তারে চেনা হলো কৃষ্ণপক্ষের পথিকরূপে
কিছু দিন আগে আবিষ্কার করলাম, পড়ার অভ্যাস শূণ্যের মাত্রায় নেমে আসছে। ব্যাগের ভিতর একটি বই রেখে দিলাম। অফিসে অবসর সময়ে আড্ডাবাজি ছেড়ে বইটা খুলে বসলাম। খুক খুক করে হাসার শব্দে আশেপাশের সহকর্মীরা বারে বারে তাকাচ্ছে। একজন এসে জানতে চাইলে কোনমতে হাসি থামিয়ে বললাম, বহুব্রীহি পড়ি। লেখক হুমায়ূন আহমেদ। একসময়ের জনপ্রিয় ধারাবাহিকের ছাপা অক্ষরের এই বইটি সেদিন আমাকে নতুন করে পাঠকে পাঠকে পরিণত করেছিল। না, এ আমার প্রথম পরিচয় নয় লেখকের সাথে। হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার পরিচয় সেই ছোটবেলায়। প্রথমে নাট্যকার হিসেবে আমার চেতনায় তার অনুপ্রবেশ। ”হঠাৎ একদিন” নাটকটি কারো মনে আছে কিনা জানিনা। কিন্তু সেই ছোট্ট অভির মতো ছোট্ট আমার মনে ঠিকই বাসনা জেগেছিল একদিন চিড়িয়াখানা থেকে একা একা বাসায় আসার। কঙ্কাল দেখে ভয়ে হাউমাউ করে উঠার দৃশ্যগুলো আজো মনে আছে। জানি না কি করে! কারণ তখন আমি নিতান্তই শিশুমানুষ। এরপর হুমায়ূন সাহেব আবার আমার ছোট্ট মাথার কোষগুলোতে স্থান করে নিলো বহুব্রীহির বোকা আনিস, মামা, কাদের-এর নানা সংলাপ দিয়ে। শেষ পর্যন্ত ”তুই রাজাকার”-এর মতো আলোড়ন তোলা উক্তি দিয়ে। স্কুলে কাউকে পছন্দ না হলে বলতাম, তুই রাজাকার! সাথে সাথে তার মুখ অন্ধকার হয়ে যেতো। ধরে নেয়া যেতে পারে, হাস্যজ্জ্বল নাটকীয়তার ¯স্রষ্টা যে হুমায়ূন আহমেদ তার সাথে এভাবেই আমার প্রথম পরিচয়।
এরপর বড় হওয়ার পথে ভিন্ন আরেক হুমায়ূন আহমেদ-এর সাথে পরিচয় ঘটলো কোথাও কেউ নেই দিয়ে। কলোনিতে বড় হয়েছি। এক একটি নাটকের এপিসোড দিয়ে দেখেছি, সত্যিইতো আশেপাশে কতই না বাকের ভাই! টিন এইজ বয়সটাতে আবেগী মোড়-অলি-গলি চিনিয়ে দেয় হুমায়ূন আহমেদকে সেই বার চিনলাম নতুন করে। ছাদের উপর তিনটি অসহায় মেয়ের নুপুর পায়ে নাচা (যার মধ্যে একজন ছিলেন তমালিকা কর্মকার), বাচ্চাদের অনুকরণে কথা বলা- নতুন ট্রেন্ড হলো। মনে আছে, নিউ মার্কেটে বাজার করতে আসা ”কুত্তাওয়ালি” ধাওয়াও খেয়েছিলেন সাধারণ জনতার। আর বদি ভাই মানে আব্দুল কাদেরকে এখনও অনেকে মিস্টার বদি বললে তিনি অবাক বোধ করেন না। আর বাকের ভায়ের ফাঁসির দিনে এলাকায় ঠিক যেন কার্ফিয়্যু। এভাবেই একজন শক্তিশালী নাট্যকারের সাথে এবার আমার পরিচয় হলো টিন এইজড বয়সে, যার নাম হুমায়ূন আহমেদ।
