ইউজার লগইন

স্মৃতির পাতায় ১৩ই সেপ্টেম্বর

আজ সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ।
এই দিনটার অনেক গুরুত্ব আছে আমার কাছে। সেটা পরে বলছি।
নিউয়র্কের সংক্ষিপ্ত গরমকাল প্রায় শেষ বলা যায়। এখন আর শুধু টি শার্ট পরে বাইরে বের হওয়া যায়না। দিনের বেলায় নরম রোদ, আরামদায়ক উষ্ণতা। বেলা পড়তে শুরু করলেই শীত অনুভব করা যায়। আরো বুঝতে পারি যখন দেখি হাত পা শুকনা আর খস্ খসে লাগে, লোশন মাখাতে হয়। রাতের বেলায় আর এ,সি চালাতে হয়না। ফ্যান না হলেও ঘুমানো যায়। বারো মাস লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমা্নোর অভ্যাস আমার। শীতে তো দিতেই হয় আর গরমকালে এ,সি / ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর মজাই আলাদা।

বহু বছর আগে সেপ্টেম্বরের এই দিনটায় আমি এই শহরে এসেছিলাম সুদুর বাংলাদেশ থেকে। আমার কোনই পরিকল্পনা ছিল না বিদেশে যাবার। মাস্টার্স শেষ করে প্রায় সাথে সাথেই ঢুকে পড়েছিলাম একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কের চাকুরিতে। ভালই লাগছিলো। নয়টা পাঁচটা চাকুরি। বিকেলে শাহবাগ এ গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গভীর রাতে মোহাম্মদপুরে বাসায় ফিরে ঘুম। পরদিন আবার একি রুটিন। আমার সাথে্র ঘনিষ্ঠ ক’জন তখন পাড়ি জমিয়েছে দেশের বাইরে। ওরা প্রায় ফোন করে আমাকে অফিসে। খোঁজ খবর নেয়। এর ওর কথা জিজ্ঞেস করে। বেতন কত পাই জানতে চায়। আমার বেতনের কথা শুনে ওরা হাসা হাসি করে। বলে এটাতো আমাদের একদিনের বেতন। ছিহ, এটা কোন জব হোল? তুই চলে আয় আমাদের এখানে। অনেক মজা। আমি কানে তুলতাম না এসব। তাছাড়া তুলেই বা কি হবে! আমার এমন কি যোগ্যতা আছে যে আমি ভিসা পাবো? এত কম বয়সে কি কেউ বেড়াতে যাবার জন্য ভিসা পায় নাকি। আর পেলেও টিকেট কেনার টাকা পাবো কই? যা বেতন পাই পনেরো দিনেই শেষ হয়ে যায় রিক্সা ভাড়া, সিগারেট আর শাহবাগের আড্ডায় চা কফি খেয়ে। থাকা খাওয়া তো বোনের বাসায় ফ্রি। কাজে ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমি আমার মত দিন কাটাচ্ছিলাম।

