বর্তমানের ভাবনা
সমাজের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সমাজের নীতি-নৈতিকতা নির্ধারণ করে। ধর্ম যে কৃষিভিত্তিক সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিকশিত হয়েছে সেখানে ধর্ম দাসের প্রতি মানবিক হতে অনুরোধ করলেও যেহেতু তৎকালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দাসের উপস্থিতি প্রয়োজনীয় ছিলো তাই কোনো ধর্মই সরাসরি দাস ব্যবসাকে নাকচ করে দিতে পারে নি। সমাজে দাসবিষয়ক মানসিকতা পরিবর্তনের জন্যে শিল্পবিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছে। শিল্পবিপ্লবের ফলে বিদ্যমান কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অপ্রচলিত হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষমতাকাঠামো টিকিয়ে রাখতে দাসদের খুব বেশী প্রয়োজন ছিলো না। সমাজ সংস্কারকদের চাপে, বিভিন্ন ধরণের মানবতাবাদী উপাখ্যানে মুক্ত মানুষের ধারণা প্রচলিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই দাসব্যবসা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আফ্রিকা থেকে জাহজ ভরে মানুষ ধরে নিয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রে খোলা বাজারে নিলাম করে মানুষ বেচা বন্ধ হয়ে যায় ১৮০৮ সালে কিন্তু সে সময়েও দক্ষিণের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে দাসের প্রয়োজন ছিলো। গবাদি পশুর খামারের মতো গড়ে ওঠা দাসখামারে জন্ম নেওয়া শিশুদের কেনা বেচা অব্যহত ছিলো পরবর্তী ৫০ বছর। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবসা বেআইনী হয়ে যায়। শুধুমাত্র উপমহাদেশেই বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন পর্যন্ত সীমিত পর্যায়ে দাস ব্যবসা প্রচলিত ছিলো।
মহাবিশ্ব এবং জীববৈচিত্রের উৎপত্তি, বিকাশ এবং বিনাশ বিষয়ে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আলাদা। নিয়মতান্ত্রিক পর্যবেক্ষণ, পুণঃনিরীক্ষণ যাচাই বাছাই করে ক্রমাগত নির্ভুলতার পরিমাণ বাড়িয়ে, তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে বিজ্ঞান মহাবিশ্ব এবং জীববৈচিত্র সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা দিয়েছে তার নির্ভরযোগ্যতা বেশী। ব্যক্তিগত বিশ্বাসনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক ব্যাখা সর্বজনগ্রহনযোগ্য হতেই হবে এমন কোনো শর্ত নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন সুবিধা ব্যবহার করেও পৃথিবীর অনেক মানুষ মহাবিশ্ব এবং জীববৈচিত্র সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্বাস করে না এবং তাদের ব্যক্তিগত অবিশ্বাস বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রক্রিয়াকে খুব বেশী প্রভাবিত করে না।
চার্চ এবং সম্রাটের ক্ষমতার সীমাসংক্রান্ত সংঘাতে বিজ্ঞানের তেমন স্পষ্ট ভুমিকা ছিলো না। চার্চের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করতে সম্রাট বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সহযোগিতা নেন নি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যখন ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় যাজক-পাদ্রীদের তুলনায় বৈজ্ঞানিক গবেষকদের মতামত প্রাধান্য পেয়েছে। অনেকের দ্বিমত থাকবে মেনে নিয়েও "মহাবিশ্ব- জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারাবাহিক গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলো ধর্মগ্রন্থ বর্নিত মহাবিশ্ব এবং জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণাগুলোকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করেছে বলেই উনবিংশ শতাব্দী পরবর্তী সময়ে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের ভেতরে এক ধরণের সংঘাত তৈরী হয়েছে " এই সিদ্ধান্ত আমার কাছে আরোপিত মনে হয়।
ধর্মগ্রন্থের মহাবিশ্ব ও জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিবরণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞান এবং ধর্মের সংঘাত তৈরী হয় নি, বরং আমার অভিমত বিজ্ঞান সমাজের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে এবং ধর্ম যে ধরণের সমাজে বিকশিত হতে পারে সে সমাজ ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে ফেলেছে বলে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের ভেতরে সংঘাত তৈরী হয়েছে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে গত ১০ হাজার বছর যে ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা প্রায় অধিকাংশ সমাজেই প্রচলিত ছিলো, গত ৫০০ বছরে আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাব এবং ঔপনিবেশিকতার সুবাদে পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজেই উৎপাদন সম্পর্কগুলো বদলে গেছে। সামাজিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে গেছে। পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোতে ধর্মউপজাত নৈতিকতা তার প্রয়োজন হারিয়েছে। ক্রমশঃ অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় ধর্মপুরুতেদের সমাজের বিভিন্ন কাঠামোতে যেমন ক্ষমতাও কতৃত্ব ছিলো বর্তমানে তেমন ক্ষমতা ও কতৃত্ব নেই।
