স্মৃতিচারণ
একটা সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আলাদা কদর ছিলো, এইচএসসিতে পাশের হার ছিলো ৩৩ এর আশেপাশে, অসংখ্য ছাত্র একবারে এইসএসসি পাস করতে পারলেই আনন্দ আটখানা হয়ে যেতো, সে সময়ে গ্রামে-গঞ্জে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামটা শুনলেই লোকজন একটু আলাদা চোখে দেখতো- যদিও আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পেছনে এসব কোনো কারণই ছিলো না। পরিচিত বিভিন্ন ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা যেহেতু মেডিক্যাল বুয়েটে ঢুকে গেছে সুতরাং তাদের সাথে আজীবন তুল্য হওয়ার যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে চাওয়ার তাড়নাটা একটা বড় অনুপ্রেরণা ছিলো।
বিভিন্ন রকম হিসাব কষে অতীত উদাহরণ ঘেঁটে বুঝলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে হলে আমাকে ভর্তিপরীক্ষায় ৬০ এর কাছাকাছি নাম্বার পেতে হবে- সেটাই আমার বেঞ্চমার্ক- এর বেশী পেলে যেকোনো সাব্জেক্টে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবো, তবে কম পেলে টানাটানি পরে যাবে। সুতরাং কোচিং এর বাদলে কিভাবে ১০০তে ৬০ পাওয়া যাবে সেটা নির্ধারণ করাটা এক ধরণের কর্তব্যে পরিণত হলো।
কোথাও কোচিং এ ভর্তি না হয়ে দিব্যি আড্ডা দিয়ে, ঘুরে ফিরে চললো কয়েকদিন, মামা পরম আগ্রহে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ভর্তিপরীক্ষার ফর্ম কিনছে, পাঠাচ্ছে, আমার আপত্তির কোনো বাছ বিচার নেই, সবগুলোতেই ভর্তি পরীক্ষা দিতেও যাই নি, দিলাম জাহাঙ্গিরনগর, বুয়েটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম কিনেছিলাম আমি আর আমার আরেক বন্ধু- তখন সিরিয়ালের যুগ- পরপর সিরিয়াল হলে পাশাপাশি সীট পরবে, সুবিধা হবে- পরীক্ষার আগের সপ্তাহে বললো ন্যাশন্যাল ইয়ুথ কম্পিটিশনের ম্যাচ আছে বৃহ:স্পতিবার পাবনায়- আমি খেলাটা শেষ করে বাসে উঠবো- সীট তো ঢাকা কলেজে পরছে- তুই গেটের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করিস, একসাথে ঢুকবো।
পরীক্ষার সীট খুঁজে পেতে সমস্যা হয় নি, ওর কোনো পাত্তা নেই দেখে গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ- পরে সোয়া নয়টায় আশা ছেড়ে পরীক্ষার হলে ঢুকে গেলাম ভালো মানুষের মতো- ও পরীক্ষা দিতে আসে নি, সারারাত তিনতাস পিটিয়ে সকালে ঘুমিয়েছে- পরীক্ষা দিয়ে কি হবে?
