাইকেলও জুটেছিলো কপালে, সেই সাইকেলে পয়াডল মেরে ১০ মিনিট গেলেই স্যারের বাসা, ব্যাচপ্রতি ৮জন, হাতে খাতা আর পকেটে সাইকেলের চাবি নিয়ে স্যারের ঘরে ঢুকলাম, লিপন, রকিব, মানিক আরও ৪জন ছিলো সেখানে, সবাই সবার স্কুলের নাম বললো, পরিচিত হলাম, লিপন তখন নির্মাণ স্কুল আর দিনাজপুর ইয়ুথ টিমের খেলোয়ার, লিপনের বড় ভাইও ইয়ুথে খেলে,

আগস্টের মাঝামাঝি কোনো ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট ছিলো না, নতুন কলেজে ভর্তি হওয়া উপলক্ষে সবারইভাবভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে, লিপন পরিচিত হওয়ার পর বললো ও তুমিই সেই ছেলে ঢাকা থেকে এসেছো?

আমি যে এতটা পরিচিত তা জানা ছিলো না, বাধ্য হয়েই স্বীকার করতে হলো নিজের অপরাধ। বিকেলে কি করো তুমি?
তেমন কিছুই না,
কাজ না থাকলে তাহলে চলে আসো একাডেমীর মাঠে, ওখানে আমরা ক্রিকেট খেলি। এভাবেই দিনাজপুরে একেবারে ভিন্ন জায়গায় নতুন করে ক্রিকেট খেলা শুরু করলাম।একাডেমীর মাঠে তখন তারার হাট, দিনাজপুর লীগের খেলোয়ারেরা সবাই কোন না কোন সময় সেখানে আসে, এক সময় স্টাইলিশ ব্যাটসময়ান হিসেবে দিনাজপুরে নাম করা রাসেল ভাই, রাজা ভাই, লিপু ভাই সবাই খেলছে, আমিও সেখানে খেলা শুরু করলাম।

প্রায় প্রতিদিন বিকেলে খাওয়া শেষে হেঁটে হেঁটে একাডেমীর মাঠে ৩ থেকে ৪ ওভার বল করা আর সন্ধ্যায় প্রাইভেট টিউশনিতে যাওয়ার বাইরে কাজ বলতে আড্ডা দেওয়া, সেটারও তেমন নির্ধারিত ঠিকানা নাই, সন্ধ্যায় নিউহোটেল, তারপর কনকের দোকান, তারপর লিলিসিনেমার মোড়, কিংবা ইনস্টিটিউট, সেখান থেকে গুলশান মার্কেট, ১১টার ভেতরেই সবাই যে যার বাসায় চলে যায়, আমিও বাসায় ফিরে আসি।

একাডেমীর মাঠে একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হলো, তিন ডিনের টুর্নামেন্টে ৪টা দল, সবাই সবার সাথে লীগ খেলবে তারপর পয়েন্ট তালিকায় উপরে থাকা দুই দল ফাইনাল খেলবে, ৭ ম্যাচের টুর্নামেন্ট। ১২ ওভারের ম্যাচ, একজন ৩ ওভার, ফাইনাল ২০ ওভারের, এমন কিছু একটা নিয়ম ছিলো, টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠলাম আমরা, ফাইনালে বিশাল আয়োজন, মাঠের এক কোণে সামিয়ানা লাগানো, মাইকে ধারাভাষ্য দিচ্ছে কুনাল ভাই, টানটান উত্তেজনার ম্যাচ ছিলো না,

