একটি কাল্পনিক প্রেমের গল্প
১.
কানে তালা লেগে যাচ্ছে।বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হচ্ছে একেকটা বোমা।কানে হাত দিয়ে বসে আছে আট-দশটা প্রাণী।এরা সবাই কথা বলতে জানে।চলতে জানে।এরা মানুষ।তারপরও ঘটনার আকস্মিকতায় তারা এখন নির্বোধ।এখানে বসে থাকলে প্রাণে বাঁচবে! নাকী বের হলে রক্ষা পাবে জানেনা।শুধু জানে এটুকু সময় চলে গেলে হয়তো বাকী জীবনটা এমন ঘাপটি মেরে থাকতে হবেনা।বাঁচার আকুলতায় মানুষগুলোর চোখ ছলছল করছে।
২,
এই তো কিছুদিন আগে।
শিন্তাল্যান্ড স্বাভাবিক ছিল সবকিছু।শান্তাল্যান্ড নয়। শিন্তাল্যান্ড। এই পৃথিবীর কোন একটি কোণায় অবস্থিত এই দেশটি।এশিয়ার মধ্যাঞ্চলে।এখানকার অধিবাসী বাংলা কথা বলে।পোশাক-আচার-আচরণে আছে ইন্ডো-বাংলা ধাঁচ।শিন্তাল্যান্ডের সীমান্তজুড়ে ছয়টা বড় বড় পাহাড়। পাহাড়ের এপাশে চাষীরা জুম চাষ করে।কেউ কেউ আনারসের বাগান করে।কেউ কেউ বেছে নেয় কমলার চাষ।আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে এদেশের মানুষ।সর্ব সাকুল্যে জনসংখ্যা হবে আট হাজারের মতো।সকলে মধ্যবিত্ত।কোন গরীব নেই আবার কোন প্রাসাদওয়ালাও নেই।তারমানে এই নয় যে জোর করে তাদের উপর চাপানো হয়েছে মধ্যবিত্ততা।তারা নিজেরাই এভাবে থাকতে ভালোবাসে।দেশটির প্রধান তাকে এরা বলে প্রেসিডেন্ট। রাজা নয়। এদেশে রাজতন্ত্র নয়, চলে গণতন্ত্র। প্রতি চারবছর পর পর এদেশে জন-পোল হয়।ভোট নয়।জন-পোল। এরা এটাই বলে।একটি কাগজে নাম লেখা থাকে প্রার্থীদের।যে যা আঙুলের ছাপ দেয় সেই নামের উপর।
দেশটিতে তথ্য-প্রযুক্তির চর্চা আছে বেশ জোরেশোরে।জনসংখ্যা কম হওয়াতে সবার হাতের ছাপ নিয়ে রেকর্ড করা আছে নিজেদের কাছে।কোন শিশু জন্মানোর সাথে সাথে তার আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। আর রেকর্ড নীরিক্ষা করা হয় নির্দিষ্ট সময পরপর।এদেশটিতে কোন সামরিক বাহিনী নেই। তবে আছে শৃঙ্খলা বাহিনী।তাদের কেউ কখনো দেশটির ইতিহাসে অভিযানে যেতে দেখছে কিনা কে জানে! এমনকি অনেকের পরিবারের লোকই হয়তো জানেনা তাদের ভাইটি বা স্বামী কিম্বা বাবা সামরিক বাহিনীর সদস্য। প্রয়োজন ছিলনা বলেই হয়তো তাদের মাঠে নামতে হয়নি।কেনই বা হবে।আড়াইশো বছরের দেশটির ইতিহাসে কেউ কোন বিক্ষোভ দেখেনি। কোন আক্রমণের তোপে পড়েনি।পাহাড়গুলো বাঁচিয়ে রেখেছে দেশটিকে বুকে আগলে।প্রতিবছর দেশটি থেকে কয়েকজন বাইরে পড়তে যায়। পাশ্চাত্য থেকে পরে ফিরে আসে ঠিকই এই দেশে।নিবিষ্ট মনে কাজ করে দেশটির উন্নয়নের জন্য।শিন্তাল্যান্ডে গ্যাস আছে, তেল আছে, পাহাড়ি নদী আছে, যেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
খুব কম বিদ্যুতেই তাদের চলে যায়। কারণ পৃথিবীর সর্বত্র গাড়ি-বাড়ি-এসি চললেও এরা তা এড়িয়ে চলে। এমনকি দেশের বাইরে থেকে যারা পড়ে আসে তারাও।এতো বাতাস, এতো নির্মল পরিবেশ, কোন অসভ্য যান্ত্রিকতা দিয়ে এই সভ্যতাকে নষ্ট করার পক্ষপাতি তারা নয়।বরং এদেশের মানুষগুলো ভাবে কিভাবে আরো উন্নত জাতির ফসল বোনা যায়, নতুন প্রজাতির কমলা বা নতুন জাতের মাছের চাষ করা যায়।বাইরের মাত্র কয়েকটি দেশের সাথেই তাদের সম্পর্ক আছে।যে সব দেশে এদেশ থেকে পড়তে যায়, আর যেসকল দেশে এদেশের গবেষণা নিয়ে আলোচনা করা হয়, শুধুমাত্র সেই দেশ এই দেশের নাম জানে।কোন ডিপ্লোমেট বা রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দেশটি নিয়ে কোন আলোচনা নেই।এজন্যই হয়তো মানুষগুলোর মতো পশুপাখিগুলোও যেন শান্তিপ্রিয় হয়ে গেছে এই দেশের।বাঘে-মহিষে-হরিণে এক নদীতে জল খাওয়া অবস্থা!
এমনই একটি পরিবেশে বড় হয়েছে শিন্তাল্যান্ডের রোয়েনা।রোয়েনার বয়স এখন উনিশ।খোলা বাতাসে বেড়ে ওঠা রোয়েনা ঠিক সবুজ ঘাসের মতো।কেউ তার উপর কখনো ইট-চাপা বোঝা রাখেনি। তাই তার আচার-আচরণে কোন হলুদ ছাপও পড়েনি।রোয়েনা সবুজ-সতেজ তার সতেরো বছর বয়সী ভাইটির মতোই।রোয়েনার ভাই শিয়ান।বাবা-মায়ের ইচ্ছা পরের বছর শিয়ান কৃষির উপর উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে পড়তে যাবে।তাদের বাবা একজন নামকরা কৃষক।কমলার বিশাল বাগান।সেই বাগানের ভিতরেই তাদের বাড়ি। একতলা উঠোনওয়ালা বাড়ি।এই উঠোনে রোয়েনারা হুড়োহুড়ি করে বড় হয়েছে।রোয়েনারা বলতে তার দুই ফুপি যারা বয়সে তাদের খুব কাছাকাছি, দুই চাচাতো ভাই বোন।রোয়েনাদের পাশের বিরাট জমিতে বাগান করে সেখানে থাকে তার চাচা। তিনিও নামকরা কৃষিগবেষক।রাষ্ট্রপ্রধাণের সাথে রোয়েনাদের চাচা আর বাবার খুব ভালো সম্পর্ক।প্রায়ই তাদের দাওয়াত থাকে রাষ্ট্রপ্রধানের আবাসস্থল, রয়্যাল ফার্ম হাউজ অব শিন্তাল্যান্ড-এ।আরো আছে রোয়েনার অনেকগুলো বন্ধুবান্ধব।শিন্তাল্যান্ড ছিমছাম এই পরিবেশ নিসন্দেহে যেকোন দেশের জন্য ঈর্ষার..অবশ্য কেউ যদি তা জানতে..পারে তবেই..
