ইউজার লগইন

আমার সন্তান আমার পৃথিবী

আমার যত সুখ সব কিছুই আমার দুই ছেলেকে ঘিরে। ওদের সামনে খুব বেশি আহ্লাদি করি না। বকা ঝকাও করি। কিন্তু চোখের আড়াল হলেই শুরু হয় ওদের মিস করা। ওরা খুব ভাল করে জানে আমাকে । আর তাই সেটার সুযোগও নেয় ।

আমি আমার অতীত খোজার চেষ্টা করি ছেলেদের মাঝে। কিন্তু ওদের সাথে আমার অতীতের কোন মিল নাই। আমার মত বদ কিসিমের হয় নাই আমার ছেলেগুলি। এত বেশি ভদ্র আর ভাল যে দেখলে মাঝে মাঝে নিজেরই মেজাজ খারাপ লাগে।

আমার আর ওদের বেড়ে উঠার পার্থক্য হল আমি ছিলাম অনেক মানুষের মধ্যে কিছুটা বেওয়ারিস ভাবে থাকা । ওরা বড় হয়েছে অনেক আদর,যত্নে,নিয়মের ভিতর। কোন মাথাব্যথা বিহীন , সামাজিক নিরাপত্তায়।তাই বলে ওদের “ফার্মের মুরগি” বলা যাবেনা।ভিন দেশের মাটিতে জন্ম নিলেও আমাদের দেশি কালচার, বাংলা ভাষা, আদব কায়দা, নামায রোযা, কোরান তেলাওয়াত সব কিছুই খুব ভাল ভাবে রপ্ত করেছে। দৈনন্দিন চর্চাও করে।

আমার খুব সখ ছিল সংসারে একটা মেয়ে থাকুক। কিন্তু চাইলেই কি আর পাওয়া যায় নাকি। এই অপুর্নতাটা থেকে যাবে। যদিও আমি আমি আমার ছেলের নিয়ে অনেক শান্তিতে আছি, কোন মাথাব্যথা দেয় না। বরং আমার অগোছালো ভাব দেখলে ওরা আমাকে শাসন করে।

দুই ভাই দুই রকম। বড়টা কিঞ্চিত স্বার্থপর টাইপ। ছোটটা একেবারেই দিল দরিয়া।
বড়ভাই খুব নামাযী , টাইম মত ছোটভাইকে সাথে নিয়ে নামায পড়ে ফেলবে। আমি তখন নামায না পড়ার কারনে একটু চোরের মত হয়ে যাই। বড়জনের টাকাপয়সা সহজে খরচ হয়না। অযথা খরচ করবে না। খুব গুছিয়ে চলবে। খুব সচেতন। প্লাস্টিকের বোতলের পানি খাবে না। কলের পানি ভরে নিয়ে যাবে। হালাল ছাড়া খাবে না। তাই বাইরে খেলে সীফুড বা ফিস জাতীয় খাবে শুধু। পড়াশুনায় ছোটবেলা থেকেই খুব ভাল। নিজের মেধার গুনে সব স্পেশাল স্কুলএ পড়ে এসেছে। আমাকে কোন খরচ করতে হয় নাই। উলটা বৃত্তি নিয়ে আসতো। আমার জন্য সবচেয়ে বড় সারপ্রাইস ছিল ওর কলেজে চান্স পাওয়া নিয়ে। আমার ইচ্ছা ছিল না অনেক দূরে কোথাও পাঠানোর। তাই আগেই বলে দিয়েছি বাইরে এপ্লাই কোরো না। কাছে ধারেই চেষ্টা কর যাতে বাসা থেকে গিয়ে ক্লাস করতে পারো। ছোটবেলা থেকেই বলে আসছে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। অনেক কলেজের পাশাপাশি সে নিউইয়র্কের “কুপার ইউনিওন’ এও এপ্লাই করে বসলো। এই কলেজ সম্পর্কে আমি এর আগে কখনো শুনি নাই। ছেলের কাছে শুনে অনলাইনে গিয়ে সার্চ দিয়ে সব জানলাম। প্রতি বছর খুব অল্প সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী নেয় এরা শুধু মাত্র মেধার ভিত্তিতে।আর যারা সুযোগ পাবে তাদের কোন টিউশন লাগবে না।আমি স্বপ্নেও চিন্তা করি নাই আমার ছেলে ওই কলেজেই চান্স পেয়ে বসবে। যখন বাসায় চিঠি আসলো আমার তো কথা বন্ধ হয়ে গেলো। আমার ছেলে খুব কম কথা বলে। কিন্তু সে যে এত ব্রিলিয়ান্ট সেটা আমি আসোলেই বুঝি নাই। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চার বছরের জন্য দুই লক্ষ ডলার টিউশন ফি বৃত্তি পেয়ে গেলো এই ছেলে।অনেক বড় বাঁচা বাঁচিয়ে দিলো আমাকে। আর খুব গর্বিত পিতা বানিয়ে দিলো আমার মনের অজান্তেই।

