অপেক্ষা
কমিকসে মাঝে মাঝেই চোখে পড়তো, ঘুম না পেলে ভেড়া গুনো। আর যে বয়সে আমি চোখ চেপে-বুজে ঘুমাতে চাইতাম, সে বয়সে আমি ভেড়াই চিনতাম না, গুনবো কিভাবে! মাঝে মাঝে একা বাসায় ভয় পেতাম, তখন আমি খুব করে ঘুমাতে চাইতাম। কিন্তু ঘুম আসতো না। তবু চোখ চেপে শুয়ে থাকতাম, অপেক্ষা করতাম। একসময় ভয় কাটতো, আমি আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতাম। ঠিক তলিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে একটা দৃশ্য চোখে ভেসে উঠতো। একটা কালো বিড়াল দেয়ালের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে নামছে। কালো বিড়াল দেখে আশ্বস্ত হবার কোনো কারণ নেই। তবু আমি হতাম, কারণ ঐ বিড়ালটাকে দেখতে পাওয়া মানে ঘুমিয়ে পড়া। আমি এখনো মাঝে মাঝে ঘুমের ঠিক আগে বিড়ালটাকে দেখি। এসব কথা কাউকে সাধারণত বলি না। কেউ বিশ্বাস করবে না। কাকে আর দোষ দিব...কোনো এক কালে যে আমার ঘুমাতে সমস্যা হতো সেটা এখন আমার নিজেরও বিশ্বাস হতে চায় না!
ধানমণ্ডির এক সরু আঁকাবাঁকা গলির ভেতরে ৭১ নম্বর বাসাটা ছিল আমার ছোট খালার বাসা। এই বাসারই তিনতলায় থাকতেন নানু। আমার প্রথম শৈশবের একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে নানুর বাসা। পুরনো আমলের বাসা, বারান্দাটার দেয়াল ছিল খোপ খোপ, উপরে শিক দিয়ে ঘেরা। কয়েকটা খোপে বাসা বেঁধেছিল চড়ুই পাখি। তাদের কিচমিচ শব্দ শোনা যেত পুরো বারান্দা জুড়ে। বারান্দায় বসলে খোপের পাশ দিয়ে দেখা যেত কয়েকটা সুপারি গাছ। নড়বড়ে এই গাছগুলো ঝড় আসলেই সে কি ভীষণ নড়তো! একবার এমনই একটা ঝড় হলো। তেমন বড় কিছু না হয়তো, তবে আমার মনে পড়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে লম্বা বারান্দার পুরোটুকু ভিজিয়ে দিচ্ছিল। আর আমি সেই ভেজা বারান্দায় বসে দেয়ালের খোপের ফাঁক দিয়ে সুপারি গাছগুলোকে দেখছিলাম। এমনভাবে দুলছিল যেন যেকোনোসময় পট করে ভেঙ্গে পড়বে। তবু আকাশ শান্ত হয়ে এলে দেখি যেই কি সেই! সবগুলো সুপারি গাছ এখনো দাঁড়িয়ে। ঝড় বৃষ্টি হলেই আমার সেই সুপারি গাছগুলোর কথা মনে পড়ে।
নানুর বাসার স্মৃতির কথা যখন বলছি, তখন আমরা কাছেই ভূতের গলিতে থাকি। তারও আগে আমরা থাকতাম মুগদাপাড়ায়। আমার স্মৃতির শুরু ওখানটায়। যদিও খুব বেশি মনে নেই, তবে একটা খুব উঁচু দালানে থাকতাম মনে পড়ে। সে বাড়িটার দেয়ালে আস্তর নেই। সামনে একটা কুয়া। একটা বেশ বড়সড় কুকুরও ছিল মনে হয়, স্মৃতির এই অংশটা ঝাপসা। মুগদাপাড়াতে আমার আর আমার বোনের শৈশবের বেশ কয়েকটা ছবি আছে। এর কোনোটার কথাই আমার মনে পড়ে না।
মুগদাপাড়ার বাসার ছাদে আমি আর বড় বোন
