অবদমন
"এমন সুন্দর মেয়েটাকে এইভাবে কেউ মারে" কান্না শুনে পাশের মসজিদ থেকে হেঁটে এসে মৌলভিসাহেব বললেন : বাবা, কাউকে মুখে মারতে হয় না, মুখটা আল্লাহ নিজের হাতে তৈরি করেন।" ঘাড়গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষের রোষ তখনও কাটে নি, হাতের কঞ্চি এলোমেলো পাশের পুঁইলতার উপর চালিয়ে মাথানিচু করে ঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসে।
এই দৃশ্য প্রতিদিনের নয় কিন্তু মাঝেমাঝেই এমনটা ঘটে যায়, গরীবের মেয়ে তাও মুখ করে খুব, বিশ্রী গালি দেয়, মার খেয়ে নেতিয়ে পরে থাকে রক্তাক্ত হয়ে, তারপর ঝিম ভাবটা কেটে গেলে সটান উঠে দাঁড়ায়, হাতে ময়লা বাসন আর হাঁড়ি নিয়ে পুকুরঘাটে যায়, যাওয়ার পথে একবার তাকিয়ে দেখে মরদের দিকে,'ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই কিল দেওয়ার গোঁসাই' বলে হনহন হেঁটে যায় পুকুরঘাটে, মরদ দাওয়ায় বসে রোখচোখে তাকিয়ে দেখে। আবার ভাব হয়, প্রেম হয়, সংসার হয়, ভালোবাসাও হয় নিশ্চয় নইলে বছর বছর ছেলেপুলে হয় কিভাবে? আবার বিকেলে কোনোদিন গোঙানি শোনা যায়, পাড়া-প্রতিবেশী এসে দাঁড়ায়, মরদের ক্ষোভ কমে গেলে সিঁটিয়ে পরে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আহাউঁহু করে, মহিলারা এসে চোখে-মুখে পানি দিয়ে সান্তনা দেয়, মরদ লাঠি ভাঙে, থালা বাসন ভাঙে কিন্তু মেয়েটার তেজ ভাঙতে পারে না, কিছু হলেই মেয়েটা মুখ করে খুব, গরীবের মেয়ে , জানে জীবন নির্মম, কখনও প্রেম জুটবে কখনও কঞ্চির আঘাত, কিন্তু এরা ক্ষোভ লুকিয়ে রাখে না, ক্ষোভটা কঠোরভাবেই প্রকাশ করে ফেলে, পুরুষের অংহের জায়গাতে সুরসুরি দেয়, পুরুষ পৌরুষ দেখাতে এসে নাস্তানাবুদ ফিরে যায় আর বাইরে বন্ধুর কাছে সান্তনা খুঁজে। এরা সবাই একই রকম, আষাঢ়-শ্রাবনে মহিষের মতো কাদাজলে ঘুরে ঘুরে পরিশ্রম করে, কিন্তু কার্তিকের একটা মাস একাবারে বেকার, নিয়মিত আহার জুটে না, তখন গেরোস্থালী ঝগড়ার মৌসুম এ বাড়ীর মেয়েটা, ও বাড়ীর বৌটা মাথা নিচু করে, ঘোমটা মাথায় নিশিন্দা পাতা তুলে নিয়ে যায়।
এ বাসার কেউ খিড়কি দুয়ারের অন্যপাশে যায় না, বাসার চারপাশের গাছের আড়ালের অন্যপাশের পৃথিবীর সংবাদ বাতাসে ভেসে আসে, কখনও মানুষের মুখে, কখনও পুরুষের মুখে গ্রামের ঘটনা-রটনা সব জানা হয়ে যায়, বাসার চার ঘরে চার পরিবার, মাঝে বিশাল উঠান, উঠানের একপাশে রান্না ঘর, সেখানে বর্ষার চালা আছে কিন্তু শুকনার দিনে উঠান খুঁড়ে বানানো বড় বড় দুইটা চুলায় রান্না বসে, গোটা কুড়ি জোয়ান গামলা ভর্তি ভাত আর সালুন খেয়ে লুঙ্গিতে হাত মুছে আবার চলে যায় ক্ষেতে। সবার শেষে মেয়েরা খেয়ে, হাত ধুয়ে কুটনা কাটে , রাতে আবার এক দঙ্গল মানুষের রান্না করতে হবে, ক্ষোভ-বিক্ষোভের সময় কোথায়? খুন্তি কড়াই আর