ফেসবুকে জীবনযাপন
ফেসবুক ক্রমশঃ আমাদের অস্তিত্বের বিজ্ঞাপনে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকের বন্ধুদের কাছে আমাদের আনন্দ উল্লাস বেদনা দীর্ঘশ্বাস উন্মুক্ত করছি। মুহূর্ত যাপনের আনন্দগুলো যখন লাইক আর ফলোয়ারের পরিমাণের পরিসংখ্যানে নিরুপিত হয় তখন বর্তমানকে আড়াল করে এক ধরণের কল্পিত বর্তমান নির্মাণের ঝোঁক বাড়ে।
করুণা প্রত্যাশী কল্পনা বিলাসী প্রেমময় উক্তিসমগ্র নির্বাচন এবং বিভিন্ন ধরণের সময়সীমায় মন্তব্য এবং লাইকের সংখ্যা গুণে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত বক্তব্য সম্প্রচার করে জনপ্রিয় হতে চাওয়ার প্রবনতা ফেসবুকের আগে এতটা নগ্ন ভাবে প্রকাশিত হয় নি। ফেসবুক প্রজন্মের কাছে টয়লেটের দরজা ঘেরা আব্রুর বাইরে এখন একান্ত ব্যক্তিগত তেমন কিছুই নেই। ব্যক্তির প্রচারমুখীতা ব্যক্তির প্রাইভেসীবোধকে বদলে দিয়েছে।
ব্যক্তির আত্মরতিপ্রবনতার চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ফেসবুকে আর সে কারণে ফেসবুক অনেক ধরণের বাণিজ্যিক প্রবনতার ধারা অনুসরণের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। খামখেয়ালী ক্রমাগত নিজের অস্তিত্ব উদযাপন করতে থাকা আত্মপ্রচারমুখী ব্যক্তিকেন্দ্রীক মানুষগুলোর প্রবনতার ধরণ উন্মোচনে শত শত ব্যক্তি- প্রতিষ্ঠান শত শত এপ্লিকেশন তৈরী করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তারা পরিসংখ্যান আকারে সেসব তথ্য বেচে দিনগুজরান করছে।
জানুয়ারীর প্রথম দিন হ্যাপি নিউ ইয়ার আর ঈদের আগের দিন ঈদ মোবারক লিখে ভক্ত এবং বন্ধুদের সম্ভাষণের ভেতরে এক ধরণের সার্বজনীনতা আছে। আত্মপ্রচারমুখী প্রজন্ম প্রয়োজনীয় জনপ্রিয় ইস্যু খুঁজে, তাই পহেলা বৈশাখে শুভনববর্ষ আর বৈশাখ উদযাপনের ছবি বিনিময়ের সময় সব ভুলে শুধু নববর্ষ উদযাপন করে। সে দিন এসো হে বৈশাখে শুধু আনন্দ, কোথাও কোনো দুঃখ নেই, কোথাও ভয়াবহ অমানবিক কিছুই ঘটে না। দৈনিক পত্রিকাগুলোর মতো দিবসজীবী উদযাপনে আজকের মধ্যবিত্ত প্রচারমুখী প্রজন্ম কি ভাবছে এবং সেই ভাবনায় কতগুলো ধারা উপধারা সবই স্পষ্ট হয়ে যায়।
আমাদের ইতিহাস চেতনাও আভিজাত্য খুঁজে তাই ফেসবুকে নিয়মিত উৎপাতের মতো দেখি আজাদ আর রুমির ছবির নীচে তাদের আভিজাত্যের তিলক লাগানো। রুমি আমেরিকায় স্কলারশীপ পেয়েও গেলো না, রুমির জিদের কাছে নতিস্বীকার করে জাহানারা ইমাম দেশের জন্যে রুমিকে কোরবান করে দিলেন। আজাদ ধনী পরিবারের সন্তান, হাজার টাকার লং প্লে কিনতো, গাড়ীতে করে ঘুরতো, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে বাবার উপহার দেওয়া দামী ঘড়ি বেচে যাত্রা পথের খরচ দিয়েছে- তারা ধন্য। তারাই প্রকৃত বীর। তাদের সামনে ভালো জীবনের বিকল্প ছিলো কিন্তু সে বিকল্প গ্রহন না করে তারা মৃত্যুর মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় হেঁটে প্রাণ দিয়েছেন দেশের জন্যে।
