জীবন থেকে নেয়া-১
আজকের দিনটি আমার জন্য খুবই আবেগঘণ দিন। মানুষ যে কত ছোট ছোট বিষয়ে খুশি হয়ে যায় এটা হচ্ছে তার প্রমাণ। আবার কত বড় বড় বিষয় আমলেই নেয় না- সেটারও ক্যালাসগিরি ভাবাই যায়।
একারণেই অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম ডিজিটাল ডায়েরি লেখা শুরু করবো। টুকটাক করে যে লিখি না তাও না। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু অদৃশ্য হাত পিছন থেকে টেনে ধরে। কোনটা মুখ খামচে ধরে, কোনটা আবার কলম কেড়ে নেয়। সত্যি ভাবি- এই যে অকপটে জীবনের অনেক সত্য বলি- তাতে আবার কেউ দূবর্লতা খুঁজে পায় নাতো! বা এমন কি ভেবে নিবে না তো যে আজাইরা কথা কয়! ভাবার পরেই মনে হয়- আমি কখনই নিজের অতীত-বতর্মান বা অনাগত ভবিষ্যতের ব্যাপারে লজ্জিত- কুণ্ঠিত বা চিন্তিত নই। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আলহামদুলিল্লাহ জানি যা করেছি- তা আমার পছন্দে, যা বলি- সেটা আমার মর্জিতে আর যা করবো তাও মনের খুশিতে।
অনেকেই আছে যারা অতীত বলতে চান না, আর সারা জীবনের আনপ্রফেশনাল আমি অতীত ভুলতে চাই না। কখনো ভুলতে চাই না মাটি কামড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। অনুগ্রহে - অবহেলায় হাসিমুখে "ভালো আছি" বলার দিনগুলো। আমার পা না হয় মাটিতেই থাকুক- বাকীটা যে যার ইচ্ছে..
অনেক লেখাতেই অনেকবার বলেছি, একটা সময় অর্থনৈতিক- মানসিক- পারিপার্শ্বিকভাবে ভীষণ বিপযর্স্ত ছিলাম। নূন আনতে পান্তা ফুরায়- অবস্থাও নেই। এমনও দিন ছিল যখন নূন বা পান্তা কোনটাই বাসায় থাকতো না। আর আনার জন্য যে "আনা" দরকার সেটাও।
এমনই সময় ছিল আমার ছেলেবেলা।
আমার মনে আছে। জ্ঞান হবার পর থেকে আশ্রিত অবস্থায় ছিলাম অ-নে-ক বছর। আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদের পাশের কলোনি। আমরা থাকতাম ডাইনিং স্পেসে। একটা বড় টেবিল ছিল। খাবার টেবিল। তার পাশে রোল করে রাখা হতো আমাদের বিছানা বালিশ। আর সেখানেই গুটিশুটি মেরে থাকার ব্যবস্থা। আমরা পাঁচজন। নিয়তি-ভাগ্য তখন থেকে অনেকবছর সাথে ছিল না। যখন বাসার লোকেরা দাওয়াতে যেতো- আমরা দেখতাম। আর বাসায় কারো দাওয়াত থাকলে আমরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতাম। পাঁচ জনের কেউ মাঠের পাশে বসে থাকতো, কেউ রাস্তায় হাঁটতো, কেউ অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতো সিড়িঘরে।
তারপরও এখনও আর আশ্রয়দাতাদের ধন্যবাদ দেই যে অন্তত তারা ঘরে ঠাঁই দিয়েছিল। না হলে কি হতো! অনেক রাগারাগি - মারামারি- ঘর থেকে দুমদাম বের করে দেয়ার পরও ঐ মানুষগুলোকে এখন দেখলে আমি হাসিমুখে থাকি। বলি- ওদের বাসায় থাকতাম। কি আছে জীবনে! সবাই কি এমন যুদ্ধ করতে পারে! আমি তো বিজয়ী তাই না! আর সহজ সত্য যেটা তা হলো- একটা পুরো পরিবারকে ঘরে আশ্রয় দিতেও কিন্তু মানসিক শক্তি লাগে। এটা যে ওনাদের ছিল- এই বিষয়টাতো উপেক্ষার পর্যায়েই পড়ে না।
