পতাকা
ছাদে ওঠার সিঁড়িটার মাঝপথে দাঁড়িয়ে আয়েশা বিষন্ন দৃষ্টিতে দেখছে পতাকাটাকে, দুরের আকাশে কালো ধোঁয়া তখনও পাঁক খেতে খেতে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। গাঢ় সবুজের মাঝে লাল বৃত্তে আঁকা বাংলাদেশের আকাশে ঘরপোড়া কালো ধোঁয়া, কাল সারারাত গুলির শব্দ, মানুষের চিৎকার, কান্না বিলাপের শব্দে কারো ঘুম আসে নি ঠিকমতো, পুরোনো ঢাকার গলির ভেতরে উদভ্রান্ত মানুষের দৌড়ে পালানোর শব্দ আর দুরাগত বিলাপের ভেতরে না ঘুমানো চোখে আলোটা বালির মতো কিচকিচ করছে।
সাতটা থেকেই মাইকিং শুরু হয়েছে, ইংরেজী, উর্দু আর উর্দু উচ্চারণের বাংলায় ফরমান জারি হয়েছে, এখন থেকে কোনো বাসায় বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা গেলে সেটা সামরিক আইন বিধিভঙ্গ করবে। যার যার বাসার ছাদ থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে, এমন কি কালো পতাকার জন্যেও একই নিয়ম। কোনো রাস্তায় ব্যারিকেড থাকতে পারবে না, যে মহল্লায় ব্যারিকেড দেখা যাবে ব্যারিকেডের আশেপাশের ১০০ গজ দুরত্বের সকল বাসার মানুষ সামরিক বিধি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবে।
রেনু'পা ছাদে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে,তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো আয়েশা। সিঁড়ির গোড়ার মা দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে তাড়া, সময়টা অস্থির, সারারাত কেয়ামত হয়ে গেছে ঢাকা শহরে। বাতাসে গুজব ভাসছে নানা রকম।
আয়েশা রেনু'পার হাসি ফিরিয়ে দিয়ে পতাকার ডড়ি খুললো, ধীরে ধীরে পতাকা নীচে নেমে আসছে, পতাকাটা ভাঁজ করে নাকের কাছে তুলে গন্ধ নিলো, এখনও নতুন কাপড়ের গন্ধটা লেগে আছে পতাকার গায়ে, বুকের সাথে আলতো করে জড়িয়ে রাখলো কিছুক্ষণ, আশেপাশের সবগুলো ছাদ থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পতাকা নেমে যাচ্ছে, বাতাসে এখনও শীতের আমেজ লেগে আছে, এই ভোরে ছাদের টবে রাখা গাছগুলোর পাতার কোণায় কয়েক বিন্দু শিশির জমে আছে, সেই চেনা গন্ধ নেই, পোড়া গন্ধে ভারি হয়ে আছে চারপাশ।
পতাকাগুলো স্মৃতির মতো গেঁথে যাচ্ছে বুকের ভেতরে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশের আকাশে মানুষের স্বপ্ন পুড়ে যাওয়া গন্ধ লেপ্টে আছে, অপসৃত পতাকার সাথে বাংলাদেশের স্মৃতিও বুকের ভেতরে লুকিয়ে কতদিন কাটাবে হবে কে জানে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নীচে নেমে আসলো আয়েশা। পতাকাটা ভাঁজ করে তুলে রাখলো আলমারির উপরে রেহেলের পাশে। তারপর চেয়ার থেকে নেমে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের চোখে উৎকণ্ঠা, ভাইয়া গত রাত থেকে এখনও বাসার ফিরে আসে নি। কোনো খবরও কেউ জানে না। খাঁ খাঁ রাস্তায় ইলেক্ট্রিকের তারেও কোনো কাক নেই, গত রাতে সব কাক শহর ছেড়ে পালিয়েছে।
পেছনের জানালায় কে যেনো টোকা দিচ্ছে, বাগানের সামনে বারান্দায় গিয়ে দেখলো রেনু আপা দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখেও ভয়, কোনো খোঁজ পেলে?
ভাইয়া তো এখনও আসে নি বাসায়, কি হবে রেনুপা?
