চায়ের দোকান
ভূমিবিচ্ছিন্ন মানুষ আমি। ঘুলোগুলিতে আশ্রয় নেওয়া চড়াইয়ের ডানায় যতটুকু বুনোগন্ধ লেপ্টে থাকে, আমার শরীতে ততটা মাটির গন্ধ নেই। আমার বাংলাদেশ আদতে আমার পরিচিত মানুষের জীবনযাপন, উল্লাস আর আক্ষেপের ছবি যে ছবিতে আশার চেয়ে আশংকার পরিমাণ বেশী। যে সময়ের বাংলাদেশে আমি বেড়ে উঠেছি, সে সময়ে দেশের ১০ ভাগের ১ ভাগ লোক নগরবাসী ছিলো। গত ৪ দশকে নগরবাসীর পরিমাণ ১০ গুণ বাড়লেও আমার পরিচিতের গন্ডী ছোটো হয়ে গেছে। সময়ের সাথে বৃহত্ত্বর বাংলাদেশের সাথে আমার যোগাযোগ আরও ক্ষীণ হয়েছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো না। কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা কিংবা বন্যা আমার জীবনযাপনকে খুব বেশী প্রভাবিত করে নি। শৈশবের ট্রেনের জানালার চৌকো ফ্রেমে আর আন্তঃনগর ট্রেনের স্টেশনের প্লাটফর্মের চৌহদ্দিতে যতটুকু দেখা যায় গ্রাম বাংলার সাথে এর বেশী যোগাযোগ ছিলো না। বাজারের চায়ের দোকানে "টাউনিয়া" আমার সাথে মাটির যোগাযোগ হতো। আমাদের টাউনেও তখন মানুষ হাটের খবর রাখতো। মঙ্গল বার রেলবাজার হাট আর বৃহস্পতিবার ধুক্কুরঝাড়ি হাট। অন্য সব দিনই সেখানে ছোটো বাজার বসতো, পাশের নদী থেকে তুলে আনা কুঁচোচিঙড়ি, উঠানের মাচা থেকে কেটে আনা উচ্ছে, লাউ, কুমড়া, শসা আর একটা বেতের ঝুঁড়িতে বয়ে আনা কয়েকটা ডিম সদাই শেষ হয়ে গেলে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে দরাজ গলায় হাঁক দিতো হাটুরের দল- এক কাপ চা দিস তো এইদিকে।
আমাদের আমি-তুমি-আপনির নিয়মরীতি ছিলো। কতটুকু ঘনিষ্ঠতার পর তুই বলা যায় তার এক অলিখিত পরিমাপ ছিলো, তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেনো বয়স্কদের আপনি বলতেই হবে। দোকানের চ্যাঙরা ছোকরা অবলীলায় বৃদ্ধকে তুই বলছে দৃশ্যটা আমার শেখা তুই-তুমি -আপনির ব্যকরণ মানতো না।তাদের ঠাট্টা মশকরা আমি খুব যে বুঝতাম তাও না। শহরের মানুষেরা ভিন্ন স্বরে, ভিন্ন সুরে কথা বলতো। স্থানীয় ভাষারীতির সাথে আমার যোগাযোগ তখনও হয় নি। আশেপাশের জনবসতি থেকে শহরেই থিতু হওয়া মানুষেরা হাটবারে শহরের জন্যে তুলে রাখা বুলি ভুলে তুই-মুইয়ের ঘরোয়া ভাষায় কথা বলতো। গ্রামের মানুষদেরও শহরের লোকজনের সাথে যোগাযোগের জন্যে এক ধরণের তুলে রাখা ভাষা ছিলো। তারা সম্ভবত আপনি শব্দটাতে অভ্যস্ত ছিলো না, কিংবা আপনির আরোপিত আনুগত্য না মেনে, তুই এর অন্তরঙ্গতা ভুলে, তুমির দুরত্বের দেয়াল তুলে রাখতো।
সকালে বাজারের ময়লা টুকরিতে ভরে ফিরে যাওয়ার আগে ফুলভানু হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলতো এক কাপ চা দিবি, আমি মগ লিয়ে আসছি। ফুলভানু মাথায় মোটা করে সিঁদুর দিতো আর বড় একটা লালটিপ। কখনও বাসায় এসে ছোটো নানীকে বলতো এক কাপ চা খাওয়া বুবু। ফুলভানু আয়েশ করে চা খেতো তার এলমুনিয়ামের কাপে আর গা দুলিয়ে হাসতো। তার মেয়ে ফুলিয়া দুই বেনু ঝুলিয়ে তার পাশে বসে থাকতো কখনও কখনও। তারা মেথরপট্টিতে থাকতো, তাদের বসতির সামনেই কাদাতে গড়াগড়ি দিতো পোষা শুয়োর। সন্ধ্যারাতে দেশী মদ খেয়ে তারা হল্লা করতো। দিনের আলোতে ফুলবানু আলাদা মগে চায়ের চুমুক দিলেও সন্ধ্যারাতে ফুলবানুর সাথে একই মগে তাড়ি খেতে বাধতো না বাবুদের।
দেশী মদের আড্ডায় কিংবা সস্তা চায়ের দোকানে প্রকট শ্রেণীবৈষম্য নেই। চলতি পথে ফেরীয়ালার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শ্রমজীবী মানুষের টুকরো টুকরো ভাবনার সুতার বুননে আমার পরিচিত গন্ডীর বাইরের বাংলাদেশের অস্পষ্ট কোলাজ তৈরী হতো। অনেক দিন পর বাজারে চায়ের দোকানে বসে বুঝলাম শ্রমজীবী মানুষের পারস্পরিক হৃদ্যতা, সম্বোধন কিংবা সম্ভাষণ খুব বেশী বদলায় নি, শুধু আমার পোশাকে আর মুখোশে পরিবর্তন এসেছে। সেখানে টুকরো টুকরো সংলাপে যে বাংলাদেশের কোলাজ তৈরী হচ্ছে সে বাংলাদেশে আমি নেই, আমরা একই সার্বভৌম ভূখন্ডে পরস্পর বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশে বেঁচে আছি।
মন্তব্য করুন