টেবিলের কর্নার থেকে আমার যে ছোটবেলার শুরু- তা থেকে খুব বেশি ভালো অবস্থানে যাইনি আলাদা হতে পারার পরও। যে খাটটা অবশেষে আমাদের অবশিষ্ট ছিল সেটাতে ঠেসে ঠুসে তিনজন ঘুমাতে হতো। আর আমদের পেটে দানা না থাকলেও স্বাস্থ্য তা বলে না কখনোই। অবশেষে মায়ের সাথে বার কয়েক রাগারাগি করে মাটিতে বিছানা নিলাম।
সেখানেও জ্বালা! বিছানা থেকে মা বোন যেই নামুক না কেন ঠ্যাংটা পড়তো চেহারা বরাবর। আমি বড় হচ্ছি আর এভাবেই পা-এর আদর পেতে পেতে মাটির বিছানাটা আমার বড় হচ্ছে।
অর্থনৈতিক অবস্থা কিন্তু তখনও ঠনঠনা। স্বপ্ন বড় কিন্তু সাধ্য কিঞ্চিৎ। টাকা পয়সার নিদারুণ বিমাতা সুলভ আচরণে এবাসা সে বাসায় ভ্রমণ। আমার অবস্থানের যদিও পরিবর্তন নেই। এই যা।
এরপর ঐ যে - শখের চাকুরি বাদ দিয়ে সুখের চাকরি ( আপাত দৃষ্টিতে) শুরু করার পর স্থিতি পেলাম বটে। কিন্তু ঠাই নাই ঠাই নাই ছোট সে তরী তো চলছেই।
অবস্থান নিলাম ড্রয়ইং রুমে। সোফার পরিত্যাক্ত তিনটা ফোম জোড়া দিয়ে বেশ ঘুমাই। গরীবের শখের শেষ নাই। ঐ ঘরটায় দুই দিকে জানালা। পয়সা কম তো কি সমস্যা। গামছা দিয়ে পর্দা বানালাম। ঘরে আলো আসলেই মনে হয় ঘরটায় রংধনুর আলো ছোটাছুটি করছে। ছয় রকমের আলো- ছয় রকমের আনন্দ!
সেই বাসা থেকে যখন এলাম আরেক বাসায় - তখন একখানা রুম পেলাম বটে। সেটাও কিন্তু কম প্রাপ্তি নয়! টেবিলের পাশ থেকে রুমের যাত্রা অনেক আনন্দের নি:সন্দেহে।
এমন সময় এক ভটু কেমনে কেমনে করে যেন আমাকে বিয়ে করার সাহস করে ফেললো। এখানে বলতেই হ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার পর্যন্ত বলেন- কি করো পারছো হে ছোকড়া!
বিয়ের পর আমাদের দুইজনের রুমটা হলো ছাত্র-ছাত্রী নিবাসের মতন। দুই জনের বই খাতা, একগাদা গল্পের বই, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ আরো কত কিছু। আমাদের বন্ধু বান্ধবরা বলে- এই ঘরটা হলো বিবাহিত ব্যাচেলরদের রুম!!
তারপরো এই ১৪ বাই ১৪ রুমটা আমার খুব প্রিয়। এই ঘর আমাকে বিগত সাড়ে চার বছর যে শান্তি দিয়েছে তা আর কোন কিছু- কোন পার্থিব- অপার্থিব কারণ আমাকে দিতে পারবে কিনা সন্দেহ। বিছানাটা ছোট - সত্য। কিন্তু আমরা "মোটা-মুটি" দিব্যি এঁটে থাকি। সকাল বেলায় মোরগ নয় মোরগ বিক্রেতার ডাকে ঘুম ভাঙলে রাগ হয়- কিন্তু একদিন ডাকটা না শুনলেও কেমন কেমন লাগে। অনেকে যখন গলায় পিতলা দরদ দিয়ে বলে- রুমটা বেশ ছোট- তখন রাগে রি রি করতাম। মনে মনে বলতাম, বেশি বুঝোস!
