কোটাওয়ারী রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা
পুরানা পল্টনের ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের দোকানে ৭০০ পাতার কায়দে আজম জিন্নাহর জীবন ও রাজনীতি শিরোণামের বই খুঁজে পেয়েছিলাম একবার। ১৯৬৯ কিংবা ১৯৭০ এ বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ পরিস্থিতিতেও এমন বিশাল বই প্রকাশের সাহস প্রকাশকেরা করেছিলেন- পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে- বিশেষত সামরিক শাসন কবলিত প্রশাসনের সাথে তিক্ততার ভেতরেও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি এক ধরণের অনুরাগ বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে ছিলো।
সেক্যুলার জিন্নাহ কংগ্রেস পরিত্যাক্ত এবং বিলাতে নির্বাসিত জীবন সমাপ্ত করে দেশে ফিরে মুসলিম লীগের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করলেন। পাকিস্তানের দাবীতে তার সাথে গান্ধী-নেহেরু-বল্লালভাই প্যাটেলের মতবিরোধের প্রধান দুটো কারণ গণতান্ত্রিক সমতার শর্ত অস্বীকার করা। তিনি দাবী করলেন ২৫ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত জনপদে পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের জন্যে ৩৩ শতাংশ অধিকার ছেড়ে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবর্তে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব বেশী হতে হবে রাজনীতিতে- নইলে যেসব প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ট তাদের দাবী কেন্দ্রীয় পরিষদে অনুমোদিত হবে না।
গান্ধী-নেহেরু পরিষদ হয়তো কেন্দ্রের দাবীতে কিছুটা ছাড় দিতে আগ্রহী ছিলেন কিন্তু গণতান্ত্রিকতা পরিহার করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাড়তি অধিকারের দাবীকে তারা সমর্থন করেন নি। অবিভক্ত বাংলায় বেঙ্গল প্যাক্টে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অগণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের দাবী মেনে নিয়েছিলেন। কোলকাতা মিউনিসিপালিটিতে যতদিন না কর্মকর্তা- কর্মচারীদের ভেতরে মুসলিম কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্ব দেশের নাগরিক প্রতিনিধিত্বের সমান হয়, ততদিন পর্যন্ত তারা মুসলিমদের নিয়োগে বাড়তি সুবিধা দিবেন। অগণতান্ত্রিক হলেও এমন কোটাভিত্তিক রাজনীতি আপাতক্ষমতাসাম্যতা তৈরীতে ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালী জাতীয়তাবাদী উত্থান প্রতিরোধে এমন কোটাভিত্তিক সমতাবিধানের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিলেন। তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়েছে। আমরা মাথাগুণতি ভোটের রাজনীতিতে বৈধভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ১৯৭০ এর নির্বাচনে সরকার গঠনের অধিকার পেয়েছিলাম।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের আগে এই দেশের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সব সময়ই সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমদের রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। তাদের সমর্থনে ও সহযোগিতায় বেঙ্গল প্যাক্ট হয়েছে, ১৯৩৭ এর নির্বাচনে তাদের সহযোগিতায় কংগ্রেসকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে এবং কৃষক প্রজা ও মুসলীম লীগ ঐক্য পরিষদ রাজনৈতিক ভাবে অবিভক্ত বাংলার শাসনাধিকার পেয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের পরপর যেযার মতো লুটপাটে জড়িয়ে পরা মানুষেরা প্রথমতঃ পয়াশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিহারী সম্প্রদায়ের ব্যবসা ও জমি দখল করেছেন। প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া হিন্দু পরিবারের ভূসম্পত্তি দখল করেছেন এবং ক্ষমতাসীনদের সাথে সমঝোতা ও বন্টনের মাধ্যমে হিন্দু সম্পত্তির দখল নিশ্চিত করেছেন। দীর্ঘ ৪০ বছরেও আমরা সেসব সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে পারি নি। দখলের রাজনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ব জলাভুমি ও বনভুমি ব্যক্তির দখলে গিয়েছে। খাসজমি এবং পরিত্যাক্ত জমি দখলের উন্মাদনায় দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংস করেছেন নির্বাচিত ও অনির্বাচিত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের অনুগত কর্মীবাহিনী। আমরা ক্ষমতার পিঠা ভাগের রাজনীতির শেষাংশে চলে এসেছি। হিন্দু এবং আদিবাসী ঠেঙাতে ঠেঙাতে দেশছাড়া করা এবং তাদের সহায়সম্পত্তি দখল করতে করতে এখন খুব বেশী অবশিষ্ট নেই। এখন আমাদের নজর দেবোত্তর পরিবত্র সম্পত্তিতে। অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপাসনালয়ের জমি গেলা শেষ হলে হয়তো মুসলিমদের শ্রেণীবিভাজন শুরু হবে।
দখলের রাজনীতিতে যাদের সম্পত্তি দখল করতে হয় তাদের কোনো না কোনো কল্পিত অভিযোগে অভিযুক্ত করতে হয়। মুর্তিপূজারী হিন্দুদের খর্বিত দেশপ্রেমের অভিযোগ দাখিল করে সহজেই ভূসম্পত্তি দখল করা সম্ভব হয়েছে, বাঙালী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী কমজোরী মুসলমানদের যেভাবে ১৯৭১ এ দমনের চেষ্টা করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী- বাংলাদেশেও সে পরিস্থিতি তোইরী হবে। ফলে প্রথম ধাক্কায় এইসব ধর্মউদাসীন বাঙালী সংস্কৃতির পক্ষে সোচ্চার মানুষেরা আক্রান্ত হবেন- তারপর সম্ভবত নামাজের ওয়াক্ত গুণে গুণে মুসলিম ভাগ হবে এবং তারও পরে দাড়ির দৈর্ঘ্য আর গোড়ালীর উপরে উঠে থাকা প্যান্টের দৈর্ঘ্য মেপে মুসলিম হত্যা শুরু হবে।
নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কিংবা পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা যেমন কোটাওয়ারী রাজনীতি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তেমন একটা উদ্যোগ পুনরায় নেওয়া জরুরী।
মন্তব্য করুন