কাউন্সিলিং
শিক্ষকতা মোটামুটি একটা "থ্যাংকলেস জব", প্রায় অধিকাংশ সময়ই একজনের অবদানের স্বীকৃতি থাকে না। সাফল্যের কোনো অবদানে স্বীকৃতি না পেলেও ব্যর্থতার সবটুকু দায়ভার বহন করতে হয়। তবে সামান্য কিছু সময়ের জন্য মনে হয় শিক্ষকতা পেশা হিসেবে ততটা খারাপ না, যখন কেউ বাবা-মায়ের চেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য মনে করে এসে সহযোগিতা চায় নিজস্ব ব্যক্তগত সমস্যায় তখন সহযোগিতা করতে পারা কিংবা অনেক দিন পরে কেউ যখন এসে স্মৃতিচারণের ছলে বলে আমাদের প্রচেষ্টা তাদের উপকারে এসেছে তখন মনে হয় আসলেই " উই মেড দ্যাট ডিফারেন্স।" এইসব ক্ষণিক বিজয়ের অনুভুতি অবশ্য সার্বক্ষণিক বিরক্তি কাটাতে পারে না।
শিক্ষাঙ্গন ভবিষ্যত জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যাওয়ায় আসলে শিক্ষকদের ভবিষ্যত লড়াইয়ের অস্ত্র সরবরাহের বাইরে অন্য কোনো নৈতিকতা কিংবা আদর্শ সরবরাহের সুযোগ সীমিত। তাদের ব্যক্তিগত অনুভুতি কিংবা ব্যক্তিগত আদর্শে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে এক ধরণের পরিবর্তন সুচনা করার সুযোগ সময়ের সাথে কমে এসেছে। ভালো স্কুল এবং খারাপ স্কুলের পরিচিতি একেবারেই অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচ্য, একটা স্কুল থেকে কতজন অর্থনৈতিক লড়াইয়ে সফল যোদ্ধা বের হয়ে আসলো সেটা স্কুলের পরিমাপ দন্ড হওয়ায় একটা স্কুল থেকে আসলে কতজন ভালো মানুষ বের হয়ে আসলো সেটা কখনও বিবেচনায় আসে না।
ভালো মানুষ এবং সফল মানুষের ভেতরে বর্তমানের পৃথিবীতে সফল মানুষদের কদর বেশী হওয়ায় শিক্ষকদের সবটুকু পরিশ্রম মূলত: সফল মানুষ নির্মাণের শর্টকাট খুঁজতেই চলে যায়, এর বাইরে সামান্য কিছু সময়ের জন্য শিক্ষক মূলত শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট কোনো ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষত স্নাতোকোত্তর পর্যায়ে যারা শিক্ষকতা করছে তাদের ক্ষেত্রে এর সুযোগ অনেক বেশী কিন্তু সেই পর্যায়ে সেই মানসিকতা নিয়ে পৌঁছানো ছাত্রদের কতজনকে শিক্ষক উদ্বুদ্ধ করতে পারেন সেটা এক ধরণের প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।
এই উপলব্ধির পরেও শিক্ষকতাকে একেবারে পঁচা কোনো পেশার ভেতরে ফেলতে আমি নারাজ। গতানুতিক শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনটাকে হত্যা করছে সে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরেও সীমিত কয়েকজনের ভেতরে অনুসন্ধিৎসু মনটা টিকে থাকে, সেসব মানুষেরএই অনুসন্ধিৎসাকে রক্ষাণাবেক্ষণ করা এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করার কাজটাই এই মুহূর্তে শিক্ষকতার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তবে দু:খজনক বাস্তবতা হলো বছরে এমন ২ থেকে ৩ জন শিক্ষার্থীর বাইরে অধিকাংশই আসলে সাফল্যের শর্টকাট খুঁজতে আসে।
এদের প্রত্যেকের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে লড়াই করতে হয়, সে লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসেবে পরীক্ষার ফলাফল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সুতরাং শুধু পাঠদান নয় বরং পরীক্ষায় ভালো করার পদ্ধতিও অনুশীলন করিয়ে দিতে হয় এদের। কয়েকদিন আগে একজন এসে বললো আমি ডিপ্রেসড, বাসায় লোকজন হতাশ, তারা বলছে আমার ফলাফলে তেমন কোনো লাভ হবে না। আমি কোনো জায়গায় ভর্তি হতে পারবো না। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না, আমি জানি আমাকে পড়তে হবে, আমি জানি সময় নেই, কিন্তু উৎসাহ পাচ্ছি না।
আমি ডিপ্রেসড। এখন কি করবো? আসলেই কি পরিস্থিতি এত খারাপ?