ব্যাঙ্কে কাজ করতে গিয়ে নানারকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়। কারো কারো সাথে সখ্যতাও হয়ে যায় সমমনা আর সমবয়সী হওয়ার কারনে। তেমনি একজন ছিল, তার নাম নজরুল। গোরানের ছেলে নজরুল আমার ব্যাচ এর । অল্প দিনেই আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসে সম্ভোধন । সামান্য পুঁজি দিয়ে একটা করে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করে জাপান থেকে। ঐটা বিক্রি করে টাকা বের করে আবার নতুন করে এল,সি করে আরেকটা গাড়ির জন্য। বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তাই অনেক কথা হয়। সব কিছু জেনে নিয়ে ওকে ওর ব্যবসার জন্য লোন করিয়ে দিলাম যেন একসাথে বেশ কয়টা গাড়ি আনতে পারে। সেতো মহা খুশি। কিভাবে আমাকে খুশি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। প্রাইভেট ব্যাঙ্কে কাজ করি। সদ্য ভার্সিটি থেকে পাশ করা। ঘুষ দেয়া নেয়া বুঝতাম না। চিন্তাও করি নাই। একদিন নজরুল এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি আমেরিকায় যাবো কিনা। শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম , কেন তুমি কি আদম ব্যবসা আরম্ভ করস নাকি? শুনে ও হেসে উত্তর দেয় , ওসব কিছু না। এম্বেসি র এক লোক তার কাছ থেকে একটা গাড়ি কিনেছে। নজরুল তাকে ভাল ট্রিট করেছে । তাই ওই লোক বলেছে নজরুল বা তার কোন কাছের মানুষ যদি আমেরিকায় যেতে চায় তাহলে যেন তাকে জানানো হয়। এর জন্য কোন বাড়তি পয়সা লাগবে না। নজরুল বলল, তুমি যাও এম্ব্যাসিতে, দেখি আসোলে কাজ হয় কিনা।

আমার পাসপোর্ট ছিল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে একদিন ঠিক হাজির হয়ে গেলাম বারিধারায়। নজরুল আগেই বলে রেখেছিল। আমাকে দুই চারটা কথা জিজ্ঞেস করে বিকেল তিনটায় পাসপোর্ট পিক আপ করতে বলল। বের হয়ে দেখি নজরুল অপেক্ষা করছে, জানতে চাইল খবর কি। বললাম তিনটায় আসতে বলেছে। তখনো জানতাম না যে পাসপোর্ট রেখে বিকেলে নিতে বলার মানে হল ভিসা দিবে। যাইহোক, বিকেলে আবার গেলাম। পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দেখি ভিসার সিল দেয়া। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বাইরে এসে নজরুলকে দেখালাম। তখন বুঝলাম আমি সত্যি আমেরিকায় যাচ্ছি। ব্যাঙ্কে ফিরে এসে সবাইকে জানালাম আমি ভিসা পেয়েছি। সবাই ত অবাক। এটা কি করে সম্ভব? আমেরিকার বন্ধুদের জানালাম। ব্যাঙ্ক থেকে ছয়মাসের ছুটি নিয়ে বন্ধুর মা’র কাছ থেকে টাকা ধার করে টিকেট কিনে একদিন আমি আমেরিকায় যাবার জন্য প্লেনে উঠে বসলাম।

সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে সৌদি আরব হয়ে নিউইয়র্ক যেতে হবে। এত লম্বা জার্নি সম্পর্কে আগে কোন ধারনা ছিল না। তার উপর সস্থা টিকেট হওয়ার কারনে আরব দেশের লোকাল ফ্লাইটে এখানে ওখানে ঘুরিয়ে অনেক খারাপ ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে ভোরবেলায় নিউইয়র্কে নামলো প্লেন।

