একটি অ্যাপল কিংবা আপেলের গল্প অথবা “আমার কাজের মাঝে-মাঝে/ কান্না ধারার দোলা তুমি থামতে দিলে না যে”
[দীর্ঘদিন পরে লেখা। তাই নিজের ঘরে জমিয়ে রাখা।]
ফেব্রুয়ারির শেষ। কোথায় একটু মৃদুমন্দ হাওয়া বইবে, অথবা চারদিক কালো করে হুড়মুড়িয়ে শুরু হয়ে যাবে কালবৈশাখী; উড়িয়ে ফেলবে সবকিছু ছড়িয়ে- ছিটিয়ে। কিসের কি! বরং কেমন যেন একটা ভ্যাপসা- গুমোট আবহাওয়া। এরমধ্যে অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতি পথে রোজ বসে থাকা ঘণ্টা দুয়েক রাস্তায়। মাঝে মাঝে সৃজনের মনে হয় গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেও হয়তো আগে পৌঁছে যেতে পারবে। কিছুদিন আগেই মাত্র প্রমোশন হয়েছে, বেতন বেড়েছে, অফিস থেকে গাড়িও দিয়েছে নিজের জন্যে। বাড়তি বেতন দিয়ে আগের বাসাটা বদলে নিজেদের পছন্দ মত ফ্ল্যাটে ওঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু বাচ্চার স্কুলের কাছাকাছি কোন ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রায় সপ্তাহান্তেই এই আবাসিক- ঐ আবাসিকে ঘোরা হচ্ছে যদি কোনটা পছন্দ হয় এই আশায়। ছুটির দিনগুলো এইসব করে কেটে যাচ্ছে বলে কোথাও তেমন ঘুরতে যাওয়াও হচ্ছে না, তাই নতুন কোথায় যাওয়া যায় সেটা নিয়েও ভাবছে। নিরার পছন্দ দেশের ভেতরেই আর সে নিজে চাইছে দেশের বাইরে কোথাও। অফিসের সহকর্মীর কাছে শোনা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় নাকি বেশ সস্তায় ঘোরাঘুরির সামগ্রিক আয়োজন পাওয়া যায়, আর হ্যাটের কাছে নেপাল তো আছেই। সেই ছোটবেলায় দিনাজপুরে যখন থাকত, সবাই মিলে একবার ঘুরতে গিয়েছিল তেতুলিয়া। মহানন্দার পানি যখন শুকিয়ে যায় অক্টোবরের শেষ- নভেম্বরের শুরুতে, আকাশে মেঘ থাকেনা আবার শীতের কুয়াশার আনাগোনাও শুরু হয়না তখন দেখেছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। এতো অসাধারণ সুন্দর, মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখেছিল সবাই। প্রথমদিনই দেখা দিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা, ঐ একবারই। এরপর আরও বার কয়েক যাওয়া হয়েছে সেখানে কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দেখা যায়নি। তাই এবার নেপালটাই ঘুরছে কেবল মাথায়।
ঘামে ভিজে যাওয়া শার্টের কলারটা উঁচু করে দেয় শহীদ যদি কিছু বাতাস ঢোকে এই আশায়। প্রচণ্ড গরমে একশা হয়ে যাওয়া রোজকার রুটিনের কোন হেরফের হয় না। অফিসের সাহেবরা সবাই চলে যাওয়ার পর সব কয়টা টেবিল- চেয়ার মুছে, গুছিয়ে রেখে, লাইট-ফ্যান সবগুলা বন্ধ করে, অফিসে তালা লাগিয়ে সবার শেষে বের হয় সে। খুব বেশিদিন হয়নি এইখানে। তাদের পাড়ারই এক ছেলে এইখানে কেরানির কাজ করে, সে-ই খোঁজ দিয়েছিল এই অফিসের। এই কয়দিনে ভালোই