বোলার হিসেবে প্রথম ওভার শুরু করবো, রান আপ ঠিক করে উইকেটের দিকে যাচ্ছি, কুনাল ভাই ধারাভাষ্য শুরু করলেন, তখনও নিজের বোলিং একশন পরিবর্তনের বিষয়টা ততটা জানা ছিলো না, ইমরান খানের মতো হালকা লাফিয়ে জোরে সজোড়ে বল ছুড়লো রাসেল, হাসি থামাতে গিয়ে বল ওয়াইড হয়ে গেলো। এত এত লোকের মাঝখানে নিজের নাম ইমরান খানের সাথে উচ্চারিত হতে শোনার অভিজ্ঞতা বিব্রতকর। অবশ্য পরবর্তীতে ওয়াইড বল আর হয় নি, খেলা শেষ হলো, চ্যাম্পিয়নের ট্রফি নিয়ে কিছুক্ষণ লাফালাফি হলো, অনেক অনেক পুরস্কার ছিলো, ম্যান ওফ দ্যা ম্যাচ, ম্যান অফ দ্যা সিরিজ, বোলার ওফ দ্যা সিরিজ, ৪ ম্যাচে ২০ রানে ১০ উইকেট নেওয়ায় আমিই বোলার অফ দ্যা সিরিজ, পুরস্কারের প্যাকেট খুলে দেখি ১০ টাকা, আয়োজক হিসেবে পুরস্কার দিচ্ছিলো রোমেল, বললো টাকার পরিমাণটা দেখবি না, দেখবি কিসের জন্য পুরস্কারটা পাইলি। আমার অবশ্য পুরস্কার পাওয়ার লজ্জাটা বেশী ছিলো, রোমেলের ছোটো ভাই ছিলো আমাদের দলে, ওকে ১০টাকা দিয়ে বললাম কিছু খেয়ে নিয়ো,

রাসেল ভাই ভাইয়া শুনলে ভীষণ রাগ করবে
আরে ধুর, তোমাকে আমি দিলাম এইটা, কোনো কিছু বলবে না। স্বীকৃতির একটা আনন্দ থাকে, আমার অবশ্য তেমন আনন্দ ছিলো না।

শীত আসতে, ক্রিকেট সিজন শুরু হচ্ছে, রুপালী ট্রফি তখন জমজমাট, স্থানীয় পর্যায় পেরিয়ে রুপালী ট্রফি আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে পরিণত হয়েছে, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম থেকে টিম আসে খেলতে, ঢাকা থেকে নিয়মিত ক্ষ্যাপ খেলতে আসে বুলবুল, নান্নু, আকরাম, বালুবাড়ী ক্রিকেট ক্লাব, মিশনরোড, মুন্সিপাড়া সবাই বাইরের খেলোয়ার নিয়ে আসে। আমরা সকালে বাদাম চিবাতে চিবাতে খেলা দেখি, হাততালি দেই, দুপুরে হেঁটে হেঁটে বাসায় খেয়ে বিকেলে আবার খেলা দেখতে যাই।

লিপনের খেলা থাকলে লিপনের খেলা দেখতে যাই, ওদের ব্যাটিং এর সময় আড্ডা দেই, বোলিং এর সময় অন্য দলের বন্ধুর সাথে আড্ডা দেই, রোমেল, লিপন, সুনাল, হাসু, মনির, বাবু, তপু, মোটামুটি যাদের সাথে প্রায় নিয়মিত আড্ডা আর খেলা ওরাই বিভিন্ন দলে খেলছে।

দিনাজপুরে তখন , মনে হয় এখনও শানের পীচে প্রাকটিস হতো, নেট প্রকটিসের সময় হাফ পীচ সান বাঁধাই করা জায়গায় বোলার বল করতো, ব্যাটসম্যান ব্যাটিং করতো, আমার প্রাকটিস সেশনের অধিকাংশ বলই লাগতো শানের পীচের সীমারেখায়, বল করার সময় ঠিক ও জায়গাটাই চোখে পরতো, সেখানে বল পরলে বলের কানের পাশ দিয়ে যেতো ব্যাটসম্যানে, একদিন রাজা ভাইকে বল করতেছি,