রান্নার লকড়ি ঠেলতে ঠেলতে সকাল দুপুর বিকাল সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। হাটের বাজে মেয়েদের সাথে বাসার পুরুষের ঢলাঢলির গুজব কানে আসে, বাসার পুরুষ গায়ে অন্যের গন্ধ মেখে পান চিবাতে চিবাতে হিসাবের খাতা খুলে বসে ,তারপর বাতিটা নিভিয়ে বলে ঘুমাতে এসো। এর বেশী ঘনিষ্ঠতা কেউ আশা করে না, দিনের বেলা কোনো কোনো দিন কেউ আদর করে পানের খিলি মুখে ঢুকিয়ে দিলে পাশের ঘরের বৌ টিপ্পুনি কাটে, পুরুষেরা নিজের মর্যাদা বাঁচাতে চায়, কেউ স্ত্রৈন হতে চায় না।
প্রতিদিনের জীবনযাপনের ক্ষত জমা হয়, ক্ষোভ, অনুশোচনা শোকের ক্লেদ জমে মনের ভেতরে, মনটা মলিন হতে থাকে, প্রতিবাদ প্রতিরোধবিহীন এমন বন্দী জীবনের কষ্ট জমে জমে ক্লেদের পলিতে দমবন্ধ লাগলে তারা কাঁদতে বসে, আয়োজন করে তারা কাঁদে, বর্ষার আকাশের মতো থমঠমে মুখে চুলার আগুণ জ্বালায়, তারপর চুলার ধোঁয়ায় চোখ ভিজে যাওয়ার ছলে তারা কাঁদে, বাসার অন্য বৌয়েরা সেদিন রান্নার সব দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নেয়, আর শৈশব থেকে পড়ন্ত যৌবনের সকল দু:খ, অপমান, অবমাননার স্মৃতিচারণ করে তারা কাঁদে, শুধু কাঁদে, কখনও বিলাপ করে, কখনও গুনগুনিয়ে, কখনও সুর করে তারা কাঁদে। বাসার পুরুষ কাঁচুমাচু দাঁড়িয়ে থাকে, এমন দিনে কাউকে কিছু বলে দিতে হয় না, বাড়ীর বৌয়েরাই সে দায়িত্ব নেয়, নিয়ম করে মুখে পানি দেয়, হাতে তুলে খাইয়ে দেয়, কখনও হাতের কাজ গুছিয়ে বৌয়েরা সবাই তাল মিলিয়ে কাঁদে, কেঁদে হালকা হয়। প্রতিদিনের অবমাননা আর অপমানের ক্লেদ, মুখে লেগে থাকা ছাইয়ের সাথে ধুঁয়ে মুছে যায় চোখের জলে নইলে সংসারের এই বন্দীত্বে আত্মহত্যা না করে কেউ বেঁচে থাকতে পারতো না।
এই কান্না তাদের বাঁচিয়ে রাখে, তারা গরীব ঘরের মেয়ের মতো ক্ষোভ উগড়ে দিতে পারে না, পুরুষের ভ্রমর স্বভাব তারা নিয়তি জেনেই মেনে নেয়, জানে যাত্রাপালায় গেলে জামাইয়ের একটু রাত হবে, মুখে আর শরীরে অচেনা গন্ধ থাকবে, সেদিন পুরুষ চোখ লুকাবে, রাতে হিসাবের খাতা খুলে বসে থাকবে না, বরং অন্ধকারে পাশ ফিরে শুয়ে জেগে থাকবে পাশাপাশি দু'জনে।
তাদের প্রেমের গল্প শেষ, কিন্তু জীবন তাদের আষ্টেপৃষ্টে বেধে দিয়েছে, এ বাঁধন থেকে কারো মুক্তি নেই।
দারুন!
তাদের প্রেমের গল্প শেষ, কিন্তু জীবন তাদের আষ্টেপৃষ্টে বেধে দিয়েছে, এ বাঁধন থেকে কারো মুক্তি নেই।
অবদমন এর হয়তো আরো রূপভেদ আছে
মন্তব্টা হ্য়তো পরিসকার হলো না, ধনীদের মেয়েদের অবদমন এর রূপটা পড়তে বসে রইলাম
দারুণ!
আবদমন এর ভিন্ন রূপ আছে। তানবীরা বলেছে।বড় কঠিন বাস্তব সাবলিল প্রকাশ।অনেকদিন পর লেখা পেলাম।
আমার অবশ্য এমন ধনী পরিবারের সাথে পরিচয় নেই। আমার হাতে তাদের অবদমনের গল্প হিন্দি সিরিয়ালের বাংলা ভাষ্য হয়ে যেতে পারে
মন্তব্য করুন