বর্ষার গান
অনেক অনেক দিন পর আমার জগন্ময় দা'র কথা মনে পরলো এই বিস্তৃত মাঠে দাঁড়িয়ে, দুরের আকাশে ধীরে ধীরে মেঘ জমছে, বাতাসে বুনো মোষের মতো ক্ষ্যাপা কালো মেঘ দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে আকাশের নীল সামিয়ানা। ওক সাভানায় যতদুর দেখা যায় বুনো ঘাসের উপরে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো ওক, নীলচে সবুজ উঁচু নীচু মাঠ থেকে দূরে ছোটো টিলা, আর সেই পাহাড়ের ওপাশ থেকে বুনো মোষের মতো ছুটে আসছে কালো মেঘ, বাতাসে কেঁপে ওঠা এই নীলচে সবুজ ঘাসের গালিচা দেখে মনে হলো সারি নদীর কথা। সারি নদীর পানি এতটা হলদে সবুজ কিন্তু বর্ষায় আকাশের রঙ এর সাথে বদলে যেতো নদীটার রঙ। হলদে সবুজ থেকে কালচে সবুজ একটা জলের চাদর কেঁপে উঠতো বাতাসে, আমাদের কোষা নৌকা কাঁপতো সেই ঢেউয়ের সাথে। এখানে এই নীলচে সবুজ ঘাসের গালিচা কাঁপচে সারি নদীর ঢেউয়ের মতো আর সেই ঢেউয়ের মাঝখানে একাকী দাঁড়িয়ে আমার জগন্ময় দা'র কথা মনে পরছে
জগন্ময় দা এমনই এক মেঘথমথমে দিনে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলো বকু চল আজকে তোকে বৃষ্টির গান দেখাবো, জগন্ময় দা' আমার রুপকথার নায়ক, মা ছিলেন স্লানঘরে আমি তাকে না জানিয়েই জগন্ময় দা'র হাত ধরে বেড়িয়ে গেলাম, বুক ঢিপঢিপ শ্রান্ত জলে ভেজা দুপুর, আমার তখন বয়েস আর কত এই ১০ কিংবা ১১
আমি আর জগন্ময় দা ছোটো নৌকা ভাসিয়ে দিগ্বিজয়ে যাচ্ছি এমনটাই মনে হয়েছিলো, গাছের পাতায় লুটিয়ে পরা বাতাসের কান্না, সব শব্দ আর কোলাহল পেছনে সরে যাচ্ছে, ঘর, গ্রাম, গ্রামের সীমানার গাছ সব পেছনে সরে যাচ্ছে, তারপর আমাদের ছোটো নৌকার সীমানা পেরুলেই বিস্তৃর্ণ জলের কারাগার
নূপুর পায়ে শিশুর মতো টলোমলো বৃষ্টি ধেয়ে আসলো জলের সাম্রাজ্য জুড়ে শুধু বৃষ্টিছাপে আঁকা জলজ ক্যানভাস। আমাদের ছোটো নৌকা গ্রাস করে আরও দুরের পিছিয়ে যাওয়া গ্রাম অবধি আলম্ব অস্থির বৃষ্টির কারাগার দুলছে। আমি জগন্ময় দা'র দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি ধ্যানস্থ বুদ্ধের মতো নৌকার গালুইয়ে বসে তাকিয়ে আছেন দূরে দিগন্তের দিকে, আমাকে ডেকে পাশে বসালেন, বললেন বকু খুব নজর দিয়ে দেখ,
একটা একটা বৃত্ত তৈরি হচ্ছে জলের ক্যানভাসে, পাশের বৃত্ত গ্রাস করছে তাকে আর এভাবেই উঁচু নীচু একটা সুর তরঙ্গের মতো বৃষ্টি নাইছে জলে। আরও ভালো করে দেখ বকু, এই দেখ ছোটো ফোঁটাটা ওটা কিন্তু বাঁশীর সুর, তারপাশে দেখা টুপ করে বাজলো মাদল, সেটা এই বাঁশীর সুরটাকে গিলে ফেলবে তারপর ঐ দেখে বিচ্ছিন্ন একটা ফোঁটা ওটা এক তারার সুর।
বৃষ্টি এক তালে বাজে না, এক টানা ঝরে না, সেই অনিয়মিত বৃষ্টির ধারাপাতে কোথাও কখনও বৃষ্টিফোঁটা ঝরছে না, সেখানে অন্য সব বৃষ্টিফোঁটার আন্দোলন ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে, এক তারা দো তারা বাঁশী কাঁসা শাঁখ আর মাদল ঢোলকে মিলে মিশে বৃষ্টির সিম্ফনী জলজ ক্যানভাসে আঁকছে কেউ, জগন্ময় দা নিবিষ্ট তাকিয়ে আছেন, তার গানের শখ ছিলো খুব, গুণগুনিয়ে গাইতেন
বাসায় ফিরে আসার পর মা খুব বকেছিলেন মনে পড়ে, বলেছিলেন জগন্ময় তুমি কখনও আর একা বকুকে নিয়ে কোথাও যাবে না, ওর আশেপাশেও আসবে না তুমি। জগন্ময় দা' মাথা নামিয়ে বসেছিলেন কিছুক্ষণ উঠানে, তারপর পরাজিত মানুষের মতো দুই হাত দুই পাশে ঝুলিয়ে হেঁটে চলে গেলেন, চলে গেলেন আমার দৃষ্টির সীমানা থেকে আরও দূরে, দুরের সীমান্ত পেরিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন আমার শৈশবের রুপকথার রাজপূত্র আমি জানি না,
তবু প্রতি বছর বৃষ্টি ঝরে অনর্গল বৃষ্টির কান্না শুনি, কখনও টিনের ছাদে একটানা বৃষ্টিকনসার্টো শুনে কাঁথায় মুখ নামিয়ে জগন্ময় দা'কে মনে পরে, বুকটা হু হু করে, জগন্ময় দা কোথায় হারালে তুমি। আজ দুই যুগ বাদে আবার এই ওক সাভানার প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখলাম দুরের পাহাড় বেয়ে বৃষ্টি ধেয়ে আসছে আর নীলচে সবুজ ঘাসের নদীতে বাতাসের ঢেউ
আমার বুকটা অকারণ হু হু করে, জগন্ময় দা ফিরে এসো, বকু এবার তোমাকে নিয়ে আটলান্টিকে বৃষ্টি দেখাবে।
দারুন ভাবে মনকে বিষণ্ণ করে দেবার পোস্ট!
চমত্কার বিষণ্ণ কথকতা..
এটা রাসেল-এর লেখা ! লেখক এর জায়গায় অন্য নাম থাকলে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। বুঝতে পারছি, রাসেল নিজেকে ভাঙছেন। তেজি, তীব্র রাসেল এ কোন বিষণ্ণতার গল্প শোনালো!
মুগ্ধ, মুগ্ধপাঠ।
চমত্কার বিষণ্ণ কথকতা..
খুব ভাল লাগলো.।
চমৎকার
মন্তব্য করুন