প্রথম বলের পর রাজা ভাই বললো রাসেল ব্যাটসম্যানকে খেলাও, আরও উপরে বল দাও, আমিও চেষ্টা করি, বল আর উপরে যায় না, সেই সিমেন্টের বাঁধাই করা জায়গার কোণায় আশেপাশেই থাকে, দুইটা বলের পর বললো রাসেল আমার হেলমেট নাই, তারপরের বল করার পর বললো ঐ ছেলেকে আর বল দিবা না আমি প্রাক্টিস করার সময়। আমার উচ্চতা কিংবা ডেলিভারি স্টাইলে কোনো একটা ঝামেলা ছিলো, বল ব্যাটসম্যানের কোমরের আশেপাশে ঘুরতো। রুপালি ট্রফি, দিনজপুর লীগ খেলার তেমন সুযোগ হয় নি, বরং ক্লাশের মাঝখানে নাসিম বললো শুন দুপুরে ফ্রি তুই?
আমার তেমন কোনো কাজ কখনও থাকে না, বললাম কেনো?
একটা ময়াচ খেলতে হবে,
আমিও রাজি হয়ে গেলাম। দিনাজপুরের সেকেন্ড ডিভিশনের লীগ ম্যাচ, নাসিমদের কোনো একটা দল , দলের নামও জানা নাই, আমি যথারীতি অপেনিং বোলার, এতদিন খেলেছি চার দেয়াল ঘেরা জায়গায়, এটা একেবারে খোলা মাঠ, প্রচুর না হলেও বাতাস আছে।

প্রথম বলটা পড়লে অফ স্ট্যাম্পের পাশে বিশাল আউটসুইং করে ফার্স্ট স্লীপের পাশ দিয়ে সীমানার বাইরে। পরের বল মিডল স্ট্যাম্পের উপরে ফেলে দেখলাম সেটা ফার্স্ট স্লীপের কাছে গেলো, নাসিম কোনোরকমে ঝাপিয়ে চার হওয়া থেকে বাঁচালো।

একেবারে নতুন বল যে এই রকম সুইং করতে পারে তেমন আন্দাজ ছিলো না, ওভার দ্যা উইকেট থেকে রাউন্ড দ্যা উইকেটে বল করলাম, কোনো রকমে লাইন লেংথ খুঁজে পেলাম, ব্যাটিং করতে নেমে মনে হয় ৪ রান করেছিলাম, বোলিং এ এসে এমন দুরাবস্থা দেখে আর দ্বিতীয় ওভার দেওয়ার সাহস পায় নি ক্যাপ্টেন। উদ্বোধনী অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর হলো না।

কলেজে আড্ডা দিচ্ছি েমন সময় লিপন বললো চল, একটা ম্যাচ আছে। আমিও আড্ডা ছেড়ে লিপনের সাইকেলে উঠে রওনা দিলাম, চরু বাবুর মোড়ের কাছে একটা মাঠে খেলা, দলের স্পন্সর রুস্তম ভাই। পেশায় মর্ডান সিনেমা হলের দারোয়ান, নেশায় ক্রিকেট দলের স্পন্সর, বিহারী এই মানুষটার একটাই নেশা, টেনিস টুর্নামেন্টের ট্রফি জমানো, তার কথা, টাকা যত লাগে সমস্যা নাই, ট্রফিটা আমার চাই। তারকাখচিত দল বললেও কম বলা হয় রুস্তম ভাইয়ের দলকে, দিনাজপুরের বিভিন্ন মহল্লার সেরা খেলোয়ারেরা সবাই রুস্তম ভাইয়ের দলের সাথে বাধা চুক্তিতে- হয় রুস্তম ভাইয়ের দলে খেলতে হবে নাইলে টুর্নামেন্টে খেলা যাবে না।