বুয়েট কিংবা জাহাঙ্গীর নগরে সুযোগ না পেলেও অন্য দুটোর এডমিশন পরীক্ষায় টিকেছিলাম, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর=তির ইন্টারভিউ আর ময়মনসিংহের ভর্তির ইন্টারভিউর মাঝখানে ছিলো এক দিনের ব্যবধান।
আমি বন্ধুদের সাথে ট্রেনে উঠেছিলাম ঢাকা উদ্দেশ্যে ,সবাইকে উৎকন্ঠার ভেতরে রেখে প্রায় ৫২ ঘন্টা পর দিনাজপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছে জানলাম আমার খোঁজে মাতম শুরু হয়েছে, আমি যে মাঝপথে বন্ধুদের সাথে ময়মনসিংহে নেমে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে দিবো এটা পূর্বে ঠিক করা ছিলো না। দেখলাম অনেকে নামতেছে, আমিও নেমে গেলাম, পরের দিন সেখানে ভর্তির দিন তারিখ ছিলো, সেখানে উপস্থিত হয়ে জানলাম আমার মৎস্য পালন কিংবা এই নামের কোনো একটা ডিপার্টমেন্টে সুযোগ হয়েছে, মাইগ্রেশনের সুযোগ আছে, কৃষিতে হয়ে যাবে।
আমার সেসবের কোনোটাই জানা নেই, শুধু বন্ধুরা ভর্তি হবে, আমি তাদের সাথে থেকে গেলাম রাতটা, পরের দিন রাতটাও থেকে গেলাম তারপর সকালে ট্রেনে করে ঢাকায়- ততক্ষণে আমাকে জীবিত দেখে সবাই আশ্বস্ত যে মাঝরাস্তায় কোথাও একসিডেন্ট হয়ে মারা যাই নি আমি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বেশী সময় লাগে নি, বিস্তর দালানে ঘুরে ঘুরে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হয়েও গেলাম, সব শেষ করে দিনাজপুর ফিরে গেলাম। সেখানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আবার সংবাদ আসলো মাইগ্রেশন হয়েছে, আমি ফিজিক্সে যাচ্ছি সেটা কনফার্ম করতে হবে নাইলে ভর্তি বাতিল। অদ্ভুত নিয়ম তাই ছুটে আসতে হলো ঢাকায়।
দিনাজপুরের বন্ধুদের সাথে আডডা দিতে দিতে বললাম বিকেলের একটা ট্রেনের টিকেট কিনে আনতে হবে, ঢাকা যাচ্ছি=
কবে যাচ্ছো তুমি?
আজকে বিকালেই যাচ্ছি, বাসায় যাবো খাবো তারপর ঢাকার ট্রেনে
তোমার কি আমাদের কথা মনে থাকবে?
কারো কাছে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে কিছুটা বিব্রত লাগে, বললাম মনে থাকবে না কেনো? না তুমি এখন ইউিভার্সিটি পড়বা, আমাদের কথা মনে থাকবে কেনো?
বললাম যদি কখনও ভুলে যাই, যদি কখনও ভাব নেই তাহলে জুতা খুলে দুইটা বাড়ি দিবি।
একজন অত্যুৎসাহী বললো শুয়েরের বাচ্চা ভাব চোদাচ্ছে,ভাবিস্ট হইছো তুমি? তোমাকে লাত্থি দিয়া দিনাজপুর থেকে বাহির করবো
ঐ শালার এইটাই মনে থাকবে
বিকেল বেলা পরম উৎসাহে ১০ ১২জন মিলে লাত্থি দিয়ে ট্রেনে তুলে দিলো, একজন পরমসুহৃদ অবশ্য এর ভেতরেই আমাকে পাঁচটা সিগারেট দিয়েছে জার্নিতে খাওয়ার জন্য- সেই সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে দিনাজপুরের স্টেশন ছাড়লাম।
ঢাকায় তেমন কাজ ছিলো না, একটা ফর্ম নিয়ে ডিপার্টমেন্টে জমা দেওয়া আর একটা সিগনেচার করা, সেটা করে ঢাকায় আর করনীয় কিছু নাই, সুতরাং চলো দিনাজপুর, জুলাই মাসের কোনো এক বিকেলে ঢাকার স্টেশনে এসে ট্রেনে চড়লাম যখন তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-