৩.
রোয়েনা বাবাকে নিয়ে ভোরে হাঁটতে যায় তাদের বাগানের পিছনে।পিছন দিকটাতে বেশ ঘন জঙ্গল।কিছুদূর জঙ্গল পার হলেই সীমান্তের পাহাড়টা চোখে পারে। কিছুটা অংশ ঢালু পাহাড়টার।ঢালু অংশটায় চাষ করা হয়ে থাকে। তারপর খাড়া উঠে গেছে ঠিক আকাশের দিকে।রোয়নারা পাহাড়টা যতদূর দেখা যায় ততদূর হেঁটে আসে। যেখানে পৌঁছালে পাহাড়টা চোখে পড়ে সেখানটার বাইরে কখনো তারা যায়না। রোজ ভরে রোয়েনারা দেখে তাদের পাশ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে চাষীরা যাচ্ছে পাহাড়ে চাষ করতে।বেশিরভাগ চাষীই রোয়েনার বাবাকে দেখে মাথায় হাত ঠেকিয়ে লম্বা শুভেচ্ছা ঠুকে যায়। রোয়েনার বাবা মাথা নেড়ে সবাইকে সাড়া দেন। রোয়েনার বাবা সেই সময়টা ব্যস্ত থাকে মেয়ের সাথে আলাপে।কোন গাছের চাষ কিভাবে ভালো করা যায়, সেটা নিয়ে গবেষণা চলে তাদের মাঝে।রোয়েনার বাবা মাঝে মাঝে অবাক হয় যখন রোয়েনা নিত্য নতুন বুদ্ধি বের করে চেরি বা টমেটোর অধিক ফলনের উপর।লাল পেয়ারা চাষের সময় রোয়েনার "বেড" বুদ্ধি অনেক কাজে লেগেছিলো তার বাবা। দুই প্রজাতির গোলাপ-এর ক্রসে হলদে সবুজ গোলাপ উৎপাদনেও রোয়েনা অনেক সহায়তা করেছে। এই গোলাপ চাষের কারণে রোয়েনার বাবাকে সম্মানিত করেছে রাষ্ট্রপ্রধাণ।
রোয়েনা অবাক হয়ে দেখছে বাবার মনটা ঠিক আলোচনায় নেই আজ।আজ বললে ভুল হবে। বাবা বারিদ চৌধুরী একটু অন্যমনষ্ক বেশ কিছু দিন ধরেই।বিশেষ করে পাশের দেশে একটি কৃষি কনফারেন্স করে আসার পর থেকে। পাশের দেশ "মায়"-তে কখনো এর আগে কেউ যায়নি এদেশের।পাশ্চাত্যে গেছে।এবার গিয়ে কেমন যেন খটকা লেগেছে বারিদ চৌধুরীর।খটকা লেগেছিল আমন্ত্রণের ফোন পেয়েই।এদেশে মোবাইলের ব্যবস্থা আছে।তবে হাতে হাতে নয়। মোবাইল থাকে এদেশের পরিবারের প্রধান ব্যক্তি এবং গৃহকর্ত্রীর কাছে।শুধু মাত্র প্রয়োজনীয় যোগাযোগ রাখার জন্য।আর দেশটি এতোই ছোট যে সবার হাতে মোবাইল রাখার দরকারই নেই। চাইলে একঘন্টায় তো চলেই যাওয়া যায় দেশের এমাথা থেকে ওমাথা। খামাখা বিদ্যুৎ খরচ করে কি লাভ!
কনফারেন্সে যাওয়ার ফোনটা আসে বেশ রাতে। শিন্তাল্যান্ডে সবাই তাকে চিনে ছোট চৌধুরী নামে।কিন্তু এর বাইরে সবাই তাকে নামেই চিনে।ফোনে তাকে সম্বোধন করা হয় "ছোট চৌধুরী"। একটা ছোট্ট ধাক্কা খায় সে বটে। কিন্তু ধরে নেয়, নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়ে ফোন করেছে। কিন্তু কনফারেন্স-এ যাওয়ার পর দেখে ঐ দেশের সরকারের এদেশ সম্বন্ধে ভালোই আগ্রহ আছে।খোঁজও জানে।এমন খবরও জানে যা পাহাড়ের ওপাড়ে যাওয়ার কথা না।গেলো কি করে সেটা একটা প্রশ্ন! আরেকটি প্রশ্ন হলো, তার আলাচোনার বিষয় ছিল "উন্নত কৃষি এবং শিন্তাল্যান্ড"।যেখানে তারা দুই ভাই মিলে বিজ্ঞান এবং হাতে কলমে কৃষির উন্নয়ন নিয়ে বেশ আলাপ করেছে।বেশি গভীরে না গেলেও শ্রোতার আগ্রহ ছিল আরো বেশি।খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চেয়েছে অনেক কিছু।আর কেমন যেন একট অস্বস্তিকর জ্বলজ্বলভাব দেখেছে ওদেশের শ্রোতাদের চোখে বারিদ চৌধুরী। বড়ভাই জলদ চৌধুরীও। অস্বস্তিটা তাদের দুজনের মাঝেই।কিন্তু কেউ কাউকে বলেনি।
রোয়েনা একটু আঁচ পাচ্ছে সেই অস্বস্তির।পুরোটা নয়।বাবা গল্প করছে আনারসের।কিন্তু তার মনোযোগটা সেদিকে নেই।রোয়েনা অবাক হয়ে দেখলো বাবা তাদের হাঁটার সীমানা পার হয়ে যাওযার পরও আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রোয়েনা কৌতুহলটা চেপে রাখতে পারেনা।
"বাবা, আরো দূরে যাবে?”
