মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ১ম পর্ব
চার ধারায় বিভক্ত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধুমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের এক চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। দেশে সরকার স্বীকৃত আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে এবং রয়েছে ক্বাওমী মাদ্রাসা ব্যবস্থা। এ দুই ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসা প্রতি ছাত্র সংখ্যার ব্যবধান থাকলেও মোটা দাগে বলা যায় ক্বাওমী মাদ্রাসা এবং আলীয়া মাদ্রাসায় মোটামুটি সমান সংখ্যাক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। যেহেতু ক্বাওমী মাদ্রাসার সনদের সরকারী স্বীকৃতি নেই, সুতরাং আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আট ভাগের একভাগ নিজেকে শিক্ষিত মনে করলেও এদের শিক্ষার কোনো স্বীকৃতি নেই। এরা শিক্ষিত বেকার এমনও বলা যাবে না কারণ এদের সরকারী কোনো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহনের যোগ্যতা নেই।
বিশ্বাস করা কঠিন সম্রাট আকবরের সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে, সকল ধর্মের সকল শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসা উন্মুক্ত করে দেওয়ার সাথে সাথে মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন গৃহীত হয়। ফলে সংস্কৃত, ফার্সী এবং আরবী ভাষা শিক্ষার সাথে সাথে মাদ্রাসাগুলোতে প্রতিটি শিক্ষার্থীই সংস্কৃত কাব্যের রস আস্বাদন করতে শিখতো।
রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রয়োজনে রাষ্ট্র শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করে। বিদ্যালয়- বিশ্ববিদ্যালয় মূলত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক এবং দেওয়ানী কর্মকান্ড পরিচালনার প্রয়োজনীয় জনবল সরবরাহ প্রতিষ্ঠান। আকবর যে রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যে আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন পূরণে এমন আন্তঃধর্মীয় কিংবা ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজনীয় ছিলো।
সিপাহী বিপ্লবের(১৮৫৭) পর দেওবন্দে পুনরায় মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইংরেজ পরিচালিত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা করে তারা ধর্মভিত্তিক পাঠ্যক্রমসম্বলিত নতুন বিদ্রোহী মাদ্রাসা ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। যুগোপযোগী প্রয়োজনীয় সংস্কার গ্রহন না করে , প্রাচীন পাঠ্যপুস্তকের ভিত্তিতে তারা যে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পরসারণ করলেন তা যুগের প্রয়োজন পুরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। এই সময়েই এইসব বিদ্রোহী মাদ্রাসা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় জনবল নির্মাণে সহযোগি প্রতিষ্ঠানের বদলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মসজিদগুলোর মোয়াজ্জ্বিন সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে ১৯০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত অন্তত ১২টি পৃথক শিক্ষা কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী সংস্কার করে দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাইলেও মাদ্রাসা শিক্ষক এবং তাদের নেতাদের গোয়ার্তুমিতে মাদ্রাসা পশ্চাতপদ , প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। তাগুদী কুফরী শেখানো প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে আমাদের কাওমী মাদ্রাসার ধর্মনির্ভর পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞানের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। অনুদাননির্ভর এবং ভিক্ষুক হিশেবে সক্রিয় শিক্ষার্থীদের মুষ্ঠিভিক্ষায় যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে পরিচালিত বলে এই শিক্ষার্থীদের সামনে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।
কাওমী মাদ্রাসার পরিচালকেরা সরকারী পরামর্শ মানবেন না, তারা পরিচালক হিশেবে তাদের শিক্ষার্থীদের এইসব কুফরী শিক্ষায় শিক্ষিত না করার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন, রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য। দেশের প্রাথগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক তৃতীয়াংশ কাওমী মাদ্রাসা, সারা দেশে ৪০ হাজারের বেশী কাওমী মাদ্রাসা রয়েছে, প্রতিটিতে প্রতি বছরে ৫০ জন শিক্ষার্থী স্নাতক হলেও এই মাদ্রাসাগুলো থেকে প্রতি বছর অন্তত ২০ লক্ষ " শিক্ষিত" তৈরি হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০ ভাগের এক ভাগ যদি উচ্চমাধ্যমিক সমপর্যায়ের এবং তদুর্ধ প্রতিষ্ঠান হয় তবে প্রতিবছর অন্তত ২ লক্ষ মানুষ দেশের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে যাদের শিক্ষা সনদের কোনো মূল্য নেই।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাঃ রাষ্ট্র এবং শাসকেরা নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষাপদ্ধতি সংস্কার করে। একই ধরণের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় উপমহাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে উপমহাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইতিহাস দুই হাজার বছরের পুরোনো। উপমহাদেশের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়েছিলো ৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বে শহরের কাছাকাছি মালাবারে। এক দশকের ব্যবধানে নতুন একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিলো, সুতরাং মোহাম্মদের ধর্মপ্রচারের সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিম ব্যবসায়ীরা অন্তত উপমহাদেশে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে উপস্থিত হয়েছেন। বন্দরকেন্দ্রীক বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও বিস্তৃত না হলেও ধারণা করা যায় আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরেও খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকের আগেই মুসলিম বাণিজ্যিক জাহাজ উপস্থিত হয়। মসজিদ নির্মিত হলেও উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা