ফরমালিন
“ফরমালিন” কথাটা মাথার ভিতর ঘুর ঘুর করছিল কয়দিন ধরে।
অনলাইনে ঘাটা ঘাটি করলাম এটা নিয়ে। এটা কি , কেন ব্যবহার হয় এসব। এটুকু জানা ছিল যে মরা লাশে পচন ধরা বন্ধ করার জন্য মর্গে কিংবা ল্যাব এ ফরমালিন নামক রাসায়নিক তরল গ্যাস ব্যবহার করা হয়।
স্কুল জীবনের অনেক প্রিয় বন্ধু খোকন ময়মনসিং মেডিকেল কলেজে পড়তো। সেই সুবাদে আমি প্রায় ঢাকা থেকে ট্রেনে চেপে চলে যেতাম ময়মন্সিং মেডিকেলের বাঘমারা হোস্টেলে। আড্ডা মারাই মুলত ব্যাপার ছিল। খোকন ক্লাস থেকে ফিরে হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে বলতো, দেখ লাশ কাটা কাটি করে হাতের আঙ্গুল কেমন শক্ত হয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম , তা কেন হবে? তখন ও বলত লাশ ফরমালিন দিয়ে রাখা হয় যেন না পচে, আর বডি ডিসেকশন করতে গিয়ে এখানে সেখানে ধরতেই হয়, আর তাতেই হাতে ফরমালিন লেগে যায়। আমি জিজ্ঞেস করতাম ফরমালিন কি? তখন ওর কথায় জানতে পারলাম এটা অনেক বিষাক্ত তরল গ্যাস। মৃত লাশ ছাড়াও অনেক কিট পতংগ , প্রানী ফরমালিন মিশিয়ে বড় কাঁচের জারে সংরক্ষন করা হয়। এরপর আমি আর এই ফরমালিন শব্দটা শুনি নাই মানে শোনার দরকার হয় নাই দেশে থাকাকালীন।
আশির দশকে দেশে মনে হয় সাধারন মানুষের কাছে এই ফরমালিন শব্দটা খুব বেশি পরিচিত ছিল না। নব্বই এর দশকে বলা যায় সব মানুষের কাছে এই শব্দটা অতি পরিচিত হয়ে গেসে। দেশে বেড়াতে গেলেই এই শব্দটা মুখে মুখে শুনতাম। বুঝতাম না মানে বুঝতে চাইতাম ও না। কারণ আমি ভুলেও চিন্তা করি নাই যে এই মারাত্বক বিষাক্ত গ্যাস কেউ মানুষের খাবারে মিশাতে পারে।
বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে গেসি। খুব স্বাস্থ সচেতন। তাই কারো বাসায় দাওয়াত খেতে যাবার সময় মিষ্টি কেনার পরিবর্তে আমি ফল মুল কেনা প্রেফার করি। এখানে একটা ছোট ঘটনা বলি। অনেক আগের কথা। তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। শাহবাগ আর নিউমার্কেট ছিল আমাদের বিচরন ভুমি। তখন দেখতাম শাহবাগের ফুটপাথে , নিউমার্কেটে ফল নিয়ে বসতো মানুষ। এখনো মনে আছে বিদেশ থেকে আনা আঙ্গুর সুতায় বেধে ঝুলিয়ে রাখা হোতো। দুই চারটা আঙ্গুর ঝরে গেলে সুতা দিয়ে সেগুলি আবার আটকানো হোতো। আর ফলের চারপাশে মাছি ভন ভন করতো।আঙ্গুর তখন অনেক দামি ফল ছিল। সাধারনত কেউ হস্পিটালে রোগি দেখতে গেলে আঙ্গুর ফল নিয়ে যেতো। আর সেই আঙ্গুর খেতে পারলে যেন জীবন ধন্য হয়ে যেতো।
মিষ্টি কিনতে গেলে দেখতাম অনেক মাছি। বিরক্ত লাগতো। ফলের দোকানে গিয়ে দেখি সাদা আলোর বাতিতে ঝুলিয়ে রাখা ফল দেখতে এত সুন্দর লাগে যে দেখা মাত্রই খেতে ইচ্ছা করে। আগে এত ফল পাওয়া যেতো না। এখন ত দেশি ফলের পাশা পাশি অনেক বিদেশি ফল ও দেখা যায়। আর এত ফ্রেশ ফল দেখে আমার মন ভরে যায়। সবার বাসায় ফল নিয়ে যাই। কমলা, আপেল, নাশপাতি, সফেদা, আঙ্গুর, পেয়ারা আরো কত ফল। সবাইকে জ্ঞ্যান দেই মিষ্টি খেলে ডায়বেটিস হবে। ফল খেলে শরীর ভাল থাকবে ইত্যাদি। আমি তখনো জানি না যে ফল গুলি এত ফ্রেশ থাকে কেন?