“চল, আজ পাহাড় পর্যন্ত ঘুরে আসি..”- বাবার দৃষ্টি সামনে। কেমন যেন নিরত্তাপ গলায় বললো কথাটা।
পাহাড়ের ঠিক নীচে চলে আসে তারা। সূর্যের তাপ বাড়ছে।আকাশের পূব কোণায় কালো মেঘ।রোয়েনা ঐদিকে তাকিয়ে বলে,
“ বাবা দেখো, আজ বৃষ্টি হবে।আবার ময়ুরগুলো নাচবে"..
বাবার কাছ থেকে কোন উত্তর পায়না রোয়েনা।অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, বাবা তাকিয়ে আছে অন্য দিকে।দৃষ্টি সরু। বাবা পাহাড়ের গায়ে যেন চোখ দিয়ে এক্সরে করছে। রোয়েনা ক্ষাণিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। দুই/তিন মিনিট পর বাবার চেতনা যেন ফিরে এলো।বলে,
“হুমম, ময়ুর! কেনো ময়ুর আসবে!”
বাবার এমন প্রশ্নে রোয়েনা আরেকটু অবাক হয়। এরমানে বাবা লক্ষ্যই করেনি সে কি বললো!..অবাক কণ্ঠে রোয়েনা বলে, "বাবা মেঘ.. ঐযে..”
বাবা পাহাড়ের দিকে চোখ রাখতে রাখতেই পূব দিকে ফিরে..তাকিয়ে দেখে মেঘ।বাবা রায়েনার হাতে সামান্য ঝাকি দিয়ে বলে,
“চল ফিরি..না হলে ঝামেলায় পড়ে যাবো..”
দ্রুত গতিতে ফিরে এলো তারা বাড়িতে।বাবা হাঁটছে অনেক জোড়ে।রোয়েনা হিমশিম খাচ্ছে তাল মিলাতে..
রোয়েনা দেখে বাবা শূণ্য দৃষ্টিতে এগুচ্ছে..আসলে লক্ষ্য করছেনা কিছুই..
৪.
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক্ষণ। রোয়েনা আর তার দুই ফুপি, এরিনা আর জুডিনা বেশ করে ভিজলো। শিয়ান ফিরলো ভিজতে ভিজতে।তার স্কলারশিপ হয়ে গেছে।খুশিতে সে ডগমগ।ইন্টারনেটে বসে পড়লো স্কলারশিপ দেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জানতে।
তখনও তারা উঠোনে, রোয়েনা, এরিনা এবং জুডিনা।বাবা তৈরি হয়ে কোথায় যেনো যাচ্ছে।এরিনা বলে ওঠে, দাদা কই যাও!
বাবা গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, বড়-দার বাসায়...
বলে হাঁটা শুরু করে...সেদিকে তাকিয়ে এরিনা বলে, "রো, দাদার কি হয়েছে? এতো গম্ভীর!”
"জানিনা ফুপটু, সকালেও এমন ছিল..হাঁটার সময়। মনে হয় পাহাড়ে নতুন কিছু চাষের কথা ভাবছে..”
এরিনা আর জুডিনা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ায়। আবার তারা মগ্ন হয় খেলায়-হুড়োহুড়িতে। শুধু একবার রোয়েনা তাকায় বাবার দিকে।বাবা যত দূরে যাচ্ছে ততই ক্রমশ পিঠ শক্ত হচ্ছে..
৫.
জলদ চৌধুরী যেন অপেক্ষায় ছিলেন ছোট ভাইয়ের।ছোট ভাই আসতেই উঠোনে পেতে রাখা চেয়ারে বসতে বললো।
মিনিট ক্ষাণেকের নীরবতা।নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলে উঠলো বড় ভাই
“যা আশঙ্কা করছি, তা নিয়ে শৃংখলা বাহিনীর সাথে আলাপ করতে চাও!”
“কিন্তু দাদা, আমরা তো কেউ ধরতে পারছি না আসল বিষয়টা। শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করে কি এতোদূর যাওয়া ঠিক হবে!”
“আমি ভাবছি অন্য কথা!”- কন্ঠস্বরে উদ্বেগ ঝরে পড়ে "আমরাই কি পথটা করে দিয়ে এলাম?”
ছোটভাই সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলে ওঠে,
“ না দাদা..তা কেনো হবে! আমাদের তো কোন কিছু করার নেই!..তবে..” থেমে যায় বারিদ চৌধুরী। জলদ চৌধুরী তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বারিদ আবার বলে,
“একটু খেয়াল রাখতে হবে। আমি আজ গিয়েছিলাম পাহাড়ের নীচে। কিছু চোখে পড়েনি..”
বড়ভাই যেন সামান্য আশ্বস্ত হলো।বলে
“দেখো আমরা গোটা জাতি শান্তি প্রিয়। শান্তি বাদে কিছু দেখিনি। সত্য। কিন্তু দেখতে হলে সেটার প্রতিকার নিয়েও ভাবতে হবে।সামনের কয়েকটা দিন খুব ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে।চারদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।তারপর হয়তো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।"
“ আশা করছি দাদা তেমন কিছু হবেনা।তবে কেন যেন মনে হচ্ছে প্রেসিডেন্টকে জানালে মন্দ হয়না।তুমি কি সত্যি যেতে চাও!”
“তাহলে এই সপ্তাহটা দেখি। তারপর না হয় পুরো বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবো।"
উঠোন থেকেই উঠে যায় বারিদ।বড় ভাই পিছন দিক থেকে বলে..
“চা খেয়ে যা!”
“ না দাদা, আমি একটু পাহাড়ের কৃষকদের সাথে কথা বলবো।"- বলে বারিদ চৌধুরী হেসে রওনা দেয়।
জলদ চৌধুরী হেসে বিদায় দিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়ে আবার।হয়তো সব আশঙ্কাই মিছে তারপরও এটা চাপা উত্তেজনা এসে দরজায় কড়া নাড়ছে।সবচেয়ে বেশি তাকে কষ্ট দিচ্ছে কনফারেন্স-এর বিষয়টি।এমন যেন না হয়, তাদের দেয়া তথ্যই তাদের অশান্তির কারণ হয়ে উঠলো..
