ইউজার লগইন

ক্ষুদে পাইনের বসতি

যে মহল্লায় থাকি তার নাম ক্ষুদে পাইনের বসতি। সম্ভবত যখন এখানে প্রথম বসতি স্থাপিত হয়েছিলো তখন আশেপাশের ছোটো ছোটো টিলার উপরের পাইন গাছগুলো ক্ষুদ্র ছিলো, সেসব গাছের বয়েস বেড়েছে। শহরও গতরে বেড়েছে। শহরের চরিত্রই এমন, নাগরিক সুবিধাগুলোর আনুভুমিক বিস্তৃতির সাথে জনবসতি বাড়ে। কোনো একজন বসতির সামনে ছোটো একটা মুদি দোকান খুলে ফেলে, তার পাশেই কেউ চুল ছাঁটার দোকান, কেউ কাপড় সেলাইয়ের দোকান খুলে, তারপর ধীরে ধীরে দোকানের ধরণ বদলায়, মুদি দোকান থেকে কনভেনিয়েন্ট স্টোর কিংবা সুপারমল তৈরী হওয়ার পর মুদির দোকানী তৈরী খাবারের দোকান খুলে জাঁকিয়ে বসে।

এখানেও কোনো এক সময় এমন পরিস্থিতি ছিলো, তবে আমরা আসার কয়েক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয় কাছের পাহাড়ে স্থানান্তরিত হওয়ায় ক্ষুদে পাইনের বসতির জনঘনত্ব বহুগুণ বেড়েছে। টিলার এপাশ ওপাশে উঁচু-নীচু রাস্তা ধরে হাঁটলে বুঝা যায় কাছেপিঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি কিভাবে এলাকার আর্কিটেকচারাল হোমোজিনিটি নষ্ট করে ফেলে। থাকার বাসা আর ভাড়ার বাসার ভেতরে কাঠামো আর সজ্জার বিস্তর ব্যবধান। যারা পুরোনো বাসিন্দা, তারা বাসার পাশেই কিচেন গার্ডেনের জায়গা রেখেছে, একটা দুটো পাইন গাছ নইলে ফল ফুলের গাছ লাগিয়েছে, ভাড়ার বাসায় এমন কোনো সবুজ সজ্জ্বা কিন্নগবা আচ্ছাদন নেই। টিলার উপরে যে যতটুকু জায়গা পেয়েছে, কয়েকটা ঘর তুলে শিক্ষার্থীদের ভাড়া দিয়েছে। এখনও আশেপাশে নতুন নতুন বাসা তৈরী হচ্ছে।

অসংখ্য ভাড়া বাসার ভীড়ের পেছনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টিলা, আর টিলার উপরে সারি সারি পাইন গাছ। সন্ধ্যা নেমে আসার পর সে জনবসতি ক্রমেই জনশূণ্য হয়ে যায়, সারিসারি তিনকোণা বাড়ীর জানালায় আলো জ্বলে, সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাত নেমে আসলে ধীরে ধীরে জানালাগুলো অন্ধকার হতে হতে রাত ১০টায় মোটামুটি সব বাসার আলোই নিভে যায়।

ক্ষুদে পাইনের বসতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হাঁটা পথে কম বেশী ২০ মিনিট। রাত ৮টার পর ল্যাবরেটরী থেকে বের হয়ে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে নীচে নামলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিমটিমে রাস্তার আলো অন্ধকারের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। সেই শুন-শান নিশ্চুপ পথে ভালুকের ভয়, নীচে খাদের কোনো এক জায়গায় ভালুক এই শীতে শীতঘুম যায়। পাহাড়ী রাস্তা সমতলে মেশার জায়গায় একটা কনভেনিয়েন্ট স্টোর- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে যারা থাকে গভীর রাতে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপ্ত্রের চাহিদা মেটায়। জাপানের পৌঁছানোর পর প্রথম দিন রাতে এখান থেকেই একশ টাকায় এক পাউন্ডের পাউরুটি কিনেছিলাম।
সেখান থেকে পশ্চিমে হাঁটলে কিছু দুরেই ক্ষুদে পাইনের বসতি।
কনভেনিয়েন্ট স্টোর পার হওয়ার পর রাসার দুই পাশেই টিলা, জনশূণ্য পথে তবু আমি একা নই, আমার মাথার ভেতরে অসংখ্য স্বর- টুকরো টুকরো ভাবনার স্রোত ঠেলতে ঠেলতে আমাকে ঘরের দিকে নিয়ে আসে। রাস্তার উপরে ভাড়া বাসায় মসজিদ বানিয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে পড়তে আসা মুসলিম শিক্ষার্থীরা, সেখানে দরজায় লেখা No Paeking on the street, তাড়াহুড়োয় কি বোর্ডে আর এর বদলে ই টাইপ করে প্রিন্ট নিয়েছে দুই বছর আগে, এখনও সে ভুল কারো নজরে আসে নি কিংবা নজরে এলেও এটা সংশোধনের কোনো প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করে নি। সেই সাইনবোর্ড পার হওয়ার পর একটা সিগারেট ধরালে শেষ টানটাই বাসার পার্কিং।

