ইউজার লগইন

সৌরকেন্দ্রীক মহাবিশ্ব

বিজ্ঞান মোটা দাগে সভ্যতার সামষ্টিক অর্জন। যোগাযোগের দুর্গমতায় দুই হাজার বছর আগের ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার মানুষের নিয়মতান্ত্রিক পর্যবেক্ষণের সংবাদগুলো পরস্পরের অজানাই রয়ে যেতো অধিকাংশ সময় কিন্তু যন্ত্রযুগে ছাপাখানা এবং ইন্টারনেটের কল্যানে আমাদের যোগাযোগ অনেক বেশী সাবলীল। মধ্যযুগের ইউরোপে অনুবাদকদের কল্যানে গ্রীক সভ্যতার দার্শণিক বিজ্ঞানিদের অবদানের কথা সবাই জানতো, সে তুলনায় মিশরীয়, ব্যাবিলনীয় কিংবা অসীরিয় সভ্যতার অবদান খুব বেশী প্রকাশিত কিংবা প্রচারিত নয়। The Adaptation of Babylonian Methods in Greek Numerical Astronomy নিবন্ধটা দুটো ভিন্ন সভ্যতার দার্শণিক পর্যবেক্ষকদের বৈজ্ঞানিক তথ্য বিনিময়ের সম্ভাবনা প্রকাশ করেছে। নিবন্ধটা অন্য একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ, পরস্পরবিচ্ছিন্ন দুটো ভিন্ন সভ্যতার দার্শণিক বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে চাঁদের গতিবিচ্যুতির তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে, কি গতিবিচ্যুতি পর্যবেক্ষণ এবং তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ভেতরের সময়ের ব্যবধানটুকু ২ হাজার বছরের বেশী। আমরা বর্তমানের সময়ে যা কিছু পর্যবেক্ষণ করছি আমাদের সময়কালে সব পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রত্যাশা করা উচিত হবে না কখনও কখনও পর্যবেক্ষণ এবং ব্যাখ্যার মাঝে হাজার বছরের ব্যবধান লুকিয়ে থাকে।

Decoding the ancient Greek astronomical calculator known as the Antikythera Mechanism

বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্ধিত-পরিবর্তিত-পরিশীলিত হয়। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কোনো নির্দিষ্ট একজন ব্যাক্তি আমাদের সকল বোধ-বিবেচনায় ঝাঁকুনি দিয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মধারায় বিপ্লব এনে দেন, সেইসব সংক্ষিপ্ত তীব্র ঝাঁকুনি বাদ দিলে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় জ্ঞান উৎপাদনের ধারাটা নিস্তরঙ্গ ক্রমবর্ধমান।

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে না কি সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে বিতর্কটার কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। প্রতিটি সভ্যতায় মহাকাশ পর্যবেক্ষণ এবং গ্রহ-নক্ষত্রের গতি বিশ্লেষণের সময় দুই দল দার্শণিক-বিজ্ঞানীর ভেতরে এ বিতর্ক হয়েছে, কখনও এই বিতর্কে সুর্যবাদী মতবাদ বিজয়ী হয়েছে, কখনও পৃথিবীবাদী মতবাদ বিজয়ী হয়েছে। উভয় মতবাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা ছিলো যদিও উভয় মতবাদই পর্যবেক্ষণকে সরল-জটিল উপায়ে ব্যাখ্যা করতে পারে। এই দুই মতের অনুসারী দার্শণিক-বিজ্ঞানীরা কিরিচ-কুড়াল-লাঠি নিয়ে নিজের মতবাদের পক্ষে জঙ্গী মিছিল করেছিলেন এমনটা জানা যায় নি।

নিশ্চিত বলা যায় না কেনো খ্রীষ্টান মিশনারীরা এরিস্টটলের বিশ্ববীক্ষায় আস্থা স্থাপন করলেন এবং কেনো টলেমীর পৃথিবীকেন্দ্রীক মহাবিশ্বের ধারণাটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো, কিন্তু পরবর্তী এক সহস্রাব্দ জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা অন্বেষণের কেন্দ্র হিসেবে চার্চ সূর্যকেন্দ্রীক মতবাদকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। কোপার্নিকাস, ব্রুনো ,কেপলার গ্যালিলিও কেউই এককভাবে সৌরকেন্দ্রীক মহাবিশ্ব ধারণার জনক নন, ধারণাটা তাদের জন্মের হাজার বছর আগে হয়ে যাওয়া বিতর্কের বিস্তারিত বিবরণ অনুবাদে হলেও প্রাচীন লাইব্রেরীতে সভ্যতার ইতিহাসে উপস্থিত ছিলো।