উফফ- ঠিক এমন ভাবনাটিই বারিদ চৌধুরীর মাথায় এলো।আপন মনে মাথা নাড়লো। বারিদ চৌধুরী যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে।কয়েকজনের সাথে আলাপ সেড়ে আসতে হবে।দূরের পাহাড়টিকে দেখে দানব মনে হচ্ছে। সূর্যের আলোয় যতটা শ্যামল.. আঁধারে ততটাই গা ছমছমে পাহাড়গুলো। কে বলবে পাহাড়ের এপাড়ে কত নিষ্পাপ একটি ভূখন্ড..আর ওপাশে এই ভূখন্ডের রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত কিছু মানুষ।
গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো তার।প্রেসিডেন্ট-এর সাথে কথা বলতে যেতে চায়না বারিদ চৌধুরী।কিন্তু বলতে হলে কি বলবে তাই ভাবছে।আকাশটা পরিষ্কার। হাটতে হাটতে আকাশের দিকে তাকিয়েই ভাবছে বারিদ চৌধুরী।পরিষ্কার আকাশের যেখানে মেঘ- সেটা লালচে হয়ে আছে। আকাশভর্তি তারা।বাতির মতো জ্বলজ্বল করছে। কি অদ্ভুদ এই আকাশ।আর তার নীচের পৃথিবী।একটা তারা কি খসে পড়লো! প্রাথর্না শুরু করলো বারিদ চৌধুরী।চোখ বন্ধ করে দেশের শান্তি কামনা করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল।চোখ খুলে।তারাটাকে খোঁজা শুরু করে বারিদ চৌধুরী।তারাটা পড়ে পাহাড়ের উপর, পাহাড় থেকে একটু নীচে সাদা সরল রেখা দেখা গেল, ধপ করে নিভে গেল পড়ে।বারিদ চৌধুরী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।ওটা আসলে তারা ছিলনা।ছিল কোন একটা সিগনাল..
৬.
ঘরে ফিরে বারিদ চৌধুরী গম্ভীরমুখে বসে আছে।কি করবে বুঝতে পারছেনা।কাকে অবিশ্বাস করবে বারিদ চৌধুরী। পাহাড়ের লোকগুলো একেকটি শিশুর মতো। কাস্তে তাদের খেলনা..ফসল গুলো আদরের বিছানা। কি করে কি হবে জানিনা।ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিদেশী বন্ধুদের জানাবে কিনা ভাবছে।কিন্তু পুরোটা ঘটনাই কল্পনার হলে লজ্জার সীমা থাকবেনা।
শিয়ান খুব খুশি।তার বিশ্ববিদ্যালয় ছবির মতো সুন্দর।পাহাড়ে ঘেড়া এই দেশের ছেলে সমুদ্র দেখবে ভাবতেই চোখ ভিজে যাচ্ছে তার।রোয়েনা মা'র কাছে আব্দার করে যাচ্ছে যেন শিয়ানকে পৌছে দিতে এ যেতে পারে।মা কিছুতেই রাজি না।বাবা ডাকে শিয়ানকে।
“যেতে হবে কবে?”
“এই তো-এ সপ্তাহ পরেই"..
“রোয়েনাকে নিয়ে যেও..”
শিয়ান খুশিতে তালি দিয়ে ওঠে।তার দুটো চাচাতো ভাইবোন হঠাৎ করেই বিদেশ চলে গেছে আজ।তারা দুই ভাইবোনও যাবে। একদিন ওখানে সবাই মিলে পিকনিক হবে।ভাবতেই মজা লাগছে তার।রোয়েনাও হুড়ড়ে বলে ঘরে ঢুকে যায়।অবাক হয় মা।
কাছে এসে স্বামীর কাছে জানতে চায়,
“কি হয়েছে বলোতো!”
“কি হবে"
“তুমিতো ঐরকম সভ্যতার আঁচ লাগতে দিতে চাওনা ওদের মাঝে, তাহলে এখন"
“বেড়াতে পাঠাচ্ছি নওরেজা, থাকতে নয়..”
“বলবেনা সেটা বলো..”- কথা শেষ করে নওরেজা গাল ফুলিয়ে চলে যায়..
বারিদ চৌধুরী জানালা দিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকায়। এই প্রথম, তার জীবনে, সন্তানদের এই দেশ থেকে সে দূরে রাখতে চাইছে।..কেনো জানেনা। কিন্তু একটা ভয় কাজ করছে। নাহ প্রসিডেন্টের সাথে আলাপ সাড়তেই হবে...ভেবে উঠে পরে বারিদ চেয়ার থেকে। ভাবলো, তার আগে আলোর বিষয়টা নিয়ে দাদার সাথে আলাপ করা জরুরী..আর তারও আগে..
শার্টটা বদলে বের হয়ে গেল রাতের অন্ধকারেই।
৭.
শিন্তাল্যান্ডে কোন কিছুর কমতি নেই। সব আছে পরিমাণ মতো। এই প্রথম, রাতে হঠাৎ করে ইন্টারনেটের লাইন কেটে গেল।শিয়ান তখন মেইল পাঠাচ্ছে এর বন্ধুদের।জানাচ্ছে কবে যাবে।এমন সময় লাইন কেটে যায়।
রোয়েনা হাটছিল আর মায়ের মোবাইল থেকে বাবাকে ফোন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাবা হঠাৎ করে কোথায় গেল কে জানে।চাচার বাসায় শিয়ান ঘুরে এসেছে সেখানে বাবা নেই।পাহাড়ে গেল কি! এই রাতে পাহাড়ে যাবে কেনো! বাসায় এসেছে রোয়েনার মামাতো জমজ বোন আর মামি। জমজ বোন দুটো দেখতে এক রকম।নামও একরকম।রূপু আর রুশু। একজনকে ডাকলে আরেকজন উত্তর দেয়। রোয়েনার পিছু পিছু ওরা দুজন হাটতে থাকে।বারো বছরে দুষ্টুমি করে চার বছরের বাচ্চাদের মতো।হঠাৎ রোয়েনা লক্ষ্য করলো, মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই।ঘরের ভিতরটা রোয়েনা যেখানে দাঁড়ানো সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।মামি আর মা বসে গল্প করছে। এপাশের ঘরে শিয়ান তার কম্পিউটারে এখন নেট না পেয়ে হতাশ হয়ে খেলছে গেম।আকাশটা পরিষ্কার।রোয়েনা আকাশের দিকে তাকায়। ওপাশের কালো পাহাড়টা থেকে কেমন যেন একটা আলো ঠিকরে পরছে।দ্রুত আলোটা বাড়তে থাকে।রোয়েনার চোখ বুজে আসে আলোর তীব্রতায়।চোখ বন্ধ করে রোয়েনা।সুক্ষ্ম একটি আওয়াজে কানে তালা লাগার যোগার...রূপু-রুশু হা করে তাকিয়ে আছে ওদিকে।শিয়ান ঘরে বসে দেখলো এরা তিনজন কেমন যেন একটি অস্বাভাবিক আচরণ করছে।শিয়ান ঘর থেকে বের হয়ে আসে।হঠাৎ আকাশটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে আলোটা মাথার এপর দিয়ে এসে পরে দেশটির আরেক দিকে।বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় আলো জ্বলা বোমাটি। রোয়েনার চোখ গলে পানি পড়ছে..রূপু রুশু ভয়ে চিৎকার দিল। মামি দৌড়ে এলো উঠোনে।আর মা? মা প্রথমে গেলেন বাবার ঘরে।ঘর খালি দেখে ছুটে এলেন শিয়ানের কাছে..বললেন শুধু..