এরপর ধীরে ধীরে আমার মাঝে যখন জন্ম নিচ্ছে একজন পাঠক, তখন সবার আগে হাতে নিলাম নন্দিত নরকে। ধীরে ধীরে হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, রূপা বন্ধু হলো। পরিচয় হলো দুর্দান্ত লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাথে। যেদিন কৃষ্ণপক্ষ পড়লাম, সেদিন সারারাত বালিশে মুখ গুজে কেঁদেছি। জানি এটা গল্প, জানি কেউ সত্যিকারের মারা যায়নি, তারপরও সেই কান্না আটকে রাখতে পারিনি। যখন কবি পড়লাম তখন পরীদের জন্য এক ধরণের চাপা কষ্ট জমাট বাধতে লাগলো বুকের মাঝে। সম্পর্কের টানাপড়েনের, আবেগের আলো-অন্ধকার, গুপ্ত-সুপ্ত চিন্তা চেতনার রচয়িতা যে হুমায়ূন আহমেদ তার সাথে এবার আমার পরিচয় ঘটতে লাগলো।
আর এখন? আবার নতুন করে পাঠকের পুনর্জন্মের প্রাক্কালে পাঠকের দিকে মমতার হাত বাড়ালেন সেই প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
যার প্রতিটা লেখা, সৃষ্টি, ভাবনা নতুন করে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন এক অনুভূতির সাথে, তাঁর সাথে ”প্রথম পরিচয়”-এর পর্বটা সহজে শেষ হয়নি। বরং, প্রতিবার তাঁকে চিনেছি, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে- নতুনের মতো করে। একজন লেখক তার প্রতিটি চরিত্রের মাঝে যখন রক্ত মাংসের মানুষকে বেধে ফেলতে পারে, তখন তিনি সামনে আসেন নিত্য নতুন রূপে। একেকটি রূপের সাথে একেকবার পরিচয়- প্রথম পরিচয়।
এমন লেখকের সাথে বাস্তবেও সাক্ষ্যাতের সৌভাগ্য হয়েছে বহুবার। পত্রিকায় কাজের সুবাদে নানা অনুষ্ঠানে স্যারের সাথে দেখা হয়, দূরে দাঁড়য়ে থাকি। হিমু, শুভ্রর স্রষ্টাকে দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে যায়। অবশেষে তার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর দ্বায়িত্ব কাঁধে পড়তেই এলোমেলো পায়ে দখিন হ্ওায়ায় যাওয়া। কথা বলা। স্যারের হাত থেকে অটোগ্রাফসহ বই উপহার প্ওায়া। সেই প্রথম মুখোমুখ কথা বলা। আমার প্রিয় সাহিত্য ব্যক্তিত্ব হুমায়ূন আহমেদ।
জীবন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা লেখকের উপর মান-অভিমান থাকতেই পারে, সেই অভিমানের অধিকার তো তিনিই আমাদের দিয়েছেন! তিনি হয়তো নিজেও জানতেন না, শুধু মাত্র তাঁর লেখা চরিত্র দিয়ে কত পাঠক প্রথম বারের মতো হিমু হয়ে খালি পায়ে রাস্তায় হেঁটেছে, শুক্লপক্ষের রাতে বুক পর্য›ত শালবনে পুতে জোছনা-স্নান করতে চেয়েছে, কত দস্যি ছেলেমেয়ের দল নিয়ম ভেঙে দারুচিনি দ্বিপ দেখতে গিয়েছে, কত মেয়ে কানাবাবাদের হাত ধরে জীবন কাটাতে চেয়েছে! তিনি কি জানেন, তাঁর একেকটা নতুন চরিত্র, নতুন রচনাই পাঠকের সাথে তাঁর নতুন করে পরিচয় করাতো!