ভরসা রাখো আয়েশা, সব ভালোয় ভালোয় শেষ হয়ে যাবে, ভরসা রাখো।
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে রেনুপার গলা ভেঙে গেলো, সে নিজেও ভরসা পাচ্ছে না। সামনের গলিতে সন্ত্রস্ত মানুষ দ্রুত মাথা বের করছে, দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে, পরিচিত কোনো বাসায় ঢুকে পড়ছে কিন্তু কেউই বড় রাস্তায় যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। মহল্লার সবাই সবাইকে চিনে, একই মহল্লায় সবাই মোটামুটি একটা জীবন কাটিয়ে দিলো, গত রাতে দয়াগঞ্জের সামনে ব্যারিকেড দিতে যাওয়া কেউই বাসায় ফিরে নি। কেউ কারো খবর জানে না। উৎকন্ঠার ভেতরেই ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসলো,আবারও গুলির শব্দ, আবারও আগুণের লালচে আভা, এভাবে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ভোরের আলো ফুটলো। সকাল বেলায় কার্ফ্যু নেই, লালচে চোখের ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ মাথা নীচু করে পরাজিত ফিরে আসছে, আর ঘাড়ে হাতে বোচকা নিয়ে সবাই উদভ্রান্তের মতো শহর ছেড়ে পালাচ্ছে।
দুপুরের দিকে বাবুল ফিরে আসলো অবশেষে, শহীদ মিনার ভেঙে গুড়িয়ে আগুণ ধরিয়ে দিয়েছে, গোলাগলি শুরু হওয়ার পর ওরা সবাই মেডিক্যালে লুকিয়ে ছিলো, ওখানে গোলাগুলি হয় নি, তবে সারারাত গুলি চলেছে আর শহীদ মিনারে যখন কামান দাগলো তখন মেডিক্যালের ক্যান্টিনও কেঁপে কেঁপে উঠেছে।
রেনু আপারা মাঝে দুই তিন সপ্তাহের জন্য গ্রামে চলে গেলেও ফিরে এসেছে, কোনো কোনো বিকালে রেনু আপা আসে, জিজ্ঞাসা করে কোনো খবর পেলে, ভাইয়া চলে যাওয়ারও এক মাস পেরিয়ে গেলো। কলেজ নেই, সারাদিন বাসায় বন্দী থাকতে ভালো লাগে না, রাস্তায় টুপি পড়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, সবাই ভাঙাচোড়া উর্দুতে কথা বলে রাস্তায়, সকালে একটা দুইটা রিকশা পাওয়া গেলেও দুপুরের পর থেকে রিকশা থাকেই না বলতে গেলে, বিনোদবিবি মসজিদের ইমাম এসে উঠেছেন বিপীন কাকাদের বাসায়, কাকারা কবে মহল্লা ছেড়েছেন কেউ জানে না। এই ডামাডোলের ভেতরে হৈহট্টগোলের ভেতরে কোনো একদিন সন্ধ্যার উলু ধ্বনি স্তব্ধ হয়ে গেছে, সন্ত্রস্ত মানুষ কিছুই খেয়াল করে নি।
জুলাইয়ের শেষে ভাইয়া একদিন ফিরে আসলো বাসায়, সাথে আরও কয়েকজন, লম্বা চুলের ভাইয়াকে আগের চেয়ে কিছুটা লম্বা দেখায়, রংটা একটু জ্বলে গেছে, রেনু আপা সংবাদ পেয়ে বাসায় এসেছে, ভাইয়া রেনু আপার সাথে ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর বাগানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে ভাইয়ার সাথে আসা ছেলেগুলো। হাসছে নিজেদের ভেতরেই তেমন শব্দ নেই, তবে হাসিটা চোখের কোণে আটকে থাকে অনেকক্ষণ। বারান্দার সামনে সারি করে লাগানো মোরগঝুঁটি গাছগুলোর গোড়া মারিয়ে ওরা বারান্দায় উঠে আসলো।
খালাম্মা ক্ষিধে লেগেছে, কিছু পাওয়া যাবে।
আম্মা রান্না ঘর থেকে আওয়াজ দিলো এই একটু বসো, আমার হয়ে গেছে প্রায়।
দুপুরে খাওয়ার পর ওরা ঘুমাতে গেলো আর আম্মা ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে বসালো নিজের ঘরে, শুকিয়ে কি অবস্থা হইছে দেখছিস তুই? আর চুল এমন উস্কোখুস্কো কেনো, দাঁড়া তোর চুল আঁচড়ে দিচ্ছি
মা তুমি যে কি না? এখনও কি স্কুলের বাচ্চা আমি , খবরদার আমার চুলে হাত দিবে না।
তুই মুখে মুখে কথা বলবি না, চুপ করে বসে থাক। মায়ের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লো ভাইয়া, আর রেনু পা আর মা ঘরের ভেতরে নিজেদের ভেতরে কি জানি গল্প করছে
কয়েকটা জিনিষ রাখতে হবে, প্রয়োজনের সময় যেনো পাওয়া যায়। খালাম্মা পারবেন না?