টাইকো ব্রাহের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণের দীর্ঘ ৫ বছর শেষে কেপলার যখন সকল পর্যবেক্ষণকে গাণিতিক মডেলে উপস্থাপন করলেন- তিনি লক্ষ্য করেছেন গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে কক্ষপথে ঘুরছে। গ্রহের গতিবেগ, কক্ষপথে পুনরায় ফিরে আসার সময়কালের ভেতরে তিনটি গাণিতিক সম্পর্ক তিনি তার জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বইয়ে প্রকাশ করেছেন। কেপলারের গাণিতিক সূত্র প্রকাশের আরও ৬০ বছর পর কেম্ব্রীজে আপেল গাছের নীচে বসে থাকা নিউটনের মাথায় আপেল ভেঙে পরলো, আমরা নিউটনের মহাকর্ষ বিষয়ক সূত্র পেয়ে গেলাম। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির প্রক্রিয়াটা এমন না। কেপলারের গাণিতিক সূত্র নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে অনেক বেশী প্রভাবিত করেছে, তাকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। নিউটনের ঘনিষ্ট বন্ধুরা অনুযোগ করেছেন নিউটন কেপলারের ঋণ স্বীকার করেন নি।

নিউটনের সময়কালের পর সূর্যকেন্দ্রীক মহাবিশ্বের ধারণা নিয়ে তেমন বড় বিশৃঙ্খলা তৈরী হয় নি ইউরোপে। চার্চের কতৃত্বের সীমারেখা তার আগেই চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। আমাদের বাস্তবের জগতে সূর্য উদিত হয়, অস্ত যায়, বৈজ্ঞানিক অনুসিদ্ধান্ত মেনে নিলে পৃথিবী পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘুরে, আমাদের পায়ের নীচে মাটি আর উপরে আকাশ। যদিও মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে এমন কোনো উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম দিকনির্ধারনী কম্পাস কোথাও নেই। নিউটন অনেক অংক কষে হিসেব মিলিয়ে দেখিয়েছেন মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে আকর্ষণ করে । গণিত বলছে অসীম সময় ধরে এই ধরণের আকর্ষণ বলবত থাকলে বস্তুকণাগুলো জটলা পাকাবে। "জট পাকানো মহাবিশ্ব" এই ধরণের আকর্ষণের যৌক্তিক পরিণতি। যেহেতু এখনও মহাবিশ্ব জট পাকায় নি সুতরাং মহাবিশ্বের একটা সূচনা আছে- সাড়ে তিনশ বছর আগে এমন একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মানুষেরা বিগ ব্যাং, আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্ব কিংবা হাবল টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে না জেনেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে।

পৃথিবীর বুকে সর্বগ্রাসী সর্বভুক আমরা যতই দাপটে চলাফেরা করি না কেনো, মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে আমাদের পৃথিবী খুবই সাধারণ মাত্রার একটা পাথরখন্ডের বেশী কিছু না, সেই পাথরখন্ডের গায়ে লেপ্টে থাকা মানুষ আর এমিবা ব্যাক্টেরিয়ার ভেতরে তফাত করে একটা উৎকৃষ্ট এবং অন্যটিকে নগন্য ঘোষণা করা মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে চুড়ান্ত অর্থহীন ভাববিলাসীতা। চুড়ান্ট অর্থহীনতার ভেতরে ধর্ম বিভাজন এবং ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে মানুষ মানুষের মতাদর্শিক আধিপত্যবাদীতার সংঘাতগুলো এত বেশী অর্থহীন এবং চারপাশে এই অর্থহীন সংঘাতের মাত্রাতিরিক্ত আবেগী প্রকাশ দেখে মনে হয় মানুষ অহেতুক অনেক কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করে।

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরে এটাই এমমাত্র কিংবা চুড়ান্ত বৈজ্ঞানিক সত্য না, আমাদের অনুধাবনযোগ্য দিক বিভাজনের প্রেক্ষিতে এটা একটা সিদ্ধান্ত। আমাদের সৌরজগতে এমন গ্রহও আছে যারা পৃথিবীর ঘুর্ণন বিবেচনায় উলটো দিকে ঘুরছে। যেকোনো নক্ষত্রের চারপাশে পরিভ্রমণরত যেকোনো গ্রহের ক্ষেত্রে মাত্র দুটো দিকে ঘোরার স্বাধীনতা আছে, সুতরাং গ্রহকে এই দুটো পথের যেকোনো একটা গ্রহন করতে হবে। হাজার পাতা অংক কষে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাবে না নক্ষত্রটি নির্দিষ্ট এই শর্তগুলে পুরণ করলে তার চারপাশের গ্রহগুলো পৃথিবীর মতো পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘুরবে।

বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের ফলাফলে উত্তর- দক্ষিণ- পূর্ব- পশ্চিম- উপর- নীচ- ঈশাণ- নৈঋত কোণের কোনো গুরুত্ব না থাকলেও আমাদের অভিজ্ঞতার জগতকে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের প্রচলিত সামাজিক শব্দগুলো ব্যবহার করতে হয়। শব্দ ব্যবহার করে ভাবনা নির্মানের প্রক্রিয়ায় আমরা একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ যে ভাষায় উপস্থাপিত হতে দেখছি- সেটা বৈজ্ঞানিক সত্য!! বলা যাবে না।

চাঁদের কক্ষপথ পরিভ্রমণের বিচ্যুতির তথ্য ৫ হাজার বছর পুরোনো ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষের জানা ছিলো। কেপলারের সূত্র এবং নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে ল্যাপ্লাস দেখালেন যেমনটা অনুমাণ করা হয়, কক্ষপথগুলো তেমন নিশ্চল সমতল নয় বরং এই সমতলীয় ক্ষেত্রটি নির্দিষ্ট অক্ষে ঘুরতে পারে। পরবর্তী পর্যবেক্ষণে দেখা গেলো এমন সমতলীয় ঘুর্ণনের অস্তিত্ব আছে এবং মোটা দাগে নিউটনের সূত্র ব্যবহার করেই এই ঘূর্ণনকে ব্যাখ্যা করা যায়।

নেপচুনের কক্ষপথের বিচ্যুতি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র মানছে না, বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে বলা হলো অন্য একটি গ্রহের অস্তিত্ব রয়েছে এবং যখন ইউরেনাস আবিস্কৃত হলো, নিউটন তখন বিজ্ঞানের চুড়ান্ত ঈশ্বর। আলোর কণিকা তত্ত্ব, প্রতিসরণ প্রতিফলনের সূত্রের অসঙ্গতি সত্ত্বেও সেসব সূত্রকে সরাসরি বাতিল কিংবা অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয় নি।
বুধ গ্রহের কক্ষপথের বিচ্যুতির হিসেব কষে দেখা গেলো বিচ্যুতির পরিমাণ নিউটনের সূত্রের প্রস্তাবিত বিচ্যুতির দ্বিগুণের বেশী। নিউটনের সূত্র অভ্রান্ত ধরে নিয়ে যেসব বিকল্প প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হলো- সকল প্রস্তাবনাই তাত্ত্বিক বিবেচনায় অগ্রহনযোগ্য প্রমাণিত হওয়ার পর সেটা উনবিংশ শতাব্দীর মহাকাশ বিজ্ঞানের গলার কাঁটা হয়ে টিকে ছিলো প্রায় ১০০ বছর। পরবর্তীতে আইনস্টাইন প্রস্তাবিত মহাকর্ষ তত্ত্ব ব্যবহার করে বুধ গ্রহের কক্ষপথ বিচ্যুতির পরিমাণ হিসেব করে দেখা গেলো আইন্সটাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব চমৎকার ভাবে বুধ গ্রহের কক্ষপথের বিচ্যুতি ব্যাখ্যা করতে পারছে। স্যার আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন কিছুটা দুর্নীতি করে হলেও আইন্সটাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে একক প্রয়াসে ইউরোপে সর্বজন গ্রহনযোগ্যতা দিয়েছেন।

মহাকর্ষ তত্ত্ব সম্পর্কে আইন্সটাইনের অনুমাণ ছিলো নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র যেভাবে মহাবিশ্বকে জট পাকিয়ে ফেলছে, তার মহাকর্ষ তত্ত্ব মহাবিশ্বকে স্থিতিশীলতা দিবে। গ্রহ-নক্ষত্র অনন্ত অসীম সময় ধরে নিজেদের নির্ধারিত কক্ষে ঘুরে যাবে মহাকর্ষ তত্ত্ব মেনেই। ১৯১৬ সালে সোয়ার্সচাইল্ড আইনস্টাইনের সমীকরণ সমাধান করে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের সম্ভাবনা ঘোষণা করলেন এবং ১৯২২ সালে অপরিচিত এক রাশিয়ান গবেষক ঘোষণা করলেন আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্ব অস্থিতিশীল, আইন্সটাইন রাশিয়ান বৈজ্ঞানিকের গবেষণাপত্রটি প্রথম পাঠেই বাতিল ঘোষনা করলেন। অংক কষে মহাবিশ্বের প্রসারন থামানোর প্রচন্ড প্রচেষ্টা করলেন কিন্তু সূত্র প্রস্তাবনার এক যুগের ভেতরেই হাবলের পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করলো মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।

পোস্টটি ৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


টিপ সই

তানবীরা's picture


টিপ সই

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.