লাগছে তার এই অফিসটাকে, মাঝেমাঝে টুকটাক ফুট-ফরমাশ খাটা লাগলেও সবাই হাসিমুখে কথা বলে, বকা-ঝকা করেনা কেউ। সবাই মোটামুটি ঠিক-ঠাক সময়ে আসেন, দেরি করে অফিসে থেকে যায় না কেউই। কাজেই প্রায়দিনই সন্ধ্যার পরপরই সেও নিশ্চিন্তে বাসার দিকে রওনা দিতে পারে। খুব একটা খারাপও লাগে না, বরং একটু দেরি করে রওনা দেয়ায় সে কিছুটা খুশিই! সন্ধ্যায় রাস্তায় ভয়ংকর জ্যাম! সেই তো বাসে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে। এশার আযানের পরপর চারদিক একটু মনে হয় ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে যেখান থেকে বাসে ওঠে, বেশিরভাগ দিনই সিট পাওয়া যায় না, দাঁড়িয়ে যেতে হয়। ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, পাশের জনের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে। কিছুটা কৌতুকও মনে হয় তার এই সময়। খুব বেশিদিন স্কুলে যাওয়া হয়নি, কিন্তু তাও যে কয়দিন গিয়েছিল পড়াশুনায় দূর্বলতার কারণে শিক্ষকের কাছে বকা শুনতে হত মাথা নিচু করে, স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই প্রথম কাজের খোঁজে যাওয়া রিকসা গ্যারেজের মালিকের অকথ্য গালিও শুনতে হত মাথা নিচু করে, আগের অফিসে পান থেকে চুন খসলেই কতজনের কত কথা শুনতে হতো। সবসময়ই তো নত মাথা, উঁচু করে দেখার সুযোগটাই বা কোথায়? তাই বাসে দাঁড়িয়ে মাথা কাত করে রাখতে কখনই খারাপ লাগে না তার।
জ্যামে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎই চোখ পরে রাস্তার পাশের বিলবোর্ডে। মুঠোফোনের বিজ্ঞাপন দিয়েছে এক মুঠোফোনের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। মাসিক কিস্তির সুবিধা সাথে আরও নানা কিছু। বাসায় ছেলের কথা মনে পরে গেল। মাত্রই ৪র্থ শ্রেণি শেষ করে ৫ম-এ উঠেছে ছেলেটা। সব ফোনের খুঁটি-নাটি মুখস্থ, কোনটায় কি সুবিধা, কোনটায় ছবি ওঠে ভালো, সবজান্তা। বাবা-ছেলের কথা হয়েছিল ক্লাসে প্রথম হতে পারলে নতুন ফোন কিনে দিবে। নানা কাজের চাপে সে ভুলেও গিয়েছিল এর মাঝে। এখন মনে হতেই গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হল বিক্রয়-কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে, ছেলেকে অবাক করে দেবে উপহার দিয়ে। সন্ধ্যায় এই দোকানগুলোর খুব জমাটি পসার। প্রচুর মানুষ আসছে, ঘুরে দেখছে, পছন্দ হলে কেউ কিনছে, কেউ না কিনে বেড়িয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ অনেকগুলা মডেল দেখে একটা আইপ্যাড পছন্দ হল তার। এজন্যে অবশ্য সে বিক্রয়কর্মীর কাছে কৃতজ্ঞ। এতক্ষণ সময় নিয়ে ধৈর্য ধরে তার সবকয়টা প্রশ্নের উত্তর দিল, তাকে একটার পর একটা সেট দেখালো হাসিমুখে। নানান কথার পর যখন শুনল বাচ্চার জন্যে, সেই তখন প্রস্তাব দিলো আইপ্যাডের। বেশ বড়সড়, সাথে কলমও আছে তাই হাতেও লেখা যায়। ক্রেডিট কার্ডে দাম চুকিয়ে আধ-খাওয়া অ্যাপলের ছবিওয়ালা প্যাকেটটা গুছিয়ে যখন গাড়িতে উঠছে সৃজন, চোখেমুখে তার একরাশ প্রশান্তি আর ভালবাসা।