তোমরা কি কয়েক দিন থাকবে না কি আজকেই চলে যাবে?
ঢাকা ছেড়ে যাবো না, শহরেই এদিকে ওদিকে থাকবো কয়েকদিন। সমস্যা নাই, মাঝে মাঝে আসবো।
আগস্টের শুরুতে ওরা আবার আসলো, ততদিনে ভাইয়ার এই বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয়েছে আয়েশার, শুকনো ফর্সা ছেলেটার নাম শাহেদ, তার সাথে বাচ্চু, রফিক। মা এই দিকে শুনে যাও, দেখো শাহেদ কি বলছে। এবার ১৪ই আগস্ট না কি ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের পতাকা উড়াব। তোমরা কি পতাকা বানাতে পারবে?
দুই সপ্তাহের ভেতরে অনেকগুলো পতাকা বানাতে হবে, নষ্ট করার মতো সময় নেই, আলমারীর উপর থেকে পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রের নক্সাটা ট্রেসিং পেপারে তুললো আয়েশা, তারপর ছক কেটে কেটে আরও কয়েকটা ট্রেসিং পেপারে অবিকল বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকলো।
সকালে রেনু আপা এসে বললো চল নিউমার্কেটে যাবো আজকে। পলাশী বাজার হয়ে আজিমপুর কলোনীর পাশ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে, নীলক্ষেতের পুড়ে যাওয়া বস্তির কালো কাঠ এখনও সরিয়ে ফেলে নি কেউ। শহরে মানুষ হাঁটছে, টাউনসার্ভিসের বাস চলছে কিন্তু ভেতরে মানুষ কম। কয়েকটা দোকানে ঘুরে ৩ গজ, ৫ গজ করে লাল কাপড় কেনা হলো, পরের দিন ইসলামপুরের দোকান ঘুরে হলুদ কাপড় আর ৩০টা সবুজ লুঙ্গি কিনলো আম্মা।
দোকানির চোখে সুরমা, বললো এত সবুজ লুঙ্গি দিয়ে কি করবেন খালাম্মা?
আজিমপুরের এতিমখানায় দিবো,
যান খালাম্মা, আল্লার নাম নিয়া যান।
ছোটো বড় বিভিন্ন মাপের দুশ পতাকার একটা বান্ডেল তৈরি হয়ে গেলো কয়েক দিনের ভেতরে। শহরে আর্মি পুলিশের টহল বেড়েছে, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে কারা যেনো গ্রেনেড ফাটিয়েছে, রামপুরা ব্রীজে মিলিটারি জীপে গুলি চালিয়েছে,
১৪ই আগস্ট সকালে রেনু আপাদের গাড়ীটা বের করলো ভাইয়া, সাথে শাহেদ ভাই। পেছনে রেনু আপা আর আয়েশা, আর একটা গ্যাসের সিলিন্ডার। গাড়ীর মেঝেতে একটা ব্যাগে অনেকগুলো রঙ্গীন বেলুন, আর একটা ব্যাগে পতাকা।
আজিমপুর কলোনীর পাশের রাস্তায় থেমে কয়েকটা বেলুনে গ্যাস ভরে ব্যস্ত হাতে সেগুলোর সাথে পতাকা বাঁধলো ওরা। তারপর গোরস্তানের দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে উড়িয়ে দিলো।
ধানমন্ডি সেকেন্ড ক্যাপিটাল পাকমোটর ঘুরে সিদ্ধেশ্বরী আর রায়েরবাগ, সেখান থেকে মতিঝিল, যেখানেই সুযোগ পেয়েছে ওরা পতাকা উড়িয়েছে।
শেষ বিকেলে চেক পোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন সৈন্য বিহ্বল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রাইফেল তাক করে, আকাশে ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা। রাইফেল তাক করে একটা গুলি করলো একজন সৈন্য, পতাকাটা একটু টাল খেলো, বাংলাদেশের মানচিত্রে একটা ফুটো হলো, অদম্য পতাকা স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে নিয়ে ঊড়তে থাকলো অবরুদ্ধ শহরের আকাশে
অসাধারাণ লাগলো গলপটা। সিমপলি অসাধারাণ
এই গল্পটায় এত কম কমেন্ট দেখে মন খারাপ লাগতেছে।
আপনার কাছে এমন আরও গল্প চাই। ভাল থাকেন ভাই।
অসাধারণ একটা লেখা। এত ভালো লিখেন আপনি!
অসাধারণ একটা লেখা...
পোষ্ট দেয়ার সাথে সাথেই পড়ছিলাম। দারুন!
মন্তব্য করুন