কলি-কথা ১ (কলকাতা টু সারপ্রাইজ অঞ্চল ভায়া দিল্লী ...)
ঢাকা থেকে বেনাপোল:
আগস্টের শুরুর দিকে। টান টান উত্তেজনা ঘরময়। পরিবারের প্রবীণ সদস্য হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমাদের ঠিক সেই সময়ই অন্তত দশ-বারোদিনের জন্য দেশ ছাড়ার ইচ্ছে। আর যাই হোক, কাউকে অসুস্থ রেখে তো যাওয়া যায় না। বর বেচারা মুখ হাড়ি করে ঘুরছে। কারণ একবার বাসের টিকেট হাতছাড়া হয়ে গেলে আর পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। তাও নয় আগস্টের তারিখের টিকেটটা হাতছাড়া হয়ে গেল। রইলো হাতে ৮ তারিখের টিকেটের অপশন। মেডিকেল রিপোর্ট হাতে আসবে ৭ তারিখে। ঐ রিপোর্টের উপরই সব নির্ভর করছে তখনও। ওদিকে আমাদের এবার ইচ্ছে ছিল ঈদের আগের দিন বাড়ি ফিরে ঈদটা করবো। অর্থ্যাৎ শ্যামবাবুকে বশ করা সাথে কূলও রক্ষা আর কী! অবশেষে ৭ তারিখে অফিস থেকে বরকে ফোন দিলাম। আমি কিছু বলার আগেই সে বললো, "৮ তারিখে যাচ্ছি.. ব্যাগ গোছানো শুরু করো।" লাফনো মন নিয়ে বাড়ি ফিরে প্যাকিং শুরু করলাম।
এবারকার প্যাকিংটা বেশ অন্যরকম। সবসময় কলিকাতা যাই দুইসেট কাপড় আর প্রায় শূণ্য সুটকেস নিয়ে। এবার তো আর কলিকাতা নয় সাথে দিল্লী আর বরের এক সারপ্রাইজ (সেই সারপ্রাইজের উদঘাটন হবে পরের পর্বে)। ফলে ব্যাগ এবার ঢাকা থেকেই বেশ বোঝ-বোঝাই। ৮ তারিখে তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে ফিরে প্রায় তৈরি হয়ে আছি মাগার আমার বরের দেখা নাই। তেনার কি অফিসের মিটিং পড়েছে -এই সেই। এবার আমি মুখ হাড়ির মতো করে বসে রইলাম। তিনি ফিরলেন রাত দশটায়! বাস ১০.৩০-এর। এবং এই সময় মেসবাহ ভাইয়ের সময় নয়!! সত্যি সত্যি ১০.৩০!! কোনমতে বের হয়ে রিকশা নিলাম, জ্যামে পড়লাম। যখন বাস স্টপেজে পৌঁছালাম তখন বাজে ১০.৪৫। দেখলাম, বাসও জ্যামে। আসেনি তখনও। বাসে চাপলাম ১১টায়। সেই বাস সাভার ত্যাগ করলো রাত্রী ১.৩০টা নাগাদ!! এরপর যা হলো তা ইতিহাস। বাস-ওয়ালা কি খেয়েছিল আল্লাহ মালুম। পাখির মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল বেনাপোলে বাসটাকে অতি অল্প সময়ে। আর আমি বেচারা সব সময়ই চাকা ঘুড়ার আগেই যেখােন ঘুমিয়ে যাই, সেখানে সারা রাত কেন যেন উল্লুক হয়ে রইলাম!! তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সেই ইতিহাস। অত:পর ঝামেলা ছাড়া বর্ডার পার। ভারতবর্ষে পদচারণের সূচণা।
পার হয়ে বর্ডার-এ কেমন অর্ডার!