আমি গিয়ে দেখলাম খেলা পশু হাসপাতালের মাঠে ক্রিকেট খেলা বন্ধুদের সাথে, ওখানে খেলতেছে কিরন, রাজু, সুমন। ওরাও আসলো, বললো কি রে তুই কি রুস্তম ভাইয়ের দলের হয়ে খেলতে আসছিস? আমি আসছি খেলা দেখতে,
তাহলে আমাদের দলে খেল,
আমার সমস্যা নাই, সমস্যা রুস্তম ভাই, তিনি আমাকে খেলতে দিবেন না, তার একটাই কথা এই হারামির বাচ্চাকে বিশ্বাস নাই, ও অনেক কিছু করতে পারে। আমি খেলোয়ার হিসেবে রুস্তমভাইয়ের দলে খেলি নাই, তেমন ভাবে পরিচিতও না, তার দলের লোকজন অনেক বুঝানোর পর খেলার অনুমতি পাওয়া গেলো।

আমাদের ফিল্ডিং, অপেনিং করবে রাজু, লাইফ ভাই অপেনার। লাইফ ভাইয়ের সাথে একাডেমি মাঠে অনেক খেলা হয়েছে, লেগ স্ট্যাম্পের উপরে গুডলেংথে বল দিলে লাইফ ভাই ব্যাক ওয়ার্ড পয়েন্টে কয়াচ উঠিয়ে দেয়, এছাড়াতেমন দুর্বলতা নাই। একজনকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে পাঠিয়ে রাজুকে বললাম ঠিক পায়ের উপরে বল দিবি
রাজুর বলটা একেবারে নিঁখুত ছিলো, প্রত্যাশা মতোই বল ঠিক ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টেই গেলো, কিন্তু সেখানে যাকে ফিল্ডিং করতে রেখেছিলাম, সে তখন মাথর ক্যাপ ঠিক করতেছে, নিশ্চিত আউট হলো না, ক্যাচ মিস হলো। ওরা মেরে কেটে সোজা করে দিলো, আমরাও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হারলাম। তবে রুস্তম ভাইয়ের দলের বিরুদ্ধেই আমার দিনাজপুরের টেনিস টুর্নামেন্টে শুভ উদ্বোধন হলো।

রুস্তম ভাইয়ের দলে আর খেলা হয় নি, কয়েক দিন পর আড্ডায় কনক বললোএকটা টুর্নামেন্ট ধরছি মামা তোমাকে খেলে দিতে হবে। দিনাজপুরে তখন ফেন্সিডিলের প্রচন্ড প্রসার, খেলায় কোনো খেলোয়ারকেই টাকা দেওয়া হবে না, সবাই হাফ বোটল ফেন্সিডিল পাবে, সাথে ফিলিংস ফ্রি, মানে চা সিগারেটের বন্দোবস্তও করবে কনক।

খেলোয়ারের অভাব নেই, ফিলিংসের টানে অনেকেই খেললো , আমার তেমন ফেন্সিডিল আসক্তি ছিলো না, আমি খেলবো চা সিগারেট খাবো, আড্ডা দিবো, প্রথম দিন লিপু ভাই ছিলো আমাদের দলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দলের খেলোয়ার ছিলো তখন, হঠাৎ করেই ছাত্রমৈত্রির কাউকে শিবির পিটিয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, তিনি দিনাজপুরে, হইচই করতে পারেন অনেক।

আমরা ব্যাটিং করে ১২ ওভারে ৪৯ রানে ওল আউট, লিপু ভাই উইকেট কীপিং এ, আরে কোনো চিন্তা কইর না ছোটো ভাইয়েরা, ৪৯ রানেই ওদেরকে আটকায় দিবো। কোনো ব্যাপার না, শুধু ঠিক করে বল করো, ম্যাচ তো আমাদের হাতেই। উইকেটের পেছনে লিপু ভাইয়ের সারাক্ষণ চিৎকার কিংবা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যেকোনো কারণেই হোক আমরা ৩০ রানেই ওদের সবাইকে আউট করে ফেললাম, বিশাল রকমের আত্মবিশ্বাস নিয়ে পরের ম্যাচগুলো জিতে চ্যাম্পিয়ন।