ক্যালেন্ডারের পাতায় বসন্ত এসেছে তবে সকালে দরজা খুললেই দেখি সামনের ছাদ শিশির জমে সাদা হয়ে আছে। সূর্য উঁকি দিলে সাদা রঙ স্বচ্ছ হয়ে যায়। এই বসন্তেও বাঙালী চামড়ায় শীতের কামড় টের পাই। দুই প্রস্ত কাপড় মুড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ল্যাবরেটরি যাই। পরিচ্ছন্নতাকে জীবনের অংশ করে ফেলা জাপানীরাও রাস্তায় টুকরো কাগজ ফেলে কিংবা আমাদের মতো ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন দেশী মানুষেরাই রাস্তায় এসব ফেলে রাখে। আমি জানি না কিন্তু ল্যাবরেটরীতে গেলে বুঝতে পারি আমাদের কাজের সাথে জাপানীদের কাজের ভীষণ রকম তফাত। সেখানে সবচেয়ে অগোছালো টেবিলটা আমার। ব্যবহৃত জিনিষের স্তুপ বানিয়ে কর্মব্যস্ততা প্রদর্শনের বিশ্রী স্বভাব হয়তো। জাপানী শিক্ষার্থীরা সময় নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে কাজ করে, কাজ শেষ করার পর আবার মোটামুটি সব কিছু গুছিয়ে টিপটপ রেখে দেয়। এই পরিচ্ছন্নতা অভিযানে কাজের শুরুর আর শেষের ১ ঘন্টা তারা মূলত গোছানোর কাজটাই করে আর সব মিলিয়ে আমার কাজের সময় ১ ঘন্টা। সব কিছু টিপটপ রাখলে পরবর্তী জনের কাজের সুবিধা হয় কিন্তু স্বভাবে নেই তাই মনে রেখে সব দিন করা সম্ভব হয় না।

এর ভেতরে একদিন ল্যাবের নিরাপত্তা আর পরিচ্ছন্নতা প্রতিবেদন দেওয়ার দায় চাপলো ঘাড়ে, টিপটপ ল্যাবরেটরী ঘুরে দেখলাম আমার টেবিল এবং এর সংলগ্ন এলাকাই ল্যাবের সবচেয়ে বিপদজনক জায়গা, একটা স্তুপকে ভেঙে চুড়ে ৪টা স্তুপ বানানোর পর মনে হলো অনেক গোছানো হয়েছে সবকিছু, পরের সপ্তাহে অন্য একজন নিরাপত্তা প্রতিবেদনে জানালো ল্যাবের জিনিষপত্রের অনেকগুলোই অগোছালো, সেসব সে গুছিয়ে রেখেছে। আমার চোখের সামনে সারাক্ষণ এই দৃশ্যের উপস্থিতি ছিলো অথচ এটা যে গুছিয়ে রাখা দরকার, তেমনটা আমার মনে হয় নি।

পোস্টটি ১০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


Smile

তানবীরা's picture


বাংলাদেশি ছেলেদের স্বভাবেই হয়তো গোছানো শব্দটা নেই Sad

টুটুল's picture


Big smile

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


দ্য প্লেস বিয়ন্ড দ্য পাইনস
নামের একটা মুভি মনে পড়ে গেল হঠাৎ!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.