ভবিষ্যতের শ্রমিক, সৈনিক, পেশাজীবীদের চাহিদা পূরণের জন্যে সমাজ এবং রাষ্ট্রে নতুন শিশুর চাহিদা ছিলো। যন্ত্রযূগে যখন কায়িক শ্রমের চাহিদা পূরণের জন্যে রাষ্ট্র-সমাজের খুব বেশী শিশুর প্রয়োজন নেই বরং বিদ্যমাণ কলকারখানায় যন্ত্র পরিচালনার জন্যে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী প্রয়োজন হয়, রাষ্ট্র শিশুর শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন অনুভব করেছে। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে শ্রমিকের চাহিদা আরও কমেছে, ফলে রাষ্ট্র এবং সমাজ নারীর শরীর এবং গর্ভের স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন নীতিমালা তৈরী করছে। রাষ্ট্র গর্ভস্থ ভ্রুণের উপরে নজরদারি করছে না কিন্তু গর্ভধারণের কতদিন পর গর্ভস্থ ভ্রুণের মানবাধিকার জন্মায় সে বিষয়ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
নভেম্বরের শুরু থেকে আয়ারল্যান্ডের নারীবাদীরা প্রধানমন্ত্রী এন্ডা কেনীকে নিজেদের রজঃস্রাবের বিস্তারিত টুইট করছেন। রক্তপাতের পরিমাণ, ঘনত্বের বিস্তারিত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে করা টুইটের প্রধান লক্ষ্য আসলে আয়ারল্যান্ডের প্রচলিত গর্ভপাতবিরোধী আইন সংস্কারের দাবী। আয়ারল্যান্ডের নারীরা তাদের গর্ভধারণ এবং গর্ভমোচনের স্বাধীনতা দাবী করছেন। গর্ভমোচনের পরাধীনতায় আয়ারল্যান্ডে গত শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত বিবাহবহির্ভুত শাররীক সম্পর্কে জন্ম নেওয়া শিশুদের একাংশ কতৃপক্ষীয় উদাসীনতায় খুন হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতেও গর্ভমোচন অপরাধ। শুধুমাত্র প্রাণসংশয় ঘটলে গর্ভমোচন অনুমোদিত। যৌনস্বাস্থ্য সচেতনতার অপ্রতুলতায় সেখানে শিশু-কিশোরী মাতার সংখ্যা বাড়ছে। এদের একাংশ যৌননিপীড়নের শিকার কিন্তু রাষ্ট্র নির্বিকার। ভ্রুণের উপর রাষ্ট্রের নজরদারিতে এইসব ১০-১২ বছরের মেয়েরা গর্ভধারণের পর পরিবারপরিত্যাক্ত হয়ে যাচ্ছে চার্চের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত শিশুমাতাসদনে। শিশুমাতাসদনে জন্ম নেওয়া শিশুরা আয়ারল্যান্ডের মতো চার্চের সচেতন উপেক্ষায় গণহত্যার মুখোমুখি হচ্ছে কি না জানা যাবে না এখনই।
উৎপাদন ব্যবস্থার ক্রমশঃ যান্ত্রিকীকরণে মানবশিশুর প্রয়োজন কমেছে। উন্নত বিশ্বের নাগরিকেরা সন্তান ধারণ এবং লালনপালনের ঝঞ্ঝাট নিতে অনাগ্রহী কিন্তু রাষ্ট্র এখনও সকল উৎপাদন প্রক্রিয়াকে যন্ত্রানুগত করতে পারে নি, ফলে উন্নত বিশ্ব শিক্ষিত শ্রমিক নিচ্ছে। বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ড পরিচালনায়,কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং গবেষণার প্রয়োজন মেটাচ্ছে এইসব শ্রমিক, কখনও কায়িক শ্রমের চাহিদা পূরণ করছে।
ঔপনিবেশীকতা শিল্পবিপ্লবপরবর্তী ইউরোপীয় সভ্যতার ছোঁয়াচ লাগিয়েছিলো অইউরোপীয় কৃষিভিত্তিক সভ্যতাগুলোতে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদন সম্পর্কগুলো বদলানোর আগেই সস্তা শ্রম এবং মুনাফার চাপে সেসব অইউরোপীয় সভ্যতায় বিকৃত সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিলো, সেসব অপরিপুষ্ট সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা সময়ের প্রয়োজনে ইউরোপে নিজেদের সামাজিক সংস্কারসমেত উপস্থিত হচ্ছে। শিল্পবিপ্লব যেভাবে ইউরোপে ধর্মের নৈতিক প্রয়োজনীয়তাকে সীমিত করেছে, এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশের সমাজগুলোতে উৎপাদন সম্পর্কের যথাযথ পরিবর্তন না ঘটায় সেখানে ধর্মের নৈতিক প্রয়োজনীয়তা কমে নি। উৎপাদন ব্যবস্থা কৃষিনির্ভর হওয়ায় এখানে শিশুজন্মহার বেশী। নারীর শরীর এবং গর্ভের স্বাধীনতার বোধ বিচ্ছিন্নভাবে শহুরে শিক্ষিত নারী পুরুষের ভেতরে তৈরী হলেও সেটা সমাজের প্রধান স্বর হয়ে উঠতে পারে নি। গাধার পিঠে জেট এঞ্জিন বেধে চন্দ্রবিজয়ের স্বপ্ন দেখা মানুষেরা বিজ্ঞান প্রযুক্তি সমাজ ধর্ম এবং নৈতিকতার সম্পর্কগুলো যথাযথ অনুধাবন করলে এবং রাষ্ট্র যদি কখনও ভোটব্যাংক পৃষ্টপোষকতা ছেড়ে ব্যক্তি নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠে হয়তো পরিস্থিতি বদলাবে, তবে বর্তমানের উৎকট সংকর সমাজে সার্বজনীন আধুনিকতা প্রত্যাশা করাটা মুর্খতা।
মন্তব্য করুন