ইউজার লগইন

গল্প পুরাণ : দুইটি বা একটি গল্প।

গল্প ১:

ঘুট ঘুইট্যা আন্ধারের মাঝে খালি দুই জোড়া সাদা সাদা গোল গোল চোখ চরকির মত ঘুরতাছে।

শালার মায়রে বাপ!

শীতকালের শুকনা নাড়ায় পা পৈড়া জ্বালা কৈরা উঠতে খ্যাচ কৈরা উঠে রহমান।
মতির সাদা চোখ দুইটা কেবল একটু পিছনে ফিরা রহমানরে দেখে, আর কিছু কয়না। চোররে আস্তে কথা কওনের কথা শিখানের দরকার হয়না, সেডা জানে।

বিড়ি একটা ধরাই, কি কস?
আবারো ফিসফিসায় রহমান।

মতি কিছু কয়না। রহমান অবশ্য কিছু মনে করেনা। জানে হ কৈতে হৈলে মতি একটা ঘোঁৎ করতো, না হৈলে চুপ।
যদিও আজকে প্রথমবারের মত তারা আজকে একসাথে চুরী করতাছে। তবে কিনা আজকের টা রাজচুরি।!!
রাজচুরী বলে রাজচুরী!!
মনে হৈতেই রহমানর ঘাম শুরু হয় আবার।
অত্র এলাকায়, চুরীর ইতিহাসে, এমন ঘটনা ঘটেনাই!! কোনো এলাকাতেই কি ঘটছে?
বুদ্ধিটা মতির।
রহমানের মাথায় এত বুদ্ধি আসবার নয়।

মতি, আর তো বেশিক্ষন না, না? উসখুশ করতেই থাকে রহমান। এত বড় চুরীর পরে, স্নায়ু ঠিক রাখতে হিমশিম খাইতে হৈতাছে। এডা তো আর চোর পুলিশ খেলা না। সারাজীবনের দাও মারা হৈছে, সারা জীবনের শত্রুতা কিন্না।

আলীমপুরের আশে পাশের ৫০/৬০ মাইলের সব বড়লোকের বাড়িতে অনেক বছর গল্প চলবে, এই চুরীর, গল্প চলবে আরো অনেকের মাঝেও। অন্তত পুরা ঘটনা টা প্রকাশ পাইলে, গল্পের চাইতেও আরো কিছু চলবে।
একদল লোক কুত্তার মত খুঁইজা বেড়াইবো আরেকদল লোকেরে।

ঘোঁৎ কৈরা শব্দ করে মতি, অন্ধকারে ভারী বোঝা নিয়া প্রায় হুমড়ি খাইয়া পড়ে হাড়জিরজিরে রহমান, মতির ঘাড়ে। শুকনা নাড়া পাড়াইয়া, এতখানি হাঁইটা আইসা একটু কাহিল রহমান। এমনিতে চোরেরা কষ্ট সৈহ্য করতে পারে বেশুমার, চুরীর জিনিষও সটকাইতে পারে ওজনদার। কিন্তু আজকে হৈলো স্নায়বিক উত্তেজনা।
তাই হাঁপাইয়া গেছে রহমান।

মতি আস্তে কৈরা জনায়:

এইখানেই।

রহমান অন্ধকারে মতির মুখের ভাব বুঝার চেষ্টা করে। আরেকবার বিড়ি ধরানের কথা কৈয়া দেখবো? বুকটা হুতাশ হুতাশ লাগে, এতক্ষন বিড়ি না খাইলে।
কিন্তু ঠিক বুইঝা উঠতে পারেনা।
মতি বৈসা পৈড়া নিজেই একটা বিড়ি ধরাইলে খুশি হৈয়া যায় রহমান।
নিজেও বৈসা, মতির মতই আগুন লুকাইয়া একটা বিড়ি ধরাইয়া, গফ শুরু করার জন্য আঁ.. কৈরা উঠতেই,
"হুফ" কৈরা থামাইয়া দেয় মতি।
দুইজনে নিরিবিলি বিড়ি টানে বৈসা কতক্ষন

মতি যখন একটা বড় কৈরা শ্বাস ছাড়ে, রহমান বুঝতে পারে, এইবেলা সহজ হৈয়া দুইটা কথা কওয়া যাইবো।

মতি, এখনি শুরু করুম কুপানি?


হ, আস্তে ধীরে শুরু করি চলো।

দুইজনে মাটি গর্ত করার জিনিষ পাতি বাইর করে, রহমানের ঝোলা থেইকা, আর বড় সড় ৩ টা বাক্স!
কত টাকার জিনিষ হবে ভিতরে, দুইজনের কারোই আন্দায নাই।
আশে পাশের ৫০/৬০ মাইলের যত বড়লোক আছে, সংখ্যায় ৬৭ টা বাড়ি, ঐসব বাড়ী থেইকা করা চুরীর মালের সব সোনা গয়না গুলা এইখানে।

৩ গ্রামের ৪ টা চুরীর দল, মতির ওস্তাদের আন্ডারে, ঐসব বাড়ীর লোকেদের কাজের লোকের সাহায্যে, পরপর দুইরাতে, কেউ টের পাওনের আগেই, এইসব চুরী করছে।
ইতিহাসে এমনটা আর হয়নাই।
আর এইটা যদি ইতিহাসে না হৈয়া থাকে, তাইলে তার পরের অংশটুকু ভবিষ্যতেও কখনো হৈবোনা।
মতি আর রহমান, সেই মাল, চোরের দলের কাছ থেইকা চুরী করছে তারপরের দিনই। একটু আগেই, কৈরা নিয়াসছে, আগে থেইকা ঠিক কৈরা রাখা যায়গায় লুকাইয়া রাখতে।

স্বাভাবিক বিচারে, মতি আর রহমানের কল্লা কালকাই উইড়া যাওনের কথা। চোরদের মাঝেও কিছু এথিকস আছে, তারা সেইগুলাও ভাঙ্গছে, যার যার দলের সাথে বেঈমানি করছে।

কিন্তু, কথা হৈলো, এইটা মতির ৩/৪ বছরের পরিকল্পনা। মতি বড়লোক হৈত চায়।
তাই সে নিজে চোরের দলে ঢুকছে, বলদা মামাতো ভাইরে ওর নিজের গ্রামের চোরের দলে ঢুকানের ব্যাবস্থা করছে আর ওরা যে ভাই ভাই, সেডা সফল ভাবে লুকাইতে পারছে।

মতি শুরুতে দলে ঢুকছে, হাত পাকাইছে স্বল্পতম সময়ে, কারন তার ছিলো বুদ্ধি আর এইম ইন লাইফ। পরিকল্পনা কৈরা প্রতিটা ধাপ আগাইছে সে। তারপর একসময় সে তার ওস্তাদ আসগরের ডাইন হাত হৈছে।
এই গেলো ৩ টা বছর সে পুরাপুরি একজন নিবেদিত সৎ চোর হিসেবে নিজের ইমেজ দাড় করাইছে।
তারপর আজ থেইকা ৮ মাস আগে তার ওস্তাদের মাথায় এই চুরীর প্ল্যান ঢুকাইছে।
পুরা চুরীর প্ল্যানটা সেই সাজাইছে আর ওস্তাদরে বুঝাইছে। শুধু, চুরী শেষে যে আরো একটা চুরীর প্ল্যান তার ছিলো, সেডা সে নিজের ভিত্রেই রাখছে।

তার এমন একজন লোক দরকার, যে কিনা সে বাইরে থাকা অবস্থায় খেয়াল রাখতে পারবো, চোরাই মালের উপরে, আর, একটু কৈরা পাচার করতে পারবো, সেই লোকটা হৈলো রহমান।

আজকে রাইতেই মতি পালাইবো এই আলীমপুর ছাইড়া।
সবাই জানবো, মতি চুরী কৈরা ভাগছে। রহমান থাকবো গেরামেই।

৩ গ্রামের ৪ টা চুরীর দল একসাথে, পরপর দুই রাতে যা চুরী করছে, মতি আর রহমান চোরের উপর বাটপারী কৈরা সেইগুলা নিয়া পলাইছে, চোরের আস্তানা থেইকা। এম্নিতে বিষয়টা এত সহজ হওনের কথা ছিলোনা, কিন্তু, মতি, তার সাথের চোরদের চাইতে, অনেক দূর ভাইবা রাখছে।

কতফিট যাওন লাগবো?
রহমান জিগায় মতিরে।

১০/১২ ফিট।
মতির উত্তর

অন্ধকারে মতির দিকে তাকাইয়া বুঝার চেষ্টা করে রহমান, ঠিক কৈতাছে, নাকি মশকরা করতাছে মতি। বুইঝা উঠতে পা পাইরা, জিগাইয়াই ফেলে,

এত দূর যাইয়া কি করুম?