যেটা সবচাইতে বেশি মনে পড়ে সেটা হল ট্রেন। মুগদাপাড়ার বাসাটার সিড়িঘর থেকে ট্রেন দেখা যেত। আর প্রায় প্রতিদিনই মা আমাকে সিড়িঘরে বসিয়ে ট্রেন দেখাতো আর ভুলিয়ে-ভালিয়ে লাবড়া-মার্কা খিচুড়ি খাওয়াতো। বাবার পোস্টিং তখন কিশোরগঞ্জে, মা খিচুড়ি মুখে ঢোকাবার ওজর হিসাবে কোনো একটা ট্রেনকে হয়তো বাবার ট্রেন বলে চালিয়ে দিতো। মায়ের সেই লাবড়া-মার্কা খিচুড়িটা ছিল সত্যিকার অর্থেই খিচুড়ি। চাল ডাল সবজি মাংস থেকে শুরু করে যা যা খাওয়ানো সম্ভব সবকিছুর কমপ্লিট প্যাকেজ। এই খিচুড়িটার একটা স্পেশাল গন্ধ আছে, নাকে এলেই আমি চিনতে পারি। বড় হলে মনে হয় এই খিচুড়িটা আর খাওয়া যায় না...কাউকে খেতে দেখি নি।
প্রতি শুক্রবার নানুর বাসায় মামা-খালারা সবাই পরিবার নিয়ে জড়ো হতো। তারপর আমরা জুনিয়র ব্যাটেলিয়ান সিনিয়রদের থেকে আলাদা হয়ে যেতাম। মামা-খালারা সবাই খাবার ঘরে বসে গল্প করতো অথবা কিছু একটা করতো। আমরা নানুর ঘর দখলে নিতাম। এটা স্পষ্ট মনে আছে যে তখন খুব মজা হতো, শুধু সবগুলা ঘটনা খুঁটিনাটিসহ মনে নাই। প্রায় সময়ই আমরা যেটা করতাম, নানুর পাউডারের কৌটা নিয়ে মেঝেটা পিচ্ছিল বানাতাম। তারপর দৌড়ে এসে স্লিপ কাটতাম। প্রতি শনিবার সকালে নানুর পাউডারের কৌটা খালি থাকতো। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এরকম একটা ভয়ে নানু পাউডারের কৌটা লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু সপ্তাহে সাতটা দিন নানু বাসায় কাটানোর সুবাদে পাউডারের কৌটা কোথায় পালাতে পারে সেটা আমার আন্দাজের মধ্যে থাকতো। তাই কোনো শুক্রবারই আমাদের জুনিয়র ব্যাটেলিয়ানের পাউডারের অভাব হয়নি।
যে দুর্ঘটনার ভয় করছিল বড়রা, সেটা একদিন ঘটলো অবশ্য। আমি আর মামুর ব্যাটা নানুর বিছানার(পালঙ্ক বলা ভাল, জমিদারি আমলের উঁচু খাট) উপরে রেসলিং শুরু করলাম। বাকি সবাই নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিতে লাগলো। বাইরের ঘরে বড়রা তখন গল্প করছে। মারমারির এক পর্যায়ে এসে জানালার শিকে মাথা ঠুকে গেল মামাতো ভাইয়ের। রক্ত দেখে সবাই ভড়কে গেল, ও নিজেও ভ্যা করে কেঁদে বসলো। বড়রা এসে পরে মাথায় পানি ঢালো রে, ডাক্তার ডাকো রে শুরু করলো। সেদিনের পরে আমাদের মারামারি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। তবে তারপরেও শুক্রবারের নানু বাসার মজা শেষ হলো না। একবার আমরা মিথ্যেবাদী রাখাল বালকের গল্পানুসারে একটা মঞ্চ নাটক মতো করলাম। আমি আর মামাতো ভাই ছিলাম রাখালের দুই ভেড়া। হামা দিয়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না তেমন, শুধু বাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর থেকে মরার মতো শুয়ে থাকতে হলো। শুয়ে শুয়েই দেখলাম নাটক শেষে বড়রা সবাই হাততালি দিয়ে ঘর কাঁপিয়ে ফেলছে। নাটকের সবাই মাথা বাউ করে অভিনন্দন নিচ্ছে, আমরা দুই গরু শুধু মরার মতো পড়ে রইলাম।