কথা ছিলো কনক এই একটা টুর্ণামেন্টই ধরবে, দেখা গেলো ওরও রুস্তম ভাইয়ের মতো ট্রফির নেশা ধরছে, টুর্নামেন্ট ধরে, আমরা যাই , খেলি, চ্যাম্পিয়ন হই, ট্রফি নিয়ে আসি, টাকা ৮টা ট্রফি জেতার পর সম্ভবত টাকায় টান পরায় ও ক্ষান্ত দিলো ট্রফি শিকারে।

আমরাও নিজেদের পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম, টেস্ট পরীক্ষা কাছাকাছি, তখনও সিলেবাস জানি না। বাংলা, ইংরেজী কোনোটাই পড়ি নি, অংকের বইয়ের পাতা উল্টাই নি, কেমিস্ট্রি পড়েছি সামান্য, শুধু পড়ার মধ্যে ফিজিক্স পড়া হয়েছে। বায়োলজিরও কিচ্ছু জানি না। একটা ভীষণ রকম হায় হায় ভাবনা। লিপন প্রেমে পড়েছে, কিংবা লিপনের প্রেমে পড়েছে একজন, লিপনের অবস্থাও মোটামুটি খারাপ, টেস্ট পরীক্ষায় কোনো রকমে ফেল করা নিয়ে টানাটানি অবস্থা, এর ভেতরে রাতে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরলাম যখন তখন সাড়ে ১১টা। আমরা নতুন জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে গেছি, নিজের একটা আলাদা রুম আছে, সেখানে রাতে সিগারেট টানলেও সমস্যা নাই, একেবারে আলাদা রুম।

ঘরে ঢুকতেই শুনলাম কে যেনো আমাকে খুঁজে গেছে কয়েকবার। রাতে পৌনে ১২টায় আম্মা বললো ঐযে আবার আসছে, কি করছো দেখো, এত রাতে মানুষ আসবে কেনো বাসায়?

গেলাম, ছেলেটাকে চিনি, মুখ চেনা, কিন্তু নাম জানি না। বললো একটা টুর্নামেন্টে দল নিছি, তোমাকে আমার দলে খেলতে হবে?
আমি তো খেলবো না, পরীক্ষা আছে, পরীক্ষার প্রস্তুতি
তাহলে তুমি ঐ টুর্নামেন্টে অন্য কোনো দলের হয়েও খেলবা না, যদি দেখছি তোমাকে অন্য কোনো দলে কুপিয়ে হাত নামিয়ে দিবো।
মেজাজটা আরও খারাপ হলো, বাসায় এসে কেউ এ রকম হুমকি দিবে সেটা হজম করতে হবে?
পরের দিন সকলা ঘুম ভাঙলো, একজন এসেছে বাসায়, একই জায়গায় থাকে, কয়েক দিন আড্ডায় দেখেছিও, বললো আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি আমার বন্ধুর মতো, তোমাকে আমার দলের হয়ে খেলতে হবে। সেই একই টুর্নামেন্টে, ওর টিম আর আগের রাতে আসা ছেলেটার টিম- বললাম আমি তো সেনাকে বলে দিছি আমি খেলবো না।
ঐটা সেনার টিম, এইটা আমার টিম, ওর সাথে তোমার বন্ধুত্ব নাই কিন্তু তুমি আমার ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ডের রিকোয়েস্ট রাখো।
বললাম সম্ভব হলে খেলতাম, কিন্তু আমার পরীক্ষা সামনে, এখন আর খেলবো না।
তাহলে তুমি সেনার টিমের হয়েও খেলবে না, যদি খেলো তাহলে খবর আছে।

