জীবন থেকে নেয়া-২
আমার ছেলেবেলার টানা-হ্যাচড়াময় জীবনের সূচনা আগেই করেছি। অতএব এখন আবার বলার হয়তো প্রয়োজন পড়বে না। সূচনা না হয় না থাকুক। গল্পের বাকীটা তো আছেই।
আজকের গল্প আমার জীবনের সেই না খেয়ে থাকা অধ্যায়ের আরেকটি পর্ব নিয়ে।
আমি বড় হয়েছি আজিমপুর কলোনিতে। সরকারি জায়গায় আর কিছু না থাকুক- ব্যক্তিগত তোড়জোড় মানুষের সবসময় ছিল। সরকারি গাছ- নিজের গাছ বা সরকারি মাঠ নিজের বাগান বলে চালিয়ে দেওয়া বড়ই স্বাভাবিক বিষয় ছিল কলোনি বাসীর জন্য। এমনকি পুকুরগুলোতেও দিব্যি জাল ফেল মাছের চাষ চলতো। এখন চলে কি না জানি না। কারণ সেই মাঠ অনেকগুলোই ইমারতের নীচে চাপা পড়েছে আর পুকুরগুলো হারিয়ে গেছে আবাসনের ভীড়ে।
এখন যখন বিকেলে মাঝে মাঝে হাটঁতে যাই কলোনিতে সবকিছু অচেনা লাগে। কোন মানুষ চিনি না- নতুন ইমারতগুলোও অচেনা। চেনা শুধু সেই গাছ গুলো- আর ইমারত হবার অযোগ্য ছোট্ট মাঠগুলো।
আমাদের বাসাটার সামনে তেমনই একটি ইট-ফলনের অযোগ্য মাঠ ছিল। যেটার পুরাটাই সামনের বিল্ডিং মানে তেরো নম্বরের দোতলার বাসিন্দার দখলে ছিল। সেই পরিবার অবশ্য নিষ্ঠার সাথে সেখানে চাষবাষ করতেন। একেবারে ফার্মভিলের মতো নিয়ম করে এই সবজি - সেই সবজি, অথবা গাদা ফুল বা কোন শাক। ফুলকপির দিনে ফুল কপি এমনভাবে হতো মনে হতো কপির বাগান। আবার গোলাপি রঙের বাধাকপির মতন কি যেন হতো। অনেক বেশি ফলন হলে আমরাও পেতাম একটু অথবা দুটো। কারণ এলাকার সবাই জানতো আমাদের টানাপড়েনের কথা।
এই বাগানের বেড়া দেওয়া হয়েছিল গাছ-ঝাড় দিয়েই। সেই ঝাড়ে লাল লাল একটা ফল হয়ে থাকতো প্রায়ই। আমাদের জীবনে তো কোন কিছুই কিনে খাবার অবস্থা ছিল না। তাই ওগুলো পেড়ে খাবার মাঝেই ছিল অনেক আনন্দ। ছোট্ট হাতুদুটো ভরে আবার কখনো স্কার্ট-এর কোচড়ে করে একগাদা লালফল নিয়ে আসতাম বাসায়। আর টেবিলের কোনায় বসে খেতাম। একদিন আম্মা দেখে ফেললো। ভাবছিলাম জীবন শেষ! কিন্তু না!!
অভাবের শেষ সীমানায় থাকা ভদ্রমহিলার চোখ চিকচিক করে উঠলো। আম্মা জানালো এই ফলটির নাম চুকাই। আর জিজ্ঞেস করলো কোথায় পেলাম এগুলো। বলতেই আম্মা সরাসরি ঐ দোতালায় গিয়ে বেড়ায় হতে থাকা চুকাই ফল পেড়ে নেয়ার অনুমতি নিয়ে আসলো। যেহেতু বেড়ায় হয় আর ফলটি টক-টক তাই দোতালার বাসিন্দারা মনে হয় "না" করলো না।
আম্মা খুব আগ্রহ ভরে একগাদা চুকাই নিয়ে এলো বাসায়। তারপর খুব ভোরে উঠে এটা ওটা জোড়া দিয়ে মজার এক খাবার তৈরি করে ফেললেন। চুকাইয়ের জেলি! অসাধারণ মজার- গাঢ় গোলাপি রঙের যথার্থ ঘনত্বের মজার জেলি।
ও আচ্ছা। খুব ভোরে বানানোর কারণ হলো- যেহেতু আমরা আশ্রিত ছিলাম তাই আমাদের পিকটাইমে রান্না-গোসল এমনকি প্রয়োজনে বাথরুম করারও উপায় ছিল না।
যাক গে সেসব।
বলি জেলির কথা। সেই চুকাইয়ের জেলি দিয়ে পাউরুটি খেলাম- আমার মনে আছে, আনন্দে সেদিন মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সেরা খাবার খাচ্ছি। মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হলে দুটো জিনিষ হয়- এক- তাদের সংগ্রামের দিনের সকল ঘটে যাওয়া বিষয়কে ঘৃণা হয় এবং দুই- সংগ্রামের দিনের প্রতিটি সময়- প্রতিটি উপাদানকে বুকে জড়িয়ে রাখে। আমি দ্বিতীয়দের দলে। তাই আজো আমি চুকাইয়ের জেলির সেরকম ভক্ত। আজকেও সকালো একইভাবে নাশতা করলাম। আম্মার হাতের বানানো চুকাইয়ের জেলি। একই রকম স্বাদের- বর্ণের। আমার গাঢ় গোলাপী রঙের জেলিময় দিনগুলো!