যেম্নে কৈছে, কাম করতে থাক।

দুইজন মানুষ, ৩ সাড়ে ৩ ঘন্টার অমানুষিক পরিশ্রমে, ৮/১০ ফিট গর্ত কৈরা ফেলে।

এইবার বাক্স সব গুলা খুইলা, সব নতুন কৈরা সাজাইতে থাকে মতি, ভারী গয়না গুলান একটায়, পাথর ওয়ালা গুলান একটায় আর অন্যান্য জিনিষ সহ হালকা গয়না একটায়। সাথে দুইটা ছোট্টো পুটলিও বানাইছে, অল্প কিছু গয়না নিয়া একটাতে, আরেকটাতে সোনার লাঠির মত দেখতে কয়টা জিনিষ।
ভারী গয়নার বাক্স মাটির একদম নীচে রাইখা, এক প্রস্থ মাটি চাপা দিলো, প্রায় ৩ ফিটের মত, পাইয়া শক্ত করলো।তার পর পাথরের আর তারও পর হালকা গয়না রাইখা, মাটির কাছাকাছি রাখলো সোনার লাঠির পুটলি, তারপর মাটি চাপা দেয়া হৈলো আরেকটা পুটলি বাইরে রাইখাই।
ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝতাছে রহমান।
কেউ কোনো কারনে যায়গাটার খোঁজ পাইয়া ফেললেও, পুরাটা হাতছাড়া হওনের ভয় রৈলোনা আর। মতি হৈলো জাত চোর। নিজের চুরীর জিনিষ নিজে না পাইলে, আর কাউরে পুরাটা পাইতে দিবোনা।

একটা পুটলি নিয়া মতি আজ রাইতে গ্রাম তো গ্রাম, জেলা ছাইড়া যাইবো।
আর রহমান যাইবো নিজের ঘরে।
পরে, মাস ছয় বা বছর গুরলে, সব ঠান্ডা হৈলে, রহমান মাল বাইর করার ট্রাই করবো। সব মতির ঠিক করা।
রহমানরে শুধু, বেঁফাস কথা না কওনের লাইগা, চুরী ছাইড়া দিতে হৈবো, একটা বছর কষ্টের কামে ঢুকতে হৈবো। সেডাও, ক্যাম্নে কি করবো, মতি ঠিক কৈরা দিয়া গেছে।

তারা যেই জায়গাটা ঠিক করছে, সেডা গ্রামের প্রায় বাইরে, ক্ষেত যেইখানে শেষ হৈছে, তার পরে একটা ময়লা ফেলার মত জায়গা, কেউ আসে টাসে না এই দিকে। যেইখানে তারা মাটি খুঁড়ছে, তার ঠিক দশ পা সাম্নে, একটা কাফিলা গাছের পেটের কাছে একটা মোটা ডাইল ভাইঙ্গা গিয়া, কিছু কষ বাইর হৈছিলো এককালে। এখন শুকাইয়া গেছে।
সেই গাছটার গায়ে টর্চের আলো ফেলতেই, মনে হৈলো, একটা বুড়া বেডা মুখটা একটা কোণা কৈরা ভ্যাচকাইতাছে---ভাঙ্গা ডাইলে কষের দাগ এরম নক্সা বানাইছে।

ফেরার সময় হৈলো চোরেদের।
একবার সব দেইখা শুইনা, এইখান থেইকা বিদায় নিলো মতি আর রহমান।
পিছনে রৈলো, কয়েকরাজার ধন।
মতি দেশ ছাড়া হৈলো, আর রহমান বাড়ি ফিরলো।

তখন কি আর রহমান জানতো, বাড়ী গিয়া সে তার মায়রে মৃত্যূ শয্যায় দেখবো, আর তার মা তারে চোরাই জিনিষ ব্যাবহার না করার কসম দিয়া যাইবো মরনের কালে?

গল্প: ২:

খালাতো ভাইয়ার মেয়েটার অসুখ লেগেই আছে জন্মের পর থেকেই। দের বছর বয়স, কিন্তু দেখলে মনে হয় ৫/৬ মাসের বাচ্চা। কত রকম ডাক্তার, এ্যলোপ্যাথী হোমিওপ্যাথী করা হলো, কিন্তু অসুখ ছাড়ছে না।
তাই, ভাই মানত করেছিলো, সব বড় বড় পীর আউলিয়াদের কাছে দোয়া চেয়ে আসবে। সেইজন্য গেলো দেড়মাস ভাইয়া চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা করে বেড়িয়েছে।
আমিও মাঝে মাঝেই সাথে গিয়েছি।
এখন কেউ যদি বলে, অমুক যায়গার পীরের খুব শক্তি, তাহলে সেইখানে ছুটে ভাইয়া, আবার যদি বলে, তমুক যায়গার পীর অসুখ বিসুখের তদবীরের জন্য সেরা, সেইখানেও ছুটে যায়।

সেদি আমরা গেলাম, সোনা পীরের মাজারে।
ছোটোখালা খবর এনেছেন, প্রতন্ত্য অঞ্চলের এই পীরের কেরামতির খবর। সোনা পীরের দরবারে মানত করে, পোকায় ধরা আস্ত বাগান বাঁচানো কিংবা পুরো গ্রামের চিটা ধানের সুস্থ্য সবল হবার ঘটনা শুনে আমরা বুঝতে পারি, এই আমাদের সেই পীর।

মাজার পর্যন্ত যেতে কোনো কষ্ট হয়না, পুরোটাই রাস্তা করে দেয়া, সমতল মজবুত ইটের রাস্তায় গাড়ির কোনো সমস্যা হয়না। যদিও, গ্রামের লোক গুলো, মাজারের ব্যাপারে একটু উদাসীন দেখলাম।
যতদূর বুঝতে পারলাম, মামুলী কোনো সমস্যা সমসাধানে, সোনা পীর খুব একটা আগ্রহী না। তাই গ্রামের লোকের পাঁচড়া কিংবা গাছে লাউ না ধরা বিষয়ক সমস্যার সমাধানের জন্য, মাজারে গিয়ে বিফল হয়ে আগ্রহ হারিয়েছে কিছুটা।
যদিও.....

আমরা মাজারের গেটে নামতে, কাউকে এগিয়া আসতে দেখিনি শুরুতেই, অন্যান্য ছোটো মাজারের খাদেমদের মত।
বোঝা যায়, এই মাজার কালে অনেক বড় হয়ে উঠবে।

মাজার চত্বর মাটির উঠোন। সেই উঠনের বায়ে পাকা মশজিদ আর ডানে মাঝারি রকমের বড় টিনের চালা ঘরে নানা রকম আয়োজন।

আমরা মশজিদে ঢুকে আনাড়ীর মত শুরুতেই কবর জিয়ারতে চলে যেতে চাইলে পরে একজন এগিয়ে আসে প্রথম বারের মতন।
একজন খাদেম। বাদমী গায়ের রঙে, পুরুষ্ট ঠোঁটে জানতে চাইলেন:

আপনেরা কি কোনো আর্জি নিয়া আসছেন?

