একে খন্দকারের বই
এ কে খন্দকারের ১৯৭১ ভেতর বাহিরের প্রথমাংশ পড়লাম। এ কে খন্দকারের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য দেখানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত লোকজনদের ভেতরে এক ধরণের তীব্র আলোড়ন তৈরী করেছে, অনানুষ্ঠানিক ভাবে হলেও সংসদে বইটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বর্তমানের মহান জাতীয় সংসদের অনির্বাচিত সদস্য, যাদের পড়ার আগ্রহ এবং রুচি নিয়ে আমার ব্যপক সন্দেহ, তারা পড়ে এবং অধিকাংশই না পড়ে বঙ্গবন্ধু অবমাননার অভিযোগে বইটি নিষিদ্ধ করার এবং এ কে খন্দকারকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আটকের দাবী জানিয়েছেন। ব্যপক সমালোচনার মুখে প্রথম আলো এবং একে খন্দকার বইটির সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছেন সেখানে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী হলো শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষনে জয় বাংলা জয় পাকিস্তান/জিয়ে পাকিস্তান বলেছেন পূর্বের সংস্করণে ছিলো শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণটি জয় পাকিস্তান বলে শেষ করেছিলেন।
আফসান চৌধুরী ৭ই মার্চের ভাষণের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান জিয়ে পাকিস্তান বলেছিলেন কি না এই বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ উল্লেখ করেছেন, সেখানে উভয় পক্ষেই কিছু বক্তব্য আছে, মঞ্চে উপস্থিত একজন এমএলএ বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমান জিয়ে পাকিস্তান বলেছিলেন এবং মঞ্চে উপস্থিত অন্য একজন (তোফায়েল আহমেদ) এই কথা শুনতে পান নি। তবে পরের দিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ ভাষ্যে প্রকাশিত ভাষণে জিয়ে পাকিস্তান শব্দটি নেই। উপস্থিত সাংবাদিকেরা শেখ মুজিবুর রহমানের চলতি ভাষায় দেওয়া বক্তব্যকে সংবাদ পত্রের উপযোগী সংশোধন করে প্রকাশ করেছেন। রেডিওতে সম্প্রচারিত ভাষণ এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভাষণে শব্দগত এবং ভাষাগত তফাত বিদ্যমান।
৭ই মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের উপরে ছাত্র নেতাদের স্বাধীনতা ঘোষণার যে তীব্র চাপ ছিলো সেই চাপের মুখে " এইবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।" শুনে উপস্থিত জনগণের একাংশ মনে করেছে শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, তবে যারা আরও স্পষ্ট করে আমরা পাকিস্তানের আনুগত্য অস্বীকার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছির মতো ঘোষণা শুনতে চেয়েছিলেন তারা এই ধরি মাছ না ছুঁই পানি ঘোষণায় তৃপ্ত হন নি।
মার্চের আগে থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র লীগের একাংশ লেফট রাইট, ডামি রাইফেল নিয়ে কুচকাওয়াজ করার মতো যুদ্ধ প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলো। তবে সার্বিক বিবেচনায় একে খন্দকার যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সেটা বাস্তব, দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের একাংশ সশস্ত্র যুদ্ধের প্রত্যাশা করে সশস্ত্র যুদ্ধের সীমিত প্রস্তুতি গ্রহন করলেও দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকাংশই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।
২৪শে মার্চ প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই ভেবেছিলেন অহিংস পন্থায় শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের চাপ দিয়েই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করা যাবে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এমন নৃশংস গণহত্যা শুরু করতে পারে এই বিষয়ে তারা বিন্দুমাত্র ভাবেন নি। সেনাবাহিনীর কয়েকজন রাজনীতিসচেতন সদস্য সাম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় তাদের করনীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখলেও অধিকাংশ সেনা সদস্য সাম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসনে তাদের করনীয় নিশ্চিত করতে পারেন নি। চট্টগ্রামের শিক্ষানবিস সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সবাই বিনা প্রতিরোধে খুন হয়েছেন, অধিকাংশ ক্যান্টনমেন্টেই কর্মরত বাঙালী সেনাসদস্যরা সপরিবারে অবরুদ্ধ হয়েছেন, বিভিন্ন ছলছুতায় যাদের বিচ্ছিন্ন করে দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তারাও নিজেদের ভেতরে যোগাযোগ করতে পারেন নি, পিলখানার পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ইপি আর বাহিনীর সদস্যরা সাম্ভাব্য করনীয় সম্পর্কে ৩২ নাম্বারের হেড কোয়ার্টারের পরামর্শ চেয়েও পান নি, ফলে সেখানেও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে অসহায় মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে তাদের। অন্ধকারে পোশাক ছেড়ে তাদের একাংশ পালিয়ে যান এবং তারা পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।
যারা ডামি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহন করেছিলেন তাদের সামরিক প্রস্তুতি কি প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্যে যথেষ্ট ছিলো? একাত্তরের মার্চে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সামরিক প্রস্তুতি নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন ডামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে কুচকাওয়াজ করার অভিজ্ঞতা সম্মুখ সমরে কোনো কাজে আসে নি। ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি নিতে সহযোগিতা করেছিলো কিন্তু ৭ই মার্চের ঘোষণার পরে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নেওয়া উৎসাহী যুবকেরা সম্মুখ সমরে খুব বেশী ভুমিকা রাখতে পারেন নি।