পরপর দুই দিন একেবারেবাসার দরজায় এসে হুমকি দিয়ে গেলো মানুষজন। দিনাজপুরে শালার কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্টই খেলবো না। টেস্ট পরীক্ষা হলো প্রতিটা সাবজেক্টে কোনো রকমে ৩৩ ৩৪ পেয়ে দেখা গেলো সব মিলিয়ে ৮ সাবজেক্টে পেয়েছি ১৮৫, আব্বা রেজালট শীট দেখে একেবারে নির্বাক। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে তার কষ্ট নাই, ম্যাথে ২৩? হয়তো অন্য সময় হলে পিটিয়ে লাল করে দিতো কিন্তু বড় হয়ে যাওয়ার পর কথা কাটাকাটি হয়ে তেমন কিছুই বলে নি।

অবশেষে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো, মাঝে ফুটবল বিশ্বকাপ, খেলার মাঝখানে পড়ি আর খেলা শেষ করে ঘুমাতে যাই। সেই ১ মাসেই যা পড়ার পড়লাম। পরীক্ষা শেষ হলো । শুরু হলো প্রশ্নপত্র দেখে নাম্বারের হিসাব, প্রতিটা প্রশ্ন দেখি, একটা করে নাম্বার লিখি, এমনটাই তো দিলাম, পরীক্ষার দিন এসে যে প্রশ্নে ধরেচি ৭০, মেরে কেটে দেখা গেলো সেখানে ৬৫ থাকে না, কোনো মতে ৬০ পেলেই হয়, টার্গেট ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া। শেষমেষ অনেক ভাবে হিসাব করে দেখলাম সব মিলিয়ে ফোর্থ সারজেক্ট বাদ দিলে মার্ক আসে ৬৮০, এর কম পাওয়ার সম্ভবনা নাই, বুঝলাম যেমন পরীক্ষা হয়েছে তাতে ফোর্থ সাবজেক্টে যা পাবো তার উপরে নির্ভর করবে অনেক কিছু। এমনিতে ফার্স্ট ডিভিশন নিয়া সমস্যা হবে না, ফার্স্ট ডিভিশন পাবো, কিন্তু ৭০০ র উপরে পাইতে হলে ফোর্থ সাবজেক্টে অন্তত ১০০ পাইতে হবে।
ফোর্থ সবেজক্টে ১০৫ পাওয়ায় দেখা গেলো সব মিলিয়ে পেলাম ৭০৫।

সবাই কোচিং করতে ঢাকায়, আমি দিনাজপুরে আড্ডা দেই, মাঝে মাঝে কোচিং গাইড বই খুলে পড়ি, এর বাইরে কোনো কাজ নাই। খেলার সুযোগ হয় না তেমন। তারপর এই ভর্তি পরীক্ষা- সেই ভর্তি পরীক্ষা, আমার টার্গেট ঐ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিক্যাল এইসবে যাওয়াই যাবে না, মেলা পড়ার চাপ, গেলে বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আড্ডাবাজির সুযোগ থাকবে আর ক্লাশ না করলেও কোনো সমস্যা নাই। আবার হিসাব করতে বসলাম, সোহাগ ভাই ভার্সিটিতে চান্স পাইছে ৪৭ পেয়ে, তার দুইটা স্ট্যান্ড, আমার কোনো মতে ৭০০, এইখানেই আমি প্রায় ২০ পিছনে, আমার তাহলে লাগবে কম করে হলেও ৬৫, ৬৫ হলেই ফার্মেসিতে হয়ে যাবে। ৪টা সাবজেক্ট ২৫ করে, ৩টাতে ফুল মার্কস পেলেই হবে, সেই রকম হিসাব করেই পরীক্ষা দিতে আসলাম, যতটা সহজ ভেবেছিলাম ২৫ পাওয়া ততটা সহজ হলো না। কিন্তু ভার্সিটিতে সুযোগ হলো।

মৈমনসিং কৃষি ভার্সিটি আর ঢাকা ভার্সিটির ভেতরে কোনটাকে বাছাই করবো তখনও ঠিক করতে পারি নি, ময়মনসিংহের রেজাল্ট হয়েছে, ভর্তি হতে হবে, সে ভর্তির দিনের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট দিবে, কৃষি অনুষদে সুযোগ হয়েছে, ভর্তি হতে পারি, টাকা নিয়ে ময়মনসিংহে গেলাম, ২ দিন থাকলাম হোস্টেলে তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম এইখানে ভর্তি হবো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হওয়ার পর দিনাজপুর ফিরে আর একটা মাত্র টুর্নামেন্ট খেলেছি।

