ইউজার লগইন

আমাদের ভাষা আন্দোলন :: এক নজরে


দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান সরকারে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরাই প্রায় সব জায়গা দখল করে রাখে আর এর ফলশ্রুতিতে তারা ঠিক করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।

ভারত বিভাগের আরও আগে থেকেই বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়। বাংলা কে পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশিক ভাষা করার জন্য সর্বপ্রথম প্রস্তাব করে "গণ আজাদী লীগ"। এই সময় তৎকালীন সংবাদপত্র গুলোতে এই বিষয়ে বেশকিছু গবেষনা নিবন্ধ আসে। এর মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নিবন্ধটি ছিলো বেশ সারা জাগানো ও সেই সময়ের পরিস্থিতি অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ। তবে সকল নিবন্ধের সারকথা ছিলো বাংলাকে প্রদেশিক ভাষা হিসাবে স্থান দেওয়ার পক্ষে। তমুদ্দন মজলিশ "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা-বাংলা না উর্দু" বইটি লিখে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলা ও উর্দূ উভয়কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করে। করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে এই সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন প্রদেশে ব্যবহার এবং প্রাথমিক স্তরের আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এসে জড়ো হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়। সেই মাসেই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা "রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ" গঠন করে।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি গণপরিষদে বাংলা ভাষায় কথা বলার দাবী জানিয়ে একটি সংশোধনী আনেন। বিতর্কের পর সংশোধনীটি ভোটে বাতিল গণ্য হয়। গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশে ১১ই মার্চ ধর্মঘট আহবান করা হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং-এ অংশ নেয়। ফল স্বরূপ বিভিন্ন স্থানে তাদের পুলিশের লাঠিচার্জের সম্মুখীন হতে হয়। এর প্রতিবাদে সভা আহবান করা  হলে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মাঝে অন্যতম ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলি, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ।

মুসলীম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিপর্যস্ত খাজা নাজিমুদ্দিন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ১৫ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবী- দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্ত অনুসারে ১৫ মার্চেই বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়।

২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ একটি ভাষণ প্রদান করেন। তার ভাষণে তিনি ভাষা আন্দোলনকে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি বলেন উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ২৪শে মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা ব্যক্ত করেন। ছাত্ররা সেখানে তার প্রতিবাদ করেন।

১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রথম সফল গণআন্দোলনের স্মৃতি উজ্জল করে ধরে রাখার লক্ষ্যে “রাষ্ট্রভাষা দিবস” পালিত হয়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরে এসে পল্টনের এক জনসভায় বক্তৃতা দানের এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, যা ছিলো মূলত জিন্নাহ্র কথারই পুনরুক্তি। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯শে জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের "সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ" গঠিত হয়। পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারী হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।

ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারী এক মাসের জন্য সকল রকমের সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ঐদিন রাতেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

২১শে ফেব্রুয়ারী সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হতে থাকে এবং ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে। এই সময় পুলিশ তাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে। বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাধা দেয় এবং সভায় তাদের দাবি উত্থাপনের দাবি জানায়। এর মধ্যে কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা আইন সভার দিকে যাত্রা শুরু করলে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি বর্ষন করা শুরু করে। পুলিশের গুলিতে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ২২শে ফেব্রুয়ারী নবাবপুর রোডের বিশাল মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষনে শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে মারা যান।

১৯৫৪ সালে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ের অচলাবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে করাচীতে মুসলীম লীগের সংসদীয় কমিটির একটি সভায় বাংলা ভাষাকে উর্দূর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু আবদুল হকের সৃষ্ট সহিংস ঘটনায় এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকার দূরে সরে আসে।

১৯৫৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে তা সংবিধানের অন্তর্গত করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রায় দশ বছর পর বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী। সংবিধানের ২১৪ অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়:
"214.(1) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali"

পোস্টটি ৩০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

অদ্রোহ's picture


তথ্যবহুল পোস্ট ।

শাতিল's picture


ধন্যবাদ

মুক্ত বয়ান's picture


চমৎকার দরকারি পোস্ট।
সাথে সচলের এই পোস্টটাও পড়া মোটামুটি ফরজ।
http://www.sachalayatan.com/nabiul/30465

দু্ইটা মিলায়ে অনেক তথ্য জানা যাবে। Smile

শাতিল's picture


লিংকের লেখাটি আরও অনেক বিশদ। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ Innocent

নজরুল ইসলাম's picture


চমৎকার লেখা। আজকের দিনের জন্য আঠা লাগিয়ে কাধেঁ তুলে রাখার দাবী জানাচ্ছি মডুদের নিকট

ভাস্কর's picture


এই পোস্ট স্টিকি করা হোক...

সাঈদ's picture


তথ্যবহুল ।

নুশেরা's picture


টুটুল's picture


তথ্য বহুল পোস্ট

১০

শাওন৩৫০৪'s picture


তথ্যমূলক পোষ্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ...

১১

মুক্ত বয়ান's picture


অ:ট: কই গেলেন?? ব্যস্ত নাকি??

১২

তানবীরা's picture


সরাসরি প্রিয়তে

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাতিল's picture

নিজের সম্পর্কে

What sense does it really makes to describe the self. I am too honest to lie, and truth if revealed will create havoc. We all have storms inside, and when we describe we only talk about deep sea water which is all calm. It is actually not calm, it is pretending to be calm, and otherwise battle of wind and water cannot be played on the surface.