জি হুজুর, হাত কচলে জবাব দেয় আমার ভাই। আমরা মাজারের সবাইকে যথেষ্ট সন্মান করতে জানি।
মাজার ঘুরে ঘুরে, কম তো আর অভিজ্ঞতা হয়নি।

তো, আর্জি জমা দিছেন?
আবাররো জানতে চেয়েছিলো খাদেম হুজুর।

আমরা ব্যাপারটা জানতাম না, এই মাজারে আগে আর্জি পেশ করতে হয়, পরে জিয়ারতে বা মানত করতে যেতে হয়।

ও, বলা হয়নি মনে হয়।

তো, কি করতে হবে জানতে চাইতেই, হুযুর বললেন,

আগে আপনাদের কে মেজো হুযুরের কাছে আর্জি জমা দিতে হবে। সেইটা মেজো হুযুর পেশ করবেন বড় হুযুর, মাওলানা সোখেন নাখশবী আল রহমান বাবাজীর কাছে।
উনি যদি মনে করেন, আপনাদের আর্জি আর মানত গ্রহন যোগ্য, তবে আপনারা সরাসরি পাক হুযুর, সোনা পীর ইনতিখাব নাখশবী আল মতিনূঊর বাবাজীর মাজারে গিয়ে দোয়া মাঙ্গতে পারবেন, বড় হুযুরের ডাইরেক্ট তত্বাবধানে।
এই প্রক্রিয়া হুযুরের নিজের বেছে নেয়া বলে, এর অন্যথায়, আপনাদের মানত পূর্ন হবেনা।

আমরা দূর থেকে গিয়ে ছিলাম। বার বার যাওয়াটা অনেক ঝক্কির ব্যাপার, এইসব কথা খাদেম হুযুর কে ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম।
সোনা পীরের মাজারের হুযুরদের দয়ার দিল।
উনি আমাদের সমস্যাটা বুঝতে পারলেন।
খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
বললেন,
একটা প্রক্রিয়া আছে, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে, মানৎএর পুরোটাই আজকে দিতে হবে, আর এর পরিমান নির্ধারন করবেন, স্বয়ং বড় হুযুর।
কিন্তু বড় হুযেরের দেখা পাওয়াটা তো এক বিশাল সৌভাগ্য। তাই কিছুই বলা যায়না।
তবে, এই সপ্তাহে, উনি সবার সাথে টুকটাক কথা বলছেন, হুযুরের পীরের সাথে কথা বলেছেন গেলো পুরা একটা সপ্তাহ।
মনে হয় এই সপ্তাহে আর বলবেন না।

আমরা বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম,

উনি গেলো এক সপ্তাহ কার সাথে আলাপ করেছেন?

খাদেম হুযুর বিরক্ত হয়ে বললেন

আরে, আপনারা কি কিছু না জেনেই এসেছেন নাকি?
আমাদের বড় হুযুর, আজ থেকে ১০ বছর আগে, স্বপ্নে আমাদের পীরে মুরশিদ সোনা পীর ইনতিখাব নাখশবী আল মতিনূঊর বাবাজীর সাক্ষাৎ পান।
বড় হুযুর আগে ছিলেন একজন, ভিক্ষুক সেবক।
কিন্তু স্বপ্নে পীর সাহেব বললেন, বেটা, তুই অমুক যায়গায় (এইযায়গায়) গিয়ে, আমার মাজার গড়বি।
ভিক্ষুক হয়ে দ্বীনের সেবা করতে চাইলে, তুই মানুষের উপকারে আসবিনা, শুধু নিজের উপকারে আসবি।
তুই নিজের উপকারের সাথে, অন্য বান্দাদেরও যথাবিহীত সাহায্য করবি।

এর পর থেকে বড় হুযুর হুযুরে পীরের আশেক।

উনি এলাকাবাসীকে বললেন, এইখানে হবে সোনা পীরের মাজার।
উনি সবাইকে নিঁখুত নিশানা দেখাইলেন, যে, কি করে তিনি এইখানেই সোনা পীরকে খুঁজে পাবেন।
তারপর থেকে, উনি আমাদের, ওনার খেদমতদারদের, ওনার ভক্ত দের দো জাহানের মুক্তির জন্য, নেয়ামতের জন্য, হুযুরে পীরে সোনা বাবাজীর খেদমতে নিয়মিত হাজির হন, মারাফতের অন্য স্তরে।
সুবহান আল্লাহ।

শুনে আমাদের গায়ের রোম দাড়িয়ে গেলো, রোম কুপের ভেতর থেকে ভক্তি চুঁইয়ে পড়তে লাগলো।

আমার ভাইয়ের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

আমরা বুঝে গেলাম, এই হুযুরই পারেন।
এর পর খাদেম হুযুর, হুযুরের চমৎকারিত্বের আরো যা বর্ননা দিলেন ,তাতে আর কোনো সন্দেহই রৈলো না।

এমন সময় হালকা রুপালী জরির লাইনিং দেয়া, ঘিয়ে রংয়ের একটি আলখোল্লা পরিহিত, সুকান্তি নধর একজন হুযুর এগিয়ে এলেন।
ওনার চেহারায় নুরানী জেল্লা, খাদেম হুযুরের চাইতেও বেশি।
আমাদের বুঝতে বাকী রৈলো না, ইনিই বড় হুযুর।
আমাদের কি সৌভাগ্য!!!!!

খাদেম যখন তার হাতে চুম্বন করলেন, আমরাও মনে আর চোখে আশা নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম, যেনো, আমাদেরকেও হস্ত চুম্বনের সুযোগ দেয়া হয়।
উনি মনে হয় অন্তর্যামী, উনি বুঝলেন। স্মিত হেসে বাড়িয়ে দিলেন বা হাঁত।
হাতের মধ্যমায় বিশাল আকারের একটি আংটি, হস্ত চুম্বনে বাঁধা হতে পারলো না।

যখন খাদেম জানালেন, উনি মেজো হুযুর, আমাদের বিষ্ময়ের সীমা রইলো না।
মেঝো হুযুরই এমন দিব্য কান্তি!!
বড় হুযুর কেমন হবেন??

তখন খাদেম হুযুর মেজো হুযুর কে আমাদের মনোবাসনা খুলে বলতে দুশ্চিন্তার একটা ছোট রেখা পড়লো হুযুরের কপালেও।
বললেন,
আজ তো মনে হয় পারবেন না আপনারা।
এইখানে কেবল, সোনা স্বর্ণ মানত করা যায়।
কম হোক আর বেশি, আপনাকে স্বর্ণ মানত করতে হবে।

এটা আমাদের জন্য নতুন।
আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
ভাইয়া তার বিয়ের আংটির দিকে তাকালেন।
মেজো হুযুর বললেন,

নানা, বহু ব্যাবহৃত স্বর্ন নয়, আপনাকে নতুন একটু কিছু দিতে হবে। পরিমানে খুবই সামান্য হলেও।
আর, আপনার বিবির পেয়ারের জিনিষ আমরা নেবো কেনো?
আমরা মানুষের মহব্বতের মর্ম জানি।
মহব্বতই তো দুনিয়া।
এইযে আমাদের হুযুর, বাবা পীরে হুযুরের মহব্বতের টানে এখানে এসেছেন।
আর আপনি যদি মহব্বত না করে হুযুর কে কিছু মানৎ করেন, তবে আপনার মনো বাসনাও পূর্ণ হবেনা।

ভাইয়ার মুখে একই সাথে সস্থি আর আশংকা দেখা গেলো।

আমি এগিয়ে গেলাম,
বললাম,
হুযুর, যদি মানতকৃত স্বর্ণের সম পারিমান টাকা দেই...?