বাসা থেকে কলেজে যেতে প্রায় দুই ঘন্টা লাগে। সে হোষ্টেলে যেতে চাইলো। আমি নিজে ছাত্রজীবনে দুই টাকা ভাড়ার দুরত্বে থেকেও হলে চলে গিয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু স্বার্থপরের মত নিজের ছেলের ব্যাপারে বেঁকে বসলাম।অগত্যা ছেলে দুই ঘন্টা সময় লাগিয় বাসে ট্রেনে করে কলেজে যায় , অফ পিরিওডে বাসায় না এসে লাইব্রেরীতে বসে পড়ে , টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমায় আর গভীর রাতে অনেক ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে। ওর অবস্থা দেখলে আমার নিজের ই খুবমন খারাপ হয়ে যেতো। এতে করে পড়ারও খুব ক্ষতি হচ্ছিল। কিন্তু বুঝেও তখন আর কিছু করার ছিলনা। বছরের মাঝখানে ডর্মে সিট পাওয়া যায়না। আর এই কলেজে শুধু মাত্র ফ্রেস্ ম্যান ইয়ারে ডর্মে সিট দেয় তারপর নিজ নিজ ব্যবস্থায় থাকতে হবে। হাইস্কুল থেকে কলেজে গিয়ে যেন পুকুর এ সাতার শিখে সাগরে সেটা প্রাক্টিস করতে যাওয়া। আমার অন্তত তাই মনে হইসে। আমার গোয়ার্তুমির কারনে ছেলে রেসাল্ট একটু খারাপ করে ফেলেছে ফার্স্ট ইয়ারে। আমি ভেবেছিলাম বাসার বাইরে থাকলে হয়ত উলটা পালটা কাজ করে ফেলবে যা আমি বুঝতে পারবো না। নিজেকে দিয়ে ছেলেকে বিচার করে ফেলেছিলাম। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার ছেলে আমার চেয়ে হাজার হাজার গুনে ভাল আর মেধাবি। ঠিক তখুনি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম সেকেন্ড ইয়ার শুরু হলেই ছেলেকে ওর ইচ্ছামত কলেজের আশে পাশে বন্ধুদের সাথে বাসাভাড়া করে থাকতে দিতে রাজী হব।

সামারের লম্বা ছুটি কাটিয়ে ছেলেরা দেশ থেকে ফিরে এলো। দেশ ওদের অনেক প্রিয়। দাদা আর নানা বাড়ির আদর ওরা ভালই আদায় করতে জানে। ওদের কাজিনের বিয়েতে অনেক হৈ চৈ করেছে। হলুদের অনষ্ঠানে নেচেছে । ভিডিও দেখে বুঝলাম খুব উপভোগ করেছে দেশের বিয়ে। সামার প্রায় শেষ। কলেজের ছুটিও শেষ। ছেলে বন্ধুদের সাথে বাসা ভাড়া করেছে কলেজের ঠিক পাশেই। গিয়ে দেখে এসেছি। মুরগির খোপের মত রুমে দুইজন থাকবে। রুম মেট ওর হাইস্কুলের সহপাঠি। চাইনিজ বশোদ্ভুত। ওরা সাধারনত পড়াশুনায় অত্যন্ত ভাল হয়। তবুও জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম রেসাল্ট কেমন হয়েছে ফার্স্ট ইয়ারে। কুত কুতে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জার সাথেই উত্তর দিল জিপিএ ফোর। শুনে বুঝলাম জিনিয়াস ছেলে। আমার আর চিন্তা করার কিছু নাই।
আজ সারাদিন ছেলের শপিং করলাম। ছেলে লিস্ট করে নিয়েছে কি কি লাগবে। আমাকে বলছে আর আমি কিনছি। এক পর্যায়ে বলল “আব্বি, একটা বদনা লাগবে।” আমি হো হো করে হেসে দিলাম।