পার্থক্য একটাই আজ উপরওয়ালার অসীম করুণায় কারো কাছ থেকে চুকাই চেয়ে নিতে হয় না। আমার ঝগরাটে আম্মা এখন বাজার থেকে চুকাই কিনে তারপর জেলি বানায়। ইচ্ছেমত সময়ে- যত খুশি। আলহামদুলিল্লাহ ।
সেই দোতালার বাসিন্দাদের ধন্যবাদ- ওরা না অনুমতি দিলে এই খাবারটা আমার অচেনা থাকতো.. কি জানি হয়তো জীবনে জানাই হতো না।
আর ধন্যবাদ আমার ঝগরাটে আম্মাকে যার সাথে জীবনেও আমার ঝগরা থামবে না আর তাই বলাও হবে না- ভদ্রমহিলা আসলেই ভালো রান্না করেন।
যাক, দূরপ্রতিবেশী একজনকে অন্তত পেলাম। তবে চুকাইটা ঠিক বুঝলাম না।
লেখাটি পড়ে মজা পেলাম।
তাই নাকি? কত নম্বরে থাকতেন??
কত নম্বর না, কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোডে ছিলাম (বাসা নং-২৭/১৫)। ছাপড়া মসজিদ, চায়না বিল্ডিং, পলাশি ব্যারাক আর আজাদ স্টাফ কোয়ার্টার চষে বেড়িয়েছি এক সময়। তাইতো নিকট নয়, দূরপ্রতি্বেশী লিখেছি। ধন্যবাদ।
তাই তো তাই তো...
ঘটনা কি?
পড়তে পঁচা হয়েছে? 
আপনার লেখা পড়লেই আমার মন খারাপ হয়। কত কষ্টটাই না করেছেন। এটা ভেবে অবাক লাগে। আর মানসিক ভাবে কতটা শক্ত থাকলে সেই অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। আপনাকে অভিবাদন।
শোনেন ভাই, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। আমি এখন জানি আমার ক্ষমতা কতটুকু আলহামদুলিল্লাহ। আপনাদের সবার দোয়াতে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি -এটাই বড় কথা। দোয়া করবেন সবসময়। আর মন খারাপ করবেন না একদম।
অসাধারণ!
অতি সাধারণ....
ভাল্লাগলো
জীবনের গল্প তো এমনই হবে। অন্ধকারের দীর্ঘ প্রহর শেষে ভোরে যে সূর্যের আলোটা হাসে- সেটার মূল্য যে অনেক বেশী। দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা না থাকলে জীবন পরিপূর্ণ হয়না।
লেখাটা ভাল লাগলো। জীবনের ছায়া আছে তো! ভাল থাকুন অনেক।
ইনশাআল্লাহ..
আসলে আপনে একটা বস্।
আই কিচ্চি!
চুকাই এমনি এমনি অনেক খেয়েছি, বাসা ভর্তি গাছ ছিলো। ঐ গাছের পাতা দিয়ে ছোটমাছ রান্না করলে দারুন স্বাদের হয় টকটক ভাবের কারনে। জেলির কথা কেবল শুনেছি, খাওয়া হয়নি।
আপনার এই ধরনের লেখা একদম মনে লাগে।
তাইলে সব বাদে এখন জীবনী লেখা শুরু করবো?
এমন কিছু পড়লে মনে হয় বাইচা থাকার আগ্রহ আর সাহস একটু হইলেও বাইড়া যায়। থ্যাঙ্কুস!
আল্লাহ আপ্নাকে অনেক অনেক অনেক ভালো রাখুন।
আপনাদের সবার দোয়াতেই আমাদের ভালো থাকা। ইনশাআল্লাহ উপর-ওয়ালা সাথে আছেন- থাকবেন সবসময়..
মন্তব্য করুন