হুযুর মনে হলো একটু মনোক্ষূন্ন হলেন।
বললেন ,এটা শুধুই বড় হুযুরের এখতিয়ারে।

অতএব, আমরা চললাম, বড় হুযুরের আসনে।
মশজিদের পিছনে ছোট্ট একটা ঘর বড় হুযুরের জন্য, তার পরই মাজার। সোনা পীরের মাজার।
সেইখানে গিয়ে, মেজো হুযুর আগে গেলেন, তার ক্ষানিক পরে খাদেম হুযুর।
তারও আধা ঘন্টা পর, আমাদের ডাক পড়লো।

ঘরের ভেতর আধো অন্ধকার আধো আলো প্রায় অন্ধকারের দিকেই।
সুগন্ধী ধোয়ায় আচ্ছন্ন না হলেও, পরিমিত মাত্রার যেনো একদম সব কিছু।
অতি সামান্য ধোঁয়া।
আর ঘরের ঐ পাশের দরজা দিয়ে আলো আসছে, সরাসরি মাজারের পাথরের বেদীর পেট ছুঁয়ে।
যেনো, মাজারের আলোয় আলোকিত বড় হুযুরের ঘর...
আর হুযুর, পীরের আশেকে, ধ্যানে বসে থাকত থাকতে যদিও প্রায় বিশাল আকৃতি ধারন করেছেন, কিন্তু তার চকচকে গালের উপর বসানৈ ভাসান চোখ দুটিতে যেনো, উপচে পরা স্নেহ আর ঘোর।
এক এক অসামান্য ঘোর।

বড় হুযুর কথা বলেন খুব আস্তে।
কিন্তু যেনো মাটির মানুষ।
শুদ্ধ ভাষা নয়।
একদম মাটির কাছাকাছি, কিংবা আকাশের কাছাকাছি মানুষের ভাষা।
আমাদের গায়ের পশম এবার কাঁটা দিয়ে দাঁড়িয়েই রৈলো, বাড়ী ফেরার আগ পর্যন্ত আর নামেইনি।
বড় হুযুর বললেন, তোদের কথা শুনছিরে।
নিয়ম ভাঙ্গা ঠিক না, কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়ের কষ্টে আমার চোখে পানি চৈলা আসছে।
আমি জানি, আমার নিয়ম ভাঙ্গার কারনে, বাবা পীর মুরশিদ সোনা ইনতিখাব নাখশবী আল মতিনূঊর (বলে উনি ডান হাত টাকে বুকে লাগিয়ে, তারপর মুখে চুমু খেলেন, ডান হাত কে, এমন পরপর তিনবার----ওনার পরপরই মেজো হুযুর আর খাদেম হুযুর ও এমন করলেন, দেখাদেখি আমরাও। বুঝলাম, এটা পীর বাবার জন্য সন্মানার্থে)
আমার উপর খুব নাখোস হৈবো, কিন্তু আমি যখন নান্না বাচ্চাটার কথা বুঝাইয়া কমু, তখন তার দিলে রহম হৈবৈ।

আমরা সস্থির নিশ্বাস ফেললাম।

বড় হুযুর, আমাদের জন্য মানৎ এর হাদিয়া, ২১১১১ টা নির্ধারন করলেন।
ভাইয়া খুশি মনে রাজী হলেন।
এ এক পরম পাওয়া।
এর পরে আমার ভাতিজি সুস্ত্য না হয়ে পারেই না।
যদি নাও হয়, বুঝতে হবে, সেটা আমাদের, বড়দের পাপের ফল।
আর কিছু হবার ছিলো না।

এর পর আমরা অযু করে (যদিও আগেই করা ছিলো, কিন্তু বড় হুযুরের পাশে বসে অযু করাও সোয়াবের কাজ) আমরা গেলাম মাজারের পাশে।
সুরা-কালাম পরে হুযুরের সাথে দুআ করলাম।
এর পর খাদেম আর আর মেজো হুযুর, আমাকে আর ভাইয়াকে নিয়ে গেলেন কবরের পাথরের আবরনের দুই প্রান্তে, আমাকে গিলাপ উঁচিয়ে খাদেম হুযুর ভেতরে নিয়ে, মাজারের পাথরের আরবী খোদাই হরফের গায়ে হাত দিয়ে মানৎ করালেন---

খাদেম হুযুর বললেন: আমার সাথে সাথে বলেন: আমি
আমি বললাম আমি:
হুযুর বললেন: এই মাজারের পবিত্র পাথর ছুঁয়ে
আমি বললাম: এই মাজারের পবিত্র পাথর ছুঁয়ে
হুযুর বললেন:আমার ভাতিজির সুস্থ্যাতার আবদার জানিয়ে
আমি বললাম:আমার ভাতিজির সুস্থ্যাতার আবদার জানিয়ে
হুযুর বললেন:দেড় ভরি স্বর্নের সমমূল্যের সমান, ২১১১১ টাকা
আমি বললাম:দেড় ভরি স্বর্নের সমমূল্যের সমান, ২১১১১ টাকা
হুযুর বললেন:দান করার নিয়ত করলাম
আমি বললাম:দান করার নিয়ত করলাম
হুযুর বললেন:আমিন
আমি বললাম:আমিন

আহ, আমার বুকটা আনন্দে ভরে গেলো। ভাইয়াও নিশ্চিৎ তাই।
আমাদের মনে হলো, আমাদের মেয়েটা সুস্থ্য হয়ে গেছে।

পরে অবশ্য একটু কনফিউশন হয়ে ছিলো, কারন আমি আর ভাইয়া আলাদা ভাবে মানৎ করায়, টাকাটা নাকি ডাবল দিতে হবে, জনপ্রতি ২১১১১ টাকা।
তবে বড় হুযুর জানালেন, আমার যেহেতু দূরের সম্পর্ক, সেহেতু আমাকে কিছুদিন পরে দিলেও চলবে।
আমি অবশ্য পরের দিনই টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলাম।
আমি আর ভাইয়া গিলাপ থেকে বের হয়ে, মাজার কে সন্মান দেখিয়ে একটু ঝুঁকে, পুরোটা সময় অবশ্যই মাজারের দিকে কখনই পিছন না ফিরে, বের হয়ে আসি।
বের হয়ে আসতে আসতে চোখ তুলে দেখি, একটা বিশাল কাফিলা গাছের মাঝের দিকের এটা ডাল ভাঙ্গা, ভাঙ্গা অংশটার দিকে টাকাতেই মনে হলো, একটা বুড়ো, ঠোঁটে একটা কোনাচে হাসি নিয়ে ভেংচি কাটছে।
এও নিশ্চিৎ কোনো কুদরত।
নাইলে মানুষের মুখের আদল হবে কেনো?
হয়তো কোনো শয়তান, কোনো কালে হুযুরের সাথে বেয়াদপী করে, এমনটায় পরিনত হয়েছে।

আমরা দিলে শান্তি নিয়ে চলে আসলাম।
পরদিন যখন আবার টাকা দিতে যাই আমি একা, তখন শুনেছিলাম, বড় হুযুর, তার যৌবন কালে, কেমন করে লোকজনকে জানিয়েছিলেন, ঐখানটাতেই সোনা পীরের মাজার।
উনি মাটি খুঁড়ে দেখিয়ে ছিলেন, ঐখানে সব স্বর্নের লাঠির একটা পুটলি।
হুযুর হাড় গুলো, স্বর্নের লাঠিতে রুপান্তরিত হয়েছিলো, আর জায়গা কম নেয়ার জন্য, কাফনের কাপড় টাও, গুটিয়ে গিয়েছিলো। সেই স্বর্ন লাঠি গুলোই এখন মাজারে শয়িত।

নি:সন্দেহে চকমপ্রদ।
সোনা পীরের কেরামতির কি নমুনা।


ও, প্রথম গল্পের শেষ অংশ:

রহমান চোরা, তার মায়ের মৃত্যূ শজ্যার প্রতিজ্ঞ্যা করে, সে চোরাই মাল ব্যাবহার করবোন।
তাই, সে সেই মাল, মতিরে আর পাঠায় নাই।
কিন্তু রহমান চায়নাই, সে নিজে না পাইলে, মতিরেও নিতে দিবেনা ঐ মাল।
কোনো চোর কখনো চায় না। মতি চোরা হৈলেও চাইতো না।
কিন্তু মতি ফেরৎ আসলে ক্যাম্নে ঠেকাবে রহমান?
তার কুটবুদ্ধির সাথে পারার মত কি বুদ্ধি বের করা যায়?
রহমান ভাবছে আর ভাবছে---
সারারাত ভাবছে----
ভাবছে আর ভাবছে---
কোনো বুদ্ধি তার মাথায় আসলে, সে গঞ্জের পীরের মাজারে ২০০ টাকা মানৎ করছে..
তারপরে ভাবছে....
অনেক ভাবছে...

গল্প ১:

ঘুট ঘুইট্যা আন্ধারের মাঝে খালি দুই জোড়া সাদা সাদা গোল গোল চোখ চরকির মত ঘুরতাছে।

শালার মায়রে বাপ!