বাংলাদেশের অধিকাংশ স্কুল কলেজে যেহেতু স্টুডেন্ট কাউন্সিলর নামের কোনো পদ নেই, সুতরাং কাউন্সিলিং এর কাজটাও সময় সময় ঘাড়ে চেপে বসে। সব শুনে বললাম ডিপ্রেশন তো ড্রাগ দিয়ে দুর করা যায় না, তোমার ভিতর থেকে পরিবর্তন আসতে হবে। তোমাকেই নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, তুমিও জানো তোমার লক্ষ্য কি, তুমি জানো সেখানে কিভাবে যেতে হবে। কিন্তু সেখানে যেতে হলে তোমাকে যা যা করতে হবে সেসব করার মতো আগ্রহ তোমার নেই। আমার মনে হয় না তোমাকে কোনো ড্রাগ প্রেসক্রাইব করলেই তোমার আগ্রহ তৈরি হবে।
তুমি বরং তোমার বাবা মা কে জানাও বিষয়টা, বলো তুমি আসলে ভয় পাচ্ছো আর তোমার তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন, এই মুহূর্তে তাদের এইসব ভয়-ভীতি দেখানো তোমার কোনো কাজে আসছে না। তুমি কয়েক দিন শুধু নিজের জনয় রেখে ভেবে বের করো তোমার কি করতে হবে। তোমার যদি প্রফেশন্যাল সাহায্য লাগে সেটা তোমার নিজেকে ঠিক করতে হবে।
তাকে ভয়ে বলতে পারলাম না তোমার আসলে সাইকোলজিস্টের সাথে কনসাল্ট করাটা বেশী যুক্তিযুক্ত, কারণ তারা তোমার এই হতোদ্যোম অবস্থার কথা শুনবে মনোযোগ দিয়ে, তোমার নিজের ভেতরের ভাবনাগুলো শুনবার জন্য একজন প্রফেশন্যাল মানুষ দরকার, যে পরিস্থিতি বিবেচনা করে তোমাকে এবং তোমার পরিবারকে সবচেয়ে ভালো উপদেশটা দিতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন পরামর্শক হিসেবে সাইকোলজিস্টদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক ধরণের জড়তা কাজ করে। এখানে সাইকোলজিস্ট মানে যারা পাগলের চিকিৎসা করে , সুতরাং তাকে আমি সাইকোলজিস্টের সাথে দেখা করতে বলতে পারলাম না। সেটা এক ধরণের ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে। বললাম তুমি এমন একজনের সাথে কথা বলো যার উপরে তুমি নির্ভর করতে পারো, যাকে দেখলে তোমার মনে হয় সে তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো উপদেশটা দিবে
তবে তুমি যা করতে পারো সম্পূর্ন বিষয়গুলোকে আলাদা আলাদা ভাবতে পারো। তোমার ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারা না পারাটা ঠিক এই মুহূর্তে তেমন বড় সমস্যা না, সেটা নিয়ে আপাতত মাথা না ঘামালেও হবে। তোমার এই মুহূর্তে ভাবা প্রয়োজন তোমার এই পরীক্ষাটা ঠিক মতো দিতে হবে। সেটার জন্য মনোযোগী হতে হবে।
এই পরীক্ষা শেষ করে তুমি ভাববে তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, তুমি তখন ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিবে, এখন সেসব নিয়ে মাথা গরম করলে তোমার এই কূল ঐ কূল দুইটাই যাবে, সো ফোকাস অন ইয়োর ইমিডিয়েট নিড। সেট আপ ইয়োর প্রায়োরিটিস একোর্ডিংলি।