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, আমাদের অবস্থা অনেকদিন ধরেই "সূর্যের চেয়ে বালি গরম" টাইপ। বাসায় কাজ করার স্পেস লাগবে, আমি বই রাখার জায়গা পাচ্ছিনা তাই বই কেনা হচ্ছে না। কাপড় রাখার কায়দা না হয় বাদই দিলাম!! আর আমার ভটু মাঝে মাঝে কিন্তু বউ রাখারও জায়গা পায় না।
অতএব সবার সম্মতিক্রমে উপরতলায় উঠে যাবার সিদ্ধান্ত গৃহিত হলো। কিন্তু বেচারা আমার শ্বাশুড়ি তা রেহাই পেলেন না আমার চাহিদা থেকে। এত্তোবড় লিশ্টি ধরিয়ে দিয়েছি তাঁর হাতে। বলেছি- আপনি দিবেন। আর খানাদানা তো একসাথেই থাকবে (ইনশাআল্লাহ)। বলে রাখা ভালো - হিন্দি এবং বতর্মানের বাংলা সিরিয়ালের মুখে ছাই দিয়ে আমি সেরারারাম শ্বশুড়বাড়ি পেয়েছি- আল্লাহর অশেষ রহমতে।
সেই বাসাটা ঠিকঠাক করার প্রকৃয়া চলছে। কিন্তু গতকালই বাসার চাবি আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে এসে গেছে আমাদের। তারপর থেকে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো টেবিলটা- কলোনির ডাম্প বাসাটা- মাটির বিছানা- গামছার পর্দাটা চোখে ভাসছে! এমন কি সবার চোখে ছোট কিন্তু আমার চোখে বিশাল ১৪ বাই ১৪-এর রুমটার দেয়াল আমাকে টানছে!
মানুষ কত সহজেই না ভাবুক হয়ে যায়। আমার নিজের মতো করে সাজানোর আস্ত একটা বাসা পাওয়ার মতো কল্পনা করাও টেবিলের পাশে গুটিসুটিময় জীবনটায় ছিল রূপকথার মতন! সেই রূপকথাটা এভাবে ভটুর হাত ধরে সত্যি হবে তা কে জানতো!
সেই সময়গুলোর স্থিরচিত্র কল্পনায় উড়ে আসলেও জানি- সেসময় সময় গুলোর কারণেই মাথা নীচু করে পালিয়ে যাবার কথা চিন্তাও করি না। অসম্ভব মানসিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকি রূপকথাকে বাস্তব করার অপেক্ষায়।
নতুন জায়গায় নতুন ঘরে শুরু হোক আপনার নব যাত্রা। খুব ঝরঝরে লেখা। খুব ভাল লাগলো। ভাল থাকুন।
লেখাটা পড়েই মন ভালো হয়ে গেল।
আমার তো দফায় দফায় কান্না আসছে..
কি যে করি!! 
পড়লাম, কিছুটা মন খারাপ হলো, আবার ভালোও লাগলো অকপটে নিজের কথা বলে ফেললেন! তবে দিন শেষে সফল মানুষেরাই এসব কথা বলে যায়!
সফল না বিফল সেটা বলার এখনও সময় আসেনি। তবে এইটা বলতে পারি- বুকের পাটা আছে আল্লাহ দিলে..
ওরে, তোমার লেখা পড়ে বড়ই ভালো লাগলো রে।
লিখতে থাকো রে।
-জাফর
অদ্ভুত ভালো লাগলো আপনার জীবনের সত্যি কথাগুলি শুনে . খুব কম মানুষ পারে এমন নির্জলা সত্যি কথা বলতে .
আপনার মত এত গুছিয়ে লিখতে পারিনা তবেও আমিও কমবেশি আমার জীবনের কথা এক আধ্টু লিখেছি . আমার মত উটকো হয়ে বেয়ে উঠা আরেকজন মানুষের জীবনের গল্প শুনে অনেক ভালো লাগলো .
অনেক শুভকামনঅ রইলো আপনার জন্য .
যতো সহজে কথাগুলো লিখছো রুমপা জামান কথাগুলো ততো সহজ না। তোমার মতো সাহস নাই, যুদধও সেভাবে করি নাই কিনতু আনদাজ করতে পারি। আচছা এখন লও লও লও সালাম
বাই দ্যা ওয়ে, এই নামে আমারো একটা সিরিয়াল চলে বহু বছর ধরে পুরাই হিনদি ফিলম সটাইলে, আরমভ হইছে কিনতুক থামবে না। আমাকে রয়্যালিটি দিও "সমনামী" হওয়ার
হিনদি সিরিয়াল হবে কথাটা
(
ওয়াআলাইকুম আস সালাম আফা..