শীতকালের শুকনা নাড়ায় পা পৈড়া জ্বালা কৈরা উঠতে খ্যাচ কৈরা উঠে রহমান।
মতির সাদা চোখ দুইটা কেবল একটু পিছনে ফিরা রহমানরে দেখে, আর কিছু কয়না। চোররে আস্তে কথা কওনের কথা শিখানের দরকার হয়না, সেডা জানে।

বিড়ি একটা ধরাই, কি কস?
আবারো ফিসফিসায় রহমান।

মতি কিছু কয়না। রহমান অবশ্য কিছু মনে করেনা। জানে হ কৈতে হৈলে মতি একটা ঘোঁৎ করতো, না হৈলে চুপ।
যদিও আজকে প্রথমবারের মত তারা আজকে একসাথে চুরী করতাছে। তবে কিনা আজকের টা রাজচুরি।!!
রাজচুরী বলে রাজচুরী!!
মনে হৈতেই রহমানর ঘাম শুরু হয় আবার।
অত্র এলাকায়, চুরীর ইতিহাসে, এমন ঘটনা ঘটেনাই!! কোনো এলাকাতেই কি ঘটছে?
বুদ্ধিটা মতির।
রহমানের মাথায় এত বুদ্ধি আসবার নয়।

মতি, আর তো বেশিক্ষন না, না? উসখুশ করতেই থাকে রহমান। এত বড় চুরীর পরে, স্নায়ু ঠিক রাখতে হিমশিম খাইতে হৈতাছে। এডা তো আর চোর পুলিশ খেলা না। সারাজীবনের দাও মারা হৈছে, সারা জীবনের শত্রুতা কিন্না।

আলীমপুরের আশে পাশের ৫০/৬০ মাইলের সব বড়লোকের বাড়িতে অনেক বছর গল্প চলবে, এই চুরীর, গল্প চলবে আরো অনেকের মাঝেও। অন্তত পুরা ঘটনা টা প্রকাশ পাইলে, গল্পের চাইতেও আরো কিছু চলবে।
একদল লোক কুত্তার মত খুঁইজা বেড়াইবো আরেকদল লোকেরে।

ঘোঁৎ কৈরা শব্দ করে মতি, অন্ধকারে ভারী বোঝা নিয়া প্রায় হুমড়ি খাইয়া পড়ে হাড়জিরজিরে রহমান, মতির ঘাড়ে। শুকনা নাড়া পাড়াইয়া, এতখানি হাঁইটা আইসা একটু কাহিল রহমান। এমনিতে চোরেরা কষ্ট সৈহ্য করতে পারে বেশুমার, চুরীর জিনিষও সটকাইতে পারে ওজনদার। কিন্তু আজকে হৈলো স্নায়বিক উত্তেজনা।
তাই হাঁপাইয়া গেছে রহমান।

মতি আস্তে কৈরা জনায়:

এইখানেই।

রহমান অন্ধকারে মতির মুখের ভাব বুঝার চেষ্টা করে। আরেকবার বিড়ি ধরানের কথা কৈয়া দেখবো? বুকটা হুতাশ হুতাশ লাগে, এতক্ষন বিড়ি না খাইলে।
কিন্তু ঠিক বুইঝা উঠতে পারেনা।
মতি বৈসা পৈড়া নিজেই একটা বিড়ি ধরাইলে খুশি হৈয়া যায় রহমান।
নিজেও বৈসা, মতির মতই আগুন লুকাইয়া একটা বিড়ি ধরাইয়া, গফ শুরু করার জন্য আঁ.. কৈরা উঠতেই,
"হুফ" কৈরা থামাইয়া দেয় মতি।
দুইজনে নিরিবিলি বিড়ি টানে বৈসা কতক্ষন

মতি যখন একটা বড় কৈরা শ্বাস ছাড়ে, রহমান বুঝতে পারে, এইবেলা সহজ হৈয়া দুইটা কথা কওয়া যাইবো।

মতি, এখনি শুরু করুম কুপানি?


হ, আস্তে ধীরে শুরু করি চলো।

দুইজনে মাটি গর্ত করার জিনিষ পাতি বাইর করে, রহমানের ঝোলা থেইকা, আর বড় সড় ৩ টা বাক্স!
কত টাকার জিনিষ হবে ভিতরে, দুইজনের কারোই আন্দায নাই।
আশে পাশের ৫০/৬০ মাইলের যত বড়লোক আছে, সংখ্যায় ৬৭ টা বাড়ি, ঐসব বাড়ী থেইকা করা চুরীর মালের সব সোনা গয়না গুলা এইখানে।

৩ গ্রামের ৪ টা চুরীর দল, মতির ওস্তাদের আন্ডারে, ঐসব বাড়ীর লোকেদের কাজের লোকের সাহায্যে, পরপর দুইরাতে, কেউ টের পাওনের আগেই, এইসব চুরী করছে।
ইতিহাসে এমনটা আর হয়নাই।
আর এইটা যদি ইতিহাসে না হৈয়া থাকে, তাইলে তার পরের অংশটুকু ভবিষ্যতেও কখনো হৈবোনা।
মতি আর রহমান, সেই মাল, চোরের দলের কাছ থেইকা চুরী করছে তারপরের দিনই। একটু আগেই, কৈরা নিয়াসছে, আগে থেইকা ঠিক কৈরা রাখা যায়গায় লুকাইয়া রাখতে।

স্বাভাবিক বিচারে, মতি আর রহমানের কল্লা কালকাই উইড়া যাওনের কথা। চোরদের মাঝেও কিছু এথিকস আছে, তারা সেইগুলাও ভাঙ্গছে, যার যার দলের সাথে বেঈমানি করছে।

কিন্তু, কথা হৈলো, এইটা মতির ৩/৪ বছরের পরিকল্পনা। মতি বড়লোক হৈত চায়।
তাই সে নিজে চোরের দলে ঢুকছে, বলদা মামাতো ভাইরে ওর নিজের গ্রামের চোরের দলে ঢুকানের ব্যাবস্থা করছে আর ওরা যে ভাই ভাই, সেডা সফল ভাবে লুকাইতে পারছে।

মতি শুরুতে দলে ঢুকছে, হাত পাকাইছে স্বল্পতম সময়ে, কারন তার ছিলো বুদ্ধি আর এইম ইন লাইফ। পরিকল্পনা কৈরা প্রতিটা ধাপ আগাইছে সে। তারপর একসময় সে তার ওস্তাদ আসগরের ডাইন হাত হৈছে।
এই গেলো ৩ টা বছর সে পুরাপুরি একজন নিবেদিত সৎ চোর হিসেবে নিজের ইমেজ দাড় করাইছে।
তারপর আজ থেইকা ৮ মাস আগে তার ওস্তাদের মাথায় এই চুরীর প্ল্যান ঢুকাইছে।
পুরা চুরীর প্ল্যানটা সেই সাজাইছে আর ওস্তাদরে বুঝাইছে। শুধু, চুরী শেষে যে আরো একটা চুরীর প্ল্যান তার ছিলো, সেডা সে নিজের ভিত্রেই রাখছে।

তার এমন একজন লোক দরকার, যে কিনা সে বাইরে থাকা অবস্থায় খেয়াল রাখতে পারবো, চোরাই মালের উপরে, আর, একটু কৈরা পাচার করতে পারবো, সেই লোকটা হৈলো রহমান।

আজকে রাইতেই মতি পালাইবো এই আলীমপুর ছাইড়া।
সবাই জানবো, মতি চুরী কৈরা ভাগছে। রহমান থাকবো গেরামেই।

৩ গ্রামের ৪ টা চুরীর দল একসাথে, পরপর দুই রাতে যা চুরী করছে, মতি আর রহমান চোরের উপর বাটপারী কৈরা সেইগুলা নিয়া পলাইছে, চোরের আস্তানা থেইকা। এম্নিতে বিষয়টা এত সহজ হওনের কথা ছিলোনা, কিন্তু, মতি, তার সাথের চোরদের চাইতে, অনেক দূর ভাইবা রাখছে।

কতফিট যাওন লাগবো?
রহমান জিগায় মতিরে।

১০/১২ ফিট।
মতির উত্তর

অন্ধকারে মতির দিকে তাকাইয়া বুঝার চেষ্টা করে রহমান, ঠিক কৈতাছে, নাকি মশকরা করতাছে মতি। বুইঝা উঠতে পা পাইরা, জিগাইয়াই ফেলে,

এত দূর যাইয়া কি করুম?