সবার মুখে মুখে শুনে পরে আমি জানতে পারলাম ফরমালিনের রহস্য। জানতে পারলাম এখন শুধু ফল নয়,মাছ, সবজি, বেবি ফুড সব কিছুতেই এই বিষ মেশানো হয়। প্রতিনিয়ত সবাই বিষ মেশানো খাবার খাচ্ছে নির্বিকার ভাবে। কিছু করার নাই তাই। অনেক বাসায় গিয়ে শুনি গ্রাম থেকে নিজের পুকুর থেকে ধরে আনা মাছ খুব গর্ব সহকারে বলে। আবার অনেকে বলে সোয়ারি ঘাট এ ভোর বেলায় গিয়ে মাত্র ধরে আনা তাজা মাছ নিয়ে এসছে। এসব মাছে কোন ফর্মালিন নাই। ফর্মালিন রহস্য জানার পর বুঝেছি কেন জ্যান্ত মাছ পেয়ে এত খুশি হয় কেউ। ফর্মালিন মেশানোর কারনে বাজারে মাছে নাকি মাছি বসেনা।মাছের গন্ধ আর পাওয়া যায়না। কাঁচা আম জোর করে পাঁকিয়ে ফেলা হয়। লাল শাক আরো লাল করতে লাল রঙ মেশানো হয়। আর কি কি শুনতে হবে কে জানে।
আমার প্রশ্ন হলো যারা এই ফর্মালিন মিশিয়ে খাওয়ার জিনিস বিক্রি করছে ওদের মনে কি কোন দয়া মায়া নাই? শুধু আর্থিক লাভের জন্য মানুষ এহেন ক্ষতিকর কাজ করতে পারে? আর এই বিষাক্ত গ্যাস যা কিনা অনেক কন্ট্রোল্ড থাকার কথা , সেটা কি করে সাধারন মানুষের ধরা ছোয়ার ভিতর আসে? যারা এই ফর্মালিন মেশানোর ব্যবসা করে ওদের হয়ত ধারনা নাই যে এটার দীর্ঘমেয়াদি কুফল কি হতে পারে।
আমাদের দেশে এত ফর্মালিন্ মেশায় সব কিছুতে। আর তাই হটাত মাথায় একটা চিন্তা ঢুকলো। অনেকদিন বাইরে থাকার কারনে নিজেই নিজের কাঁচা বাজার করার অভ্যাস। আর তাই খুব বাজারে যাই আমি। তাজা সবজি আর মাছ দেখলে সব কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে। কিনিও প্রচুর। ফল মুল , সবজি, মাছ সব কিছু এত টাটকা দেখে হটাাত আমার মাথায় চিন্তা এলো , আচ্ছা এরাও নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও ফর্মালিন মেশায়, নইলে সব কিছু এত তাজা থাকবে কি করে?
যেসব দোকানীর সাথে এক আধটু খাতির হয়েছে ওদের জিজ্ঞেস করি সব কিছু এত তাজা থাকার রহস্য কি? ওরা অবাক হয়ে বলে এটা আবার কি কথা! তাজা না থাকলে তো বিক্রি হবেনা আর তাই বাসি জিনিস ফেলে দিতে হয়। ফর্মালিন এর কথা জিজ্ঞেস করায় এমন চেহারা করল যে বুঝলাম এই নাম কোন দিন শুনেই নাই। পরে যখন বুঝালাম ফর্মালিনের রহস্য তখন অদ্ভুত চেহারা করে আমার দিকে তাকালো যেন আমি কোন অপরাধ করে ফেলেছি এই কথা বলে।
অগত্যা অনলাইনে খোজা খুজি করা শুরু করলাম। আমেরিকার কোন কোন খাবারে কি পরিমানে ফর্মালিন মেশানোর আইন আছে ইত্যাদি। অবাক হয়ে খাবার জিনিসে ফর্মালিন মেশানোর ব্যাপারে কোথাও কিছু পেলাম না। হ্যাঁ যেটা পেলাম তা হোলো আমেরিকায় ফর্মালিন মেশানো হয় কিছু কিছু ঘর বাড়ি তৈরি করার সরঞ্জামে। যেমন প্লাই উড ( পাতলা কাঠ) । বাড়ির ছাদে ব্যবহার করার সরঞ্জামে যেন বরফ , বৃষ্টিতে পঁচন না ধরে। এখন শুনছি এইসব সরঞ্জামেও যাতে ফর্মালিন না মেশানো হয় তার জন্য বিল উঠাবে ওদের সংসদে। কারন বাড়ি ঘরের সরঞ্জামে ফর্মালিন থাকার কারণে নিশ্বাসের সমস্যা,হাঁপানি, ক্যান্সার এসব রোগ হবার অনেক আলামত পাওয়া গেছে।