আমি নিজে যখন আজ লিখতে বসি, তখন প্রিয় লেখকের মতো নতুন করে ভাবার চেষ্টা করি। প্রতিবার লেখার সময় আমার সাথে ফের প্রথম করে পরিচয় হয় একজন অদৃশ্য প্রেরণার উৎসের সাথে যার নাম- হুমায়ূন আহমেদ।
বোধ করি, আজ যখন লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয় অমাবস্যার রাতে, তখনও তাকে নতুন করে চিনেছে পাঠক। তিনি কি তাঁর মৃত্যু দিয়েও প্রথমবার পরিচয় হওয়ার সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতিকে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন? তার গান বলে, ”চাঁদনি পসর রাইতে” তিনি মৃত্যু চান, আর তখন আকাশ চাঁদহীন! এই রহস্যের সমাধান করবে কে? হয়তো মিসির আলী রহস্যের সমাধান করতে পারতেন। সে সুযোগ আর রইলো কই! অথবা সমাধান হয়তো লেখক নিজেই দিয়ে গেছেন, কারণ হুমায়ূন আহমেদ নিজেই তো তার গল্পের শিরোনাম দিয়ে ছিলেন. ”যখন গিয়াছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ”..। হ্যাঁ, লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার আবারো নতুন করে পরিচয় হলো এভাবেই, তাঁর মহাপ্রয়াণের ক্ষণে- কৃষ্ণপক্ষের পথিকরূপে; এলেবেলে রহস্যভরা উক্তি আর যুক্তির আড়ালে অন্ধকার রাতে মুক্তির দিনে।
(এই লেখাটির একাংশ অনলাইন পত্রিকার জন্য ছিল.. এরপর মনে হলো, কালের স্রোতে সবই মুছে যাবে..এই লেখকের জন্য না হয় আর কিছুটা সময় ধার্য করি.. অতি আবেগের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী..সব কিছুর উপরে হুমায়ূন আহমেদ আমার বেড়ে ওঠার সময়ের সাক্ষ্মী অথবা বলা যায়, তার লেখা চরিত্র গুলো আমার বেড়ে ওঠার শাব্দিক রূপ..বিদায় প্রিয় লেখক.. বিদায় কৃষ্ণপক্ষের পথিক..)
উনার পরপারের শান্তি কামনা করছি।
লোকজন যত যাই বলুক হুমায়ুন আহমেদ এক অন্যরকম শ্রদ্ধার স্থানে আছেন, থাকবেন...
অবশ্যই..
আরো বেশী কষ্ট পাইলাম উনার লাশ নিয়া নোংরামী দেইখা। উনার পরিবারের নোংরামী না, অতি উৎসাহী মিডিয়া আর ফেসবুকবাসী জনগনের নোংরামী
আর আমাদের প্রিয় বাংলানিউজ ২৪..আল্লাহ রে..কি যে পেইন দিতেছে..
হূমায়ূন ভ্রাতৃত্রয় (হূমায়ূন , জাফর ইকবাল , আহসান হাবীব ) আর সেবা প্রকাশনি এবং কাজী পরিবার এ দুইকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্য হয়তো থাকবে কিন্তু বাংলা পাঠক আর বইয়ের বাজার থাকবে না।
মা নবী
কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান....
এই মানুষ্টার লেখা ভাল্লাগতো। এত্ত তাত্তাড়ি চইলা যাইবেন ভাবি নাই
হমম
যেতে সবাইকে হবে তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি যাবে এটা ভাবি নাই।
হমমম...
Rumpa thank you so-much.
আপনাকে ধন্যবাদ মামা..
বিদায় প্রিয় লেখক..
বিদায়..
(
হুমায়ূন আপনি আমাদের স্বপ্ন।
চমৎকার লিখেছেন রূম্পা।
একদমই মনের কথারে ভাই..একদম মন থেকে...
কৃঞ্চপক্ষ আমারও খুব প্রিয়
কৃষ্ণপক্ষ আর শূণ্য- এই দুইটা আমার সবচেয়ে প্রিয়..তারপর বাকীগুলো..
হুমায়ূন আহমেদের শূণ্যতা কখনও পূরণ হবার নয়।
সত্যি..
উনার পরপারের শান্তি কামনা করছি।
মন্তব্য করুন