ভালোয় ভালোয় বর্ডার পার করে বাসে উঠে বসলাম। বেনাপোল কাস্টমস অফিস এমনিতে বড়ই বিরক্তিকর। এটা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। এর আগে আমাকে বলেছিল- আমি নাকী আমি নই..!! কি যে আজব প্রানী এরা! সে আরেক বিশাল ইতিহাস। বর্ডার থেকে আমাদের সাথে নিজের দেশে এলো ১৪ জন বিভিন্ন মেডিকেল পড়ুয়া কাশ্মিরী ছাত্রী। তারা বেশ "হইসে"- "গেছে" রপ্ত করে ফেলেছে।
যাই হোক বাসে উঠার পর যে ব্যাটা সুপার ভাইজার সে ফোনে আলাপ শুরু করলো। একটু পরপর বাস থামায় আর সবাইকে জিজ্ঞস করছে কে কত ডলার ভাঙিয়েছে। খামাখা দেরী হচ্ছে বলে সবাই বিরক্ত! কিন্তু দাদা শুনে কার কথা!! আমাদের গাধা বানিয়ে ৫ মিনিট পর পর বাস থামিয়ে সে তার কাজ করছে। অবশেষে জানা গেল কোন একজনের ডলার নাকী জাল। ব্যাটা দাদা ঘোষণা দিল বর্ডারের মান এক্সচেঞ্জ থেকে লাক না আসা পর্যন্ত বাস ছাড়বে না! বাপের রাজ্য আর কি। পরে সবার তোপের মুখে এক পরিবারকে নামিয়ে রেখে বাস নিয়ে চলে এলাম। সেই পরিবার থেকেই নাকী জাল নোট এক্সচেঞ্জড হয়েছে। শত শত লোকের ভীড়ে কি করে তাকে ম্যানেজার ব্যাটা ধরতে পারলো বুঝলাম না!! তার দাদাগিরির ফলে কলকাতায় আসতেই বেশ ক্ষাণিকটা দেরী হলো।
(যদি আল্লাহ না করুক এমন কোন কেউ পরিস্থিতে পড়েন চোখমুখ শক্ত করে বসে থাকবেন। কারণ নোট জাল হলে বুথ থেকে তৎক্ষণাৎ সেটা ধরা পড়ার কথা- আধাঘণ্টা পরে নয়। এটা কোন ফাঁদ হতেই পারে)
মার্কুইস স্ট্রীটের হত্যা রহস্য!!
বরাবরের মতো যে হোটেলে থেকে আমরা অভ্যস্ত সেই হোটেল শুধুই হতাশা হয়ে রইলো। কোন সিট নেই। সব নাকী বাংলাদেশিতেই ঠাসা!! কথা আসলেই সত্য। নিউমার্কেট এলাকাটায় এক চক্কড় দিলে ছুটির সময় পরিচিত দলের সাথে যোগাযোগ হবেই হবে। এবারও জানি অনেকেই যাচ্ছে। দেখা হবে- এই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে উঠে পড়লাম আরেক হোটেলে। আগেই বলে নেই। ভ্রমণকারী হিসেবে আমাদের জুটিটা অতটা বিলাসী-প্রিয় নই। যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই আমরা ব্যয় করি। আর মনভরে খাওয়া-দাওয়া করি, প্রাণ ভরে সিনেমা দেখি। হোটেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়েই বেরিয়ে পড়লাম সবসময়ের মতো। কলকাতা গেলে আমরা দুই জনই কিছু না কিছু সারাক্ষণ খেতে থাকি। এবার তার ব্যতিক্রম হবে কেন? শুরু হলো প্রিয় ম্যাঙ্গো লাচ্ছি দিয়ে। ৩০ রূপি দিয়ে এতো বড় গ্লাসের লাচ্ছি- কি দারুণ কি দারুণ!! এরপর মারিয়ার চিকেন চাওমিন আর মোমো। পেট ঢোল করে চলে গেলাম ফোরামে। উদ্দেশ্য ব্যাটম্যান দেখবো। গিয়েই দেখা হলো আরেক বন্ধু দম্পতির সাথে। যদিও কেনাকাটা করবোই না- তারপরও টুকটাক কিনছি তখন থেকেই। সিনেমার অনেক বাকী। পাপড়ি চাট, পানি-পুড়ি, চা খেয়ে বেশ সময় যাচ্ছে। বর-মশাই আসছে পুজার আনন্দমেলা কিনে িনল। আশেপাশের মার্কেটে ঘুরাঘুরি করে শো-এর আগে ফিরে অসাধারণ মুভিটা দেখা হলো। ফিরলাম চারজন একসাথে। পরদিন