“তোর বাবাকে নিয়ে আয়..”
তার কথা হাড়িয়ে গেল বোম আর বুলেটের আওয়াজে।চারপাশের চিৎকার ছাপিয়ে গেল সব কিছুতে।রোয়েনা সবাইকে টেনে নিয়ে এলো একটি ঘরে।ভয়ে বসে পড়ে মাটিতে। কানে যেন তালা লেগে যাচ্ছে।এরা প্রত্যেকেই মানুষ..কিন্তু কারো নড়াচড়ার শক্তি নেই। জানেনা এখানে নিথর হয়ে লুকিয়ে থাকলে বাঁচবে নাকি কোনমতে পাহাড়ে লুকাতে পারলে প্রাণে রক্ষা পাবে।..ধপ করে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল...প্রথমে ইন্টারনেট, তারপর ফোন ..এবার বিচ্ছিন্ন হলো বিদ্যুৎ..গোটা দেশ এখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন।..রোয়েনা থরথর করে কাঁপছে...ভাবছে বাবা কোথায়!
৮.
বুটের আওয়াজ উঠোনটায়।রোয়েনারা সবাই জড়শর হয়ে একরুমে।তাদের মোটামুটি বড় খামারবাড়িটির প্রতিটি ঘরের দরজায় লাথি মারছে।ধাম ধাম করে।প্রতিটি লাথির আওয়াজে কেঁপে উঠছে রূপু আর রুশু।দরজা খুলতেই অযথাই ব্রাশ ফায়ার করছে..গুলির শব্দে কানে তালা লেগে গেল। সবাই তারা শব্দ প্রতিবন্ধী।কিছু শুনতে পারছেনা।শিয়ান কি যেন বললো..ঠোঁট নাড়াটা বুঝলো..কিন্তু কথা কানে গেলনা কারো।হঠাৎ মা উঠে দাঁড়ালেন। মামিকে হ্যাচকা টেনে উঠালেন।বের হলেন ঘর থেকে..দরজাটা ফাঁক...রোয়েনা দেখতে পাচ্ছে..উঠোনভর্তি আর্মি।কোন দেশের কে জানে! মা গিয়ে কিছু বোঝাচ্ছে...একজন আর্মি অফিসার এসে ঠাস করে চড় লাগায় মা'র গালে..রোয়েনা মাত্র শিয়ানের হাত ধরতে যাবে..তার আগেই শিয়ান লাফ দিয়ে ওঠে..দৌড়ে বের হয় ঘর থেকে..কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিয়ানের দিকে তাক করে বন্দুক..অন্তত পাঁচজন।কয়েক হাজার বুলেটে বিদ্ধ শিয়ান লুটিয়ে পরে মাটিতে...ঘরে আরো মানুষ আছে বুঝতে পেরে সেই ঘরে ঢুকে দুজন অফিসার..মাকে টেনে একজন নিয়ে যায় বাবার ঘরে..মামিকে নিয়ে যায় শিয়ানের ঘরে..রোয়েনার মাথা পুরো খালি..কিছু বুঝতে পারছেনা..চোখের সামনে তার মামাতো বোনদের উপর ঝাপিয়ে পরে দুজন ষন্ডা অফিসার..রোয়েনা অজান্তে চলে যায় পর্দার আড়ালে.. একসাথে চার চারটি মানুষের চিৎকারে বারিদ চৌধুরীর বাসা কেঁপে কেঁপে ওঠে...চিৎকার শেষ..এরপর বুলেট..মামাতো বোন গুলোর উপর যখন গুলি চালানো হচ্ছে তখন ঘরে আসে আরেক অফিসার..এসেই পর্দার আড়ালে রোয়েনাকে দেখতে পায়।রোয়েনা তাকিয়ে আছে লাশের দিকে।ঐ দুজন অফিসার রোয়েনার হাত ধরে টেনে বের করে..অফিসারের দিকে ঠেলে বলে..
“এটা আপনার ক্যাপ্টেন..”
অফিসারের বুকে ধাক্কা লাগে রোয়েনার।রোয়েনা ছলছল চোখে তাকায় অফিসারের দিকে। অফিসার চমকে ওঠে হঠাৎ।বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ এ বাড়ি আমার পছন্দ হয়েছে। এই মেয়েকেও। এটা আমার। তোমরা এক ঘন্টার মধ্যে বাড়ি পরিষ্কার করে চলে যাবে।"
রোয়েনাকে টেনে আনা হলো উঠোনে।ক্যাপ্টেন তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।রোয়েনার চোখের সামনে পাঁচ পাঁচটি লাশ পুতে দেয়া হলো মাটিতে।উঠোনের বাইরে।যেখানে ময়ুর আসতো।তারপর যতটুকু সম্ভব বাড়িটিকে সৈনিকরা গুছিয়ে দিল।
বাইরে থেকে বাড়ির ভিতর এলো আরো কয়েকজন অফিসার।
ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে
“এটা তো ভালই..।"
“স্যার দাসী করে রাখবো ভাবছি..”
“হা হা" বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলে, “দেশের কোথায় কোন যুবক বেঁচে নেই..আছে কেবল দাসী.”.."তো বাসাটাকি তুমি নিচ্ছ!”
"স্যার যদি অনুমতি দেন"
“অনুমতি, ভালো বলেছো। তোমার পরিকল্পনায় আজ আমরা এখানে..যাও যাও মৌজ করো..”
রোয়েনার কনুই ধরা ক্যাপ্টেন।রোয়েনা শুধু ঘুরে একবার তাকায় ক্যাপ্টেনের দিকে..এই লোকটির পরিকল্পনায় তার দেশের এই অবস্থা..। ক্যাপ্টেনের মুখের হাসি মিলিয়ে যায় রোয়েনার দিকে তাকিয়ে..বাকিরা চলে যায়। উঠোনে শুধু ক্যাপ্টেন, রোয়েনা আর কিছু মৃত মানব শরীর এপাশে ওপাশে..
শিন্তাল্যান্ড পরাধীন।আর শিন্তাল্যান্ডের জীবিত মানুষগুলো এখন দাস..
৯.
