ক্লোনিং সাইকোলজি
১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে বিশ্বের প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্লোন তৈরী হলো, ডলি। অমেরুদন্ডী সরল প্রাণী নয় বরং স্তন্যপায়ী মেরুদন্ডী একটি প্রাণীর অবিকল প্রতিরূপ তৈরীর সংবাদের নিজস্ব বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। সে সময়ে অবশ্য আমরা রাষ্ট্র, অর্থনীতি সমাজ বিষয়ে খুব বেশী সচেতন ছিলাম এমনটা বলা যাবে না, বরং আমাদের মনে হয়েছিলো পৃথিবীতে ক্লোনিং পদ্ধতির সুচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হতে পারে মনোবিজ্ঞানে। মনোবিজ্ঞান আদৌ বিজ্ঞান কি না, মানুষের বেড়ে ওঠায়, তার আচরণে স্মৃতি এবং সামাজিকতার প্রভাবগুলো চমৎকার পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ক্লোন মানব আমাদের এমন অনেকগুলো শিশু দিবে যাদের শাররীক গঠন থেকে শুরু করে মস্তিস্কের কোষের গঠন অবিকল একই রকম। সুতরাং আমরা এমন অনেকগুলো স্যাম্পল নিয়ে কাজ শুরু করবো যেগুলোকে অনায়াসে " আইডেন্টিক্যাল" বলা যাবে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে রেখে তাদের পরিণতি পর্যবেক্ষণ করলে প্রতিটি সামাজিক প্রেক্ষাপট একজনের জীবনে কি ধরণের ভূমিকা রাখে, কিভাবে তারা স্মৃতি নির্মাণ করে এবং কিভাবে তারা অভিজ্ঞতার সাথে বোঝাপড়া করে এই বিষয়গুলো স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার এক ধরণের নৈতিকতা আছে, আমাদের প্রাথমিক উচ্ছাসে এমন কোনো নৈতিকতার উপস্থিতি ছিলো না।
পরবর্তীতে মনে হয়েছে এ ধরণের পরীক্ষা কিংবা শুধুমাত্র একটি তত্ত্বকে প্রমাণ করা কিংবা ভুল হিসেবে উপস্থাপনের জন্য একই ধরণের অসংখ্য শিশুকে ভিন্ন ভিন্ন ক্লেশকর অভিজ্ঞতা দেওয়া এবং সেসব ক্লেশকর অভিজ্ঞতা তারা সামাজিক আচরণকে কিভাবে প্রভাবিত করছে এ বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করার ভেতরে এক ধরণের অমানবিকতা আছে। মানুষের গড় আচরণের সামাজিক প্রভাব নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রদার্শণিকদের নিজস্ব বিবেচনার কোনো কোনোটি এইসব পরীক্ষণে প্রতিষ্ঠিত হবে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারা ল্যাবরেটরীতে উৎপাদিত ক্লোন হলেও ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর তারা আসলে পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু।
যখন আমরা নিজস্ব উদ্যোগে কোনো একটি তত্ত্ব প্রমাণ- অপ্রমাণের জন্য গবেষণাগারের গিনিপিগ হিসেবে কয়েকটি অবিকল একই রকম শিশুকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহারের কথা কল্পনা করছি- নিজের ভেতরে এক ধরণের ঋণাত্মক প্রেষণা তৈরি হচ্ছে। বাস্তবতা হলো আমাদের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আমাদের সমাজ, আমাদের গোত্র এবং পরিবার অনবরত আমাদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিতে হস্তক্ষেপ করে। আমাদের রাষ্ট্র " আদর্শ দেশপ্রেমিক, আস্তিক, আইনানুগ সৎ " নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। আমাদের শিক্ষানীতির ঘোষিত উদ্দেশ্য পূরণ করে আমরা যেনো ঠিক মতো গড়ে উঠতে পারি রাষ্ট্র অসংখ্য আইনী বিধান তৈরি করেছে আমাদের জন্য। আমাদের প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য তারা দেশের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত রেখেছে।
প্রতিটি স্কুল নিজস্ব লুকানো কিংবা বিবৃত আদর্শে আমাদের গড়ে তুলতে চায়। তারাও আমাদের বেড়ে ওঠা এবং আমাদের সাম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াগুলো সব সময়ই ভাবছে এবং কতটা চমৎকার ভাবে তারা আমাদের " তাদের উদ্দেশ্য পুরণে" তৈরি করে নিতে সক্ষম হবে সে লক্ষ্যে পরিশ্রম করছে। আমাদের বিকাশের পথটা তারা তাদের অভিজ্ঞতা এবং আকাঙ্খা অনুসারে তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। আমরা আসলে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে একটি প্রতিষ্ঠানের আদর্শিক গবেষণার উপাদান।
রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে যারা টানাটানি কাড়াকাড়ি করছে এদের প্রত্যেকেই নিজস্ব ছাঁটে আমাদের ছেঁটে ফেলতে চায়। তারা ইতিহাস নিয়ে টানাটানি করে, তারা মানুষের অনুভুতি নিয়ে টানাটানি করে, সমাজের বিদ্যমান নানাবিধ ছোটো ছোটো বিরোধকে উস্কানি দিয়ে লালন পালন করে বৃহৎ দানবে রূপান্তরিত করে আমাদের কখনও ভয় দেখাতে চায়, কখনও আমাদের ভেতরে শ্রদ্ধাবোধ এবং আনুগত্য তৈরি করতে চায়। রাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যতটা বৃহৎ পরিসরে এই ধরণের গবেষণা করে, ক্লোন শিশুদের পরিমাণস্বল্পতায় হয়তো তারা অতি নগন্য একটা অংশ শুধুমাত্র মানসিক বিকাশের ধাপগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত বলতে পারতো মানুষের সামাজিক অভিজ্ঞতাএবং মানুষের ডিএনএ কাঠামের ভেতরে মানুষের সামাজিক অভিজ্ঞতাই তার আচরণ নির্ধারণ করে দেয়। এই সামাজিক অভিজ্ঞতাকে কৌশলে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। যদি ঠিক মতো পরিকল্পনা করা হয় তবে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভেতরে আনুগত্যবোধ নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
প্রতিনিয়ত চলমান এই গবেষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। যে স্কুল আনুগত্য শেখানোতে পারদর্শী এবং একই সাথে পার্থিব অর্জনগুলোর তালিকা উপরের দিকে তারা সবই গুরুত্বপূর্ণ স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেখানে অনবরত আমরা এই ধরণের ঘটনাগুলো ঘটতে দেখছি প্রতিদিন।
ক্লোনিং ছাড়াও এজাতীয় গবেষণা সম্ভব । প্রাকৃতিকভাবে যেসব ক্লোন শিশু জন্মায় তাদের দিয়ে । মনোজাইগোটিক টুইন এবং হেটারোজাইগোটিক টুইনদের জীবনভর অনুসরণ করে এমন অনেক গবেষণা হচ্ছে । মিনেসোটা টুইন স্টাডিজ নামে বিশাল একটা গবেষণা এখনো চলছে । এগুলো দেখে এখন পর্যন্ত পাওয়া ফল বেশ চমকপ্রদ । না, বরং বিষ্ময়কর ।
মিনেসোটাতে যেসব মনোসমীক্ষণ চালানো হয় জমজদের উপর সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে জন্মের পরপরই যেসব মনোজাইগোটিক টুইন আলাদা হয়ে যায় তাদের ক্ষেত্রে যত ভিন্ন পরিবেশেই তারা বড় হোক না কেনো তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রায় অর্ধেক হুবহু একই রকম হয় । এমনকি পছন্দের জামাকাপড়, রাজনৈতিক বিশ্বাস , এমনকি টয়লেট ব্যাবহার করার আগে একবার ফ্ল্যাশ করে নেয়ার মত তুচ্ছ ব্যাপার স্যাপারও ।
আবার হেটারোজাইগোটিক টুইনরা একই পরিবেশে বড় হোক বা আলাদা আলাদা পরিবেশে বড় হোক , তাদের মধ্যে এমন কোন দৃষ্টিগ্রাহ্য মিল পাওয়া যায় না ; যেটা সম্পূর্ণ র্যান্ডম দুইটা মানুষের মধ্যেও পাওয়া যাবে না ।
মানে চরিত্রের প্রায় অর্ধেক অংশ জেনেটিক পর্যায়ে নির্ধারিত হয় । বাকি অর্ধেক ধরা যায় পরিবেশ এবং প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা আলাদা জীবনকাহিনী দিয়ে নির্ধারণ হয় । কিন্তু আশার এবং মজার ব্যাপার হলো ঠিক পরিবেশের কোন অংশটা দিয়ে চরিত্রের বাকি বৈশিষ্ট্যগুলা ঠিক হয় এটা পিনপয়েন্ট করা যাচ্ছে না । মনোজাইগোটিক টুইনরা একই পরিবারে বড় হলে তাদের মধ্যে যতটা মিল পাওয়া যাচ্ছে ; তেমনভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই পরিবারে বড় হলেও তাদের মধ্যে একই পরিমাণ মিলই পাওয়া যাচ্ছে , এটা ইংগিত করে যে পরিবারের পরিবেশের কোন প্রভাব নাই শিশুর চারিত্রিক গঠনের উপর । সেটা একই বিদ্যালয়ে বা একই প্রতিষ্টানের জমজদের ব্যাপারেও প্রযোজ্য ।
ঝামেলা হচ্ছে, মানুষ পশুপালন এবং চাষবাসে এতটা সাফল্য অর্জন করে ফেলেছে যে নিজের অধীনস্ত বা অপরিণত কোন কিছুকে নিজের ইচ্ছামত যেভাবে খুশি সেভাবে বড় করা যাবে ; এই ধারণা তার মস্তিষ্কে অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে । কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়া খাটবে না বলেই এখন পর্যন্ত গবেষণার ফল থেকে মনে হচ্ছে ।
রাসেল ভাই , আমার ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি দেশের চলমান সংকটাদি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন । গত এক দের বছরে বিশেষ করে পাঁচ জানুয়ারীর আগে পরে কত কি ঘটে গেল, কত মানুষ নিহত হল গুলিতে-বোমায় । এগুলো নিয়ে আপনার লেখা নেই । লিখেন ক্লোনিং নিয়ে, শিশ্নকাতর বাস যাত্রীর চঠুল ফোনালাপ নিয়ে । '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, আমি যা বুঝি, ছিল স্বাধীকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য । স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আজ সে পরম চাওয়ার গণতন্ত্র নিকৃষ্ট গ্যাঁড়াকলে, পাকি-আমল থেকেও । অথচ এসব নিয়ে আপনার কোন লেখা পাইনা ব্লগে । হতাশ হই ! আমাদের কবিকুল, লেখককুল বা সূশীলরা বড্ড বেশি দলদাস ইদানীং ! সাধারণ মানুষ কার কাছে আলো আশা করবে ?
দোষ নেবেননা । ব্লগীয় ভাই হিসেবে অধিকার আছে, তাই লিখতে সাহস হল ।
পড়লাম কিন্তু বুঝলাম অল্পই!
মন্তব্য করুন