কিছু জানিনা, চিনিনা। জীবনের প্রথম বিদেশে এতদুরে একা একা আসা। অন্য সবাইকে অনুসরন করে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম। আমেরিকার বন্ধুরা বলে দিয়েছিল সম্ভব হলে যেন কৃষাংগ অফিসারের হাতে না পড়ি। ওরা নাকি খুব জালায়। অনেক কয়টা কাউন্টার। কিন্তু নিজের কোন চয়েস নাই। ওদের লোক যেখানে দাঁড় করালো তাকিয়ে দেখি, আমার পোড়া কপাল, বিশাল দেহী এক কৃষাংগ মহিলা অফিসার হাত ইশারা করে আমাকে ডাকছে। ভয়ে ভয়ে মহিলার সামনে গিয়ে ‘গুড মর্নিং”বলে পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। আমার গুড মর্নিং এর কোন উত্তর না দিয়ে বিরক্ত চেহারা নিয়ে পাসপোর্টের ছবির সাথে আমার চেহারা মিলিয়ে দেখে নিচ্ছে। এদিকে আমার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। একবার শীতে ঠিক ঠক করে কাঁপি আবার দেখি গরমে দর দর করে ঘামছি। ঢাকার বন্ধুরা চাঁদা উঠিয়ে নতুন ব্লেজার, টাই ,জুতা কিনে দিয়েছিল। ওসব পরে ভাবছিলাম আমাকে না জানি কত ইম্প্রেসিভ লাগছে। মহিলা ওসব কিছুই না দেখে আমাকে নিরস করে পাশের একটা কামরা দেখিয়ে ওদিকে পাঠিয়ে দিলো। শুনেছি কাউন্টারেই এন্ট্রি সিল মারে। কিন্তু সেটা না করে অন্যরুমে পাঠানোর মানে হল কপালে দুঃখ আছে। ভিসা পেলেই যে কেউ আমেরিকা্তে ঢুকতে পারবে এমন কোন গ্যারান্টি নাই। ইমিগ্রেশন অফিসার কিছু সন্দেহ করলে এয়ারপোর্ট থেকেই যে কাউকে ডিপোর্ট করতে পারে। তার জন্য কোথাও ধর্না দিয়ে কোন কাজ হবেনা। পত্রপাঠ বিদায় হতে হবে। বুক ফেটে কান্না আসছিল। আমার বেলায় যদি তাই হয় তাহলে কি উপায় হবে, ঢাকায় ফিরে গিয়ে কেমন করে মুখ দেখাবো? আর ধার করে কেনা লাখ টাকার টিকেটের টাকাই বা শোধ করবো কিভাবে? এসব ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করল।

বেশ অনেক্ষন পর এক শ্বেতাংগ অফিসার রুমে ঢুকেই ‘হ্যালো, গুড মর্নিং” বলে চেয়ার টেনে বসলো। আমার পাসপোর্ট দেখে জিজ্ঞেস করলো এখানে কোথায় যাবো, কতদিন থাকবো, কত টাকা নিয়ে এসেছি। সব জেনে নিয়ে একটু পর পাস্পোর্টে এন্ট্রি সিল দিয়ে “ওয়েল্কাম টু আমেরিকা”বলে পাস্পোর্ট ফেরত দিল। তখনো বোকার মত বসে আছি দেখে অফিসার বলল , তুমি এবার যেতে পারো। যেন জ্ঞ্যান ফিরে ফেলাম, তাড়াতাড়ি উঠে সাইন ফলো করে লাগেজ এর জন্য বেল্টের কাছে চলে এলাম। লাগেজ নিয়ে বাইরে বের হতেই দেখি দাঁড়িয়ে আছে বন্ধু মাশুক। বুঝলাম আর কোন বিপদ নাই আপাতত।

আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো বুকে। পরিচয় করিয়ে দিল সাথে আসা কয়েকজন কে। বাইরে এসে আমাকে যে গাড়িতে উঠালো সেটা আমি জীবনে চোখের দেখা দূরে থাক কোন সিনেমায় ও দেখি নাই। ইয়া লম্বা ছয় চাকার গাড়ি। গাড়ির ভিতরে ঢুকে আরো বোকা বনে গেলাম। দেখি বিশাল সোফা দুই পাশে। ছোট টেলিভিশন,ফ্রিজ, টেলিফোন আছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা বিয়ার বের করে খুলে আমাকে খেতে দিলো। হটাত উপরে তাকিয়ে দেখি মাথার উপর থেকে গাড়ির ছাদ সরে যাচ্ছে। আকাশ দেখা যায়। সব কিছু আমার কাছে ভোজবাজির মত লাগছিল।মাশুকের সাথে আসা বন্ধুরা খুব মজা পাচ্ছিল আমার চেহারায় অবাক হবার নমুনা দেখে। সবাই খুব হাসা হাসি করছিল আমার অবস্থা দেখে। আর আমি মনে মনে ভাবছিলাম, বাহ এরা কত বড়লোক। কত বড় গাড়ি চালায়।
পরে জেনেছিলাম ওটার নাম স্ট্রেচ লিমোজিন। এক ধরনের ট্যাক্সি। ভাড়া করা যায়। যেই বন্ধুটা ওই গাড়ি চালাচ্ছিল সে একজন স্টুডেন্ট। পড়ার খরচ চালানোর জন্য পার্ট টাইম লিমোজিন চালায়। মাশুকের বাসায় পৌছে গেলাম। মাশুক আর তার বেয়াই থাকে একটা বাসায়। বেয়াই বরিশাল থেকে সরাসরি আমেরিকায় চলে এসেছে। কখনো ঢাকা শহর দেখে নাই বলা যায়। বেয়াই আমার জন্য নাস্তা বানালো চারটা ডিম পোচ, আট দশ স্লাইস পাউরুটি, এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস, বিশাল এক বোল ফল। এত খাবার দেখে মনে পড়ল সুর্যসেন হলে সকালের নাস্তায় রুটি আর ভাজির সাথে একটা ডিম খেতে পারলে জীবন শান্তি হয়ে যেতো, তাও প্রতিদিন খেতে পারতাম না পয়সার জন্য। আস্তে আস্তে আরো বন্ধুরা এসে হাজির হল আমাকে দেখতে। সারাদিন আড্ডা হোল। হলের সিনিয়র হেলাল ভাই খবর পেয়ে ফোন করে রাতে ওনার বাসায় খেতে বলল। সবাই ওনার বাসায় গেলাম সাবওয়ে ( পাতাল রেল গাড়ি) করে। দেশ থেকে পাতলা শার্ট প্যান্ট পরে এসেছিলাম। বিকেলে যখন বাসা থেকে বের হয়ে হেলাল ভাই;র বাসায় যাই তখনো ঠান্ডা লাগে নাই। রাতের খাওয়া শেষ করে যখন ওনার বাসা থেকে বের হলাম, ঠান্ডা বাতাসে আমি ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছিলো বরফ ঠান্ডা বাতাস আমার পাতলা শার্ট, প্যান্ট আর জুতা ভেদ করে হাড্ডির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। তাড়া তাড়ি আবার হেলাল ভাই’র বাসায় ফিরে এলাম।উনি জ্যাকেট আর মাথার টুপি দিলো। ওসব পড়ে তারপর বাসায় ফিরলাম । সেদিন ছিল সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ। আমার আমেরিকার দীর্ঘ জীবনের প্রথম দিন।

তারপর অনেক দিন মাস বছর কেটে গেছে। আমিও অভ্যস্থ হয়ে গেছি এই দেশের ঠান্ডা আর গরমের সাথে। খাবার আর পরিবেশের সাথে। হয়ে গেছি এই দেশের ই একজন। কিন্তু কখনোই ভুলিনা এই দেশে আসার প্রথম দিনটার কথা।

পোস্টটি ১২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


ওহ, দারুণ পোষ্ট। মুগ্ধ হলাম আপনার সরল বর্ননায়!

সামছা আকিদা জাহান's picture


খুব ভাল লাগল।

তানবীরা's picture


নজরুল নিজে না এসে আপনাকে কেন সুযোগ দিলো? !!

একটা পারটি দিতে পারেন, এ্যামেরিকা কামিং ডে Big smile আমরা দুই চাইরটা ভাল মনদ খাই, দুয়া করি Big smile

টোকাই's picture


চইলা আসেন . আপনেরে খাওয়াই .

টোকাই's picture


আমি ছিলাম ফার্র্স্ট এক্সপেরিমেন্ট . নজরুল ও পরে চইলা আইসে তিতা'ফু . Glasses

মাহবুব সুমন's picture


আপনার সাথে আমার একটা মিল আছে, ১৩ তারিখে , মাসটা ছিলো ফেব্রুয়ারি

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.