রাতের আহার একসাথে করবো বলে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে আনন্দমেলাতে চোখ বুলাতেই দেখলাম সূচীপত্রে লেখা, "মার্কুইস স্ট্রীটে হত্যা-রহস্য"। আমি চোখ গোল গোল করে বরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা যেখানে আছি, সেটা মার্কুইস স্ট্রীট না? সে বললো- হ্যা। এরপর দুইজন মিলে কত রহস্য কল্পনা করে ফেললাম!! না করে উপায়ই বা কি?? চারটি ঘিঞ্জি বাড়ি যুক্ত করে একটি রিসিপশন বানিয়ে হোটেল! কত যে চিপাচাপা! এখানে অনেক রহস্যই থাকতে পারে! আমরাও গল্পের কল্পে জিনিষপত্তর ভালোভাবো গুছিয়ে রাখলাম..আর আশেপাশে রহস্য খুঁজতে লাগলাম।..
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া..
যেহেতু একটা পর্যায়ে ভ্রমণ প্রায় অনিশ্চিত ছিল, বর বেচারা আর কোন কানেকটিং ফ্লাইট বা রেলের টিকেট কাটেনি। ভাগ্যক্রমে যে হোটেলে উঠেছিলাম আফরিনের ছ্যাকা খেয়ে- সৌভাগ্যক্রমে দেখি ঐ হোটেলের নীেচই একটি দোকান আছে যেখান থেকে দিব্যি টিকেট বুক করে ফেলা যায়। সেখান থেকে কলকাতা থেকে দিল্লী আর দিল্লী থেকে "সারপ্রাইজ" অঞ্চলের টিকেট কাটা হলো। যেহেতু সারপ্রাইজ- আমি বাইরে হাটাহাটি করছি। টিকেট প্রসেস করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দিল। দোকানের সবাই মুসলিম বলে তখনকার মতো কাজ বন্ধ করে দিলেন বটে.. কিন্তু টিকেটের ব্যাপারে আশ্বস্ত করলো। আমরা বের হয়ে চা খেলাম। ঐ অতটুকু মাটির পাত্রর চা খেয়ে আমার মন ভর না। দু-তিনবার খেতে হয়। প্রতিবারই পাত্র গুলো ফেলে দেয়। ভাবলাম, আমাদের দেশে ধর্ম নিয়ে মানুষের কত চিন্তা! অমুকে নামাজ পড়ে ক্যান! তমুকে হিজাব নেয় ক্যান!- কত শত প্রশ্ন। অথচ পাশের দেশেই ছূ্ৎ-অচ্ছুৎ, যে যার ধর্ম নিজেদের মতো পালন করছে। কেউ কোন মন্তব্য করছে না। ওখানে কোন আমাদের মুল্লুকের "অসাম্প্রদায়িক" বলুক দেখি, একই পাত্রে চা খাওয়ার জন্য! আই বেট। বিদেশ গেলে দেশি ভাইরা সব নিয়ম মানে.. দেশেই কেবল মানতে নারাজ।
মমতার মমতা:
কলিকাতা নিয়ে লেখার আসলে কিছু নাই কমবেশি সবাই সব কিছু জানেন। তাই ঐ পথ মাড়ালাম না। বরং মমতা দিদির কিছু কাজ দেখলাম। যেমন কলকাতার বিভিন্ন স্ট্রীটগুলো সবুজ বোর্ডে নতুন করে জ্বল জ্বল করছে। কীড স্ট্রীট, টর্টি লেন, কেমাক- কোনটাতেই এখন হারানোর উপায় নেই। রাস্তায় রাস্তায় তিন বাতির একটি করে লাইটপোস্ট একটু পরপর। পুরো কলকাতা ঝলমল করছে রাতের বেলায়। ট্রাফিক আইন হয়েছে আরো কড়া। দিদি যতই বেশি কথা বলুক না কেন- নিয়মনীতিতে মাৎ দিচ্ছেন বলে মনে হলো। সকালে বরাবরের মতো ব্লু -স্কাইতে নাশতা করে সারাদিন এই মার্কেট সেই মার্কেট আর রাতের বেলা বন্ধু দম্পতির সাথে খেয়ে দেয়ে দিনটা চমৎকার কাটলো। পরদিন আবার রাজধানী ট্রেন। আমি প্রথমবারের মতো দিল্লী যাচ্ছি, মনের ভিতর ভুটুর ভুটুর করে লাড্ডু পরস্ফুটিত হচ্ছে..কিন্তু এ আবার কি?? পেট কেন গড়বড় করছে.. চিন্তার বিষয় বটে!