রোয়েনার হাতবাধা।খাটের এক কোণায় তাকে ফেলে রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন অন্যান্য ঘরে জিনিষপত্র উলটেপাল্টে দেখছে। বিশেষ করে বাবার বই আর চাষের তথ্য লেখা খাতাগুলো।ততক্ষণে ইন্টারনেট চলে এসেছে।মনে হয় ফোনও চালু হয়েছে। ক্যাপ্টেন যেন কার সাথে আলাপ করছে শুনেছে রোয়েনা।এরমাঝে যতবারই রোয়েনার কাছাকাছি ক্যাপ্টেন এসেছে ততবারই সে কেঁপে উঠেছে।ক্যাপ্টেন ওর দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে চলে গেছে।দুপুরে খেতে দিয়েছে। কিসব শুকনো রুটি। একবার ভাবছিল বলে, হাত খুলে দিক রোয়েনা নিজেই রান্না করবে।কিন্তু একটা খুনিকে সে খাওয়াবে! ভাবতেই গা ঘুলিয়ে উঠেছে তার।
দুইদিন এইভাবেই গেল।শুকনো রুটি, হাত বাধা।না পেরে রোয়েনা ডাকলো।
“এই যে ক্যাপ্টেন, আপনি তো আমাদের ভাষাই বলেন..”
ক্যাপ্টেন মাত্র গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি তথ্য ফোনে দিয়েছে..দুই দিন পর নারীকণ্ঠ শুনে একটু চমকে ওঠে।তার ধারনা ছিল মেয়েটি বোবা হয়ে গেছে। তাই কথা বলতে দেখে একটু ভড়কে গেল বৈকি!
“এই যে শুনুন, আমার নাম রোয়েনা, আমার হাতটা খুলে দেন"
“কেনো?”
রোয়েনা রীতিমতো বিরক্ত হলো যেন,
“কেনো মানে? আমি গোসল করবো..রান্না করবো..দস্যুর মতো ঘরে ঢুকে বসেছেন আপনার মানুষ মারা ছাড়া কি পারেন? রাধতেও পারেননা..”
ক্যাপ্টেনের কেন যেন হাসি চলে এলো।কিন্তু সেটা চেপে গেলো। যে মানুষটা এতো বড় শক পেয়েছে দুইদিন আগে তার সাথে বাজাবাজি না করাই ভালো। সে সৈনিক হতে পারে কিন্তু হাজার হোক মানুষ তো!
রোয়েনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিন্তু তুমি যদি পালিয়ে যাও?”
“ এই দেশটা কতটুকু সেটাতো আপনি জানেন, আপনার পরিকল্পনাতেই হামলা তাইনা! পালিয়ে যাবো কোথায়? আপনি চাইলে পায় রশি দিতে পারেন..”
খোঁচাটা নীরবে হজম করলো ক্যাপ্টেন।বাগান থেকে একটা বড় শিকল এনে কাছে এলো রোয়েনার।রোয়েনার বুকটা দূরু দূরু করছে। ক্যাপ্টেন ওর হাতের বাধঁন খুলে দেয়। পায়ে শিকল পরায়। আরেক দিকটা খাটের এক পায়ের সাথে বেধে দেয়।রোয়েনার মুখের খুব কাছে মুখ আনে। রোয়েনার চোখে পানি চলে আসে প্রায়।কানে ঠোঁট আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলে, "আমার নাম হামদান। ক্যাপ্টেন না।"
বলে উঠে চলে যায়। রোয়েনার চেপে রাখা শ্বাসটা বের হয়ে আসে।হামদান পিছু ফিরে তাকিয়ে সেটা বুঝে হেসে ওঠে। রোয়েনার ঠোটের কোণায় হাসি ফুটে ওঠে।
ঘরের সাথেই গোসলখানা বলে গোসল করতে সমস্যা হলোনা।কিন্তু রান্নাঘরটা তো দূরে।রোয়েনা কিছতেই সেখানে যেতে পারছেনা।হামদান একটু দূরে।রোয়েনা হাক দেয়..
“হামদান, আমি রান্নাঘরে যাবো..”
হামদান অবাক হয়ে তাকায়। রোয়েনাকে দেখে একটু চমকে ওঠে। গায়ে পানি পরার পর মেয়েটি যেন আরেকবার বেঁচে উঠেছে।এতো সুন্দর! সেদিন রাতে ঐ অফিসারগুলো লক্ষ্য করলে তো একে বাঁচানো যেতো না।
রোয়েনা আবার চিৎকার দেয়..
“আজ আমি আপনার ঐ শক্ত রুটি খেতে পারবোনা।হয় সবার মতো মেরে ফেলেন ..না হলে রান্না করে খেতে দেন..”
হামদানের মুখটা কালো হয়। তার কাজের একটা অংশই তো এটা।এখানে তার কি দোষ। এক দেশে সে হামলাকারী।আর নিজের দেশের বীর।
মুখ কালো করে হামদান আসে রোয়েনার কাছে। খাটের শেকল খুলে নিজের হাতে বাধেঁ।রোয়েনা সেই অবস্থাতে রান্না করে।হামদান একটু মুখে দিয়ে এবার সত্যিসত্যি অবাক হলো। একদম অন্যরতম স্বাদের সবজি।এজন্যই এদেশের দিকে নজর ছিল সবার।কিন্তু দেশের ভিতর থেকে প্রতারণা করার কোন কারণ খুঁজে পেলনা সে।কে করলো কেনো করলো।এমনভাবে যদি শান্তিতে থাকা যায় তাহলে দরকার ছিল লোভের..
১০.
এক সপ্তাহ কেটে গেল রোয়েনার এভাবে।হামদানকে এখন আর সে ভয় পায়না।হয়তো বাকি অফিসারদের মতো নয় হামদান।একটু বা অন্যরকম।রান্না করে।এখন গল্প করে।চাষের, গাছের, পাহাড়, ময়ুরের। হামদান অবাক হয়ে শোনে।কি নিষ্পাপ তাদের জীবন ছিল! তবে রোয়েনা কখনো চাষাবাদ ভালো করার রহস্য বলেনা।এড়িয়ে যায়। হামদান বেশ বুঝে। কিছু বলেনা।
দেশটির প্রেসিডেন্ট বন্দী। রয়্যাল প্যালেসে বন্দী করা হয়েছে দেশের গণ্য-মান্য সকলকে। সব বিজ্ঞানী, গবেষক আর বড় বড় কৃষককে।বেশির ভাগ যুবক এখন একটি জেলের মতো জায়গায় বন্দী বা মৃত।মেয়েদের উপর অত্যাচার হয়েছে। শিশু গুলোকে ধর্মীয় কেন্দ্র আটকে রাখা হচ্ছে। প্রেসিডেন্টকে চাপ দিয়ে চুক্তি করাতে চাইছে হামলাকারী মায় দেশটি।তারা দেশে সব সবজি, ফসল চায় কম দামে।চায় তেল, গ্যাস আর বিদ্যুৎ।আর চায় শিন্তাল্যান্ডকে নিজের অঙ্গরাজ্য করে নিতে।
স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয়ার কারণ নেই।কিন্তু ধীরে ধীরে প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারছে, আর আশার আলো নেই। কে বাঁচাবে! কেউ জানেনা গত সাতদিনে এই দেশটির ভিতরে কি ঘটনা ঘটে গেছে। বিদেশে যারা এখন আছে তারা যদি বুঝতে পারে তাহলে রক্ষা।কিন্তু বুঝবে কি করে! উপায় কি!
