ফুল বঊ - আবুল বাশার
মানবীয় সকল প্রচেষ্টা ও উদ্যমকে ব্যর্থ করে দিয়ে পরাজয়ের অনিবার্যতা স্বার্থক ট্রাজেডীর বৈশিষ্ঠ্য। মানুষ স্বভাবতই প্রতিকূলতার বিপক্ষে লড়াই করে, আশাকে সম্বল করে টিকে থাকে বিরুদ্ধ পরিবেশে কিন্তু প্রকৃতি সমাজ বাস্তবতা তার বিপক্ষে চলে যেতে পারে, সকল সম্ভবনা সত্ত্বেও বিজয়ী মানুষের সামগ্রিক পরাজয় আমাদের নতুন করে বিমর্ষ করে, আমরা হতাশ হয়ে ভাবি লেখক আরও একটু উদার হতে ভালো হতো, এভাবে হারিয়ে দেওয়াটা তার ঠিক হয় নি মোটেও, আমরা আসলে সুন্দর সমাপ্তির প্রত্যাশা করি, কিছুটা নিয়তিবাদী আমরা অলৌকিক কিছুর প্রত্যাশায় বসে থাকি আর লেখক আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন সব সময় সব প্রত্যাশা সামাজিক দাবি পুরণ করতে পারে না, লেখক বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সমাজের বিদ্যমান শর্তগুলোকে সামনে রেখে চরিত্রের পরিণতি নির্ধারণ করেন, তাই পাঠকের প্রত্যাশাপুরণে ব্যগ্র না হয়ে লেখককে সামাজিক বাস্তবতার প্রতি সৎ থাকতে হয়, সে পরিণতি আমাদের সব সময় ভালো লাগবে এমনটা আশা করা অনুচিত।
আবুল বাশারের ফুলবউ পড়েছিলাম তাও দুই দশক হতে চললো, তখন ততটা বুঝি নি আসলে দ্বন্দ্বটা কতটা মর্মান্তিক হতে পারে, সামাজিক বিধান এবং ধর্মীয় বিধানের ভেতরে অনেক সময়ই গুরুতর পার্থক্য থাকতে পারে, যা কিছু ধর্মসম্মত তার সবটুকুই যে সমাজ সম্মত এমন নয়, এই দ্বন্দ্বটুকুই আসলে ফুলবউয়ের মূল ট্রাজিক উপাদান।
ধর্মীয় বিধান আর সামাজিক বিধান আমাদের অলক্ষ্যে নিয়ন্ত্রন করে, আমাদের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে সেসবের ভিত্তিতেই, তাই একটা সম্পর্কের সামাজিক মর্যাদা সময় সময় ধর্মীয় মর্যাদার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তোমার আমার বন্ধ দরজার ভেতরেও সমাজ অনায়াসে ঢুকে পরে, বৈধ অবৈধ সম্পর্কে সেই সমাজই জড়তা তৈরি করে। কখনও উত্থানরহিত করে, কখনও তীব্র মর্ষকাম জাগায়, আমাদের বিস্মিত করে সমাজের সুক্ষ্ণ উপস্থিতি। আমরা বাতাসের মতো সমাজের ভেতরে বসবাস করেও কখনও সেটার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারি না যতক্ষণ না সামাজিক সম্পর্কগুলো এক ধরণের তীব্র আলোড়ন তৈরি করে আমাদের চেতনার জগতে। প্রকাশিত হওয়ার পরে উপন্যাসটি যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছিলো সংগত কারণেই, আমাদের সবার ভেতরে অবচেতনে সমাজ অস্তিত্বমান।
হাজী নিসার হোসেন আচমকা একদিন বিয়ে করলো। রাজিয়ার ভাষায়
" তোমার বাপ আমায় আচমকা একদিন বিয়ে করলো। বদনা হাতে মাঠ সারতে গিয়ে মাঠ পেরিয়ে আমাদের গাঁয়ে এল সকালবেলায়। রাত্রে বিয়ে হলো। তার আগে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের সমন্ধ নিয়ে কথা উঠেছিল। তুলেছিলো, তোমার দাদী। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ী এসে আমার থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে ভারি পছন্দ করে বলত, এটা আমার মিল্লাতের গিন্নি।"