ডিপ্রেশন ফিজিওলজিক্যাল কোনো সমস্যা না, এটা সাইকোলজিক্যাল সমস্যা। যদিও প্রতিটি অনুভুতির পেছনে এক ধরণের রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়, প্রতিটি অনুভুতি নির্দিষ্ট একটি রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতির পরিমাণ পরিবর্তন করে কিন্তু আমাদের অনুভুতির সাথে সে রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতির সম্পর্কটা একমুখী।
আমি আনন্দের সাথে সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক যৌগের পরিমাণ রক্তে বাড়িয়ে দিলেই যে আমার অনেক উল্লসিত মনে হবে এমন না। আমার সচেতন সিদ্ধান্ত, আমার কর্মসৃহা, আমার আগ্রহ শুধুমাত্র এইসব রাসায়নিক যৌগের বিভিন্ন মিশ্রনের নির্ধারিত হয় না।
আমাদের অনুভুতি যেমন কোনো রাসায়নিক যৌগের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় তেমন ভাবেই কোনো কোনো রাসায়নিক যৌগের উৎপাদন কমিয়েও দিতে পারে, সে জন্য আলাদা করে সেই রাসায়নিক যৌগের জোগান দিয়ে অনুভুতি পরিবর্তন ঘটবে না, প্রয়োজন সে অনুভুতির উৎস খুঁজে পাওয়া।
এইসব এক্সট্যাসি ড্রাগ মানুষের লজিক্যাল ডিডাকশন প্রসেসকে বাইপাস করে তার ভেতরে এক ধরণের কৃত্রিম উন্মাদনা তৈরি করতে পারে , যুদ্ধরত সৈনিকদের যেভাবে নিয়মিত ড্রাগের জোগান দেওয়া হয় যেনো তাদের অতীত শিক্ষা এবং অপরাধবোধের অনুভুতিগুলো তীব্র না হতে পারে, তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণে এইসব বোধগুলোকে নিয়ন্ত্রন, দমন ও হত্যা করতে শেখানো হয়। তারপরও প্রতিটি যুদ্ধের পরেই অসংখ্য লক্ষ্যবিহীন, হতাশ মানুষ তৈরি হয়। এরা যুদ্ধ উন্মাদনা নিয়ে যুদ্ধে যায়, যুদ্ধের মাঝখানেই এদের ভেতরের হতাশার পরিমাণ বাড়তে থাকে, যুদ্ধের অনিশ্চয়তা যেমন এদের ভেতরেএক ধরণের রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয় তেমনি এইসব ডিপ্রেসনরেজিস্ট্যান্ট কিংবা এক্সট্যাসি ড্রাগ অন্য সব রাসায়নিক যৌগের সাথে মিলে মিশে এক ধরনের জীবন বিমুখ মানুষের জন্ম দেয়।
সেসবের জন্য এক ধরণের কাউন্সিলিং এর প্রচলন আছে, এইসব শিশু-কিশোর যারা অহিংসা কিন্তু মারাত্মক একটা যুদ্ধে জড়িয়ে আছে অবচেতন ভাবে তাদের জন্য আলাদা কোনো কাউন্সিলিং এর উদ্যোগ নেই এখানে।
কিনতু সব সমস্যার মাদার হচছে এই সমস্যা
দারুণ লেখা!
ডিপ্রেসন মারাত্নক জিনিস। শিক্ষক হিসাবে এমন কাউকে যদি সাহায্য করতে পারেন তাহলে খুব ভালো।
শিক্ষকতা অত্যন্ত সন্মান জনক পেশা।
বিষন্নতা আসলে এক ধরনের অসুস্থতা। মুস্কিল হোল এটা আমাদের সমাজে খারাপ চোখে দেখার কারনে আলোচনায় আসে না। এর জন্য ঔষধ আছে, আছে থেরাপি, বা কাউন্সিলিং।
মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকই হতে পারেন ছাত্রদের সফল কাউন্সিলর। তাদের অনুপ্রেরনায় অনেক হতোদ্যম ছাত্র নুতন উদ্দমে জীবন শুরু করতে পারে। মোড় ঘুরে যেতে পারে অনন্ত সম্ভবনায়!
ভাবনার বিষয়।
চমতকার লিখেছেন রাসেল ভাই।
আমিও একসময় কলেজে পড়াতাম।
নিজেকে এখুনু 'সাবেক শিক্ষক' হিসেবে পরিচয় দেই।
কেউ কি আমাকে সিলেট এ কোন ভাল কাউন্সিলিং ইন্সটিটিউট অথবা কাউন্সিলর এর নাম ঠিকানা দিতে পারবেন প্লিজ
মন্তব্য করুন