শুরুতে আমার ঘুমের কথা বলছিলাম, নানুর বাসায় ঘুমাতে আমার কখনো সমস্যা হতো না। নানু হয়তো একবার বলতো যে,- আমাদের তানিম তো অনেক শান্ত, অনেক লক্ষী; ঘুমায় পড়ো দাদুভাই। আমি সে প্রশংসায় গলে যেতাম, চুপচাপ ঘুমের জগতে হারিয়ে যেতাম। প্রশংসায় গলে যাবার প্রবণতা আমার এখনো আছে। আমার ধারণা আমার ধারেকাছের সবাই ব্যাপারটা জানে এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে।
নানুর বাসায় দুপুরের খাবারের দুইটা আইটেম আমার সবসময় মনে থাকবে। একটা ইলিশ ভাজা আর আরেকটা বেগুন ভাজা। ইলিশ নিয়ে নানুর একটা কবিতা মতো ছিল। কবিতাটা মনে হয় খুব কমন।
ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
বোয়াল মাছের দাড়ি
তানিম মিয়া যাবে এবার
______বাড়ি
নানু কবিতাটা প্রয়োজন মতো পাল্টে নিতেন। শেষ লাইনে কখনো শ্বশুর বাড়ি বলে আমাকে বিব্রত করতেন, কখনো আবার চাঁদপুরের গাড়ি বলে ছন্দ মিলাতেন। এই কবিতাটা নানু শুধু ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে দেবার সময়ই বলতেন; বোয়াল মাছ কখনো এতোটা গুরুত্ব পায়নি।
তারপর এক দুপুরের কথা। খাবার ঘরে বসে আছি আমি। চোখের সামনে ধোঁয়া ওঠা ভাতের বোল, পাশেই পিরিচে গোল করে কাটা বেগুন ভাজা, ডালের বাটি ঢাকনা দেয়া। দুপুরের ভাত একসাথে খাব, তাই নানুর জন্য অপেক্ষা। আমার অপেক্ষার আর শেষ হয় না ...
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম খুব তীব্রভাবে।
অনেকদিন পর লিখলেন......ছোটবেলাগুলো উড়ে পুড়ে চলে যায় ঠিকই কিন্তু কত কি রেখে যায়
আহা ছোটবেলা...মন কমেন করে...ছেলেবেলার পাহাড় আমায় ডাকে...
মন খারাপ করায় দিলেন ভায়া
কত কি মনে করিয়ে দিলেন! মন ছুঁয়ে গেলো লেখাটা। ছোটবেলার বেশীরভাগ সময় কেটেছে নানা-নানুর সাথে। চোখ বুজলে নানুর হাসিটা এখনো দেখতে পাই।
নানুন যেখানেই থাকেন যেনো শান্তিতে থাকেন। আর তুমিও ভালো থাকো তানিম। তোমার জন্যও শুভকামনা। আর একটু ঘন ঘন কীবোর্ড ঝাড়াপোঁছা করো
ধুর মিয়া সকালবেলা এভাবে মন খারাপ করে দিলেন/দিলা।

এতো ভাল লেখেন, আর এতো কম লেখেন? মনটা ছুয়ে গেল। আমার মেয়ে আর তার নানুকে আলাদা করার কোনো উপায় নেই। মনে হয় যেন দুই বান্ধবী।
নানু'র বাসা'র বারান্দা'টার বিবরন, আমার স্মৃতি হাত্রে পাওয়া আমাদের সবচেয়ে পুরনো বাসা'র আমার আব্বু-আম্মু'র বারান্দা'টার কথা মনে করিয়ে দিলো।
বৃষ্টি'তে ভেজা সেই সুন্দর শৈশব!
আপনার লেখে পড়ে হঠাৎ করেই খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেই দিন গুলো'তে
খুব খুব খুব ভালো লাগল।।
পারফেক্তো ব্লগ মাইটি ........
হায়রে নানাবাড়ী... ছোটবেলায় ঘহুমানোর সময় ভয় পেতাম... হরর মুভি এই কারণে এখনো দেখিনা...
মন্তব্য করুন