আসলে জীবনের ঐ পার্টটা হলো আমার কাছে শেখার পার্ট। আমি ঐ সময়ই শিখেছি কষ্ট না করিলে কেষ্ট মশাই সন্তুষ্ট হয় না। আর বিনা কষ্টে হাতে পাওয়া কেষ্ট বিনা জানানিতে সঙ্গ ছাড়ে..
দারুন একটা লেখা পড়লাম।
যত মজা করে, অতিব সহজে লিখে ফেললেন রুপকথার মতোন শোনালেও বাস্তবতা অন্নেক কঠিন গেছে, আসলেই অনেক মনোবল নিয়ে আগাইছেন আপনি! আর এই অবস্থানটা আপ্নে অর্জন করে নিছেন!
আপ্নের রুমের কান্দুনি দেখে আমার তো নিজের বাড়ির জন্যে কান্দুনি আরো চেপে বসছে!! যদিও অনেক ভিন্নই আমারটা।
প্রতিটা বিষয় দুইভাবে নেয়া যায়। কঠিন এবং সহজভাবে। আমার কেন যেন মনে হয়- কঠিন করে যাই দেখবেন তাতেই আপনার আত্মগ্লানি বাড়বে। আমাদের জীবনে এতো প্যাড়া তারমাঝে আরো কঠিন করে বিষয়গুলো দেখার কি আছে!
বিবাহিত ব্যাচেলর রা যেখানেই যাক না কেন তাদের কপালে একবার এই সুনাম ( মতান্তরে দু্র্নাম ) লাগলে তা কখনোই ঘুচে না , স্পেশালী যদি থাকে বই এর নেশা ... নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ,দেশে সেই স্কুল জীবন থেকে প্রবাসের এই জীবন পর্যন্ত সবসময় ডাবল খাটে সিঙ্গেল মানুষটা বড়ই কষ্টে শুয়েছি ...কারনটাও ঐ বই, সেই ছোটবেলা থেকে প্রতিদিনই বই এর সাগরে সাতার কেটে একটু জায়গা করে শুতে হয় ...
আম্মু মাঝে মাঝে স্কাইপে আমার ঘরের এই অবস্হা দেখে বকা দেয় আমিও তাকে অলমোষ্ট প্রতিবারই পরের দিন গুছানোর প্রমিস করি ... এভাবে এক যুগের ও বেশী সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু আমার সেই পরের দিন টা এখনো আসেনি ....
তবে যাই বলেন! আমরা দুইজনই বিবাহিত-ব্যাচেলর হুড উপভোগ করি..
রুম্পা নাকি রে! বেশ ভালো লিখিস। আমার তো কখন মনে হয় নাই তুই এমন কোনো কষ্টে ছিলি ,
সারা জীবন তো হা হা হি হি টাইপ ই দেখেছি তাই বুঝি নাই ! কিন্তুযে হারে গলা শুকায় ফেলসস আশা করি ১৪ বাই ১৪ এর পরের টা প্যালেস হিসাবেই থাকবে।
তোর্ মত যদি লিখতে পারতাম ! অকপটে নিজের জীবনকে নিয়ে ফান করা সহজ না , সবাই পারে না।
সুন্দর গল্প বাস্তবতার ছোয়ায় বাস্তব কে গল্পের কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে ।নতুন ঠিকানায়
সুখে থাকিস সারা জীবন দোস্ত
আর নেক্সট টাইম দাওয়াত দিবি কিন্তু
এমিলীর বাপ
সেটা আর বলতে হবে না এমিলির বাপ! দাওয়াত কনফার্ম।
আর আমারে দেখলে অনেক কিছুই বোঝা যায় না কলাম!!!
সকাল বেলা উঠে মন খুশী করা গল্প পড়লাম। দুটো ভালো খবর পেলাম আজ। বাংলাদেশের সোহাগ গাজীর সেন্ঞ্চুরী আর আপনাদের টুনাটুনীর সুখী সংসার।
আপনারা ভাগ্যবান, এরকম সুখী হতে হলেও সাধনার প্রয়োজন। লেখা চমৎকার বলতেই হয়
এক হলো সোহাগ গাজীর সেঞ্চুরি আবার হ্যাট্রিক। অন্যদিকে বাসার আনন্দ সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা.. আল্লাহ ভরসা। দোয়া করবেন ভাইসব। ...
ধন্যবাদ,সুন্দর লিখছেন। সুযোগ পেলে আমার জীবনের কাহিনী শেয়ার করব।
মন্তব্য করুন