এদিকে যাকে বিশ্বাস করেছিল সেই লোক এখন মধ্যস্থতা করে নিজে দেশের ক্ষমতা চাইছে।জলদ চৌধুরী। কৃষিগবেষক।মা তে কনফারেন্সে গিয়ে এই লিয়াজোঁ করে এসেছে।তার ধারণা এদেশ তাকে গবেষণা করার সুযোগ দিচ্ছেনা। মায়-এর সাথে সমঝোতা করলে জলদ চৌধুরী পুরো দেশ জুড়ে গবেষণা করে যুগান্তকারী কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলবে।তখন ছয় পাহাড়ে ঘেড়া এই ছোট্ট শিন্তাল্যান্ড হবে পুরো পৃথিবীর হেড কোয়ার্টার।কৃষি স্বর্গ।
কিন্তু জলদ চৌধুরী জানতো না এর মাশুল তাকে এভাবে দিতে হবে..
১১.
রোয়েনা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।হামদানের সাথে ভাবের বিনিময় হচ্ছে ইথারে ইথারে।এরমাঝেই এক রাতে চরম হতাশায় হামদান মদ খেলো। রোয়েনা আবার কাঁপাকাঁপি শুরু করলো ভয়ে।হামদান ঢুলতে ঢুলতে আসে রোয়েনার কাছে। এখন তারা এক ঘরে থাকে।রোয়েনা খাটে, হামদান মাটিতে।হামদান রোয়েনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।রোয়েনার গালে ঠোঁটদুটে ছোঁয়ায়।তারপর সামনে ঠাস করে পরে যায়। রোয়েনা সেদিকে তাকায়।
খুব সকালে রোয়েনার ঘুম ভাঙে।দেখে সামনে তার দিকে তাকিয়ে হামদান বসা।হামদান হাসে।রোয়েনা বুঝেনা কি হলো। হামদান তার পায়ের শেকল খুলে দেয়।তারপর বের হয়ে যায় ঘর থেকে।রোয়েনা কিছুক্ষণ বাকহীণ তাকিয়ে থাকে।ডাকে..প্রাণপণ,
“হামদান..”
হামদান ঘুরে তাকায়।ফিরে আসে..।রোয়েনা উঠে হামদানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।হামদান ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।রোয়েনা অবাক হয়।ওর ধারণা ছিল হামদান তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।হামদান ঘুরে ঘরের দরজা আটকায়। রোয়েনা হেসে ওঠে..হামদান একে জড়িয়ে ধরে আরো শক্ত করে।
১২.
চারদিকে সামান্য গোলাগুলি শুরু হলো হঠাৎ। হামদান চমকে ওঠে।ঘোর তখনো কাটেনি দুজনের কারো।তারপরও জোর করে উঠে হামদান। ইউনিফর্মটা ঝোলানো। সেটা পরে নিল। বন্দুকটা নিল।দরজা খুলে দেখলো তাদের ব্যাটেলিয়নের একজন দৌড়াচ্ছে। কোনমতে বললো, স্যার পালান, ওরা ফিরে এসেছে..।
হামদান গিয়ে টিভি ছাড়লো, একটি বিদেশী চ্যানেল ধরলো, দেখলো খবরে বলছে, শিন্তাল্যান্ডে সাহায্য নিয়ে ফিরেছে দেশটির পালিয়ে যাওয়া জনগণ।দেশটির পাশে সামরিক সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব শান্তি সংঘ।এই মাত্র খবর পাওয়া গেছে, বিশ্বাস ঘাতক প্রখ্যাত কৃষি গবেষক জলদ চৌধুরীর লাশ পাওয়া গেছে। এবং রয়্যাল হাউজের সবাই এখন মুক্ত।মা-সেনা বাহিনীরা পালিয়ে যাচ্ছে বা প্রাণ হারাচ্ছে জঙ্গী হামলায়..
হামদান কাতর চোখে তাকায় রোয়েনার দিকে।
বলে, রোয়েনা, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে..আমাকে যেতে হবে..
রোয়েনা অস্থির হয়ে উঠে, আমি বলবো তুমি কিছু করো নি।
“রোয়েনা তোমার বাসায় পাঁচটি লাশ..কে শুনবে তোমার কথা? আমি যদি বেঁচে থাকি..ঐ দেশ ছেড়ে চলে আসবো..তুমি অনেক বড় একজন বিজ্ঞানী ..আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে পারবোনা রোয়েনা..”
“আমি একা কি করবো!” রোয়েনার কথায় হামদান দু হাত দিয়ে তার দুই গাল চেপে ধরে।
"আমাদের কাছে সব তথ্য ছিল..তোমার বাবা বেঁচে আছেন।তিনি জানতেন তার ভাই এসব করেছেন..আমার ধারণা তিনি সহায়তা নিয়ে এসেছেন। রোয়েনা.. বাবা ফিরে আসবে। আমিও..আমার হাতে সময় নেই..আমি গেলাম"..
প্রচন্ড গুলির আওয়াজ পাত্তা না দিয়ে হামদান ছুটে বেরিয়ে যেতে লাগলো গেট দিয়ে। হঠাৎ দাঁড়ালো। রোয়েনার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
কয়েক সেকেন্ড।
হামদান লুটিয়ে পড়লো মাটিতে..
রোয়েনা চিৎকার দিয়ে ছুটে যেতে গিয়ে দেখলো হামদানকে গুলি করেছে তার বাব বারিদ চৌধুরী।
রোয়েনার বাকরুদ্ধ..সামনে হামদান পরা মাটিতে..দাঁড়ানো বাবা..জ্ঞান হারায় রোয়েনা..
১৩.