হয় মুসলিম শাসকদের উদ্যোগে। নববিজিত প্রদেশে নিজস্ব প্রয়োজনে উপাসনালয় নির্মাণের সাথে সাথে এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন মুসলিম শাসকেরা। সময়ের সাথে মুসলিম অধিকৃত ভূখন্ডের কলেবর বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন প্রয়োজন পুরণে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থানীয় ও ধর্মীয় আইনে বিচারিক দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রয়োজনীয় জনবল, রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনার প্রয়োজনীয় জনবল, শিক্ষক, গবেষক এবং ধর্মবেত্তা নির্মানের প্রয়োজনীয় জনবলের চাহিদা পুরণের জন্যে মাদ্রাসা শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং একই সাথে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত শিক্ষকদের বেতন ভাতা প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। একই সাথে মাদ্রাসা পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্যে মাদ্রাসাগুলোকেও ভূসম্পত্তি প্রদান করা হয়। পাঠ্যক্রম নির্ধারণে যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন মূখ্য ছিলো তাই এইসব মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে এক ধরণের ইহজাগতিকতা কিংবা প্রায়োগিক প্রয়োজন পুরণের তাগিদ ছিলো, পাঠ্য তালিকায় ধর্মীয় শিক্ষা খুব বেশী গুরুত্ব পায় নি।
বিশ্বের অন্যান্য স্থানে যখন নারীদের জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয় নি সে সময়ে উপমহাদেশে শুধুমাত্র নারীদের জন্যে আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। কোরান হাদীসের বুৎপত্তি অর্জনের সাথে সাথে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীরা চারু ও কারু কলায় দক্ষতা অর্জন করতো। মুসলমান শাসকেরা এই ধরণের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ করতেন। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে সম্রাট আকরবের শাসনামলে, তিনি সকল শিক্ষার্থীর জন্যে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্মুক্ত করে দেন। সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী ভাষা শিক্ষা, যেকোনো ধর্ম পুস্তকের আলোচনার সুযোগ এই সময়ের মাদ্রাসাগুলোকে সেক্যুলার শিক্ষালয় হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। আন্তঃধর্মীয় যৌথ শিক্ষা ব্যবস্থা পরবর্তী সময়েও প্রচলিত ছিলো।
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা ত্রয়োদশ শতকে তবে হোসেন শাহী সুলতানদের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারিত হয় এবং বিদ্বান ব্যক্তি হিশেবে মাদ্রাসার প্রধানের এক ধরণের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ছিলো। মুঘলের সুবাহ বাংলা দখল করার পর ফার্সী দাপ্তরিক ভাষা হিশেবে গণ্য হয়, ফলে এই দেশে বসবাসরত হিন্দুদের ভেতরেও ফার্সী ভাষা শিক্ষার প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। মুসলিম জনগোষ্ঠী স্বাধীন সুলতানদের সময়ে যেভাবে সংস্কৃত ও বাংলার চর্চা করতো মুঘলদের সময়ে তা হ্রাস পায়।
১৭৫৭ সালে পলাশীতে সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত করার ৮ বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা নিজের হাতে গ্রহন করে, মাদ্রাসা পরিচালনার জন্যে প্রদত্ত নিস্কর জমিও এদের রাজস্ব করের আওতায় চলে আসায় মাদ্রাসা পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ কঠিন হয়ে যায়। তবে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহন করলেও পরবর্তী ৩ দশকে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী হস্তক্ষেপ করে নি, এই সময়ে তারা কোলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে বাংলা এবং তারপর ইংরেজী দাপ্তরিক ভাষা হিশেবে গণ্য হয়, এবং একই সময়ে আলীয়া মাদ্রাসায় ইংরেজী ভাষা শেখানোর উদ্যোগ শক্ত হাতে প্রতিহত করে মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত। একই সময়ে উত্তর ভারতের উর্দুভাষী মুসলমানেরা কোলকাতার উপস্থিত হয় এবং বাংলার মুসলমানদের নেতা হিশেবে গণ্য হয়। ফলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত মুসলমানদের ভেতরে এক ধরণের বাংলা বিদ্বেষ তৈরি হয়। উর্দু হয়ে যায় মুসলমানদের জাতীয় ভাষা। সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় দেওবন্দে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ, অতীত ঐতিহ্যে পুনরুদ্ধারের ধারণা থেকে সংকীর্ণ্মনা মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়। ফলে মাদ্রাসাগুলো রাষ্ট্রের প্রয়োজন পুরণে দক্ষ জনবল তৈরির প্রতিষ্ঠান থেকে মসজিদে মোয়াজ্জ্বিন সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
মুসলমানদের ভেতরে ইংরেজী শিক্ষা প্রসারে অনুদানে পরিচালিত মাদ্রাসা-হাই মাদ্রাসাগুলোতে ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন, আলীগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা, অব্যহত হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রতিরোধের বিপরীত স্রোত হিশেবে মুসলমানদের প্রশাসনিক পৃষ্টপোষকতার উদ্যোগের ভেতরে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গৃহীত হয়।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজ, কোলকাতাকেন্দ্রীক মুসলিম নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাগের বিরোধিতা করলেও ঢাকা কেন্দ্রীক মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গকে সক্রিয় সমর্থন প্রদান করে। তবে অব্যহত বিরোধিতার মুখে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর ঢাকায় একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেনো এই এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষিত শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে সে জন্যে মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয়। পরবর্তী ১০০ বছরে অন্তত ১২টি শিক্ষা কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করে।
গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ!
খুব সেন্সেটিভ ইস্যু এই সময়ের।
অনেক কিছু জানলাম
মন্তব্য করুন