যেম্নে কৈছে, কাম করতে থাক।

দুইজন মানুষ, ৩ সাড়ে ৩ ঘন্টার অমানুষিক পরিশ্রমে, ৮/১০ ফিট গর্ত কৈরা ফেলে।

এইবার বাক্স সব গুলা খুইলা, সব নতুন কৈরা সাজাইতে থাকে মতি, ভারী গয়না গুলান একটায়, পাথর ওয়ালা গুলান একটায় আর অন্যান্য জিনিষ সহ হালকা গয়না একটায়। সাথে দুইটা ছোট্টো পুটলিও বানাইছে, অল্প কিছু গয়না নিয়া একটাতে, আরেকটাতে সোনার লাঠির মত দেখতে কয়টা জিনিষ।
ভারী গয়নার বাক্স মাটির একদম নীচে রাইখা, এক প্রস্থ মাটি চাপা দিলো, প্রায় ৩ ফিটের মত, পাইয়া শক্ত করলো।তার পর পাথরের আর তারও পর হালকা গয়না রাইখা, মাটির কাছাকাছি রাখলো সোনার লাঠির পুটলি, তারপর মাটি চাপা দেয়া হৈলো আরেকটা পুটলি বাইরে রাইখাই।
ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝতাছে রহমান।
কেউ কোনো কারনে যায়গাটার খোঁজ পাইয়া ফেললেও, পুরাটা হাতছাড়া হওনের ভয় রৈলোনা আর। মতি হৈলো জাত চোর। নিজের চুরীর জিনিষ নিজে না পাইলে, আর কাউরে পুরাটা পাইতে দিবোনা।

একটা পুটলি নিয়া মতি আজ রাইতে গ্রাম তো গ্রাম, জেলা ছাইড়া যাইবো।
আর রহমান যাইবো নিজের ঘরে।
পরে, মাস ছয় বা বছর গুরলে, সব ঠান্ডা হৈলে, রহমান মাল বাইর করার ট্রাই করবো। সব মতির ঠিক করা।
রহমানরে শুধু, বেঁফাস কথা না কওনের লাইগা, চুরী ছাইড়া দিতে হৈবো, একটা বছর কষ্টের কামে ঢুকতে হৈবো। সেডাও, ক্যাম্নে কি করবো, মতি ঠিক কৈরা দিয়া গেছে।

তারা যেই জায়গাটা ঠিক করছে, সেডা গ্রামের প্রায় বাইরে, ক্ষেত যেইখানে শেষ হৈছে, তার পরে একটা ময়লা ফেলার মত জায়গা, কেউ আসে টাসে না এই দিকে। যেইখানে তারা মাটি খুঁড়ছে, তার ঠিক দশ পা সাম্নে, একটা কাফিলা গাছের পেটের কাছে একটা মোটা ডাইল ভাইঙ্গা গিয়া, কিছু কষ বাইর হৈছিলো এককালে। এখন শুকাইয়া গেছে।
সেই গাছটার গায়ে টর্চের আলো ফেলতেই, মনে হৈলো, একটা বুড়া বেডা মুখটা একটা কোণা কৈরা ভ্যাচকাইতাছে---ভাঙ্গা ডাইলে কষের দাগ এরম নক্সা বানাইছে।

ফেরার সময় হৈলো চোরেদের।
একবার সব দেইখা শুইনা, এইখান থেইকা বিদায় নিলো মতি আর রহমান।
পিছনে রৈলো, কয়েকরাজার ধন।
মতি দেশ ছাড়া হৈলো, আর রহমান বাড়ি ফিরলো।

তখন কি আর রহমান জানতো, বাড়ী গিয়া সে তার মায়রে মৃত্যূ শয্যায় দেখবো, আর তার মা তারে চোরাই জিনিষ ব্যাবহার না করার কসম দিয়া যাইবো মরনের কালে?

গল্প: ২:

খালাতো ভাইয়ার মেয়েটার অসুখ লেগেই আছে জন্মের পর থেকেই। দের বছর বয়স, কিন্তু দেখলে মনে হয় ৫/৬ মাসের বাচ্চা। কত রকম ডাক্তার, এ্যলোপ্যাথী হোমিওপ্যাথী করা হলো, কিন্তু অসুখ ছাড়ছে না।
তাই, ভাই মানত করেছিলো, সব বড় বড় পীর আউলিয়াদের কাছে দোয়া চেয়ে আসবে। সেইজন্য গেলো দেড়মাস ভাইয়া চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা করে বেড়িয়েছে।
আমিও মাঝে মাঝেই সাথে গিয়েছি।
এখন কেউ যদি বলে, অমুক যায়গার পীরের খুব শক্তি, তাহলে সেইখানে ছুটে ভাইয়া, আবার যদি বলে, তমুক যায়গার পীর অসুখ বিসুখের তদবীরের জন্য সেরা, সেইখানেও ছুটে যায়।

সেদি আমরা গেলাম, সোনা পীরের মাজারে।
ছোটোখালা খবর এনেছেন, প্রতন্ত্য অঞ্চলের এই পীরের কেরামতির খবর। সোনা পীরের দরবারে মানত করে, পোকায় ধরা আস্ত বাগান বাঁচানো কিংবা পুরো গ্রামের চিটা ধানের সুস্থ্য সবল হবার ঘটনা শুনে আমরা বুঝতে পারি, এই আমাদের সেই পীর।

মাজার পর্যন্ত যেতে কোনো কষ্ট হয়না, পুরোটাই রাস্তা করে দেয়া, সমতল মজবুত ইটের রাস্তায় গাড়ির কোনো সমস্যা হয়না। যদিও, গ্রামের লোক গুলো, মাজারের ব্যাপারে একটু উদাসীন দেখলাম।
যতদূর বুঝতে পারলাম, মামুলী কোনো সমস্যা সমসাধানে, সোনা পীর খুব একটা আগ্রহী না। তাই গ্রামের লোকের পাঁচড়া কিংবা গাছে লাউ না ধরা বিষয়ক সমস্যার সমাধানের জন্য, মাজারে গিয়ে বিফল হয়ে আগ্রহ হারিয়েছে কিছুটা।
যদিও.....

আমরা মাজারের গেটে নামতে, কাউকে এগিয়া আসতে দেখিনি শুরুতেই, অন্যান্য ছোটো মাজারের খাদেমদের মত।
বোঝা যায়, এই মাজার কালে অনেক বড় হয়ে উঠবে।

মাজার চত্বর মাটির উঠোন। সেই উঠনের বায়ে পাকা মশজিদ আর ডানে মাঝারি রকমের বড় টিনের চালা ঘরে নানা রকম আয়োজন।

আমরা মশজিদে ঢুকে আনাড়ীর মত শুরুতেই কবর জিয়ারতে চলে যেতে চাইলে পরে একজন এগিয়ে আসে প্রথম বারের মতন।
একজন খাদেম। বাদমী গায়ের রঙে, পুরুষ্ট ঠোঁটে জানতে চাইলেন:

আপনেরা কি কোনো আর্জি নিয়া আসছেন?