পথে নামার আগে আমার ঘাড়ের ছোট্টো ব্যাগে একটা টি শার্ট- একটা প্যান্ট- জার্নিতে সাম্ভাব্য ভাড়ার দ্বিগুণ পয়সা নিয়ে যাওয়ার বাইরে অন্য কোনো সাবধানতা কখনও অবলম্বন করি না। যদি কোথাও কোনো ঝামেলা হয় যেনো পকেটের পয়সায় বাসায় পৌঁছাতে পারি এটুকু নিশ্চিত হলে আমি রাস্তায় নেমে পরতে পারি-
তখন ঢাকা দিনাজপুর ট্রেনের টিকিট ১৪০ টাকা, যমুনা ব্রীজের সারচার্জ ৫ টাকা। পকেটে একটা ৫০০ টাকার নোট আর খুচরা মিলিয়ে ৭০০ টাকার বেশী নেই- সেটাই সম্বল করে ট্রেনে উঠলাম। সকালের ট্রেন, হিসাব মতো পৌঁছে যাবো রাতে-
বর্ষাকালের ট্রেনের জার্নি চমৎকার, ট্রেন লাইনের দুইপাশে গ্রাম, থইথই পানি আর গাঢ় সবুজ গাছ। নতুন পাতা আর ঠান্ডা বাতাস, বিলাসিতা বলতে চলতি ট্রেনের খাওয়ার কামরায় গিয়ে আয়েশ করে চায়ের চুমুক দিতে দিতে সিগারেট টানা।
যমুনা ব্রীজ নেই, সুতরাং জামালপুর থেকে ঘাটে, ঘাটে স্টীমারে উঠে অন্যপারে যাও, তারপর সেখান থেকে দিনাজপুরের ট্রেন। যমুনার দুইপারে দুইটা ট্রেনে যাতায়ত।
ট্রেনে পরিচয় হয়েছিলো নিউটন ভাইয়ের সাথে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়ে তিনি মাস্টার্সের ছাত্র, আমাকে দেখে বললেন তুমি কোথায় পড়ো-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
কোন ডিপার্টমেন্ট
বললাম, তিনি নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে গেলেন, আমিও একটা সেবার বই কিনে পড়া শুরু করলাম। চমৎকার ভ্রমণ- জামালপুরে পৌঁছালাম যখন তখন দুপুর- ঝুম বৃষ্টি আর নদীর ঘাট ভাঙছে
স্টীমারের ঘাটের দুইপাশে বিভিন্ন ছোটোখাটো হোটেল, প্রতিবারই সেখানে যাওয়ার সময় বিভিন্ন খাওয়ার দেখি, একা গেলে মাঝে মাঝে খাওয়া হয় কিন্তু বেশীর ভাগ সময় স্টীমারেই খাই। আজকে স্টিমারে খাওয়া জুটবে না, স্টীমার ঘাটে ভিড়তে পারতেছে না।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার অন্য পাশে পাতলা একটা চিড়, দোকানি বললো এই ছেলে এই দিকে আসো, দেখতেছো না ঘাট ভাঙতেছে, তুমি ঐখানে কি করো?
লোকটার গলা শুনে লাফিয়ে পিছনে আসলাম, আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওটা সোজা নদীর ভিতরে গিয়ে পড়লো- বড় বড় মাটির চাঙর ভাঙছে- ঝুম বৃষ্টি- স্টিমারের লোকজন ঘাটের নৌকায় উঠে এপারে এসেছে, ওদের নিয়ে আমাদের ট্রেনও চলে গেছে, বিকাল ৫টা, বৃষ্টির বিরাম নেই-
অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে মনে হলো এবার একটু কোথাও আশ্রয় নিতে হবে- ঘাটে ভিড়তে না পারা স্টিমার দেখে দেখে বেশীক্ষণ সময় কাটানো যাবে না। পাশের একটা ট্রেনের কামড়ায় উঠলাম, ছোটো কামরা, আমার আগেই আরও একটা পরিবার উঠে বসে আছে, ৬ থেকে ১০ জনের পরিবার হয়তো- আমাকে দেখে একজন বললো এই ছেলে তুমি এই কামরা থেকে যাও, আমি এখন বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবো- আমি বাইরে বৃষ্টির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু দুধখাওয়ার মহিলার সাথে থাকা বয়স্ক মহিলা যেভাবে মুখ খুলে বললেন এই ছেলে এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেনো- আর থাকা গেলো না কামরায়, বৃষ্টির মধ্যেই নেমে যেতে হলো
অবশেষে সন্ধ্যা ৭টায় কাদা পানি ডিঙিয়ে স্টীমারে উঠলাম। স্টিমারের সিঁড়ির দুইপাশে বইয়ের দোকান, সেখানে শরৎচন্দ্র, নিমাই ঠেকে শুরু করেরসময় গুপ্ত সবার বইই পাওয়া যায়- পকেটের টাকা ভিজে গেলেও এখনও বই কেনা যাবে- একটা জুতসই বই কিনবো কিনবো ভাবছি এই সময়ে আবার দেখা হলো নিউটন ভাইয়ের সাথে - তিনি কুড়িগ্রাম নামবেন- আমি আরও কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে যাবো দিনাজপুর।
বৃষ্টিতে ভেজা শার্ট তখনও বদলানোর সুযোগ হয় নি, বললেন চলো আমার সাথে দেখো কি করতে হয়-
ট্রেনের এটেন্ডেন্টস ছিলো স্টীমারে, তারা ফার্স্ট ক্লাশের ঘরে বসে, সে ঘরের দরজায় গিয়ে বললো দেখেন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- যাচ্ছি বাসায়- কোথাও বসার জায়গা পাচ্ছি না। এখানে একটু বসতে দিতে হবে।
আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন? সমস্যা নাই বসেন।
আমি অবাক হয়ে দেখছি তাকে।
মাথা মুছে শীতে কাঁপছি ফার্স্ট ক্লাসের এসি কেবিনে বসে। সিগারেট টানতে হবে এমনটাও ভাবছি কিন্তু বাইরে বৃষ্টির ভেতরে কোথাও দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতেও আগ্রহ পাচ্ছি না। এমন সময় হঠাৎ শব্দ হলো, আমাদের স্টীমারের তলা ঠেকে গেছে নদীর চড়ায়- উদ্ধারকারী স্টীমার না আসলে এখান থেকে মুক্তি নেই-
আমরা পরিস্থিতি বিবেচনায় উদ্বিগ্ন হওয়ার আগ্রহটুকু হারিয়ে ফেলেছি- মুহূর্তেই স্টীমারের পরিস্থিতি বদলে গেলো- স্টীমার মাঝ নদীতে আটকা পরেছে, পরবর্তী খাওয়ার সুযোগ কখন আসবে জানা নেই, স্টীমারের সব লোকই মনে হয় পাগল হয়ে গেলো- ৫টাকার মুড়ি লাফিয়ে ১০ টাকা, পরিমাণে কমলো কিন্তু মানুষ খাচ্ছে- যেকোনোভাবেই হোক শরীরে শক্তি জমাতে হবে। ক্যালরী জমাতে হবে- মাত্র ১ ঘন্টায় ৫ টাকার মুড়ি ২০ টাকায় উঠলো, তারপর সব মুড়ি শেষ হয়ে গেলো। স্টীমারের নীচের ক্যান্টিনের সমুচা, অতিঅখাদ্য সিঙ্গারা এবং তারচেয়েও বাজে নুডলসও শেষ।
চায়ের নামে ঘোলা পানি, সিগারেট আর উদ্বিগ্ন মানুষের মুখের ভেতরে ঘুরছি আর চিন্তা করছি পকেটে যা আছে সেটা দিয়ে সর্বোচ্চ কয়দিন টিকে থাকা যাবে যদি এক প্যাকেট মুড়ি ২০ টাকায় কিনতে হয়।
কোনো আশা নেই, ঘড়িতে রাত ১০টা, স্টীমারেই রাতের খাওয়ার খেতে হবে- নিউটন ভাই বললেন চলো রাতের খাওয়ার খাই-
আমার ইচ্ছা তাকে খাওয়ানোর, এমন যেচে উপকার করছে- স্টীমারের ক্যান্টিনবয়কে ডেকে বললেন এখানে খাওয়ার কি ব্যবস্থা?