কাঞ্চন নদীর মাঝখানে টুর্নামেন্ট, কনকের দলের হয়ে খেলছি, আমাদের অবস্থা যথারীতি খারাপ, ম্যাচের শেষ দুই ওভারে আমাদের হাতে ২ উইকেট, রান লাগবে ১৪। আমার অন্য পাশের ব্যাটসম্যান আউট হলো, আমাদের দলের ক্যাপ্টেন কনক নামলো খেলতে, আমি গিয়ে বললাম একদম মাথাগরম করবি না, ম্যাচ এখনও আমাদের হাতে, ১৪ রান কোনো ব্যাপার না, ১০ বলে ১৪ রান করাই যায়।

প্রথম বলটা মিস করার পর কিছু একটা হলো, দেখা গেলো পরের বলটাতে কনক নিজেই স্ট্যাম্পে বাড়ি দিয়ে চলে আসলো, উইকেট কীপার ঐ দলের ক্যাপ্টেন, সে স্ট্যাম্প উঠিয়ে কনককে মারবে, কনক ব্যাট উঠিয়ে তাকে মারবে, সে আবার স্থানীয় মাস্তান, বাউন্ডারি থেকে পোলাপাইন দৌড়াচ্ছে, লাঠি সোঁটা, দা কিরিচ সবই চলে আসবে, আম্পায়ার ছিলো স্বপন, আমাদের মহল্লায় থাকতো এক সময়, ওরা দুই ভাই আমাদের বন্ধু, বললাম তুই ওদের থামা, আমি কনককে থামাচ্ছি।

পরিস্থিতি ভীষন রকম গোলমেলে হয়ে গেলো পরবর্তীতে, মাঠের মাঝখানে আমি আর স্বপন, আমার সামনে কনক, অন্য দিকে ঐ দলের কীপার, চারপাশে ঘিরে থাকা সবাই খালপাড়ার পোলাপাইন, স্বপন বললো সোজা রাস্তায় উঠে বাসায় চলে যা, এই এলাকায় থাকবি না তোরা।

কনক যাবে না, ওকে টেনে টেনে নিয়ে কোনো রকমে পৌছালাম লিলি সিনেমা হলের সামনে, এই টুর্নামেন্টের ঝাল অবশ্য কনককে হজম করতে হলো পরে, ওকে খালপাড়ার ছেলে পেলে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্লাবে কোপানি দিলো, কপালে আর হাতে আরও কয়েকটা বাড়তি সেলাই সমেত কনকের সাথে দেখা হয়েছিলো পরের কোনো এক বন্ধের সময়, তখন আমি ক্রিকেট না কবিতা নিয়ে ভাবছি।

পোস্টটি ৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


সে তখন মাথর ক্যাপ ঠিক করতেছে, নিশ্চিত আউট হলো না, ক্যাচ মিস হলো

ছেলে তো পুরাই শাহাদাত ইস্মাট! Tongue

যদি দেখছি তোমাকে অন্য কোনো দলে কুপিয়ে হাত নামিয়ে দিবো।

খাইছে! Shock

ফোর্থ সবেজক্টে ১০৫ পাওয়ায় দেখা গেলো সব মিলিয়ে পেলাম ৭০৫।

Big smile

ভাই, নামটা ঠিক করে নেন।
পুরান লেখা ভাইবা কেউ পড়তেছে না।

এই লেখাটার মাঝামাঝি অংশটা আগের লেখাগুলির তুলনায় একটু অগোছালো লাগলো! Sad

তানবীরা's picture


এটা কি দুই না তিন (নাকি দুই এর বাকি অংশটুকু)?

পড়ছি

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.