জি হুজুর, হাত কচলে জবাব দেয় আমার ভাই। আমরা মাজারের সবাইকে যথেষ্ট সন্মান করতে জানি।
মাজার ঘুরে ঘুরে, কম তো আর অভিজ্ঞতা হয়নি।

তো, আর্জি জমা দিছেন?
আবাররো জানতে চেয়েছিলো খাদেম হুজুর।

আমরা ব্যাপারটা জানতাম না, এই মাজারে আগে আর্জি পেশ করতে হয়, পরে জিয়ারতে বা মানত করতে যেতে হয়।

ও, বলা হয়নি মনে হয়।

তো, কি করতে হবে জানতে চাইতেই, হুযুর বললেন,

আগে আপনাদের কে মেজো হুযুরের কাছে আর্জি জমা দিতে হবে। সেইটা মেজো হুযুর পেশ করবেন বড় হুযুর, মাওলানা সোখেন নাখশবী আল রহমান বাবাজীর কাছে।
উনি যদি মনে করেন, আপনাদের আর্জি আর মানত গ্রহন যোগ্য, তবে আপনারা সরাসরি পাক হুযুর, সোনা পীর ইনতিখাব নাখশবী আল মতিনূঊর বাবাজীর মাজারে গিয়ে দোয়া মাঙ্গতে পারবেন, বড় হুযুরের ডাইরেক্ট তত্বাবধানে।
এই প্রক্রিয়া হুযুরের নিজের বেছে নেয়া বলে, এর অন্যথায়, আপনাদের মানত পূর্ন হবেনা।

আমরা দূর থেকে গিয়ে ছিলাম। বার বার যাওয়াটা অনেক ঝক্কির ব্যাপার, এইসব কথা খাদেম হুযুর কে ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম।
সোনা পীরের মাজারের হুযুরদের দয়ার দিল।
উনি আমাদের সমস্যাটা বুঝতে পারলেন।
খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
বললেন,
একটা প্রক্রিয়া আছে, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে, মানৎএর পুরোটাই আজকে দিতে হবে, আর এর পরিমান নির্ধারন করবেন, স্বয়ং বড় হুযুর।
কিন্তু বড় হুযেরের দেখা পাওয়াটা তো এক বিশাল সৌভাগ্য। তাই কিছুই বলা যায়না।
তবে, এই সপ্তাহে, উনি সবার সাথে টুকটাক কথা বলছেন, হুযুরের পীরের সাথে কথা বলেছেন গেলো পুরা একটা সপ্তাহ।
মনে হয় এই সপ্তাহে আর বলবেন না।

আমরা বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম,

উনি গেলো এক সপ্তাহ কার সাথে আলাপ করেছেন?

খাদেম হুযুর বিরক্ত হয়ে বললেন

আরে, আপনারা কি কিছু না জেনেই এসেছেন নাকি?
আমাদের বড় হুযুর, আজ থেকে ১০ বছর আগে, স্বপ্নে আমাদের পীরে মুরশিদ সোনা পীর ইনতিখাব নাখশবী আল মতিনূঊর বাবাজীর সাক্ষাৎ পান।
বড় হুযুর আগে ছিলেন একজন, ভিক্ষুক সেবক।
কিন্তু স্বপ্নে পীর সাহেব বললেন, বেটা, তুই অমুক যায়গায় (এইযায়গায়) গিয়ে, আমার মাজার গড়বি।
ভিক্ষুক হয়ে দ্বীনের সেবা করতে চাইলে, তুই মানুষের উপকারে আসবিনা, শুধু নিজের উপকারে আসবি।
তুই নিজের উপকারের সাথে, অন্য বান্দাদেরও যথাবিহীত সাহায্য করবি।

এর পর থেকে বড় হুযুর হুযুরে পীরের আশেক।

উনি এলাকাবাসীকে বললেন, এইখানে হবে সোনা পীরের মাজার।
উনি সবাইকে নিঁখুত নিশানা দেখাইলেন, যে, কি করে তিনি এইখানেই সোনা পীরকে খুঁজে পাবেন।
তারপর থেকে, উনি আমাদের, ওনার খেদমতদারদের, ওনার ভক্ত দের দো জাহানের মুক্তির জন্য, নেয়ামতের জন্য, হুযুরে পীরে সোনা বাবাজীর খেদমতে নিয়মিত হাজির হন, মারাফতের অন্য স্তরে।
সুবহান আল্লাহ।

শুনে আমাদের গায়ের রোম দাড়িয়ে গেলো, রোম কুপের ভেতর থেকে ভক্তি চুঁইয়ে পড়তে লাগলো।

আমার ভাইয়ের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

আমরা বুঝে গেলাম, এই হুযুরই পারেন।
এর পর খাদেম হুযুর, হুযুরের চমৎকারিত্বের আরো যা বর্ননা দিলেন ,তাতে আর কোনো সন্দেহই রৈলো না।

এমন সময় হালকা রুপালী জরির লাইনিং দেয়া, ঘিয়ে রংয়ের একটি আলখোল্লা পরিহিত, সুকান্তি নধর একজন হুযুর এগিয়ে এলেন।
ওনার চেহারায় নুরানী জেল্লা, খাদেম হুযুরের চাইতেও বেশি।
আমাদের বুঝতে বাকী রৈলো না, ইনিই বড় হুযুর।
আমাদের কি সৌভাগ্য!!!!!

খাদেম যখন তার হাতে চুম্বন করলেন, আমরাও মনে আর চোখে আশা নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম, যেনো, আমাদেরকেও হস্ত চুম্বনের সুযোগ দেয়া হয়।
উনি মনে হয় অন্তর্যামী, উনি বুঝলেন। স্মিত হেসে বাড়িয়ে দিলেন বা হাঁত।
হাতের মধ্যমায় বিশাল আকারের একটি আংটি, হস্ত চুম্বনে বাঁধা হতে পারলো না।

যখন খাদেম জানালেন, উনি মেজো হুযুর, আমাদের বিষ্ময়ের সীমা রইলো না।
মেঝো হুযুরই এমন দিব্য কান্তি!!
বড় হুযুর কেমন হবেন??

তখন খাদেম হুযুর মেজো হুযুর কে আমাদের মনোবাসনা খুলে বলতে দুশ্চিন্তার একটা ছোট রেখা পড়লো হুযুরের কপালেও।
বললেন,
আজ তো মনে হয় পারবেন না আপনারা।
এইখানে কেবল, সোনা স্বর্ণ মানত করা যায়।
কম হোক আর বেশি, আপনাকে স্বর্ণ মানত করতে হবে।

এটা আমাদের জন্য নতুন।
আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
ভাইয়া তার বিয়ের আংটির দিকে তাকালেন।
মেজো হুযুর বললেন,

নানা, বহু ব্যাবহৃত স্বর্ন নয়, আপনাকে নতুন একটু কিছু দিতে হবে। পরিমানে খুবই সামান্য হলেও।
আর, আপনার বিবির পেয়ারের জিনিষ আমরা নেবো কেনো?
আমরা মানুষের মহব্বতের মর্ম জানি।
মহব্বতই তো দুনিয়া।
এইযে আমাদের হুযুর, বাবা পীরে হুযুরের মহব্বতের টানে এখানে এসেছেন।
আর আপনি যদি মহব্বত না করে হুযুর কে কিছু মানৎ করেন, তবে আপনার মনো বাসনাও পূর্ণ হবেনা।

ভাইয়ার মুখে একই সাথে সস্থি আর আশংকা দেখা গেলো।

আমি এগিয়ে গেলাম,
বললাম,
হুযুর, যদি মানতকৃত স্বর্ণের সম পারিমান টাকা দেই...?

হুযুর মনে হলো একটু মনোক্ষূন্ন হলেন।
বললেন ,এটা শুধুই বড় হুযুরের এখতিয়ারে।

অতএব, আমরা চললাম, বড় হুযুরের আসনে।
মশজিদের পিছনে ছোট্ট একটা ঘর বড় হুযুরের জন্য, তার পরই মাজার। সোনা পীরের মাজার।
সেইখানে গিয়ে, মেজো হুযুর আগে গেলেন, তার ক্ষানিক পরে খাদেম হুযুর।
তারও আধা ঘন্টা পর, আমাদের ডাক পড়লো।

ঘরের ভেতর আধো অন্ধকার আধো আলো প্রায় অন্ধকারের দিকেই।
সুগন্ধী ধোয়ায় আচ্ছন্ন না হলেও, পরিমিত মাত্রার যেনো একদম সব কিছু।
অতি সামান্য ধোঁয়া।
আর ঘরের ঐ পাশের দরজা দিয়ে আলো আসছে, সরাসরি মাজারের পাথরের বেদীর পেট ছুঁয়ে।
যেনো, মাজারের আলোয় আলোকিত বড় হুযুরের ঘর...
আর হুযুর, পীরের আশেকে, ধ্যানে বসে থাকত থাকতে যদিও প্রায় বিশাল আকৃতি ধারন করেছেন, কিন্তু তার চকচকে গালের উপর বসানৈ ভাসান চোখ দুটিতে যেনো, উপচে পরা স্নেহ আর ঘোর।
এক এক অসামান্য ঘোর।