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঠিকই গন্তব্যস্থল চলে আসে। বাস থেকে নেমে প্রায় পৌনে এক-ঘণ্টার মত হাঁটতে হয় ঘরে পৌছতে। ঘর মানে তো আর একেবারে রাস্তার উপর সাজানো ফ্ল্যাট বাসা না, মধ্যবিত্তদের এলাকা পেরিয়েও কিছুদূর হেঁটে গিয়ে টিনের ছাউনি দেয়া ১৫ ফুট পরপর কতগুলো দেয়াল আর একটা জানলা- একটা দরজায় ঘর। তবুও ঘর মানে তো সেই পরিবার, স্ত্রী- সন্তান, ভালবাসা। গত কয়দিন ধরেই ছেলেটা বায়না করছিল আপেল খাবে বলে। যে কয় টাকা আসে মাসের শেষে, তাতে প্রতিমাসে যথেষ্টই টানাটানি। তার উপর নতুন জায়গা, অপরিচিত লোকজন, টাকা ধার চাইবে সে সুযোগও নেই। অনেক করে বুঝিয়ে এতদিন সামলিয়ে রাখা গেছে, কিন্তু প্রতিদিন ছেলের মন খারাপ করে রাখা দেখলে তার মনটাও কেমন করে ওঠে। তাই আজ বাস থেকে নেমেই সে গুটিগুটি করে ফলের দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। লাল বা সবুজ কোন আপেলটা মিষ্টি হবে ঘ্রাণ নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে, দাম শুনে দমে না গিয়ে বিপুল আগ্রহে দামাদামি শুরু করে। কেবল ২টা কিনবে শুনে দোকানির অবহেলা অগ্রাহ্য করে অনুনয় চলতে থাকে। দোকানির তিরস্কার আর শহীদের প্রতি পয়সার হিসেব বিশ্লেষণ চলতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ২টি আপেল তাদের সঙ্গীদের ছেড়ে নতুন একটা কাগজের প্যাকেটে ঢুকে পরে।
খবরে প্রকাশঃ
ক্ষুধা লাগায় একটি শিশু দোকান থেকে একটি আপেল ‘চুরি’ করায় দোকানদার তার সহযোগীদের নিয়ে শিশুটির হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে চড়-থাপ্পড় মারাসহ জুতা দিয়ে পেটায়। শিশুটির অসহায়ত্ব দেখেও আমরা তখন ব্যস্ত ছিলাম ঘটনাটি মুঠোফোনে ধারণ করতে কিংবা লোহার রড বা কাঠের টুকরা দিয়ে শিশুটিকে মারতে উৎসাহী হওয়ায়।
পরিশিষ্টঃ
নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক একটা সিনেমার গান দেখেন। দেখতে ভালো না লাগলে ব্রাউজারের উইন্ডোটা মিনিমাইজ করে কেবল গানটা শুনেন।
https://www.youtube.com/watch?v=ioT3L9uggBQ
অনেকদিন পর!
ভালো আছেন তো দাদা বিদেশ বিভূঁইয়ে?
কাঞ্চনজঙ্ঘা...সমরেশ মজুমদারের গল্পে কাঞ্চনজঙ্ঘার বর্ণনা পড়ে ঠিক করেছিলাম নেপাল যাবো। একটা বড়সড় মাটির ব্যাংকে পয়সা জমাতেও শুরু করেছিলাম...হাহাহা! কী দারুণ সেই একাবোকা স্মৃতিগুলো...অনেকদিন পর মনে পড়ে গেল। গানটাও..."ওগো দুখজাগানিয়া তোমায় গান শোনাবো..." এই গান শুনে বিষণ্নতায় ভেসে যাওয়াও হয় না কতদিন...!
মন্তব্য করুন