যাদের সামনে ভালো জীবনএর বিকল্প ছিলো না, যারা চোখের সামনে পরিজনদের আক্রান্ত হতে দেখেছেন, যারা কিছুটা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে, কিছুটা প্রতিশোধের নেশায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছেন, যারা শত মেইল পায়ে হেঁটে ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পরের দিনই আবার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে আহত হয়েছেন- এইসব হার-হাভাতের দলের কপালে বিজয় তিলক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এখানে মহান আত্মত্যাগ নেই। বড়াই করে বলার মতো অর্থের ঝংকার নেই।
একই সাথে এই প্রবনতা আমাদের পলায়নবাদী মানসিকতাকেও স্পষ্ট করে তুলে। আমরা যারা সমাজের সুবিধাভোগী অংশ হিসেবে ফেসবুকে বিভিন্ন কথা চালাচালি করে দেশ উদ্ধার করছি , যারা প্রতিনিয়ত নিজের উপলব্ধি, অনুভুতির জানান দিচ্ছি- তারা সবাই আসলে কোনো না কোনো আবে এই কাঁটাতারে ঘেরা কারাগার থেকে মুক্তি চাই। আমরা রুমির জায়গায়, আজাদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কল্পনা করি- আমি তো নিশ্চিত জীবনের লোভে পালাতাম যুদ্ধ ছেড়ে, ওরা পালায় নি।
অন্যভাবে বলা যায় বিষয়টাকে- ক্ষমতাধর অংশের সাথে ক্ষমতালিপ্সু অংশের বিরোধ- সংঘাতের আঁচ ক্ষমতাধরদের পরিজনদের উপরে ততটা বর্ষিত হয় না। ২৫শে মার্চের রাত বাদ দিলে ঢাকা শহরের উঠতি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ফরেন কানেকশনের মানুষগুলোর পরিবার পরিজন ততটা আক্রান্ত হয় নি। গ্রামের সাধারণ মানুষের ঘর বাড়ী পোড়ানো হয়েছে, পরিবারের সকলকে ডেকে হত্যা করা হয়েছে- কিন্তু ঢাকা শহর কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোর চিত্র একেবারে ভিন্ন। জনশূণ্য শহরে যারা ফিরে এসেছিলো তাদের পরিবারের মানুষদের ভেতরে আতংক থাকলেও তাদের কম সংখ্যককেই নির্বিচার হত্যাকান্ডের মুখোমুখি হতে হয়েছে । সুতরাং যুদ্ধে না গেলে রুমি আজাদও হয়তো ক্ষমতাধর পরিবারের অংশ হিসেবে বেঁচে থাকত পারতো।
শুধুমাত্র আভিজাত্য নেই বলে যে মহিলার সকল সন্তানই যুদ্ধ করেছে, যার ৫ সন্তানের ভেতরে ৪ জনই যুদ্ধে নিহত হয়েছে তার বদলে জাহানারা ইমাম শহীদ জননী হিসেবে পরিচিত হয়ে যান। একেবারে হতদরিদ্র যে মহিলা সর্বস্ব হারিয়ে কোনো মতে দিন গুজরানের উপায় খুঁজছেন হন্যে হয়ে, যিনি বলছেন যুদ্ধের পর থেকে বাবা ঘরের চালাটা আর উঠাতি পারলাম না, কোনোমতে একটু ছাদ তৈরী করে বেঁচে আছি গত ৩০ বছর তার পক্ষে সন্তানের হত্যাকারীদের বিচারের দাবীতে মিছিল করা সম্ভব হয় নি। আমাদের গণমাধ্যম এবং আমাদের বিদগ্ধ ব্যক্তিরা নিজেদের পরিচিতি ও প্রচারণার স্বার্থে কিছু ইমেজ নির্মাণ করেন। জাহানারা ইমাম, রুমি, আজাদ সেসব ইমেজের উজ্জ্বল হীরকখন্ড। তাদের অবদান অবজ্ঞেয় নয় কিন্তু তাদের তুলনায় অনেক বেশী ক্ষতি আর ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে অনেকেই।
আমরা এভাবেই কল্পলোক নির্মাণ করি, বিদ্যমান বাস্তবতার কল্পিত উপস্থাপনে এমন একটা ছবি আঁকতে চাই, যা বাস্তবের মতো কিন্তু বাস্তবরহিত।
কঠিন সব সত্য কথাগুলান!
কঠিন কিনতু বাসতব তাই
প্রত্যেকটা কথার সাথেই একমত। রুঢ় সত্যি কথা
কঠিন কঠিন কথা হলেও বুঝলাম
সবাই যখন একমত তাহলে আমি আর ভিন্ন মত কি করে করবো!
একমত!
মন্তব্য করুন