মায় দেশটির অনেক টাকা কিন্তু তাদের কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই।যখন জলদ চৌধুরী কনফারেন্সে যায়, মায়-এর হাই অফিসিয়াল তাকে ডেকে একটি ষড়যন্ত্র করে।জলদ চৌধুরী যদি দেশটিতে হামলা করার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তাকে গবেষণা করার জন্য প্রচূর অর্থ দিবে মা। পাশাপাশি দেশটির প্রধান করে দিবে।আর জলদ চৌধূরী মায়-এর সাথে ভাগাভাগি করে নিবে এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ।ছোট ভাই বারিদ কিছুটা আঁচ করতে পারে সেখানেই। এদেশের সাথে যোগাযোগটা সে ধরতে পারছিলনা কিছুতেই।সবকিছু পরিষ্কার করে দিল সেই দিন রাতের আলোর সিগনাল। ঐ সিগনালের একটি উৎসের হোতা ছিল তার নিজের বড় ভাই। পাশাপাশি পাহাড়ে গিয়ে জানতে পেরেছে এর মধ্যে তার বড় ভাই অকারণেই পাহাড় চরেছে বিভিন্ন সময়। হামলার রাতে জলদ চৌধুরীর বাসার সামনে গিয়ে সেখানে আর্মি অফিসারের সাথে হামলার প্ল্যান বলতে শোনেন।সেখান থেকে পাহাড় চড়ে পালিয়ে যায় বারিদ চৌধুরী। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা রেখে শুধুমাত্র দেশকে বাঁচানোর জন্য চলে যান অন্য দেশে। ফিরে আসে সহায়তা নিয়ে। আর জলদ চৌধুরীকে ঘায়েল করেন তার নিজের সন্তানদের দিয়ে।দেশে ফিরেই জানতে পারেন স্ত্রী এবং পুত্রকে হারিয়েছেন তিনি। আর মেয়েটি আছে বন্দী এক শয়তান হানাদারের কাছে। তাই তার প্রথম কাজ ছিল, সেই হানাদারকে হত্যা করা...
১৪.
শিন্তাল্যান্ড এখন আবার আগের মতো। শুধু সামরিক বাহিনীটিকে একটু ঢেলে সাজানো হয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় আছে রাডার।শত্রুর পদচারণা ধরার জন্য। বাবা ফিরে আসার পর রোয়েনা পড়ালেখায় মন দিয়েছে।সে এখন নামকরা কৃষি বিজ্ঞানী।দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। বাবার সাথে রোজ সকালে পাহাড়ের নীচ পর্যন্ত হাঁটতে যায়।রোজ রাতে শেকলটা আর ইউনিফর্মটা চুপি চুপি ছুঁয়ে দেখে।রোয়েনা জানে বাবা ফিরে এসেছে, কিন্তু মা বা শিয়ান আসেনি..আসবেওনা। বাবার দুঃখটা রোয়েনা খুব বোঝে..তাই নিজের দুঃখটা দেখায় না।দেখাবেই বা কেনো! হামদান তো ফিরেই এসেছে!..নতুন রূপে..ছোট্ট রূপে..!
রূপকথা................................................
…...........................................
…...............................
এক অসাধারণ গল্প পড়লাম। এত বড় একটা লেখা অথচ এত টেনে ধরে রেখেছিলো যে কখন শেষ হয়ে আসলো বুঝতেই পারলাম না। পোস্ট প্রিয়তে।
সত্য? ধন্যবাদ..আপনাদের আরো মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম..
ইয়াপ, সত্য মানে অতিকড়া সত্য। রুপু-রুশু নামকরণ ভালো লেগেছে, রোয়েনা-হামাদানের চেয়ে।
আর একটা কথা বলাও মনে হচ্ছে জরুরী; সেটা হচ্ছে গল্পের বিস্তৃত পটভূমি, চাইলেই লেখাটা আরো বড় করা যেতো, করা যেতো আপনার লেখনীর প্রতি আরো সুবিচার।
শিন্তাল্যান্ড জায়গাটা কোথায়? চৌধুরী নামের কারণে ইন্দোনেশিয়ার কথা মনে হচ্ছে বার বার।
কিছু অতিসাধারণ টাইপো রয়ে গেছে। টাইপিং এর সময় আরো মুনোযোগ দিতে হপে
ধন্যবাদ ভাইজান..অবশ্যই আরো মনোযোগী হবো..।..
আরি ??
এইসব বাক্যের জন্য ধইন্যাপাতা না হৈলেও মানুষ অন্তত শুকনা মরিচ স্যরি শুকনো হাসি তো দেয়, না কি?
ক্যায়া জামানা আয়া রে ভগবান। মুঝে উঠালে।
সুরজ না বদলা,
চাঁদ না বদলা,
না বদলা রে আসমান
কিতনা বদল গ্যায়া ইনসান।
সুন্দর লাগলো...
বর্ণনার অভিনবত্বের জন্য গল্পটা পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম...
সুন্দর।
সুন্দর
রুপকথা ভালো পাই। আমার দেখা সিনেমার মধ্যেও রুপকথা জাতীয় ফ্যান্টাসি টাইপ ছবিই বেশি। গতকালও একটা দেখলাম।
ধন্যবাদ..আমিও রূপকথা ভালো পাই...
দীর্ঘ কিন্তু উপভোগ্য। আরো বড় করে কয়েক পর্বে এলে আরাম করে পড়া যেতো। তবে পরিশ্রমসাধ্য সুন্দর কাজের জন্য রুম্পাকে সাধুবাদ।
আপনার ব্লগ মনে হচ্ছে মিস করে গেছি
। পুরনো লেখাগুলো পড়তে হবে।
বাকী আর তেমন কোন লেখা নেই যেটা পড়া যায়..এটাই যেন কিভাবে কিভাবে লেখা..ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ..
এইটা কি রূপকথা?
যাস্ট অওসাম।
এটাকে একটা কল্পনা বলা যেতে পারে..কি যেন!!..
..ধন্যবাদ
বড় লেখা সাধারণত পড়তে পড়তে টায়ার্ড হয়ে যাই।
কিন্তু এটা এক টানে পড়ে গেলাম। উপভোগ্য
ধন্যবাদ
আত্মবিশ্বাস বাড়ছে আপনাদের মন্তব্যে..ধন্যবাদ..
অনেকদিন পর একটা বড় লেখা পড়লাম। অসাধারণ।
ধন্যবাদ...
tui eto valo likhis amar janachilona..ami just hotovombo..seriuosly ,dosto..tor likhar haat oshadharon..amazing..
মুখে স্বাদ লেগে থাকা স্বাদ ।
দীর্ঘ না হলে আরো আরাম পেতাম ।
আমাদেরও প্রকৃতির সৌন্দর্য আছে ।
শুধু আমাদের দেশটা শিন্তাল্যান্ড না, এমনকি শান্তিল্যান্ডও না,
বরং অশান্তিল্যান্ড ।
চমৎকার কল্পনা শক্তি আপনার!!!
অনেকদিন পর একটা বড় লেখা পড়লাম। অসাধারণ।
বড় হলেও আকর্ষণীয় । ডাকাডাকি সত্বেও শেষ না করে উঠতে পারলাম না । "বই পড়া আর শাড়ী পরার" মধ্যেকার পার্থক্য লক্ষ্য রাখা দরকার । প্রুফ দেখা হয়নি ঠিকমত । ধন্যবাদ রূপকথককে, আর মন্তব্যকদেরও ।
মন্তব্য করুন