পর দিন বিকেল ৪.৩০ পর্যন্ত ব্যাপক খাওয়া আর ঘুরার পর জ্যামের কথা মাথায় রেখে আগেই রওনা দিলাম হাওড়ার উদ্দেশ্যে। যদিও "জিসম টু" না দেখতে পারার বেদনায় জ্বলছি..তারপরও এখনও তো পথ বাকী!
রইলাম দিদির অঞ্চল থেকে দিলওয়ালাদের অঞ্চলে যাওয়ার অপেক্ষায়..
(পরের পর্বে যা থাকছে-
# রাজধানী ট্রেেন-যা এলাম জেনে
# পাহাড়গঞ্জের আবুলরাজ্য
# কুতুব মিনার সের- আলাই হতো সোয়াসের
# দিল্লীহাট- বাজার ঘাট..ইত্যাদি
-এবং আরো তারও পরবর্তী পর্বে)
খাইছে
সব কেমন চেনা চেনা লাগতেছে ক্যান ?
চলুক
আবার জিগস..
সাথে আছি
আপনে কি মেসবাহ ভাইয়ের দলে জয়েন করেন নাই!!!!!
নাহ আফা..ওস্তাদের অন্য দল আর আমি এবং আমার বর আরেক দল..
চলুক কলি যুগের কলি কথা। ভারত ভ্রমন কবে করবো জানি না তবে আপনাদের এই সব লেখা পড়ে চায়ের স্বাদ পানিতে মিটে! খুব চমৎকার সিরিজ!
দেখা যাক শেষ পর্যন্ত আপনাদের আগ্রহ ধরে রাখতে পারি কি-না..
ভ্রমণকাহিনীতে ভইরা আছে ব্লগ। ভাবতেসি আমিও একটা দিমু নাকি
ভাবতেছি আর দিমুই না...যে হারে সবাই দিচ্ছে...
আসলে একটা মনে হয় ভালো ভ্রমণ সিজন পার হইসে সবার
আমি এমনকি শহরের পরিচিত রাস্তাগুলোর বাইরেও কোথাও পা দিইনি। এরই ভেতর চড়ে বেড়াচ্ছি দীর্ঘ, দীর্ঘদিন ধরে। এটার একটা ভালো দিকও আছে অবশ্য। চলছে জীবন আপনমনে।
তাহলে তো আপনাকে ঘুরিয়ে আনতেই হয় সেই সারপ্রাইজ এলাকা থেকে..কি বলেন?
জ্বী, খুব তাড়াতাড়ি পরের পর্ব দেন, আর সঙ্গে অনেকগুলা ছবি
সবাই ঘুরে বেড়ায় আর ঘূরন্তিস দারুণ পোস্ট দেয়। আমিই কুথাও যাইনি।এইটা কুনু কথা হইলো?
আপনি অতি চমতকার লিখেন।
সত্যি আপু!! খুব খুশি হলাম..
চলুক।
সাথে আছি।
থাকেন..
ভালো লেগেছে।
চলুক।
পড়তেসি! ভাল্লাগতেসে!
বেশ বেশ !! চলুক ......
চলিতেছে...
মন্তব্য করুন