একপ্লেট ভাত ৫টাকা, মাংস ২৫ ডাল ১টাকা,
আর আমরা যারা ভাত ডাল বেশী খাই তাদের জন্য কি? অবশেষে তিনি পেটচুক্তি ভাট আর ডালের বন্দোবস্তও করে ফেললেন তার ক্যারিশমা দেখিয়ে।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর বললেন কোনো চিন্তা করবে না, রাতে ঘুমানোর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যদি আমাদের স্টীমারেই রাত কাটাতে হয়, ব্যবস্থা একটা হবেই।
এবং রাত সাড়ে ১১টায় তিনি মোটামুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দিয়ে স্টীমার চালকদের জন্য বরাদ্দকৃত একটা ঘরও ম্যানেজ করে ফেললেন
অবশ্য তার একটু পরেই উদ্ধারকারী বোট এসে গেলো, আমরা চরের ফাঁদ থেকে মুক্তি পেয়ে যমুনা অতিক্রম শুরু করলাম। ওপারে যখন পৌঁছালাম তখন রাত ২টা। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে- গায়ের শার্ট ভিজেছে, সিগারেটের দরকার পরলে চলমান ফেরীওয়ালার কাছ থেকে জোগার হয়ে যাচ্ছে- ট্রেনের কামরা খুঁজে উঠলাম- ট্রেনের ছাদে সমস্যা- দিব্যি বৃষ্টির পানি সীট ভেজাচ্ছে- জানালা- ছাদ সব দিক দিয়েই পানি আসছে- এর ভেতরেই কোনোভাবে বসার ব্যবস্থা করতে হবে-
সহযাত্রীদের অনেকেই চাদর বিছিয়ে বসে পরলেন, এই অবিরাম জলস্রোতের ভেতরেও তারা ঘুমিয়ে পরলেন, আমি ভেজা শরীরে বসে আছি- স্টেশনের নাম পড়ি- ঘাট থেকে ৪০ মিনিট পর বোনারপাড়া জংশন- সেখান থেকে কাউনিয়া-গাইবান্ধা- কুড়িগ্রাম রংপুর পার্বতীপুর দিনাজপুর- নিউটন ভাই বললেন তুমি ঘুমিয়ে পরো সমস্যা নাই, আমি তো একটু পরেই নেমে যাবো
ট্রেন প্রয়োজনের চেয়ে অনেক আস্তে চলছে- অন্ধকারে ট্রেনের এই হালকা চালে ছোটাটাও উপভোগ্য লাগছে না, শুধু কোনোভাবে দিনাজপুরে পৌঁছাতে হবে ভাবনাটাই মাথায় ঘুরছে- নিয়মমতো ভোর হলো, বাংলাদেশের মধ্যভাগ ততক্ষণে বৃষ্টির পানিতে স্ফীত- গাইবান্ধা-কুড়িগ্রাম- কাউনিয়া- রংপুরে নদীর পানি বেড়েছে, রেল লাইন ডুবে গেছে জায়গায় জায়গায়- কয়েকটা কালভার্ট ডুবে গেছে, ট্রেনের লাইন নড়বড়ে- সুতরাং সাবধানে যেতে হবে- কয়েক জায়গায় ডুবে যাওয়া রেল লাইনের ফিসপ্লেটগুলো লাঠি দিয়ে দেখলো লাইনম্যান, সে লাইনম্যান ট্রেন লাইনে হাঁটছে আর ট্রেন তার পেছনে চলছে ।