নবীর সুন্নত পুরা করতে গিয়েই হাজী নিসার হোসেনকে চার চারটে শাদী করতে হয়েছিলো। তার এই অদ্ভুত মানসিকতা মেনে নিতে পারে নি মিল্লাত, সে ছিলো বাপের শহরের বাড়িতে, আশা ছিলো বাপ তাকে শহরের বাড়ী লিখে দিবে, বাপের মৃত্যুর পরে রাজিয়া এসে বাড়ীর দখল বুঝে নেওয়ার পরে রাজিয়া সম্পর্কে মিল্লাতের ভেতরে এক ধরণের ঘৃণা তৈরি হয়। বাপের বিয়ে করা বউয়ের হাতে বাড়ীর দখল বুঝিয়ে দিয়ে নিজের মতো ভাড়াটে বাসায় উঠে যাওয়ার বাসনা তীব্র হয়ে ওঠে তার।
মিল্লাতের বাপের মৃত্যু শয্যায় উপস্থিত ছিলো রাজিয়া, খালাস চাচ্ছিলো করুণ ভাবে, উপস্থিত লোকের ধারণা স্বামীর সম্পত্তিতে ভাগ নিতেই রাজিয়ার এ প্রহসন। খালাস আর তালাক প্রায়োগিক ধর্মে এই শব্দদুটোর অর্থ আলাদা, খালাস হলো ইহলৌকিক মুক্তি আর তালাক মানে ইহলোক পরলোক সবখান থেকে বিচ্ছেদ। মৃত্যুশয্যায় ফুঁসে উঠে হাজী নিসার হোসেন বলে উঠেছিলো
" খালাস নাই। দিব না মুই। না রে না: দিব না। সেই রাতে যা দিলি নে মালকিন, সেই ভুখ নিয়ে মরলাম, আল্লাজী তোর কসুর যেন মাফ না দ্যান, এই মোনাজাত। পুরসেরাত তোকে কে পার করে, দেখব একবার। তুই খালাস পাবি না। "
মিল্লাত বাবার এমন অদ্ভুত আচরণে বিব্রত , ক্ষুব্ধ এবং একই সাথে বাবার মৃত্যুর পরে সে তরুণীর অকালবৈধ্যবে মর্মাহত, তরুনী যে তার বৌ হতে পারতো কিন্তু সামাজিক ভাবে যে তরুণী তার মা হয়ে গেলো তার প্রতি তরুণের কর্তব্য কি হওয়া উচিত এই নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হয় অবিরাম। তার মন আন্তরিক করুণায় আদ্র হয়ে উঠে।
নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে অনুরোধ করে রাজিয়াকে বিয়ে করতে কিন্তু শহরের বন্ধু রাজিয়াকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে, বলে সে আসলে ফ্রেশ একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।
বিভ্রান্ত ধর্মের ঔরসে জন্ম নেওয়া রিয়াজের নানী রাজিয়াকে দেখে বলে " ঐ হাজী হারামজাদা ছেলের বউকে নিকে করেছে, তা কী করে জানব। এমন কচি মেয়ে যে ছেলেরই স্ত্রী হয়। বউমা হয়। চোখে সেটাই সহ্য হয়। হাজী একটা মস্ত অন্যায় করেছে। লোকটার কোনো কালচার ছিলো না।"
সময়ের পরিবর্তন যেভাবে এই বৃদ্ধাকে স্পর্শ্ব করেছে মোহমুগ্ধ পিতাকে তা স্পর্শ্ব করতে পারে নি। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে অবলীলায় ধর্মকে সাক্ষী মেনে বিয়ে করে নিয়ে আসে তরুণীকে।
সাপ লুডু খেলার ফাঁকে রাজিয়া মিল্লাতকে বলে
" আমার তো কোন আশ্রয় নেই মিল্লাত। কোন গার্জেন নেই। তুমিই আমার সব কিছু।শত্রু-মিত্র বাপ মা । কথা দিচ্ছি, তুমি যা বলবে, তাই হবে। তাড়িয়ে দাও, চলে যাবো। কিন্তু আজীবন দুষব তোমাকে। তুমিও একজন ভিখিরি মেয়েকে ঠাঁই দিতে পারোনি। "