একে খন্দকার প্রকারান্তরে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা হলো ৭ই মার্চ ইয়াহিয়ার নির্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে আলোচনার পথ উন্মুক্ত রেখে দেওয়া ভাষণের বদলে যদি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করে দিতেন তাহলে গণহত্যা ঘটতো না, তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শক্তিতে অনেক দুর্বল ছিলো ফলে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই তাদের আটকে রাখা সম্ভব হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধে যে পরিমাণ প্রাণ ক্ষয় হয়েছে ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে এই ধ্বংস এবং গণহত্যা এড়ানো সম্ভব হতো। ৭ই মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়ার পরে ২৫শে মার্চ যখন সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে এসেছে এমন সংবাদ ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে আসলো তখনও কেনো শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন এর নানাবিধ ব্যাখ্যা আছে, তবে তাজউদ্দিন, কামাল হোসেন এবং আমির উল ইসলাম যখন ৩২ নম্বর ত্যাগ করেছেন তাদের আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান কোনো নির্দেশনা প্রদান করেন নি।
মিজানুর রহমান ( ১৯৭৬ সালে নবগঠিত আওয়ামী লীগের মিজান অংশের নেতা) তার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন তিনি চাঁদপুরে ফেরীঘাটে একটি ফেরী প্রস্তুত রেখেছিলেন যেনো শেখ মুজিবুর রহমান এসে চাঁদপুরে উপস্থিত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারেন। তবে সারা রাত অপেক্ষা করেও তিনি এবং তার কর্মীরা শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত পান নি। কামাল হোসেন ২৪শে মার্চ থেকে ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত সমঝোতার ফোন কলের অপেক্ষায় ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্রে দেওয়া জবানবন্দীতে তিনি উল্লেখ করেছেন সেই ফোন কখনও আসে নি। তাজউদ্দিন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে চাপ দিলেও ২৫শে মার্চ রাত্রে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলা প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় তৎকালীন বুয়েটের একজন শিক্ষক বলেছেন তিনি ৩২ নাম্বারে একটি ট্রান্সমিটার বসিয়ে এসেছিলেন, তবে সেই ট্রান্সমিটার থেকে কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয় নি।
শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা না দিলেও আক্রান্ত জনগণ নিজেদের করনীয় নির্দিষ্ট করে ফেলে। তারা ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানের সড়কে গাছের গুড়ি ফেলে ব্যারিকেড তৈরী করে, যদিও এইসব ব্যারিকেড সেনাবাহিনীর অগ্রগতিকে বিন্দুমাত্র ব্যহত করতে পারে নি। তারা নিজেরাই স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ২৬শে মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত একটি স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত একটি ঘোষণা ধরা পরে চট্টগ্রামের বহিনোঙরে উপস্থিত একটি জাহাজের রেডিওতে। এবং ২৬শে মার্চ সকালেই চট্টগ্রামের বেতারকর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার শুরু করে। পরের দিন তারা সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমানকে ডেকে এনে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে। সেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ শুনতে পেয়েছে এবং নিজেদের মতো প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্যর আশ্বাস পেয়েছেন তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হন নি, বরং দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ সময়টাতে শেখ মুজিবুর রহমান কেনো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন না এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক তৈরী হয় নি। তখন সারা দেশের মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করতে প্রয়োজনে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আনুষ্ঠানিক ভাবে যখন জানানো হলো এই মুক্তিযুদ্ধে নিহতের পরিমাণ ৩০ লক্ষ তখন একটা মৃদু গুঞ্জন উঠে যদি ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হতো কিংবা ১লা মার্চ যখন অধিবেশন বানচাল করা হলো সেদিন যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হতো তাহলে এত মানুষ নিহত হতো না, এবং সেই সময়েই ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব এবং শেখ মুজিবুর রহমান আসলে বন্দী হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন এমনটা প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
ইতিহাস ব্যক্তির সচেতন উৎসাহে বিকৃত হয়। একজন নেতা যিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিশমায় এবং সাংগঠনিক দক্ষতায় একটি রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণকে স্বাধীকার-স্বায়ত্বশাসন এবং মুক্তির দাবীতে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্বের কোনো আন্দোলনেই তিনি নেতৃত্ব দিতে পারেন নি। তবে পূর্ব বাংলার জনগণ বিশ্বাস করতো শেখ মুজিবুর রহমান তাদের জন্যেই পাকিস্তানী কতৃপক্ষের বিরাগভাজন এবং তিনিই তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারেন।
এই ইস্যুতে আপনার মতামতের আশাতেই ছিলাম।
আশা পূরণ হইলো!
"ইতিহাস ব্যক্তির সচেতন উত্সাহে বিকৃত হয়।" ১০০% খাঁটি কথা ! অনেক কিছুর ব্যপারে কিন্তু পস্ট করে বলেননি । বিরাগভাজন হবার সম্ভাবনা ছিল বলে হ্য়তো । গা বাঁচিয় লেখার মনোভাব কিন্তু লেখকের দূরব্লতাই প্রকাশ করে ! ধন্যবাদ !
মন্তব্য করুন