যতটা আগ্রহ নিয়ে দিনাজপুর যাওয়া শুরু করেছিলাম এখন যাত্রা শুরুর ২৬ ঘন্টা পরে তেমন আগ্রহ টের পাচ্ছি না ভিতরে- মনে হচ্ছে মামার কথা শুনে ঢাকায় থেকে গেলেই হতো- অনন্তকাল যাওয়ার পর ডুবে যাওয়া রেল লাইন, ভেঙে যাওয়া রেল ব্রীজ অতিক্রম করে দুপুরে রংপুর স্টেশনে এসে জানলাম ট্রেন আর আগাবে না, সামনের রেল ব্রীজের পরিস্থিতি না বুঝে যাওয়া যাবে না, ও পারে একটা ট্রেন আসবে সে ট্রেনের যাত্রীদের নিয়ে এই ট্রেন চলে যাবে- আমাদের রংপুর স্টেশনে সেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে- তারপর কোনোভাবে নৌকায় ব্রীজ পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে ট্রেনে চড়তে হবে-
সহযাত্রীদের অনেকের সাথে বড় বড় বোচকা, ট্রেনে একেবারে স্টেশনে পৌঁছাবে তাই নিজেরাই বহন করছিলো, তারা এমন পরিস্থিতি আশা করে নি, আমার সাথে একটা টি শার্ট আর একটা প্যান্ট- এ জিনিষের মায়াও তেমন নেই- সারারাতের হাবিজাবির পরও পকেটে ৩০০ টাকা টিকে আছে- রংপুর থেকে দিনাজপুরের বাসের টিকেট ৫০ টাকা-
রংপুর স্টেশনে অনির্ধারিত কাল অপেক্ষা করতে পারি অথবা বাসে করে চলে যেতে পারি দিনাজপুর- আমি প্রথমে ভাবলাম টিকেটের টাকা রিফান্ড চাইবো- ঢাকা দিনাজপুর ট্রেন ভাড়া আর বাস ভাড়া সমান- কিন্তু এই হুজ্জতি করতে ইচ্ছাও করলো না- পকেটে ট্রেনের টিকিট নিয়ে বাস স্টেশনে রওনা দিলাম
রংপুর আন্ত:জিলা বাসস্টেশন থেকে দিনাজপুরের বাসে চড়লাম- হাইওয়েতে পানি নেই, বৃষ্টি থেমে গেছে মোটামুটি- যতদুর চোখ যায় সবুজ ধানক্ষেত আর রাস্তার দুই পাশে কলমীলতার সারি- মজে যাওয়া ডোবার সাথে খালের পানি যোগ হয়েছে, কচুরিপানা ভাসছে- হালকা নীলকরুচিপানার ফুলদানি ভেসে যাচ্ছে নদীর দিকে
প্রায় বৈশিষ্ঠ্যবিহীন প্রত্যাবর্তন শেষ হলো বিকাল ৫টায়- দিনাজপুরের রাস্তা তখনও বৃষ্টিতে ভেজা- অবসন্ন শরীরে শহরের অন্যপ্রান্তের উদ্দেশ্যে রিকশা নিলাম, ঠিকমতো বাসায় পৌঁছালাম- দুপুরের খাওয়া শেষ করে আবার আড্ডায়- বন্ধু বললো
মামা তুমি যে ট্রেনে চড়লা- এরপর থেকে বৃষ্টি আর বৃষ্টি- থামলো আজকে বিকালে
ওকে বললাম বন্ধু তুমি তো জানো না , এই শহরের প্রতিটা রাস্তা আমাকে ভালোবাসে- প্রতিটা রাস্তায় আমার পায়ের ছাপ আছে- সেই আমি যখন দিনাজপুর ছেড়ে যাচ্ছি- দিনাজপুর তো কাঁদবেই- আমি দিনাজপুরে পৌঁছানোর সাথে সাথেই বৃষ্টি থেমেছে, আমি না আসলে কি আর বৃষ্টিটা থামতো
মুড়ির দাম বাড়ার গল্পটায় খুব মজা পেলাম!
চমতকার ঝর ঝরে বৃষ্টির মতো লেখা।
প্রথম যৌবনের এই বন্ধুরা পরে কোথায় যে হারিয়ে যায়...
~
খুব ভাল একটা লেখা শেষে এসে অসাধারণ হয়ে গেল।
পুরো একটা উপন্যাস কিংবা রোমান হলিডের মতো ফ্লিম হতে পারে। অসাধারণ লাগলো
মন্তব্য করুন