উন্নত দেশে কোন খাদ্য দ্রব্যে নয়, বাড়ি তৈরির সরঞ্জামে ফর্মালিন থাকার কারনে নানা রকম কঠিন ব্যাধি হতে পারে , তাই এটার ব্যবহার নিষিদ্ধ হচ্ছে। আর আমাদের দেশে নিত্যদিন প্রায় সকল প্রকার খাবারের সাথেই কম বেশি বিষাক্ত ফর্মালিন
সকল বয়সের মানুষের পেটে যাচ্ছে। যার কারণে আস্তে আস্তে মানুষ নানারকম রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। ফর্মালিনের কারনেই বেশির ভাগ পেটের অসুখ হয়ে থাকে। যার জন্য আমরা অনেক অষুদ খেয়ে যাচ্ছি কিন্তু স্থায়ী নিরাময় পাচ্ছি না।
শুনেছি অনেকে বলেন যে ফর্মালিন দেয়া ফল মুল, মাছ এসব অনেক্ষন ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিলে ফর্মালিন্ মুক্ত হয় খাবার।আসোলে এটা সঠিক তথ্য নয়। বলা হয় ফর্মালিন এতই বিষাক্ত যে এটা একবার কোন খাবারে মিশালে সেটা পানি দিয়ে অনেক বার ধুয়ে নিলে কিছুটা প্রভাব কমতে পারে কিন্তু একেবারে ফর্মালিন মুক্ত হবে না। ফর্মালিন মানুষের শরিরে প্রবেশ করলে সেটা স্থায়ী ভাবে অবস্থান করে আস্তে আস্তে শরীরের ক্ষয় শুরু করে নানা রোগের মাধ্যমে।
ফর্মালিন মেশানোর জন্য শুধু দৃশ্যমান ছোটখাট অসাধু ব্যবসায়িদের দায়ি করে কি হবে? এর পিছনে যারা আছেন তারা অনেক বড় রাঘব বোয়াল। এর প্রতিকারের জন্য হয়ত দেশে প্রচলিত আইন ও আছে। কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ কি তাদের বেলায় প্রযোজ্য হয়? যসেটা না হলে্ হয়ত আমাদের দেশের মানুষদের দীর্ঘমেয়াদী শারিরিক ভোগান্তি সইতে হবে নানা রকম রোগ ব্যাধির মাধ্যমে। আর মরে গিয়েও পঁচে গলে যাবেনা সহজে। দীর্ঘদিন মৃত মানুষের শারিরিক বিকৃতি হবেনা ফর্মালিনের প্রভাবে যা কিনা অলৌকিক ব্যাপার বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
ফর্মালিন খেতে খেতে দেশের মানুষ গুলা সব সিস্টেমেই ফরমালিন যুক্ত। কে কতটুকু তাই এখন ধরার বিষয়!
সুন্দর রাইট আপ!
থাঙ্কিউ শান্ত
টাটকা খাবার এদেশের মানুষের আর হজম হয় না। আমরা মিউটেন্ড হয়ে গেছি।
ঠিক তাই মনে হয়। ধন্যবাদ
ফর্মালিন আছে বলেই তো বেঁচে আছি
কথা সত্য
ভালো লিখেছেন...
ধন্যবাদ ভাই
কয়েকবছর আগে শুনেছিলাম স্পেনে শসায় কার্বাইড বা কীটনাশক জাতীয় ওষুধের মাত্রার কারনে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপে। তবে যখন লিডেল বা ইকা থেকে সস্তায় সব্জী কিনি তকহন ফ্রিজের বাইরে বেশ কিছু দিন রেখে দিলেও পচে না। তখন বুঝতে পারি এরা ফরমালিন না মিশালেও অন্য কিছু মিশায়।
তবে আমাদের দেশে সবকিছুর মাত্রাই একটু বেশী।
উপকারী লেখা।
ধন্যবাদ
আমাদের বিবেক গেছে পঁচে - ফরমালিনের প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে সেখানে.
হুম, আমরা এখন ফরমালিন প্রুফ হয়ে গেছি
কথা সত্যি
অথচ আইরনি হলো আঙ্গুর শরীরের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি করে
আমি নিজে যা খাই তাই নিয়ে যাই দাওয়াত খেতে, রোল, পিজা, প্যাষটিরি, দইবড়া, মুরগীর গিরল, কাবাব, চকলেট ইত্যাদি সাথে ফুল
তাইলে তো আপনেরে শীঘ্রই দাওয়াত দিতে হয় .
মন্তব্য করুন