আমার বড় ছেলে অনেক লক্ষী আর স্ট্রীট স্মার্ট। রাস্তা ঘাট আমার চেয়ে ভাল চিনে। গাড়ি চালানোর সময় সে আমার জিপিএস হিসেবে কাজ করে। জানিনা কেমন করে থাকব ওকে ছাড়া। ছেলে মনের আনন্দে সব গুছাচ্ছে কি কি নিবে । দেখে মনে হছে যেন ছেলের বিয়ের বাজার করছি। আর ভিতরে ভিতরে মন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে দিচ্ছি না।

আমি নিজে কিছুটা কনজারভেটিব ত অবশ্যই। তবুও ওরকম না যে টিভিতে কোন চুমুর দৃশ্য আসলেই চ্যানেল চেঞ্জ করে দেই। আমি জানি আমার ছেলেরা খুব খারাপ কিছু করতে পারবে না । ওকে একা থাকতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে কিছু কারণও রয়েছে।

ওরা আমার মত পরিবেশে বড় হয় নাই। ওদের সব সময় লাগামের ভিতর চলতে হয়েছে। এর এমন হলে ওরা ঠিকমত পরিপক্ক হয়না। স্বনির্ভর হয়না। সব সময় নির্ভরশীল থাকতে চাইবে। এমন ছেলেরা জীবনে বেশিদুর এগুতে পারেনা। কিছু করতে গেলেই মা বাবা’র পারমিশন চাইবে। তাহলে শুধু বয়স বাড়লেও, পড়াশুনায় অনেক ভাল হলেও, অনেক ভাল জব করলেও ওরা শিশুই রয়ে যায়। আর সেজন্য সমস্থ দায়ভার কিন্তু বাবা মা’র উপরেই বর্তায়। তাই আমি মনে করি একটা পর্যায়ে সন্তানদের নিজের মত করে বারতে দেয়া উচিত। তাহলেই সন্তান পিতা মাতার কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করা হয়।

পোস্টটি ১৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


সুইট কিউট সন্তানের বাবার আদর মাখা পোষ্ট!

টোকাই's picture


ধন্যবাদ

সামছা আকিদা জাহান's picture


দোয়া করি বাচ্চারা যেন মানুষ হয়। আসলে যত বড়ই হোক বাচ্চা বাচ্চাই।তারা আমাদের সন্তানই থেকে যায়। শুধু মনে হয় পারবে তো? নিরাপদে থাকবে তো?তবুও যেতে দিতে হয়। কবে যে বড় হয়ে যায় টেরই পাই না।

টোকাই's picture


দোয়া করবেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


মায়ামাখা পোষ্ট, চমত্‍কার লাগলো পড়তে। ওরা অনেক ভালো থাকবে, ইনশাল্লাহ। আরেকদিন ছোট ছেলেটাকে নিয়ে লেইখেন। ভালো থাকেন।

টোকাই's picture


অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ লিখবো।

জ্যোতি's picture


বাবা-মায়ের কাছে সন্তানেরা সেরা সম্পদ। দোয়া করি আপনার ছেলেদের নিয়ে আপনার গর্ব থাকুক সারাজীবন ভর।

টোকাই's picture


অনেক ধন্যবাদ

দূরতম গর্জন's picture


আল্লার রহমত বর্ষিত হোক অনন্তধারায়

১০

টোকাই's picture


শুভকামনার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা

১১

তানবীরা's picture


আমি নিজে কিছুটা কনজারভেটিভ ত অবশ্যই।

Wink Wink Wink

শুভকামনা Big smile

১২

টোকাই's picture


আফা, এইভাবে চোখ টিপ মারলে ভর্কাইয়া যাই কইলাম

১৩

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ছেলেবেলায় অনেক কথার পরেই বাবা বলতেন- আগে বাবা হ, তখন বুঝবি সন্তানের জন্য কেমন লাগে। বাবা আজ নেই, বাবার সেই কথাটা আমার এখন প্রায়ই মনে পড়ে। খুব ভাল লাগলো আপনার মায়াভরা পোষ্টটা।

১৪

টোকাই's picture


একদম ঠিক। বাবা থাকতে মর্যাদা বুঝি না। নিজে বাবা হয়ে একটুতেই অস্থির হয়ে যাই।

১৫

টুটুল's picture


বাপ কি... কিছু কিছু টের পাই Smile

১৬

টোকাই's picture


ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা শব শিশুর ই অন্তরে

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.