বড় হুযুর কথা বলেন খুব আস্তে।
কিন্তু যেনো মাটির মানুষ।
শুদ্ধ ভাষা নয়।
একদম মাটির কাছাকাছি, কিংবা আকাশের কাছাকাছি মানুষের ভাষা।
আমাদের গায়ের পশম এবার কাঁটা দিয়ে দাঁড়িয়েই রৈলো, বাড়ী ফেরার আগ পর্যন্ত আর নামেইনি।
বড় হুযুর বললেন, তোদের কথা শুনছিরে।
নিয়ম ভাঙ্গা ঠিক না, কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়ের কষ্টে আমার চোখে পানি চৈলা আসছে।
আমি জানি, আমার নিয়ম ভাঙ্গার কারনে, বাবা পীর মুরশিদ সোনা ইনতিখাব নাখশবী আল মতিনূঊর (বলে উনি ডান হাত টাকে বুকে লাগিয়ে, তারপর মুখে চুমু খেলেন, ডান হাত কে, এমন পরপর তিনবার----ওনার পরপরই মেজো হুযুর আর খাদেম হুযুর ও এমন করলেন, দেখাদেখি আমরাও। বুঝলাম, এটা পীর বাবার জন্য সন্মানার্থে)
আমার উপর খুব নাখোস হৈবো, কিন্তু আমি যখন নান্না বাচ্চাটার কথা বুঝাইয়া কমু, তখন তার দিলে রহম হৈবৈ।

আমরা সস্থির নিশ্বাস ফেললাম।

বড় হুযুর, আমাদের জন্য মানৎ এর হাদিয়া, ২১১১১ টা নির্ধারন করলেন।
ভাইয়া খুশি মনে রাজী হলেন।
এ এক পরম পাওয়া।
এর পরে আমার ভাতিজি সুস্ত্য না হয়ে পারেই না।
যদি নাও হয়, বুঝতে হবে, সেটা আমাদের, বড়দের পাপের ফল।
আর কিছু হবার ছিলো না।

এর পর আমরা অযু করে (যদিও আগেই করা ছিলো, কিন্তু বড় হুযুরের পাশে বসে অযু করাও সোয়াবের কাজ) আমরা গেলাম মাজারের পাশে।
সুরা-কালাম পরে হুযুরের সাথে দুআ করলাম।
এর পর খাদেম আর আর মেজো হুযুর, আমাকে আর ভাইয়াকে নিয়ে গেলেন কবরের পাথরের আবরনের দুই প্রান্তে, আমাকে গিলাপ উঁচিয়ে খাদেম হুযুর ভেতরে নিয়ে, মাজারের পাথরের আরবী খোদাই হরফের গায়ে হাত দিয়ে মানৎ করালেন---

খাদেম হুযুর বললেন: আমার সাথে সাথে বলেন: আমি
আমি বললাম আমি:
হুযুর বললেন: এই মাজারের পবিত্র পাথর ছুঁয়ে
আমি বললাম: এই মাজারের পবিত্র পাথর ছুঁয়ে
হুযুর বললেন:আমার ভাতিজির সুস্থ্যাতার আবদার জানিয়ে
আমি বললাম:আমার ভাতিজির সুস্থ্যাতার আবদার জানিয়ে
হুযুর বললেন:দেড় ভরি স্বর্নের সমমূল্যের সমান, ২১১১১ টাকা
আমি বললাম:দেড় ভরি স্বর্নের সমমূল্যের সমান, ২১১১১ টাকা
হুযুর বললেন:দান করার নিয়ত করলাম
আমি বললাম:দান করার নিয়ত করলাম
হুযুর বললেন:আমিন
আমি বললাম:আমিন

আহ, আমার বুকটা আনন্দে ভরে গেলো। ভাইয়াও নিশ্চিৎ তাই।
আমাদের মনে হলো, আমাদের মেয়েটা সুস্থ্য হয়ে গেছে।

পরে অবশ্য একটু কনফিউশন হয়ে ছিলো, কারন আমি আর ভাইয়া আলাদা ভাবে মানৎ করায়, টাকাটা নাকি ডাবল দিতে হবে, জনপ্রতি ২১১১১ টাকা।
তবে বড় হুযুর জানালেন, আমার যেহেতু দূরের সম্পর্ক, সেহেতু আমাকে কিছুদিন পরে দিলেও চলবে।
আমি অবশ্য পরের দিনই টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলাম।
আমি আর ভাইয়া গিলাপ থেকে বের হয়ে, মাজার কে সন্মান দেখিয়ে একটু ঝুঁকে, পুরোটা সময় অবশ্যই মাজারের দিকে কখনই পিছন না ফিরে, বের হয়ে আসি।
বের হয়ে আসতে আসতে চোখ তুলে দেখি, একটা বিশাল কাফিলা গাছের মাঝের দিকের এটা ডাল ভাঙ্গা, ভাঙ্গা অংশটার দিকে টাকাতেই মনে হলো, একটা বুড়ো, ঠোঁটে একটা কোনাচে হাসি নিয়ে ভেংচি কাটছে।
এও নিশ্চিৎ কোনো কুদরত।
নাইলে মানুষের মুখের আদল হবে কেনো?
হয়তো কোনো শয়তান, কোনো কালে হুযুরের সাথে বেয়াদপী করে, এমনটায় পরিনত হয়েছে।

আমরা দিলে শান্তি নিয়ে চলে আসলাম।
পরদিন যখন আবার টাকা দিতে যাই আমি একা, তখন শুনেছিলাম, বড় হুযুর, তার যৌবন কালে, কেমন করে লোকজনকে জানিয়েছিলেন, ঐখানটাতেই সোনা পীরের মাজার।
উনি মাটি খুঁড়ে দেখিয়ে ছিলেন, ঐখানে সব স্বর্নের লাঠির একটা পুটলি।
হুযুর হাড় গুলো, স্বর্নের লাঠিতে রুপান্তরিত হয়েছিলো, আর জায়গা কম নেয়ার জন্য, কাফনের কাপড় টাও, গুটিয়ে গিয়েছিলো। সেই স্বর্ন লাঠি গুলোই এখন মাজারে শয়িত।

নি:সন্দেহে চকমপ্রদ।
সোনা পীরের কেরামতির কি নমুনা।


ও, প্রথম গল্পের শেষ অংশ:

রহমান চোরা, তার মায়ের মৃত্যূ শজ্যার প্রতিজ্ঞ্যা করে, সে চোরাই মাল ব্যাবহার করবোন।
তাই, সে সেই মাল, মতিরে আর পাঠায় নাই।
কিন্তু রহমান চায়নাই, সে নিজে না পাইলে, মতিরেও নিতে দিবেনা ঐ মাল।
কোনো চোর কখনো চায় না। মতি চোরা হৈলেও চাইতো না।
কিন্তু মতি ফেরৎ আসলে ক্যাম্নে ঠেকাবে রহমান?
তার কুটবুদ্ধির সাথে পারার মত কি বুদ্ধি বের করা যায়?
রহমান ভাবছে আর ভাবছে---
সারারাত ভাবছে----
ভাবছে আর ভাবছে---
কোনো বুদ্ধি তার মাথায় আসলে, সে গঞ্জের পীরের মাজারে ২০০ টাকা মানৎ করছে..
তারপরে ভাবছে....
অনেক ভাবছে...

পোস্টটি ৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাওন৩৫০৪'s picture

নিজের সম্পর্কে

অনেক সময় নিয়া শিখতে পারছি, ক্যাম্নে শিখতে হয়....
এখন এইজন্য খালি শিখতেই আছি,
তাই বৈলা কেউ আইসা ভুজুং বুঝাইয়া দিয়া যাবেন, সেইটা আবার মানতে পারুমনা.....
আড্ডা ফূর্তি, মাস্তির সাথে সুযোগ পাইলে শিখাশিখি..

কিন্তু বটম লাইন হৈলো, "শেখার কোনো শেষ নাই, শেখার চেষ্টা বৃথা তাই"