এই করুণা, স্নেহ, ন্যায় ন্যায্যতা এবং বাস্তবতার ভেতরে উভয়ের পরস্পরের প্রতি মোহ কিংবা অস্ফুট প্রেম তৈরি হয়, সমাজ আর ধর্মের দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়, তারা চাইলেই পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে দুরের বড় কোনো শহরে যৌথ পরিচয়ে জীবনযাপন করতে পারে ,কিন্তু আশৈশব বেড়ে ওঠা ধর্মীয় পরিবেশ আর সামাজিক প্রতিবেশ তাদের যৌথজীবনযাপনের কল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অদ্ভুত যৌনকাতর মিল্লাতের বন্ধু রাজিয়াকে ধর্ষণ করে এক বৃষ্টির দিনে। সেই বন্ধু যে উপস্থিত ছিলো মিল্লাতের বাপের মৃত্যুশয্যায় ধর্ষণের মাঝে চিৎকার করে বলে উঠে " খালাস নাই। দিব না মুই। না রে না: দিব না। সেই রাতে যা দিলি নে মালকিন, সেই ভুখ নিয়ে বেঁচে আছি। মরি নি। আল্লাজী তোর কসুর মাফ দ্যান নি, মোনাজাত কবুল করেছে। তোর জন্যে পুলসেরাতের পথ সাফা হচ্ছে রিজিয়া। সব পাপ তোর ধুয়ে যাচ্ছে রুপসী। কাঁদিস না। তোর মুক্তি, কোথায় কে জানে না। হাদীস কোরান জানে না। জানি কেবল আমি। আমিই সেই মরহুম স্বামী। ফুলে ফুলে কাঁদে না বিবিজান। শান্ত হ। অত ছটফট করলে গলা টিপে দোব। ওরে রাবিশ কুক্কুরী! ঠান্ডা হ! "
সামাজিক বিধানে পিতার স্ত্রী তার স্বীয় পরিচয়ে মায়ের স্থান অধিকার করে কিন্তু স্ত্রী হয়ে ওঠার পক্ষে ধর্মের নিজস্ব বিধান আছে, ধর্মমতে বিবাহিত যে তরুণীর সাথে পিতার শাররীক সম্পর্ক হয় নি, সে আসলে পিতার বৈধ স্ত্রী নয়, শুধুমাত্র কবুলিয়াত করে এক ছাদের নীচে বসবাস করলেই
কেউ স্বামী স্ত্রী হয়ে যায় না বরং উপযুক্ত দেনমোহরানার বিনিময়ে ধর্মমতে সঙ্গম না করলে বিবাহপূর্ণতা পায় না। সামাজিক মাতা তার ধর্মীয় মাতা হয়ে উঠতে পারে না, এবং এই নতুন বাস্তবতা রাজিয়া যতটা সহজে মেনে নেয় শহরে শিক্ষিত তরুণ মিল্লাত ততটা সহজে এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না।
এক ঘোরের ভেতরে মিল্লাত সিদ্ধান্ত নেয় সে রাজিয়াকে বিয়ে করবে, ফুলশয্যা সাজিয়ে সে অপেক্ষা করে কখন রিয়াজ ফিরবে কাজী নিয়ে এই ঝড়ের রাতে, আর অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে মিল্লাত। সে ঘুমের ভেতরেই রাজিয়া হারিয়ে যায় মিল্লাতের জীবন থেকে, বাইরে আকাশ ফুঁসতে থাকে, রাত্রের অন্ধকারের ভেতরে পাক খেতে খেতে সেও পথ হারায়।
আমার ও প্রায় বিশ/পচিশ বছর পর উপন্যাসটার কথা মনে পড়ল আপনার লেখাটা পড়ে।
সেই সময় সেই কেবল কৈশর উরতীর্ন বালিকার মনে এক গভীর রেখাপাত করেছিল। ধর্ম আর সামাজিকতার বিরুদ্ধে মনটা ছিল বিক্ষুব্ধ। অনেক দিন পর পুরন বইটার কাছে এসে নতুনভাবে ভাললাগা ছেয়ে গেল। এই লেখকগুলি আসলে জিবনের সিনেমা যা কালে কালে কালকে তুলে ধরে কালের কাছে। আম্রা বিচারে বসি কতটুকু এগিয়েছি বা কি পরিবর্তন এসেছে।
লেখাটা পড়ে উপন্যাসটা পড়ার জন্য খুব মন টানছে। অনবদ্য বিবরন!
চমৎকার রিভিউ। লেখা পড়ে উপন্যাসটা পড়তে ইচ্ছে করছে।
বহুদিন আগে পড়ছিলাম। আবার পড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে
কাহিনিটা পুরোই ভুলে গেছি।
আরো আরো লেখা চাই।
বহুদিন আগে পড়ছিলাম। আবার পড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে
মন্তব্য করুন